তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫
ফারহানা নিঝুম
বাড়িতে চলছে অতিথিদের আগমন। বিয়ে শুরু হবে আরো একটি ঘন্টা পর।নাচ গান হাসি আড্ডায় মুখরিত চারদিক।
এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। প্রবলেম হয়ে গেছে তার! লেহেঙ্গার সঙ্গে পরিহিত ব্লাউজের ফিতা খুলে গেছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওড়না টেনে নিজেকে ঢেকে নিল ।স্নেহা টা নেই,বেলীর কাছে আছে।ওখানে বরের বন্ধুদের সঙ্গে সবাই মিলে দুষ্টুমি করতে ব্যস্ত। আশেপাশে কোথাও আরিফা আহমেদ আর না শায়লা আহমেদ কে দেখতে পাচ্ছে ফারাহ।
দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিত ছেলে লো’ভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিষয়টা খেয়াল করেনি ফারাহ,আর খেয়াল করলেও তা ছোট মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতে পারেনি। ওড়না একাংশ লুটিয়ে পড়েছে পিঠ বেয়ে।সেদিক পানে নজর নেই তার।সে তো ফিতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কাউকে খুঁজে চলেছে। বলতে চাইছে নিজের সমস্যার কথাটুকু।
কনুইয়ে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ফিরে তাকালো ফারাহ, মুখশ্রী দেখার পূর্বেই তাকে টেনে নিয়ে এগুতে লাগলো ডান দিকে। অপরিচিত একজন পুরুষ,আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একজন ভদ্রমহিলা কে আঙ্গুলের ইশারায় ডাকলেন। মহিলা সহসা এগিয়ে এলেন। কিছু একটা বলতেই ভদ্রমহিলা কাছে এলো ফারাহর।
“দেখি পিছন ঘুরো আমি ফিতে বেঁধে দিচ্ছি।”
ভড়কালো ফারাহ,তবে প্রত্যুত্তর না করে পিছন ফিরে। ভদ্রমহিলা ফিতেটা বেঁধে দিলেন।
“ভারী মিষ্টি মেয়ে।”
ফারাহ কিছু বলল না। নিজ জায়গায় ফের চলে গেলেন ভদ্র মহিলা। সামনে দাঁড়ানো পুরুষ এগিয়ে যেতে লাগলো,ফারাহ আইঢাই করে জিজ্ঞেস করলো।
“শুনুন!”
সহসা ফিরে তাকালো তাশফিন শেখ।তাশফিন কে দেখে পিলে চমকে উঠে ফারাহর। কম্পিত হয় বক্ষঃস্থল।
“আ… আপনি!”
সেদিন নারকেল বাগনে হাত ধরা লোকটা কে দেখে হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গেল, ফাঁকা ঢোক গিললো সে।
তাশফিন চোখে হাসলো, মুখশ্রী জুড়ে অদ্ভুত গাম্ভীর্য ভাব।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কী ভেবেছিলে আমি ধরতে পারব না?”
আরেক দফা চমকে উঠে ফারাহ!সে তো শুধু দেখতে গিয়েছিল নেভিরা দেখতে কেমন হয়? সামনাসামনি কখনো দেখেনি তাই। এখন এই লোকটা কী তাকে ধরতে এসেছে?
ফের সামনে থেকে শব্দ এলো।
“লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশ…
পরের বাক্য টুকু উচ্চারণ করার পূর্বেই ফারাহ পিছন ফিরে ছুট লাগালো। এখানে থাকা মানে বিপদ।কখন তাকে ধরে নিয়ে যায় আল্লাহ মালুম।
আরিফা আহমেদ কে খুঁজতে লাগল ফারাহ। অবশেষে দেখাও মিলল। বেলীর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত তিনি। ফারাহ চুপটি করে সেখানে চলে গেল। চুপচাপ ভালো বাচ্চাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
দৃষ্টি তুলে সন্ধানি দৃষ্টিতে তাকালো আশেপাশে। লোকটা আসছে না তো? সামনে নজর যেতেই দেখতে পেলো তার দিকে তাকিয়ে আছে কমান্ডার।
আঁখিদয় ছোট হয়ে এলো তার।ঘন পল্লব বারংবার ফেলছে। সামনে প্রায় পাঁচ জনের মতো পুরুষ। সবাই একই রকম সেজেছে।কালো স্যুট ভেতরে অফ হোয়াইট শার্ট। কমান্ডার একই পোশাকে আছে, শুধু তার চুল গুলো স্প্রে করা। আবারো ফাঁকা ঢোক গিললো ফারাহ। সামনের পুরুষের দৃষ্টি যে তী’ক্ষ্ণ।বুকে হাত ভাঁজ করে সম্পূর্ণ দৃষ্টি তার দিকেই নি’ক্ষেপ করেছে।
অকস্মাৎ দৃষ্টি বদলায় তাশফিনের। আরিফা আহমেদ কে দেখে চমকিত হলো। ওনাকে চিনতে বেগ পোহাতে হলো না। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে গেল তার! তবে কি তাশফিন যা ভাবছে তা সত্যি?এই মেয়েটা তার… নিজের ভাবনাকে ধি’ক্কার জানিয়ে বলল “এসব কি ভাবছি আমি?”
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো তাশফিন। সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে।
“ভাইয়া কী হয়েছে তোমার? চিন্তিত দেখাচ্ছে যে!”
তাশফিন সংকুচিত স্বরে বলল।
“না তেমন কিছু হয়নি।”
সৌহার্দ্য মৃদু স্বরে বলল।
“তুমি কি ওনাকে দেখেছো?ওই যে আরিফা আন্টি।”
“হুঁ।”
তাশফিন ছোট্ট করে জবাব দিল। সৌহার্দ্য ফোন এগিয়ে দিতে দিতে বলে।
“আম্মু অনেকক্ষণ ধরে কল করছে। তোমার ফোনটা আমার কাছে ছিল।”
কিছু একটা ভাবলো তাশফিন। অতঃপর ফোন হাতে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল।
রুবেনা শেখ অপর পাশে ফোনের অপেক্ষায় রয়েছেন।তাশফিন কল রিসিভ করা মাত্র ধমক দিয়ে বললেন।
“তাশফিন তুই এমন কেনো? কতক্ষন ধরে কল করছিলাম?”
রুবেনা শেখ কে অবাক করে দিয়ে তাশফিন শুধোয়।
“আচ্ছা মা ওই যে আমার বিয়ে করা হবু বউ ফেলে গেছিলাম তার ছবি থাকলে দাও তো।”
তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলেন রুবেনা শেখ।ফেলে গেছে এক বছর আগে, একবার ঘুরে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। এখন আসছে ছবি চাইতে?
“তুই আমার সামনে থাকলে কান ছিঁ’ড়ে ফেলতাম তাশফিন। একবছর আগে মনে ছিল না আমার বউ টা কে এক নজর দেখে যাই? মাসের পর মাস বাইরে থাকলি। জাহাজ নিয়ে ঘুরঘুর করলি।অথচ ফোন করে জানতে চাইলি না তোর বউয়ের কথা।আরে জানতে চাইবি কি তুই তো বউ ঘরেই তুলিস নাই! বেয়াদব ছেলে একটা! আজকে তোর শখ হয়েছে বউ দেখার?এই তোর লজ….
টুট টুট শব্দ করে ফোনটা কে টে গেল। উঁহু কে টে যায় নি,তাশফিন কে টে দিয়েছে।এত লম্বা ভাষণ শোনার পর আরো কিছু শুনতে ইচ্ছে করলো না তার।
ভেতরে ফিরে এলো তাশফিন, আশেপাশে তাকিয়ে সন্ধানি দৃষ্টিতে খুঁজ করলো রমণী কে। অথচ তার দেখা নেই।
“❝উঁহু খুঁজ নিতেই হবে!কে এই মেয়ে? যদি অপরিচিত হয় তাহলে ভালো,আর যদি পরিচিত হয় তাহলে তো আরো ভালো। একবছর স্বামীর থেকে দূরে থাকার অপ’রাধে তাকে ব’ন্দি বানাবো।”❞
“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি , আহঃ আহঃ আহঃ।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,আজ আমাদের ছুটি।
কী করি আজ ভেবে না পাই,পথ হারিয়ে কোন বনে যাই?”
থেমে গেল ফারাহ,থামতে হলো তাকে।নিচে দু’জন লোক এসেছে। দুতলা থেকে দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু এরা কারা?
মধ্যখানে সোফায় বসে আছেন জয়নাল আহমেদ আর সাজ্জাদুল আহমেদ।লোক দুটো কথা বলছে তাদের সঙ্গে। ফারাহ লক্ষ্য করে দেখে চোখ মুখ কঠিন হচ্ছে জয়নাল আহমেদের।
“আপনার সাহস হলো কি করে এসব বলার? জুতো দেখছেন? সেটা দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করব।”
অকস্মাৎ এমন কথা শুনে স্নেহা আর ফারাহ দু’জনেই চমকে উঠে।শায়লা আহমেদ দৌড়ে এলেন স্বামীর চিৎকার শুনে।
“কী হয়েছে?”
“তুমি এখানে কী করছো? ভেতরে যাও।”
আরিফা আহমেদ এসে শায়লা কে পাশেই নিয়ে গেলো।
জয়নাল আহমেদ হুংকার ছাড়লেন।
“পরের বার যদি এই কথাটা চিন্তাও আসে তাহলে গলা কে টে নদীতে ভা’সিয়ে দিবো।”
লোক দুটো বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেলো। ফারাহ এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না নিচে গেল। জয়নাল আহমেদের কাছাকাছি গিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধোয়।
“কী হয়েছে চাচা তুমি রাগছো কেন?”
পবিত্র মুখখানি দেখে রাগ পড়ে গেল জয়নাল আহমেদের। শান্ত কন্ঠে বললেন।
“ফারাহ আমার জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত বানাবি?”
উপর নিচে মাথা দুলিয়ে দৌড়ে রান্না ঘরে গেল ফারাহ। স্নেহাও নিজের মতো উপরে ঘরে গেল।
“শুন একবার আমার ঘরে আয় তো সাজ্জাদুল। আরিফা ওকে দিয়ে যাও বনু।”
উপরে ঘরে চলে গেলেন জয়নাল আহমেদ। হঠাৎ কি হলো কেউই বুঝতে পারছেন না।শায়লা চিন্তিত মুখে আওড়ালো।
“উনার যে কি হয় আল্লাহ মালুম।”
আরিফা এগুতে এগুতে বলল।
“আরে ভাবি ভাইজান এমনি এমনি তো রাগ করেন না! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শায়লা আহমেদ।
রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সাজ্জাদুল আহমেদ এবং জয়নাল আহমেদ দুই ভাই বড্ড চিন্তিত। কী করবে ওরা?
কিছুক্ষণ আগে আসা লোক দুটো আর কেউ নয় বাজারের বেপারি। বড় দোকান গুলো তাদের। এলাকায় দাপ’ট নিয়ে চলাফেরা করে বরাবরই।বড় ছেলে নাদিম এক নাম্বার লুই’চ্চা। এলাকার এমন মেয়ে নেই তাকে তার পছন্দ হয় না! এবারে ফারাহর দিকে নজর পড়েছে তার। বিবাহিত জানা সত্বেও বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।আজকেও তাই, তবে কেউ কাউকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেই যে রাগ করতে হবে তেমন নয়। কিন্তু যখন নাকচ করলেন দুজনেই ঠিক তখনই তাদের মধ্যে থেকে একজন বলেছে মেয়ের খুঁত আছে,তাই তো এভাবে ফেলে রেখে চলে গেছে! ব্যস মাথা গরম হয়ে উঠেছে জয়নাল আহমেদের।
আদরের মেয়ে ফারাহ। জন্মের পর নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না সে, খুবই ছোট আর দূর্বল ছিল। অন্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো ছিলো না। ভাইয়ের পা টা ঠিক দু মাস আগেই ভে’ঙে গেছিল ফলস্বরূপ সে উইলচেয়ারে।সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে কে কোলে নিয়ে আদর করে দিয়েছিল, তাকে দেখে হেসেছিল মেয়েটা।তার নামে মন্দ শুনতে মোটেও প্রস্তুত নন তিনি।
“আচ্ছা ভাইয়া সত্যিই কী জামাই ফারাহ কে নিতে আসবে না?”
অপ্রস্তুত হলেন জয়নাল।নিজেও তো চিন্তায় আছেন।আদেও কি কখনো ছেলেটা আসবে? আচ্ছা ওনাদের কি ঠিক হবে রিজুয়ান শেখ কে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করা?
বন্ধুদের খাতিরে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য তাশফিন যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে। তিনি তো দেখেছেন। কিন্তু ওর এই হঠকারিতার সিন্ধান্তে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।
“আমাদের আরো কিছুটা দিন অপেক্ষা করা উচিত সাজ্জাদুল। দেখছিস না দু একদিন পর পর রুবেনা আপা কল করে ফারাহর খুঁজ খবর নেয়!তিনি তো এখনো মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ বলে মানেন।”
সাজ্জাদুল তাচ্ছিল্যের সহিতে আওড়ালো।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪
“যেখানে ছেলেই মেনে নিল না সেখানে ওনারা মানলেই বা কি আর না মানলেই বা কি?”
জয়নাল আহমেদ কি বলবেন বুঝতে পারছে না। সত্যি এবারে কিছু একটা করা প্রয়োজন, না হলে যে এলাকায় মেয়ে টাকে রাখা দায় হবে! গত এক বছরে কম কথা শুনতে হয় নি তাকে। এবারে আর নয়,হয়তো এসপার নয়তো ওসপার।