তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৬
ফারহানা নিঝুম
আকাশটা আজ নির্বিঘ্ন, নির্মল, স্বচ্ছ।একফোঁটা মেঘও নেই দিগন্তজোড়া নীল ক্যানভাসে। সূর্যের কোমল কিরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি গাছের পাতা, প্রতিটি ঘরের ছাদ, প্রতিটি হৃদয়। ঝলমলে সেই রোদ যেন রূপকথার আলো নরম, উজ্জ্বল, আর ছুঁয়ে দিলে গায়ে সোনা মাখা এক অনুভব জাগায়।হাওয়াটা হালকা, তাতে নেই কোনও ক্লান্তির ছোঁয়া। এই রোদের স্নিগ্ধতা মনে করিয়ে দেয় নতুন শুরুর কথা।যেন প্রকৃতি নিজেই আজ পরেছে রোদঝলমলে শাড়ি।আর ছড়িয়ে দিচ্ছে আলোয় ভেজা সৌন্দর্য ।
সেই কখন থেকে নখ কামড়াচ্ছে ফারাহ! বুঝতে পারছে না, হিসেব মিলছে না তার!কি করে হতে পারে?কেন হবে? কিভাবে হবে?
দালানের বাইরে বড় বারান্দায় বসে আছে সে।ভেবেই চলছে এক মনে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো স্নেহা! সঙ্গে আছে ঝুমুর। হঠাৎ ফারাহ কে একনাগাড়ে নখ খেতে দেখে দুজনেই হা হয়ে গেল রীতিমতো।
“আরে আরে কি করছিস এটা? হ্যা রে ঘরে তো ভাত আছে ওইটাই খেতি।”
থতমত খেয়ে গেল ফারাহ,হো হো করে হেসে উঠলো ঝুমুর। ধপাস করে বসে পড়লো ফারাহর পাশে।
“কি গোঁ ছোট ভাবি ভাত রেখে নখ খাচ্ছো কেন?”
ফারাহ হকচকিয়ে গেল, ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।
“না না তোমরা বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা। উফ্ একটা মানুষ এভাবে পরিবর্তন হতে পারে নাকি?”
কিঞ্চিৎ অবাক হলো স্নেহা আর ঝুমুর। স্নেহা জিজ্ঞাসু কন্ঠে শুধোয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কে পাল্টে গেছে?”
“আরেএ লেফট…
বাকি কথাটা আর বললো না ফারাহ।ছিহ কি লজ্জার ব্যাপার। কিভাবে বলবে শ’য়তা’ন লেফটেন্যান্ট সাহেবের কথা গুলো তার পরিবর্তন।শরমে ম’রণ হবে তার
“কি হলো ছোট ভাবি বলো।”
ফারাহ এক গাল হেসে বলল।
“কিছু না,নখ বড় হয়েছে খেতেও মজা। ছোটবেলায় শুনেছি নখে নাকি দুধ থাকে তাই।”
ফারাহর কথায় আহাম্মক বনে গেল দুজনেই। উল্টো পাল্টা কথা বলে গুটি পায়ে কে টে পড়রো ফারাহ।
দুপুর গড়িয়ে আসছে। সূর্যের তেজ যেন ক্রমেই অ’গ্নিমূর্তির রূপ নিচ্ছে। আকাশে আগুন লেলিহান জ্বলন্ত শিখার মতো রোদ ঝরছে প্রতিটি ধূলিকণায়। পথঘাট ফাঁকা, গাছের পাতারাও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে রোদ্দুরের তীব্র আঁচে। বাতাস যেন থেমে আছে, চারপাশে এক অনির্বচনীয় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে, যাকে ভাষায় বাঁধা প্রায় অসম্ভব। রোদের ধার যেন খ’ঞ্জরের মতো কাটছে ত্বক, দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসছে সেই তাপমাত্রায়। দুপুরের এই নি’র্মম রোদে প্রকৃতি যেন ধুঁকছে ক্লান্ত, পিপা’সার্ত।
দালানের পিছন দিক দিয়ে গিয়ে ডান দিক ঘুরলেই বড়সড় একটা পুকুর রয়েছে আহমেদ পরিবারের।ছিপ ফেলে পারে বসে আছেন আরিফা আহমেদ।মাছ ধরার অনেক শখ উনার।আগে সাজ্জাদুল আহমেদের পা ভালো থাকাকালীন একত্রে মাছ ধরতে আসতেন।রোদ বেশী ফলস্বরূপ ঘেমে একাকার অবস্থা আরিফা আহমেদের। আজকে বোধহয় আর মাছ ধরা হবে না উনার। অকস্মাৎ অনুভব করলেন ছায়া নেমে এসেছে মাথার উপর।একটা ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে চিরপরিচিত মুখখানি দেখে ছোটো করে হাসলেন তিনি।চাপা হাসি,তাশফিনের সুঁচালো দৃষ্টিতে তা এড়ালো না।
“কি ব্যাপার আম্মু একা একা রোদে বসে আছেন যে?”
কথাটি জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেও পাশে বসে পড়লো তাশফিন।পুকুরে ছিপ ফেলা দেখে বাকিটা বুঝে গেল সে। নৈঃশব্দ্যে হেসে বলল।
“পাক্কা নাইস ওয়ালা একটা শ্বাশুড়ি পেয়েছি, সব কিছু খাপে খাপ মিলে যায়।”
ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো আরিফা আহমেদ।
“তাই নাকি।”
“একদম।”
পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছে তাশফিন, সঙ্গে ছাতা ধরে আছে দুজনের মাথার উপর। আরিফা আহমেদ নিশ্চুপ। মায়ের নরম হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল তাশফিন
শিথিল কন্ঠে বলল।
“আচ্ছা আম্মু বলুন তো রাগের কারণ টা কি? না বললে বুঝবো কি করে?”
আরিফা আহমেদ কটাক্ষ করে বলে উঠেন।
“কি করব রাগ না করে? তুমি বাইরে গেলেই আমার মেয়েটাকে ভুলে যাও।সব ভুলে থাকো তাহলে কি করব হ্যাঁ? তুমি আমার মেয়েটাকে অবহেলা করো কিভাবে তাশফিন?”
চোয়াল প্রায় ঝু লে এসেছে তাশফিনের।কি বলছে আরিফা আহমেদ এসব?
“কি বলছো এসব আম্মু? তোমাকে এগুলো কে বলেছে?”
“কেনো কিছু কি ভুল বললাম?”
নিম্নোষ্ট কাম’ড়ে কিছুটা ভাবুক হলো তাশফিন। অকস্মাৎ কিছু একটা মনে হতেই শুধোয়।
“এটা কি ফারাহ বলেছে?”
“তো আর কে বলবে শুনি? ফারাহই তো বললো তুমি ওর সাথে এমন এমন করো।”
থম মে রে গেল তাশফিন। দুষ্টু বউ একটা।কি সুন্দর শ্বাশুড়ির কাছে খারাপ বানিয়ে দিলো তাকে। ইশ্ একবার যদি বউটাকে একা পায় তাহলে আচ্ছা করে মজা বুঝাবে।
“উফ্ আম্মু তুমিও না তোমার মেয়ের কথা মেনে নিলে?”
“তো কি করব হুঁ? তুমি আমার মেয়েটাকে কষ্ট দেবে আর আমি তা বরদাস্ত করব ভেবেছো?”
সহসা হেসে ফেলল তাশফিন।ছাতা বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে আরিফা আহমেদের হাত টেনে নিজের মাথায় রেখে বলল।
“আপনার কি মনে হয় আমি কখনো আপনার মেয়ে কে কখনো কষ্ট দেবো? উঁহু ওটা আমার দ্বারা হবে না আম্মু।”
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আরিফা আহমেদ।কিয়ৎ সময় পর ছোট্ট করে হাতের উল্টো পিঠে চুমু এঁকে দিল তাশফিন,ফের অবাক হলেন আরিফা আহমেদ। তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষ।
“আপনার ফাজিল মেয়েটার জন্য দু’দিন ধরে রেগে ছিলেন আম্মু?”
মুচকি হাসলেন আরিফা আহমেদ। ছেলেটা বড্ড আদুরে। তার মেয়েটা যে কি করে না! সবসময় বাঁদরামি।
অশ্রুসিক্ত নয়নে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূপুর। চারপাশের কোলাহল যেন তার কাছে অনেক দূরের কোনো শব্দ অস্পষ্ট, অসংলগ্ন। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ধ্বংসের শব্দ প্রতিনিয়ত ধাক্কা দিচ্ছে, নিঃশব্দে ফেটে যাচ্ছে হৃদয়ের অদেখা কণা। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে আজ বুঝে ফেলেছে সাইফুলকে বিয়ে করা ছিল কেবল ভুল নয়, ছিল এক অপূরণীয় আত্মপ্রতারণা। সাইফুল, যে কিনা একদিন প্রেমের মায়াজালে বেঁধে তার স্বপ্নগুলোকে রাঙিয়ে দিয়েছিল, সেই এখন এক নিঃস্পৃহ, দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। স্বামী নয়, যেন একজন দূরবর্তী অতিথি যার কাছে স্ত্রীর চোখের জল, সন্তানের কান্না সবই অর্থহীন। বউ বাচ্চার খবর না রাখা মানুষটি যেন নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত, সেখানে নূপুরের কোনো ঠাঁই নেই।নূপুর আজ বোঝে, সম্পর্ক মানে কেবল ভালোবাসা নয় সমঝোতা, দায়িত্ববোধ, আর শ্রদ্ধার এক সূক্ষ্ম জাল বোনা থাকে তাতে। সেই জাল আজ ছিঁ’ড়ে গেছে, আর তার ভেতর বন্দি হয়ে আছে এক অসহায় নারী, যার নাম নূপুর।
“ঠিক আছিস?”
তাশফিনের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো নূপুর, দ্রুত চোখ মুছে তাকালো।বোন টা যে কষ্টে আছে তা বুঝতে বাকি নেই উনার।
“কাঁদছিস কেন?”
“কই ?”
“শুন নূপুর জীবনে যা কিছু হয় তা যে সবসময় সঠিক সেটা কিন্তু নয়! মাঝে মাঝে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি,পরে তা আবার বুঝতেও পারি।তাই বলে যে ভুল টাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকব তা তো হতে পারে না!”
নূপুর বুঝতে পারে না তাশফিনের কথার সারমর্ম।কি বুঝাতে চাইলো সে?
বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। অপেক্ষা করে চলেছে বাস আসার। আজকে অনেকটাই লেইট হয়ে গেছে তার। এই রোদ্দুরে হেঁটে যেতে ভীষণ কষ্ট হবে।
হঠাৎ করেই একটা বাইক এসে থামলো তার সামনে। নিহাল কে বাইক সহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে পৃথা। যেমন চমকেছে তেমন খুশিও হয়েছে।
“আপনি এসেছেন?”
পৃথা প্রচন্ড উত্তেজনায় অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে। নিহাল ছোট্ট করে দম নিয়ে বলল।
“এই রোদে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“আসলে আমি কলেজ থেকে ফিরছিলাম। বাসের অপেক্ষা করছি।”
নিহাল কিছু বলল না। পৃথার ভীষণ ইচ্ছে করলো বলতে “আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যাবেন বাইকে?” কিন্তু ভয়ের কারণে বলতে পারলো না।
নিহাল আগ বাড়িয়ে বলল।
“চলে এসো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
গদগদ হয়ে উঠে পৃথা।
“সত্যি?”
“এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। তুমি জানো আমি কিন্তু..
“আপনি নূপুর আপুকে ভালোবাসেন জানি আমি।”
নিহাল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না আর।পৃথা এক রাশ আড়ষ্টতা নিয়ে বাইকে উঠে বসলো। এটুকুই তার স্বস্তি, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিহালের কাছাকাছি থাকতে পারছে সে।
নিহাল জানে পৃথা মেয়েটা বড্ড বেশি ভালো, কিন্তু ভালোবাসা তো আর বার বার হয়না। একবারই হয়। আর সেটা হয়েছে নূপুরের ক্ষেত্রে।
রাত নেমে এসেছে ধীরে ধীরে, যেন এক ক্লান্ত পথিক দিনের বোঝা নামিয়ে বসেছে অন্ধকারের কোল ঘেঁষে। সকালটা ছিল রোদের উজ্জ্বলতায় ভরা রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক, কোলাহল, আর উত্তপ্ত বাতাসে ছড়িয়ে ছিল একরকম জাগরণ। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশের মেজাজ পাল্টেছে; দিগন্তজোড়া ছেয়ে গেছে ঘন মেঘে, আর বাতাসে ভেসে এসেছে ঝড়ের পূর্বাভাস।
এখন চারপাশে এক অস্বস্তিকর অস্থিরতা। হঠাৎই শুরু হয়েছে ঝড় পাগলের মতো ছুটে চলেছে হাওয়া, যেন কেউ অভিমান করে দিগন্তকে উলটে দিতে চাইছে। জানালার কপাটগুলো কাঁপছে রীতিমতো, একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে অবিরত, সেই শব্দ যেন নিরবতার বুক চিরে আসা কোন গোপন কান্না।ঘরের ভেতর নিঃশব্দতা এতটাই ঘন যে, মনে হয় নিঃশ্বাস ফেললেই সে ভেঙে যাবে। পিনপতন নীরবতার মাঝে কেবল জানালার একে অপরের সংঘ’র্ষের শব্দ।পা টিপে টিপে নিঃশব্দে রুমে ঢুকলো ফারাহ, যেন বাতাসকেও সে জানাতে চায় না তার আগমনবার্তা।
রাত গভীর হয়ে এসেছে, চারদিকে ছড়িয়ে আছে এক অলৌকিক নীরবতা। জানালার ফাঁক গলে আসা ম্লান আলোয় ঘরটা আধো অন্ধকারে ডুবে আছে, তারই মাঝে অনিশ্চিত ছায়ার মতো বিছানাটা চোখে পড়ে।তাশফিন ঘুমিয়েছে কিনা এই প্রশ্নে তার ভেতরে এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠা। দূর থেকে বিছানার অবয়ব অস্পষ্ট, নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকা সেই মানব তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ফারাহ পায়ের শব্দ যেন কাঁচের ওপর পা ফেলা, এতটাই সতর্ক, এতটাই নরম।তার বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছে।
তাশফিনকে ঘুমন্ত ভেবেই নিঃশব্দ পায়ে কাছে গিয়েছিল ফারাহ। কিন্তু বিছানায় পৌঁছে থমকে দাঁড়াল সে। অন্ধকারে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই বুঝে গেল সেখানে আছে শুধু একটি কোলবালিশ, নরম। তাশফিন নেই!চমকে উঠলো সে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠল, নিঃশ্বাস যেন থমকে গেল এক মুহূর্তে। তাহলে লেফটেন্যান্ট সাহেব কোথায়? এই প্রশ্নটা মাথার ভেতর ঝড়ের মতো ঘুরতে না ঘুরতেই, হঠাৎ পেছন থেকে জোড়ে একজোড়া বাহু চেপে ধরল তার কোমর।আতকে উঠে চোখ খিচিয়ে বুজে ফেলল ফারাহ।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৪৫
শিউরে উঠল পুরো শরীর। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ। অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে এলো মুহূর্তে। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো এক চাপা ফিসফিসানি, নিজেকেই মনে করিয়ে দেওয়ার মতো করে।
“ফেঁ’সে গেলি রে ফারাহ!”
অস্থির কণ্ঠে মিশে রইল চমক। এবার তার কি হবে?