তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪২

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪২
ফারহানা নিঝুম

বাড়িতে ঢুকেই সর্বপ্রথম মা কে জড়িয়ে ধরলো তাশফিন।
“আম্মু।”
রুবেনা শেখ বরাবরের মতো কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন।
“উফ্ আম্মু ,এই জন্য ভালো লাগে না। সবসময় এরকম করে কাঁদতে হয় না।”
কে শুনে কার কথা? তাশফিন মা কে সযত্নে আগলে নিলো।

ঠিক তখনই দুতলা থেকে নেমে এলো ফারাহ। চোখাচোখি হয় দু’জনের। এত গুলো মাস পর দুজনের দেখা হয়েছে। ফোনালাপ তো সবে মাত্র দু কি তিন বার। এর মধ্যে তাদের আর কোনো কথা হয়নি। তাশফিন কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই মুখ বাঁকিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল ফারাহ।
না চাইতেও হেসে ফেলল তাশফিন। তার বউ পুরো আ’গুন।
পা টিপে টিপে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো তাশফিন। আষ্টেপৃষ্ঠে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
“উফ্,ছাড়ুন আমাকে। ধরবেন না একদম।”
“উফ্ বউ এত হট হতে নেই।”
“বেহায়া পুরুষ,সরুন বলছি।”
“নো ওয়ে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাশফিনের নাকচ শুনে মেজাজ রীতিমতো তু’ঙ্গে ফারাহর। জোরপূর্বক পিছন ঘুরে তাশফিনের গলায় কামড় বসিয়ে দিল সে! তবে তাতে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না তাশফিন। ফারাহ সরে আসতেই তাশফিন তার থুতনিতে কামড়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ফারাহ। নিজেকে ছাড়াতে চাইলো সে। ছেড়েও দিল তাশফিন , রাগে ফুঁসছে ফারাহ। তাকে রাগতে দেখে চোখ টিপে তাশফিন।
“বেবী ডল রাতে মজা দেখাবো।”
“অ’শ্লীল লোক একটা।”
“ইয়েস, তোমার ভাবনার থেকেও বেশি অ’শ্লীল”

নিঃশব্দ রাতের চাদরে আজও বৃষ্টি নেমেছে টুপটাপ নয়, বরং রুমঝুম রুমঝুম করে সে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চারপাশে নিস্তব্ধতার আবরণ ভেদ করে যেন প্রতিটি ফোঁটা বৃষ্টির দল এক একটি সুরের বাঁধন বুনছে। জানালার কাঁচে আঙুল ছোঁয়ানো শিশুর মত বৃষ্টির ছোঁয়া, মেঘলা আকাশের করুণ গীত।
এই নরম, ছন্দময় শব্দের মাঝে মনও যেন বৃষ্টির সাথে গলে যায় অচেনা মা’দক’তার আবেশে ডুবে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। রাতের অন্ধকারে, নির্জনতার বুক চিরে, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন মনের অব্যক্ত অনুভবগুলো শব্দহীন ভাষায় বলে যায়। মনে হয়, এ বৃষ্টি কেবল মাটিকে ভিজিয়ে দেয় না, ভিজিয়ে দেয় হৃদয়ের গোপন কোণও।
এই বৃষ্টির রাত একাকীত্বের মাঝে সবচেয়ে গভীর সঙ্গী। আলো আঁধারের মাঝে ছায়ার মত জড়িয়ে থাকে অনুভবের মৃদু কণ্ঠস্বর হয়ে। কারেন্ট চলে গেছে সেই কখন! জেনারেটর অন করা হয়েছে অথচ ফারাহ ইচ্ছে করেই লাইট অফ রেখেছে রুমের। দু’টো মোমবাতি জ্বা’লিয়ে দিয়েছে টেবিলের দুধারে। জানালা টা মেলে দিতেই বৃষ্টির ঝপটা এসে ছুঁয়ে দিল তাকে।

হালকা ঝাপটায় ভিজে উঠলো তার গাল, কাঁধ, আর খোলা চুলের প্রান্ত। সে আবেশে চোখ বুজলো, যেন এই মুহূর্তটুকু চিরকালের জন্য ধরে রাখতে চায়। বৃষ্টির ঘ্রাণ, মোমের উষ্ণ গন্ধ, আর হালকা ঠান্ডা বাতাস মিলেমিশে এক মা’দকঘন পরিবেশ তৈরি করেছে।
ঠিক তখনই, আচমকা কোমরে কারো উষ্ণ স্পর্শ! এক অনভিপ্রেত কম্পন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লো কাঁপতে কাঁপতে নিঃশ্বাস আটকে এলো তার। মুহূর্তের ভেতরেই ফারাহর সমস্ত স্নায়ু সচেতন হয়ে উঠলো, যেন সময়ও থমকে গেলো সেই ছোঁয়ার গভীরে।
“সুখ মিস ইউ ব্যাডলি।”

শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত গতিতে চলছে ফারাহর। আঁখিদ্বয় বুঁজে এলো তার,অভিমানে বুক পু’ড়ছে তার?বাইরে গেলে তাকে ভুলে যায় এই পুরুষ। এখন আবার সোহাগ করছে।
ভেজা কাঁধে, খোলা চুলে, চোখ বন্ধ করে ফারাহ এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সেই উষ্ণ হাতের স্পর্শে তার সমস্ত চেতনা ছলকে উঠলো। বুকের গভীর থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, কষ্ট আর অভিমানের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে।সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে তার বুকের ভিতর তীব্র এক ব্যথার ঢেউ খেলে গেল।
তাশফিনের চোখেও ছিল অপরাধবোধের ছায়া, অথচ তাতে মিশে ছিল অপরিসীম মমতা যেন তার সমস্ত ভুলেরও ওপরে সে আঁকড়ে ধরতে চায় তার সুখ কে।
ফারাহ কঠিন গলায় ফিসফিস করে বললো,

“ভালবাসা কি শুধুই স্মৃতির মতো এসে ছুঁয়ে চলে যাবে, আর প্রয়োজন ফুরোলেই ভুলে যাবেন আপনি?”
তার কণ্ঠে জলভেজা কাঁপন, মনে হলো যেন বৃষ্টির শব্দের মাঝেও সেই অভিমানের সুর কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।তাশফিন এগিয়ে এসে তার মুখের ভেজা চুল সরিয়ে নিলো স্নিগ্ধ আঙুলে। মৃদু স্বরে বললো,
“ভুলিনি সুখ, কখনও ভুলতে পারিনি।কেবল নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার কাছে ফিরে আসাটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় সত্য।”

ফারাহ কে নিয়ে বেরিয়ে এলো বারান্দায়, বৃষ্টিতে মেলে ধরে একে অপরকে।ফারাহর চোখের কোণে জমানো জল এবার ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। বৃষ্টির ফোঁটার সাথে মিলেমিশে সেই অশ্রু অদৃশ্য হলো, অথচ বুকের ভেতর এক অসমাপ্ত কথা রয়ে গেলো।বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে, দুজন দুজনের নীরবতা ছুঁয়ে রইলো। বাইরে ঝরে পড়া জলকণার মতো, তাদের হৃদয়ের গোপন ব্যথাগুলোও একে অপরের মধ্যে ঝরে পড়লো নীরবে, ধীরে ধীরে, গভীরে।ফারাহ অনুভব করলো, চারপাশের সবকিছু যেন ঘূর্ণায়মান। বাতাস, বৃষ্টি, সোহাগ আর অভিমানের মিশ্রণে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ঝড় বইছে।
চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো, পা দুটো টলোমলো করে উঠলো।হঠাৎ করেই সে ঢলে পড়লো তাশফিনের প্রশস্ত বুকের ওপরে।তাশফিন ঝটপট আলগোছে তাকে ধরে ফেললো, যেন ফারাহর ছোট্ট একটি আঁচ’ড়ও সে সহ্য করতে পারবে না।
কণ্ঠে উদ্বিগ্নতায় ফিসফিস করলো,

“সুখ..
কোনো উত্তর নেই।ফারাহ নিঃস্পন্দ, চোখ বুঁজে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে।তাশফিন এক মুহূর্ত দেরি না করে তাকে তুলে নিল পাঁজাকোলে অতি আদরে, অতি যত্নে।তার বাহু দুটো যেন শক্ত, অথচ সেই শক্তির গভীরে ছিল অপার ভালোবাসয়।বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের দুজনের গায়ে নরমভাবে ঝরে পড়ছিল, কিন্তু তাশফিন যেন আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছিল না।ফারাহর মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতর তীব্র কষ্টের কাঁটা বিধে গেল।
সে আপন মনে উচ্চারণ করলো।
“আমি তোমাকে ব্যাথা দিতে চাইনি, ফারাহ কখনও না।”
দরজা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকলো, যেখানে উষ্ণতার ছোঁয়া আর মোমের মৃদু আলো অপেক্ষা করছিল।তাশফিন সাবধানে ফারাহকে একটা সোফায় শুইয়ে দিলো। ভেজা চুলগুলো সরিয়ে তার কপালে এক নরম চুমু এঁকে দিল।সেই চুমুর গভীরে ছিল অজস্র অপরাধবোধ, ব্যথা, আর ভালবাসার অঙ্গীকার।

বেপাত্তা সাইফুল, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আজ এত গুলো মাস হয়েছে।মূলত তাকে ধরতেই তাশফিনের এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা! সাইফুলের উপর সন্দেহের আরো একটি কারণ আছে,যা আপাতত কাউকে বলতে পারবে না তাশফিন।তার উপর রাইমা শেখ এবং আলাফ শেখ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। পরিবার টা ভেঙ্গে গেছে তাদের। কারণটা হলো তাশফিন কেন সৌহার্দ্য কে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না।তাশফিন আর যাই করুক কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না।

সকাল সকাল ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়েছে।রুবেনা শেখ হঠাৎ থমকে গেলেন তাকে দেখে।
“ফারাহ আম্মু তুই তো বললি না যাচ্ছিস।আর হঠাৎ করে কেন ফারাহ? কালকে তো তাশফিন মাত্র ফিরলো।
“নাক বোচা করে তাকালো ফারাহ পরপর অভিমানী কন্ঠে অভিযোগ করলো ।
“তোমার ছেলে আমাকে বাইরে গেলেই ভুলে যায় আম্মু, থাকব না তোমার ছেলের সাথে আমি।”
রিজুয়ান শেখ সবে দোতলা থেকে নেমে আসছিলেন। হঠাৎ “থাকব না তোমার ছেলের সাথে” কথাটি শুনে হকচকিয়ে গেলেন।

“ফারাহ আম্মু কি হয়েছে?কার সাথে থাকবি না?”
রিজুয়ান শেখ কে দেখে আহ্লাদি ফারাহ আরো আহ্লাদি হয়ে উঠলো।
“থাকব না আপনার ছেলের সাথে আব্বু।উনি সবসময় আমাকে ভুলে যান।”
হেসে ফেলল রিজুয়ান শেখ। তৎক্ষণাৎ আগমন ঘটে নবীনের। ফারাহ সকাল সকাল তাকে ফোন করে ডেকেছে।সে থাকবে না এখানে ঐ বাড়িতে থাকতে চায় কিছুদিন।
ঘুম জড়ানো চোখে নিচে এলো তাশফিন, বিছানা হাতড়ে নিজের ফুটফুটে বউ কে না পেয়ে বাধ্য হয়েই এক প্রকার নিচে আসতে হয়েছে তাকে।
“কি হচ্ছে এখানে? নবীন তুমি এত সকালে?”
নবীন বলবে কিছু তার পূর্বেই রুবেনা শেখ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন।
“তুই আমার ফারাহ কে এত কষ্ট দিচ্ছিস?এতটাই কষ্ট দিয়েছিস যে শেষমেশ মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে?”,
তাশফিন চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক। ফারাহ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে? ফারাহর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো।

“চললাম আমি।”
দরজার দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে ভারী কন্ঠে বলল তাশফিন।
“এক পা বাড়ির বাইরে গেলে আমি কিন্তু নিতে যাবো না বলে দিচ্ছি।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছন ফিরে তাকালো ফারাহ। চোখাচোখি হয় দু’জনের। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাশফিনের।
ফারাহ হিসহিসিয়ে বলল,
“আপনার সাথে থাকব না আমি। আমি আমার আম্মু আব্বুর কাছে যাচ্ছি।”
দাঁতে দাঁত পিষে চোঁখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল তাশফিন যদি যাও তাহলে কাঁচা কা’মড়ে খাবো বলছি।
ফারাহ ঠিকই বুঝলো কিন্তু তারপরেও ঘাড় ত্যাড়ামো করছে।
“যাচ্ছি আম্মু প্লিজ আমাকে আটকিও না।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তাশফিন, এদিকে বাকিরা অপেক্ষায় আছে তাশফিন ফারাহ কে আটকাবে।
“যা যা তোকে আনতেও যাবো না আমি।দেখিস বলে রাখছি যাবো না কিন্তু।”
রাগে ফুঁসতে থাকা তাশফিন জেদ দেখিয়ে চলে গেল দোতলায়।
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ, ফাজিল লেফটেন্যান্ট তার।একটুও ভালোবাসে না।

যেন দুধ হলুদের ছায়ায় আঁকা এক শান্ত ক্যানভাস। বাতাসে হালকা শিশিরের গন্ধ, ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিন্দুগুলো সূর্যের কোমল আলোয় মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। পাখিরা যেন মধুর সুরে নতুন দিনের স্বাগত জানাচ্ছে। দূরে কোথাও একা একটা কাক ডাকছে, তার মধ্যে দিয়েও একধরনের নিস্তব্ধতা জেগে থাকে। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে ধীরে ধীরে, ঠিক যেমন করে ঘুম ত্যাগ করে একেকটা মুহূর্ত জেগে ওঠে।
দালানের বাইরে বসে আছে ফারাহ।বড় নিম গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা বড্ড খারাপ তার। ইশ্ কোন দুঃখে যে বাড়ি থেকে চলে এলো? আইঢাঁই করছে এখন! সত্যি যদি লেফটেন্যান্ট সাহেব তাকে নিতে না আসে তখন কি হবে?

সঙ্গী স্নেহাটাও নাই, মনটা বড্ড উসখুস করছে।
“এই ফারাহ সত্যি করে বল তো ব্যাপারটা কি?কি হয়েছে হঠাৎ?”
আরিফা আহমেদের প্রশ্নে থম মে রে গেল ফারাহ। আইঢাঁই করছে সে। বলবে টা কি এখন? অবশ্যই তার উচিত তাশফিনের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া।
ভ্যা করে কেঁদে উঠলো ফারাহ।চমকে উঠলেন আরিফা আহমেদ।
“কি হলো তোর? কাঁদছিস কেন এভাবে?”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪১

“আম্মু তোমার জামাই আমাকে একটু ভালোবাসে না।বাইরে গেলেই ভুলে যায়।”
মেয়ের মুখে সোনার টুকরো জামাইয়ের নামে অভিযোগ শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
“কি বলছিস এগুলো?”
“হ্যা আম্মু সত্যি বলছি। তোমার জামাই আস্ত একটা শ’য়তা’ন গোও..
আরিফা আহমেদ ফারাহর কথায় বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিন্তু অবিশ্বাস করার কারণ তো নেই!

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৩