তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৬
ফারহানা নিঝুম
বৃষ্টি যেনো ক্লান্তিহীন ছন্দে ঝরে পড়ছে দিগন্ত জুড়ে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের হালকা ঝ’লকানিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে আকাশ অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো যেনো হঠাৎ হঠাৎ চোখ মেলে তাকাচ্ছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নবীন নিঃশব্দ, গভীর এক অনুভূতিতে নিমগ্ন। সবে রুমে পা রেখেছে সে, ভেজা বাতাসের গন্ধ এখনো লেগে আছে তার শরীরজুড়ে। পেছনে ফুলে সাজানো বিছানায় তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নিঃশব্দে বসে আছে। চোখেমুখে এক অচেনা লাজুক আলো, অপেক্ষার কুয়াশায় ঢাকা গভীর ভালোবাসা।
নবীন জানে এই রাত শুধু বৃষ্টির নয়, এটি এক নতুন শুরু, নতুন ছোঁয়ার, নতুন কাঁপুনির রাত। অথচ আজকের অনূভুতি গুলো তার নিকটে ফিকে মনে হচ্ছে।এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এসেছে আঁখিপুট হতে। ছেলেদের কাঁদতে নেই, কিন্তু নবীন কাঁদছে। ভালোবাসার মানুষ পেয়ে গেছে।সে শুধু তার।তবে তার ছোটখাটো একটা ভুল ভেতরে খুব কষ্ট দিয়েছে নবীন কে।যা বলে বোঝানোর না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার উপর খুব রাগ করেছো নবীন?”
চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো নবীন।মলিন হেসে বলল।
“রাগ করব কেন?”
“তাহলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছো কেন?”
“ভাবছি,এইটাই কি তোমার ভালোবাসা?”
সবাই ঝুমুর কে কটাক্ষ করে কথা বলছে, উঁহু হয়তো সবাই দুষ্টু করছে।তা মানা যায় কিন্তু নবীনের এই কথা গুলো ছুরি’কাঘা’তের মতো এসে বুকে লাগছে ঝুমুরের।
“তুমিও এটা বলছো নবীন?আমি কিন্তু..
“আমি অনেক বার ফোন করেছি এটা বলতে যে তোমার আর আমার বিয়ে। এবং কি ফারাহ তোমাকে ছবি দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তুমি দেখোনি,সোজা বিয়ে করতে বসে গেছো। তোমার কি মনে হয় আমার সাথে যা ইচ্ছে করা যায়? আমি কি তোমার হাতের পুতুল? সিরিয়াসলি ঝুমুর?”
স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর, কিছু বলার নেই তার।হয়তো এটাই শুনতে হবে তাকে।সে যেহেতু ভুল করেছি তাহলে তো শুনতে হবেই।
“আই অ্যাম সরি নবীন, তুমি যা বলছো সব ঠিকই, আমি হয়তো ভুল করেছি।আর তা স্বীকার করছি। আমি সত্যি তোমার কাছে ক্ষমা…
বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না ঝুমুর,তার পূর্বেই ওষ্ঠো জোড়া দখল করে নেয় নবীন। পরম যত্নে চুষে নেয় তাকে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“কি মনে হয় আমি তোমার উপর রেগে আছি?রাগ করা সম্ভব? ঝুমুর ভালোবাসি তোমায়।আর আজকের দিনে তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইছো? পাগল মেয়ে, ভালোবাসি তোমায়। তুমি ছাড়া কিচ্ছু নই আমি।”
ক্রন্দনরত রমণী কে ছুঁয়ে ফেলে নবীন, দু’হাতে আগলে নেয় তাকে। আজকের রাতটা শুধু তাদের। তাদের জন্য সাজানো। আলগোছে ঝুমুর কে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল নবীন, শুইয়ে দিলো মধ্যেখানে। দু’জনে মিলে মিশে একাকার হয়ে উঠে। ভালোবাসার আলিঙ্গনে, প্রণয়ের আদিম খেলায় মত্ত হয় দুজনেই।
হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো এক স্নিগ্ধ সকাল।
সূর্যের কোমল আলো ধীরে ধীরে গলে পড়ছে পাতার ওপর,শিশিরবিন্দুতে ঝিকিমিকি করছে রোদের ঝিলিক।
পাখিরা জেগে উঠেছে মিষ্টি কুজনে,হাওয়া বইছে নরম মেঘের মতো,মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন হেসে উঠেছে নিঃশব্দে।শীত এসেছে ধীরে ধীরে, নিঃশব্দ পায়ে, নিস্তব্ধতা মেখে।কাল রাতের ঝড়ো হাওয়া আর অবিরাম বৃষ্টি যেন ঋতুর দরজায় শেষবারের মতো কড়া নেড়েছে,
আর তার পরেই খুলে গেছে শীতের অলক্ষ্য জানালা।
রাতজুড়ে জানালার কাঁচে কাঁচে ভিজে ভিজে জমে ছিল অজস্র জলকণা,যেন শহরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে বৃষ্টি তার শেষ চুমু এঁকে দিয়ে গেছে।হাওয়াটা ছিল ক্ষুব্ধ কিন্তু তার ভিতরে যেন ছিল শীতলতা,যা ধীরে ধীরে মাটি ছুঁয়ে পৌঁছে গেছে মানুষের হাড়ের গভীরে।
হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কম্ফোর্টার জড়িয়ে তাশফিনের প্রশস্ত বুকে ঘুমিয়ে আছে ফারাহ। জ্বর এসেছে মেয়েটার,খুব জ্বর।তার উপর দুজনেই রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছে।রাতের শেষ প্রহরে ফারাহ কে নিয়ে ভেতরে চলে আসে তাশফিন, মেয়েটা কেঁদে কু’টে বুক ভাসিয়েছে।তাকে নিয়ে একসাথে শাওয়ার নিয়েছে তাশফিন, নিজের কালো রঙের ফুলহাতা শার্ট টা পরিয়ে শুয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই জ্বর মেয়েটার। জ্বরদগ্ধ শরীর টা টেনে তুলতে পারে না ফারাহ। সাড়ে সাত টা ছুঁই ছুঁই। ঝাঁপসা চোখ দুটো টেনে খুলার চেষ্টা করছে ফারাহ।নড়তে গিয়ে অনুভব করলো শরীরের অস’হ্য ব্যথা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল ফারাহ, কান্নার শব্দে ঘুম ছুটে যায় তাশফিনের।
“সুখ সুখ নড়ে না ব্যথা পাবে তো!”
হো হো শব্দে কেঁদে উঠলো ফারাহ, বুকের পড়ে আছে তাশফিনের। চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজে দিলো তাশফিনের। শান্তনা দিতে ফিসফিসিয়ে বললো।
“জান কাঁদে না প্লিজ, অ্যাম সরি সুখ।”
“আপনি ভীষণ বাজে লেফটেন্যান্ট সাহেব।বার বার কষ্ট দিচ্ছেন।”
“আমিই ব্যথা দেবো, আমিই যত্ন নেবো সুখ।”
নৈঃশব্দ্যে চুপচাপ শুয়ে আছে ফারাহ। কিছু বলছে না সে। কপালে হাত ছুঁইয়ে জ্বর আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো তাশফিন,না সত্যি জ্বর বাড়ছে এবং কমছে। ঘুমিয়ে গেছে ফারাহ,তাশফিন আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে প্যারাসিটামল নিয়ে এলো। কপালে উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে ধীরে ধীরে ডাকতে লাগল।
“সুখ?সুখ উঠো, ওষুধ টা খেয়ে নাও।জান উঠো প্লিজ।”
পিটপিট চোখ করে তাকালো ফারাহ, মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে একরাতে।তাশফিন কোনো রকমে ওষুধ খাইয়ে আবারো শুইয়ে দিলো ফারাহ কে। চুপচাপ শুয়ে আছে ফারাহ।তাশফিন ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়।
ড্রয়িং রুমে টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছে নূপুর,তাশফিন কে দেখে শুধোয়।
“গুড মর্নিং ভাইয়া। ফারাহ কোথায়?”
তাশফিন সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো।
“গুড মর্নিং, ফারাহর খাবার টা দিয়ে দে তো বোন। ফারাহ একটু অসুস্থ,ওর জ্বর উঠেছে প্রচুর।”
ব্যস্ত হয়ে উঠে নূপুর।
“কি বলছো ভাইয়া? তাহলে তো ডক্টরের কাছে নিতে হবে।”
মুচকি হাসে তাশফিন। শান্ত কন্ঠে বলল।
“সমস্যা নেই তুই চিন্তা করিস না, আমি একটু পরেই ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবো।”
“আচ্ছা ভাইয়া। আচ্ছা যাওয়ার আগে একবার আঙ্কেল আন্টির সাথে দেখা করে নিও।”
সজাগ হলো তাশফিন ,সে আরিফা আহমেদের সঙ্গে কথাই বলতে পারেনি কাল ঠিক মতো। জোরপূর্বক এসেছে ঠিক আছে কিন্তু কথা তো বলা প্রয়োজন!
নূপুর কথা না বাড়িয়ে খাবার প্লেটে সাজিয়ে ট্রেতে দিয়ে দিলো।তাশফিন উপরে গিয়ে নিজে ফারাহ কে খাইয়ে দিয়েছে।আজ সারাটা দিন ঘুমিয়ে কা’টিয়েছে ফারাহ,তাশফিন ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে বলে বিকেলে ঠিক করেছে।
বাগানে বসে একত্রে দুই বেয়াইন চা খাচ্ছেন।
রুবেনা শেখ এক গাল হেসে বললেন।
“যাক এবার হিসাব ঠিকঠাক , তোমাদের মেয়ে আমাদের ঘরে আমাদের মেয়ে তোমাদের ঘরে।”
ওষ্ঠো বাঁকিয়ে হেসে ফেলল আরিফা আহমেদ।
পিছন থেকে গলা খাঁকারি দিলো তাশফিন।সহসা দুজনেই ফিরে তাকালেন। কপাল কুঞ্চন করে নিল আরিফা আহমেদ। হেসে ফেলল তাশফিন। বউটা আর তার মায়ের এক স্বভাব। কথায় কথায় কপাল কুঁচকে নেওয়া।
তাশফিন কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল।
“কি ব্যাপার আম্মু রেগে আছেন বুঝি?”
আরিফা আহমেদ চায়ের কাপটা রেখে দিলো টেবিলের উপর।
তাশফিন কে খানিকটা কটাক্ষ করে বলল।
“আমাদের রাগ করার কি অধিকার আছে? শ্বশুর শাশুড়ি আর কি বা করতে পারে?”
তাশফিন গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ধুমধাম পা ফেলে এগিয়ে এসে দুই মহিলার মাঝখানে নিজের জায়গা করে নিল। সহসা মাথাটা রাখল আরিফা আহমেদের কাঁধে।
“আমার দুটো আম্মু ,এক আমার সুখের আম্মু আর আরেকজন আমার সুখের স্বামীর আম্মু।”
অবাক নেত্রে দুই মা তাকালো ছেলের দিকে। তাশফিন অন্য হাতে রুবেনা শেখের হাতটা মুঠো করে ধরে কাছে টেনে ওষ্ঠো ছুঁয়ে দিল। আরিফা আহমেদ ক্ষীণ হেসে হাতটা রাখলেন তাশফিনের মাথায়।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে, ঘুমন্ত শহরের নির্জন রাস্তাগুলো পেরিয়ে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে, মুহূর্তেই যেন ঝরে পড়বে অঝোর বৃষ্টি। হিমেল হাওয়া জানালার কাচে ধাক্কা দিচ্ছে, যেন প্রকৃতিও বুঝে গেছে এই রাতটা কেবল ঠান্ডার নয়, কষ্টেরও।সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ফারাহ। জ্বরদগ্ধ চোখে চারপাশ যেন অস্পষ্ট। শরীরটা এতটাই দুর্বল যে চোখ বন্ধ রাখাই যেন সবচেয়ে আরামদায়ক। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়ানো, কিন্তু ঠান্ডা যেন হাড়ের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।তাশফিন এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছে, আর অন্য হাতে ফারাহর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে স্ত্রীর দিকে। সেই হাসিমাখা মুখ, যে মুখে সে রোজ সকালে নতুন করে প্রেমে পড়ে, আজ সেটা ক্লান্ত, বিবর্ণ, নিস্তেজ।তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কীভাবে পারে একটা মানুষ ভালোবাসার কাউকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখতে? বুকের ভেতর কেমন যেন টান ধরে চোখের কোনে এক ফোঁটা কষ্ট জমে, কিন্তু সে কাঁদে না। কেবল ফারাহর কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর আরও বেড়েছে কিনা। বাইরে বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে।এই মূহুর্তে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়,আপাতত যে করেই হোক তাকে থাকতো হবে।তাশফিন অপেক্ষা না করেই গাড়িটা সাইডে পার্ক করলো।
পিটপিট করে তাকালো ফারাহ, শুকনো গিলে ফিরে তাকালো তাশফিনের ঠিক। দৃষ্টি পড়লো তার তাশফিনের তামাটে ওষ্ঠো জোড়ার দিকে। কিছু ভাবতে পারছে না সে। কাঁপা হাতটি বাড়িয়ে শুয়ে ফেলল তার গাল। হকচকিয়ে গেল তাশফিন, গাড়ি থামিয়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ ফারাহর দিকে।
“কি হয়েছে সুখ? শরীর খুব খারাপ করছে জান?”
ম্লান হাসলো ফারাহ,উঠে বসতে চাইলো।তাশফিন হাত ধরে বসাতে চায় তাকে। অকস্মাৎ ফারাহ তাকে অবাক করে দিয়ে দু’পা ছড়িয়ে কোলে বসে পড়ল তাশফিনের।গলা জড়িয়ে তপ্ত ওষ্ঠো জোড়া ছুঁইয়ে দিলো। বিস্ফারিত নয়নে তাকালো তাশফিন।
“জান।”
“আপনাকে চাই।”
তাশফিন কে কোনো উত্তর দিতে দেয়নি ফারাহ, ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট গুঁজে দিলো। অতিষ্ঠ করে তুলে তাকে,অবাধ্য পুরুষ সায় পেয়ে খুব অস্থির হয়ে উঠে। উগ্র হয়ে ব্যগ্র ভাবে চেপে ধরে তাকে। নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সেকেন্ডর মধ্যে। ফিসফিসিয়ে বলে।
“স’হ্য করতে পারবে জান? আমি কিন্তু খুব তৃষ্ণার্ত!”
শব্দ বিহিন হাসলো ফারাহ,সে কি আদতেও নিজের মাঝে আছে?নেই তো।থাকলে কি আর অবাধ্য পুরুষ কে এসব করতে দিতো? শরীরের ব্যথা, জ্বর সবটা ভুলে তাশফিন কে আঁকড়ে ধরে ফারাহ। মিনিট দশেক পরেই একে অপরের অতিব নিকটে চলে এলো।এন মূহুর্তে জ্ঞান হারালো ফারাহ। জ্বরের ঘো’রে তার হুঁ’শ নেই। আঁ’তকে উঠে তাশফিন।
“সুখ?এই সুখ হোয়্যাট হ্যাপেন্ড জান?”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৫
পাশের পড়ে থাকা চাদর জড়িয়ে তাকে ওইভাবেই কোলে রাখলো তাশফিন। বৃষ্টি কমে এসেছে।তাশফিন গাড়ি স্টার্ট দিলো। কপালে উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে গাড়ি চালাচ্ছে এক হাতে। ভেতর টা কাঁপছে তার, এতটা কাছে এসেও মেয়েটা সরে গেল। পরক্ষণেই হেসে ফেলল, ম্যাডাম তো হু’শে নেই না হলে পালাই পালাই করতো! নিচের ঠোঁট কা’ম’ড়ে হাসলো তাশফিন, অস্থির মন।বউটা সুস্থ থাকলে উ’ন্মাদ স্বামী কে দেখে লজ্জায় মিইয়ে যেতো।
