তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৩

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৩
ফারহানা নিঝুম

“ইশ্ লেফটেন্যান্ট সাহেব কখন আসবেন আপনি? আমি সেইইই কখন থেকে আপনার অপেক্ষায় আছি। আপনি ছাড়া একটুও ভালো লাগছে না। চলে আসুন না তাড়াতাড়ি প্লিজ।”
বিছানায় শুয়ে শুয়ে একাকী ভেবে চলেছে ফারাহ। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল নেই তার।

সকালটা যেন ঘুম ভাঙা আকাশের চোখে জমে থাকা শেষ অশ্রুবিন্দুর মতো। মেঘলা আকাশের কোলে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে নরম ছন্দে, জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ তুলে। চারপাশে একধরনের ধোঁয়াটে আলো নয় ঝলমলে, নয় অন্ধকার, বরং কুয়াশার মতো একটা নরম পর্দা।
গাছের পাতাগুলো জলে ভিজে চকচক করছে, রাস্তার ধারে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটায় প্রতিফলিত হচ্ছে সকালের ধূসর আভা। কাকভোরের পাখিরা আজ চুপচাপ কেবল দূরে কোথাও এক আধটা পাখির ডাক ভেসে আসে, তাও যেন গলায় বৃষ্টির সুর মিশে গেছে।
দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ।ওই তো বৃষ্টির পানি যে মাঝখান দিয়ে বড় পাইপের মাধ্যমে বাইরে চলে যাচ্ছে ভেতর থেকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাড়ির উঠোনে ভিজে আছে ফেলে রাখা চায়ের কাপ, বারান্দায় জমে থাকা পানিতে ছড়াচ্ছে ছোট ছোট তরঙ্গ। মানুষগুলো আজ একটু ধীর, একটু মন্থর কারণ এই সকালটা যেন বলে, তাড়াহুড়োর দিন নয় আজ, একটু বসে নিঃশ্বাস নাও। এ এক বৃষ্টি মাখা সকাল যেখানে প্রকৃতি জেগে উঠেছে একটু বেশি স্নিগ্ধ হয়ে। মনটা নেচে নেচে উঠছে ফারাহর। বরাবরই তার বৃষ্টি ভীষণ পছন্দের।এই মূহুর্তে তাশফিন থাকলে বোধহয় আরো ভালো লাগতো তার। লোকটা যে কেনো এত দেরী করছে আসতে!

আইঢাঁই ভাবতেই কর্ণ গোচরে প্রবেশ করলো বাইরে থেকে আসা গাড়ির শব্দ।এক মূহুর্তের জন্য ফারাহর মনে হলো হয়তো তাশফিন এসেছে। চটজলদি ব্যস্ত পায়ে ছুটে যেতে লাগলো নিচে। পারছে না সে উড়ে চলে যেতে।তাশফিন যদি আসে তাহলে জাপ্টে ধরে বলবে “লেফটেন্যান্ট সাহেব আপনাকে ভালোবাসি আমি।” মনে মনে অনেক বার কথাটি আওড়ালো ফারাহ।দালানের বাইরে এসেই থম মে রে গেল সে। গাড়ি তো এসেছে তবে তা থেকে নেমে এলো স্নেহা আর আরিয়ান। স্নেহা ফারাহ কে দেখা মাত্র গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

“ফারুউউ মিস ইউ রেএ।”
মৃদু হাসলো ফারাহ,সে ভেবেছিল হয়তো তাশফিন এসেছে। ফারাহ কে চুপ দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো স্নেহা।
“কি রে আমাকে দেখে খুশি হোস নি তুই?”,
অধর প্রশস্ত করে হাসে ফারাহ,একই ভঙ্গিতে এবার স্নেহা কে জড়িয়ে ধরে।
“খুব খুব খুশি হয়েছি। আরিয়ান ভাইয়া কেমন আছেন?”
আরিয়ান স্বভাব সুলভ হেসে বলল,
“জামাই জামাই ফিলিংস নিয়ে এসেছি। তাহলে ভাবো কতটা ভালো আছি।”
সহসা হেসে ফেলল ফারাহ।
আরিয়ান সাইডে নিয়ে গেল ফারাহ কে।
“তা ছোট ভাবি এত কিসের দুঃখ যে বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন।”
নাক বোচা করে বলল ফারাহ।
“বাজে কমান্ডার আমাকে ভুলে যায়। ভালোও কম কম বাসে।”
আরিয়ান গা দুলিয়ে হেসে উঠলো।
“উমম বুঝলাম বন্ধুরে বেশি বেশি ভালোবাসার মেডিসিন দিতে হবে।”

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জগিংয়ে গিয়েছে তাশফিন। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।রুবেনা শেখ আইঢাঁই করছেন তাশফিন কে কিছু বলবে। কিন্তু ছেলের গম্ভীর মুখ দেখেই তিনি চুপ করে যান বরাবরের মতোন। ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে তাশফিন। নূপুর বার কয়েক বার জিজ্ঞেস করেছে সাইফুলের কথা।তাশফিন তাকে বলেছে সাইফুল তারই জরুরি একটা কাজে গিয়েছে।সে কিছু মাসের জন্য তাকে কাজে পাঠিয়েছে। এতদিন চিন্তিত থাকলেও এখন খুব শান্তি লাগছে তার। নূপুর ফারাহর কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিন্তু তা আর পারলো না। ফারাহর নামটা উচ্চারণ করতেই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল তাশফিন। ঝুমুর হাপিত্যেশ করছে। মেয়েটা থাকলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে। ইদানীং ঝুমুরেরও খুব একটা ভালো লাগছে না বিষয়টি।

“আপু কি করব বলো তো? ভাইয়া তো যেতেই চাচ্ছে না ছোট ভাবি কে আনতে।”
ঝুমুরের অসহায় কন্ঠস্বর শুনে থম মে রে চেয়ারে বসে গেল নূপুর।
উদাস কন্ঠে বলল,
“কি করার? ভাইয়া যদি নিজ থেকে না যায় তাহলে তো কিচ্ছু করার নেই!”
বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে তাশফিন, বড্ড ব্যস্ত সে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো সে। ছোট্ট মাহির বিছানায় উঠে এসেছে।ঠাস করে ল্যাপটপ টা অফ করে দিয়ে মাহির কে কোলে টেনে নিল সে।
“কি হয়েছে মামা মন খারাপ কেন?”
মাহির নাক মুখ কুঁচকে বলল,

“তুমি মামি কে আনতে যাবে না?”
চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো তাশফিনের, কিছুটা ভাবুক কন্ঠে বলল।
“কেনো নিয়ে আসবো?”
মাহির আধো আধো কন্ঠে বলল,
“মামি আমাকে অনেক আদর করে। আচ্ছা মামা তুমি হিংসে করো তাই না?”
কিঞ্চিৎ অবাক হলো তাশফিন, কপাল ভাঁজ করে শুধোয়,
“হিংসে?”
“হু মামী আমাকে খুব আদর করে।তাই তুমি হিংসে করো।”
ফিচলে হাসে তাশফিন,কি বলবে এখন? ফারাহ যে তার বড্ড আদুরে।আর তার আদরে ভাগ বসায় এই ছোট্ট আদুরে মামা টা তার। তাই বলে কি সে হিংসে করে? দুহাতে মাহির কে জড়িয়ে ধরল তাশফিন,সেও আধো আধো কন্ঠে বলল।

“মাহির মামা এগুলো কে বলেছে তোমাকে?”
“আম্মু বলেছে।”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নূপুর আর ঝুমুর চমকে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দরজার দিকে তাশফিন, ফাঁকা ঢোক গিললো দু’জনেই।এই মাহির টা তাদের ধরিয়ে দিলো ইশ্!
“উফ্ ভাইয়া ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ো।”
নূপুরের কান টেনে ধরে আছে তাশফিন, রাগে রি রি করতে করতে বলল,
“এসব শিখাচ্ছিস মাহির কে হুউ?”
“উফ্ ভাইয়া কি করছো তুমি?”
মায়ের কানমুলো খেতে দেখে হেসে কুটিকুটি অবস্থা মাহিরের।

“প্লিজ ভাইয়া যাওনা ফিরিয়ে আনো ফারাহ কে।”
অনুনয় করে বলল ঝুমুর, নূপুরও একই ভাবে বলল,
“হ্যা ভাইয়া প্লিজ যাও। ফারাহ কে ছাড়া কিছুই ভালো লাগছে।”
সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলল তাশফিন।
“আমার কি বলছিলাম চলে যেতে? ও তো চলে গেল।”
“প্লিজ প্লিজ যাও না ভাইয়া, প্লিজ!”
তাশফিনের মনটা আইঢাঁই করছে ফারাহর জন্য।সুখ যে তার বড্ড আদরের।
“ঠিক আছে যাবো বিকেলের দিকে।রেডি হয়ে থাক তোরা।”
তাশফিন যাবে কথাটা জানতে খুব একটা সময় লাগলো না রুবেনা শেখের। খুশিতে গদগদ উনি।

ঘটা করে বৃষ্টি কে আমন্ত্রণ জানাতে হয়নি।বিনা আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছে তিনি। টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠে।গাছের পাতা গুলো ধুয়ে পানি ঝরছে। রাস্তার ধারে গর্ত গুলোতেও পানি জমতে শুরু করেছে রিতিমত। ইদানিং মেঘ গুলো বড্ড দুষ্টু হয়ে উঠেছে। যখন তখন ঝড়ে পড়ে। দুহাত মেলে দাঁড়ালো ফারাহ। আজ তার ভিজতে ইচ্ছে করছে। বৃষ্টির পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করতে চায় সে।চোখ দুটো বুঁজে আছে বড় আবেশে।এই তো দালানের পিছনের জায়গাটা সম্পূর্ণ খালি।টিনের চিলেকোঠা পাশেই।টুপ টুপ করে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার সর্বাঙ্গে। নিজের অস্তিত্বের মাঝে আরো একটি অস্তিত্ব অনুভব করলো ফারাহ।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে, মেদহীন উদরে ছুঁয়ে দিচ্ছে লোকটা।ক্লিন শেভ করা গাল গুঁজে দিয়েছে গল দেশে। একটুখানি ফিরে দেখার চেষ্টা করলো ফারাহ। ব্যর্থ সে। ফারাহ যে চিনে তাকে, অতি জড়ানো কন্ঠে বলল,

“লেফটেন্যান্ট সাহেব।”
পরপর গলদেশে টুকরো টুকরো চুমু খেলো তাশফিন।ভিজে একাকার দু’জন।তাশফিন বাঁধন ছেড়ে আজ। চেপে ধরলো ফারাহ কে, ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে ফারাহ, ব্যথিত কন্ঠে বলে।
“ছাড়ুন”
ক্ষিপ্ত মেজাজে টেনে নিয়ে চিলেকোঠার ঘরটায় আসে তাশফিন। পরপর টেনে তার ওড়না ফেলল জমিনে। আঁতকে উঠে ফারাহ,এ কাকে দেখছে সে?বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এসে মেয়েলি কোমল ওষ্ঠো যোগল আঁকড়ে ধরে তাশফিন। গভীর অমৃত সুধা টেনে নেয় নিজের মাঝে।ডান হাতে চুলের ভাঁজে গুঁজে আরো টেনে নেয় ফারাহ কে নিজের কাছে।বাম হাত ছুঁয়ে আছে ফারাহর কোমড়। স্তম্ভিত ফারাহ, অনুভূতির জোহারে ভাসছে সে।বক্ষতলে থাকা হৃদপিন্ড টা ধুকপুক ধুকপুক করছে। নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুই।এক মূহুর্তের জন্য ঠোঁট ছাড়লো তাশফিন। নেশাতুর কন্ঠে বলল।

“আই ওয়ান্ট ইট মোর ডিপলি।”
পরক্ষণেই আবারো ওষ্ঠো জোড়া আঁকড়ে ধরে সে। দীর্ঘ সময় পর ঠোঁট ছেড়ে গলায় মুখ গুঁজে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল তাশফিন। অকস্মাৎ তাকে ছেড়ে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এলো তাশফিন।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানছে ফারাহ,কি হয়েছিল তার সাথে বুঝতে অনেকটাই সময় লেগেছে।থম মে রে দাঁড়িয়ে আছে সে।তাশফিন এসেছে, তাকে ছুঁয়েছে। ফারাহ চমকায়!লোকটা কি করলো? শুকনো ঢোক গিললো সে। ফারাহর কলিজা শুকিয়ে আসছে। তৎক্ষণাৎ চিলেকোঠার ঘরটায় এলো স্নেহা, হাতে রয়েছে টাওয়েল।
“ফারু এই নে। ভাইয়া বলছে ঠান্ডা লাগবে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করতে।”
মৃদু শব্দে বৃষ্টি মাটিতে পড়ছে,আকাশটা ঘন মেঘে ঢাকা, সূর্যের আলো ফুঁটে উঠতে পারছে না ঠিকমতো।কাঁচা রাস্তা বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। মাটির গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠেছে।

খাবার টেবিলে বসে আছেন জয়নাল আহমেদ, সাজ্জাদুল আহমেদ এবং নবীন আহমেদ। সবাই খাচ্ছে আর একে অপরের সাথে গল্প করছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো ফারাহ অনেক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে তাশফিনের দিকে অথচ লোকটা তাকে দেখছেই না!এক বারের জন্য ফিরেও তাকালো না।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এখনো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।নিজ রুমে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে তাশফিন। কপালের ওপর এক হাত রাখা, দৃষ্টি তার সিলিং ফ্যানের দিকে।অথচ মস্তিষ্ক,মন দুটোই আটকে আছে হলদেটে রমণীর আদল খানে। ফারাহ বরাবরই তার সুখ।তার মাঝে যে সুখের সন্ধান পেয়েছে সে। এত সহজে কি ছাড়া যায়? উঁহু!তবে হ্যাঁ একটু তো কষ্ট দেওয়াই যায়। কথাটি ভেবে দুষ্টু হাসলো সে।
দরোজায় টোকা পড়লো। বিরক্ত হয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল তাশফিন। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়ান।

“কি চাই? তুই এত রাতে?”
পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে দিল আরিয়ান।
“এই নে বন্ধু বেশি ভালোবাসার মেডিসিন।”
প্যাকেট টা নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলো তাশফিন। রাগে ফুঁসে উঠলো রীতিমতো।
“শালা তুই শেষমেষ..

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪২

“ভাবি বলছে তুই তাকে কম ভালোবাসির ,তাই এই মেডিসিন দিলাম।”
হেসে ফেলল তাশফিন।
“মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, আমার মেডিসিন লাগে না। তবে হ্যাঁ তোর সিস্টেমে অনেক সমস্যা আছে। এই মেডিসিন টা তোর প্রয়োজন।”
“কি! ডিরেক্ট ইজ্জতে হাত!”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৪