তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪১
ফারহানা নিঝুম
তাশফিন শেখ এক মুহূর্তের জন্য নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সজাগ দাঁড়িয়ে রইলো। সমুদ্রের অন্ধকারে ছড়িয়ে থাকা এক নিঃস্তব্ধ শীতলতা, যেখানে শুধু তার নিজের শ্বাসের শব্দই কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তার চোখের সামনে তখন সে দৃশ্য, যা কখনোই তার কল্পনায় আসেনি তার নিজের ভাই, সৌহার্দ্য শেখ, যে কিনা এক ন্যায়পরায়ণ লেফটেন্যান্ট হিসেবে পরিচিত, আজ সেই ভাইকেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।তাশফিনের মনে এক তীব্র দোলাচল চলে আসছে। পৃথিবীটা যেন এক নিমিষে বদলে গিয়েছে, তার পায়ের নিচে মাটির অনুভূতি হারিয়ে গেছে। সৌহার্দ্য ছিল তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, তাদের একে অপরের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। কিন্তু আজ সে শুনেছে, সৌহার্দ্য শেখের নাম এক অবৈধ চোরাচালান চক্রের সাথে জড়িত। তাশফিন কখনোই ভেবেছিল না, তার ভাই এমন কিছু করতে পারে।”ইনটারোগেশন রুম” সেখানেই রাখা হয়েছে সৌহার্দ্য কে! কিছুক্ষণ পরেই সেখানে যাবে তাশফিন। সে ভেবে পাচ্ছে না রাইমা শেখ এবং আলাফ শেখ কে কি উত্তর দিবেন?তারা যে ভেঙ্গে পড়বে!
সাইফুল নেই বাড়িতে তার কোনো খোঁজখবর নেই!সে কোথায় আছে জানে না নূপুর, কাউকে কিছু বলতেও পারছে না।রুবেনা শেখ যতবার জিজ্ঞেস করেছে সাইফুল কোথায় ততবার মিথ্যে বলতে হয়েছে তাকে। এবং কি আজ বিকেলে রিজুয়ান শেখ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছে সাইফুল কোথায়? প্রত্যুত্তরে নূপুর বলেছে “সে একটু বাইরে বেরিয়েছে।”
“আম্মু খাবো।”
আধো আধো কন্ঠে বললো মাহির, তখনই কলেজ থেকে ফিরছে ফারাহ।
“মাহির বাবু আমি এসে গেছি।চলো আমার সাথে খাবে।”
খুশিতে গদগদ মাহির, ফারাহ চট করে হাত মুখ ধুয়ে এলো। নূপুর তৎক্ষণাৎ টেবিলে খাবার দিয়ে দিলো। দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খেয়েছে। খাওয়া শেষে ওষুধ খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়েছেন রুবেনা শেখ। রিজুয়ান শেখ বরাবরের মতো নিজের শপে চলে গেছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাইফুল বাড়িতে নেই তাতে বেশ শান্তি লাগছে ফারাহর। কয়েক বার চেষ্টা করেছিল নূপুর কে সাইফুলের কথাটা বলার। সরাসরি না বললেও তার ভাবসাব মোটেও পছন্দ হয়নি ফারাহর নিকটে। একবার ভেবেছিল তাশফিন কে বলবে সেই জন্য ফোন পর্যন্ত করেছে, অথচ ফোন লাগেনি। হয়তোবা নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যা হয়েছে।
রুমের এককোণে বড়সড় একটা ছবি লাগালো তাশফিনের। তার নিচেই টেবিলে অনেক গুলো ছোট ছোট ছবি ফ্রেম করা।তার মধ্যে একটা তার ইউনিফর্ম পরা।হাতে তুলে নিল ছবিটা।কি স্নিগ্ধ মুখশ্রী! আনমনে হেসে ফিসফিসিয়ে বললো।
“ও লেফটেন্যান্ট সাহেব আমি আপনাকে বড্ড মিস করছি। আপনি কবে ফিরবেন বলুন তো! আমার যে একা ভালো লাগছে না!”
ফারাহ অনুভব করলো,কেউ খুব নিকটবর্তী তার। আলগোছে ছুঁয়ে আছে তার মেদহীন উদর,ধীরে ধীরে তার ক্লিন শেভ করা গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে গ্রীবাদেশ। লজ্জায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চোখ খিঁচিয়ে বুঁজে নিল ফারাহ।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব!”
“আই নিড ইউ ব্যাডলি সুখ।”
স্পর্শটুকু গাঢ় হলো,হাতের গভীর স্পর্শে মুচড়ে যাচ্ছে ফারাহ। কুন্ঠিত হচ্ছে নাজুক বদন খানি।ভ্রম,চোখ খুলে থতমত খেয়ে গেল ফারাহ। কল্পনা করছিলি সে! ইশ্ কি সব আজগুবি কথা ভাবছে! কিন্তু করবে টা কি? লোকটাকে প্রচন্ড মিস করছে!
“বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টাহরা বউ সাজনে এখুনি..
আউল মার্কা কবিতা শুনে থতমত খেয়ে গেল স্নেহা। সজোরে ধাক্কা দিলো ফারাহর মাথায়।
“এসব কি বলছিস তুই?”
“কবিতা!”
আরেক দফা আহাম্মক বনে গেল?স্নেহা।
স্নেহা বাড়িতে একা থাকবে বলে আরিয়ান এখানে দিয়ে গেছে তাকে।রুবেনা শেখ বড্ড খুশি হয়েছেন এখানে আসাতে। কিন্তু রাইমা শেখ নাক কুঁচকে নিয়েছেন। তবে তাতে পাত্তা দিলেন না রুবেনা শেখ।সেই থেকে আড্ডা দিচ্ছে ফারাহ আর স্নেহা দু’জনেই।
“এইটা কবিতা? তার চেয়ে আমি ভালো বলতে পারি!”
ফারাহ সপাটে হেসে বলল,
“তাহলে বল।”
“সর চোখের সামনে থেকে।”
নূপুর আস্ত আস্ত বেগুনি নিয়ে এলো সবার জন্য। ফুরফুরে মেজাজে দোতলা থেকে নেমে এলো ঝুমুর। নবীনের প্রেম নিবেদনের পর থেকেই ভীষণ আনন্দে থাকে ঝুমুর।আজকেও তাই।
“আপুউউ বেগুনি?”
“হুঁ।”
নূপুর ছোট্ট করে জবার দিলো। ফারাহ চট করে একটা হাতে তুলে নিল।
“উফ্ আপু এত্ত ভালো লাগে এটা খেতে কি বলব?”
স্নেহা নিজেও এক পিস তুলে নিল। পরপর প্লেট খালি হয়ে গেল মূহুর্তের মধ্যে।
“দারুণ হয়েছে নূপুর আপু।”
তৎক্ষণাৎ শোনা গেল বাইরে থেকে আসা কন্ঠস্বর,
“আমাদের রেখে একাই ঠুসে যাচ্ছো!এ তো মহা অন্যায়!”
নিহাল আর আরিয়ান একই সঙ্গে এসেছে। দু’জন কে দেখে ঝুমুর গদগদ প্রায়। ফারাহ কম যায় না।
“ভাইয়া ভোমরা?এসো এসো।”
জুতো জোড়া খুলে ভেতরে এলো দুজনেই।নিহাল আড় চোখে এক পলক দেখে নূপুর কে। আরিয়ান ফুরফুরে মেজাজে এগিয়ে গিয়ে স্নেহার কাছে বসলো।
স্নেহা খানিকটা সেটিয়ে গেল, হাঁসফাঁস ভঙ্গিতে চাইলো আরিয়ানের দিকে।লোকটা কেমন দুষ্টু হাসছে।
“ছিহ ছিহ রে নূপুর আপা আমাদের জন্য রাখলে না?
নূপুর তড়িৎ গতিতে বলল,
“আরে না না রান্না ঘরে আরো আছে,বসো তোমরা।”
নূপুর চটজলদি এগিয়ে গিয়ে রান্না ঘর থেকে বাকিদের জন্য বেগুনি নিয়ে এলো। ফারাহ নিহাল কে শুধোয়,
“ভাইয়া আপনি সমুদ্রে ফিরবেন না?”
নিহাল টিপুনি কে’টে বলল,
“কেনো গোঁ ভাবিজি তোমার কী পছন্দ হচ্ছে না আমি এখানে থাকি?”
হাপিত্যেশ করছে ফারাহ,উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“উঁহু আপনি বুঝতে পারছেন না ভাইয়া। আপনি যদি না যান তাহলে আমি খবর পাবো কি করে কমান্ডারের? একবারও ফোন করেনি আমাকে।”
ফিচলে হাসে আরিয়ান,নিহাল দুঃখ প্রকাশ করে বলল।
“কষ্ট পেয়ো না ভাবিজি, তোমার জন্য আমরা আছি। আমি আর আরিয়ান তাশফিনের বন্ধু মানে একই হলো…
চোখ টিপে নিহাল,সহসা হেসে ফেলল ঝুমুর।
“আসুক আমার ভাই এরপর বলব তোমরা কি ভাবে তার বউয়ের উপর চান্স মা’রছো।”
ফারাহ টলটলে চোখে তাকায় নিহালের দিকে।
“ভাইয়া এইটা বলতে পারলেন আপনি?”
নিহাল হো হো করে হেসে উঠলো। ফারাহ মেয়েটা বড্ড ভালো। তাকে সত্যি আদর আদর লাগে,যখন ভাইয়া বলে ডাকে সত্যি অন্য রকম নিদারুণ অনূভুতি কাজ করে। সম্পর্কে যথেষ্ট বড় যেমন তার ভাবি হয়।অথচ বয়সে তার ছোট।তাশফিন আরিয়ান এবং নিহাল দুজনকে খুব বিশ্বাস করে তাই তো এই পুরো বাড়ির দায়িত্ব টা তাদের কাঁধে দিয়ে গেছে। যতদিন আছে তারা যেনো তাদের দেখে।
সকল টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে ভেসে উঠছে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ। প্রথম সারির কাগজগুলো ছাপিয়ে দিয়েছে বিস্ফোরক শিরোনাম।
“লেফটেন্যান্ট সৌহার্দ্য শেখ চো’রাচালানের সঙ্গে জড়িত, হাতে নাতে ধরলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ।”
সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এবং নৌবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির কাছে তদন্তের জন্য সৌহার্দ্য শেখকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে। সামরিক আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কঠোর তদন্ত শুরু হবে যেখানে প্রমাণের মুখোমুখি হতে হবে তাকে, এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তির মাত্রা হবে ভয়ানক।
সবাই নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে, এই অন্ধকার অধ্যায়ের শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে।
খবরের কাগজে ছাপা সেই ভয়ানক সংবাদ পড়ে যেন ভেঙে পড়লেন আলাফ শেখ। নীরব পাথরের মতো বসে রইলেন তিনি, চোখের সামনে ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যেতে দেখলেন। পাশে বসে বড় ছেলে রিজুয়ান শেখ তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কণ্ঠের আশ্বাসেও ছিল শূন্যতার প্রতিধ্বনি।
এদিকে ঘরের কোণে বুক চাপড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাইমা শেখ। তাঁর আর্তনাদে যেন ঘরের দেয়ালগুলোও কেঁপে উঠল। রুবেনা শেখ, রিজুয়ানের স্ত্রী, এগিয়ে এসে শাশুড়িকে শান্ত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু রাইমা শেখের কান্নার মাঝেও উঠে এলো তীব্র বিষণ্ণতা আর অভিমানের ঝড়। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি কটাক্ষের ছায়ায় বললেন।
“তোমার ছেলে তাশফিন কী করে এসব করতে পারলো, হ্যাঁ? আমার ছেলেকে এভাবে তুলে দিলো? আমার ছেলে কিছু করেনি… কিছু করেনি! যদি ওর কিছু হয়, যদি আমার ছেলেটাকে হারাই, আমি কখনো তাশফিনকে ক্ষমা করবো না, কোনোদিন না!”
চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল, আর একটি অদৃশ্য ফাটল ছড়িয়ে পড়ল শেখ পরিবারের মজবুত বন্ধনে। ফারাহ মুখ চেপে কেঁদে উঠেছে,রাইমা শেখ যা তা শুনিয়েছে তাকে। তার স্বামী তার দেবর কে অপরাধী প্রমাণ করতে চাইছে!
কি হবে জানা নেই ফারাহর!
ইন্টারোগেশন রুমের নির্জন, সাদামাটা চার দেয়ালের ভেতর বসে ছিল লেফটেন্যান্ট সৌহার্দ্য শেখ। তার হাতের বাঁধন যত শক্তই হোক, দৃষ্টি ছিল অদম্য এক জেদের আগুনে দীপ্ত। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, তবুও দৃষ্টিতে ছিল এক অটুট দৃঢ়তা।তাশফিন শেখ শত চেষ্টা করেছে তাকে মুখ খুলাতে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়েছে, কখনো কড়া কণ্ঠে, কখনো শান্ত অনুরোধে। কিন্তু সৌহার্দ্য কেবল একটিই কথা বলেছে, বারবার
“আমি একা নই। এই খেলায় আরেকজন রয়েছে, সেই প্রকৃত মূল খেলোয়াড়।”
তবে নাম? পরিচয়? প্রমাণ? কিছুতেই মুখ খোলেনি সৌহার্দ্য। তাশফিন বারবার চেষ্টা করেও যখন কোনো লাভ হয়নি, তখন তার ভেতরে জমে উঠেছিল অসহায় এক ক্ষোভ আর বিষণ্ণতা।এ যেন এক যুদ্ধ, যেখানে দু’পক্ষই হারছে একজন সত্যের কাছে হার মানতে অস্বীকৃত, আর অন্যজন নিজের রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে ন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪০
দীর্ঘ ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। সময় যেন মলিন এক চাদর মুড়ে রেখেছিল চারপাশ। দুপুরের আকাশ আজও ক্লান্ত, রোদে নেই আগের মতো উজ্জ্বলতা, বাতাসেও নেই কোনো নতুনতার সুবাস। তবুও ফারাহর মনে আজ এক অদ্ভুত ফুরফুরে উচ্ছ্বাস। কারণ, আজ ফিরছে তাশফিন সমুদ্রের বিশালতার মাঝখান থেকে, হাজারো ঢেউ পেরিয়ে, অবশেষে আপন ঠিকানায়।বুকের ভেতর টুপটাপ কাঁপছে ফারাহর হৃদয়। ছয় মাসের দীর্ঘ প্রতীক্ষা, অব্যক্ত কথামালা আর জমে থাকা সব অশ্রু আজ যেন রঙিন প্রতীক্ষার ফুল হয়ে ফুটছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সমস্ত ধুলোমলিনতা আজ ঝরে পড়বে তাশফিনের এক ঝলক হাসিতে।দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, দুচোখে অনির্বচনীয় উন্মা’দনা নিয়ে ফারাহ অপেক্ষা করে। ছয় মাসের অপেক্ষা যে আজ আর কয়েক পলকেরই অতিথি!