তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১০

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১০
ফারহানা নিঝুম

ঘন অন্ধকারের বুক চিরে এক ফালি রোদ ঢুকে এলে, প্রথমে মনে হচ্ছে যেন কেউ ধূসর, স্তব্ধ পরিবেশের মাঝে সোনালি রঙের এক তুলির আঁচড় দিয়েছে। ধুলো জমে থাকা বাতাসে রোদের চিকচিকে কণা নাচতে লাগলো বোধহয়। যেন অজস্র ছোট্ট সোনার কণিকা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।জায়গাটা ধুলোমাখা বা স্যাঁতসেঁতে রোদের ছোঁয়ায় সেখানে নতুন উষ্ণতার আভাস দিচ্ছে।

চোখ বড় হয়ে উঠেছে ফারাহর , শ্বাস একটু দ্রুত গতিতে চলছে।খুব ভয় পেয়েছে সে। ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেছে, হাত-পা হালকা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। অপ্রত্যাশিত পুরুষ টি কে সামনে দেখে বক্ষঃস্থল কম্পিত হচ্ছে।এক পা, দু পা করে এগিয়ে এলো তাশফিন। টায়ারের দিকে তাকিয়ে নৈঃশব্দ্যে হাসলো সে। অবুঝ বালিকা, বাচ্চা সুলভ তার কাজকর্ম।এবারে দৃষ্টি তুলে তাকায় পবিত্র মুখ পানে।
“মিস অর মিসেস?”
“হুঁ?”
হাসলো তাশফিন, স্পর্শ করলো ফারাহর বাহু। জড়ানো কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো।
“মিস অর মিসেস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পায়ের পাতা থেকে শিরশির অনূভুতি টুকু ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। আতংকে খা’মচে ধরে ওড়নার শেষপ্রান্ত টুকু।
“আ.. আপনি আমার বা.. বাড়িতে কি করছেন?”
পুরুষালী তামাটে রঙের অধর স্পর্শ করল কানের লতি।পিলে চমকে ফারাহ।হাত পা অসাড় হয়ে এলো তার।একই টুনে কমান্ডার বলে উঠে।
“ইওর হাসব্যান্ড লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ মিসেস ফারাহ শেখ।”
আশ্চর্যের অষ্টম আকাশ বোধহয় পেরিয়ে এসেছে ফারাহ। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ?তার স্বামী? নিজের কান কে বিশ্বাস করতে অপ্রস্তুত ফারাহ।চোখ দুটো ঘাড় ঘুরিয়ে একটু তাকানোর চেষ্টা করে তাশফিনের দিকে। চোখাচোখি হয় দু’জনের।কিয়ৎক্ষণ চলল নিরবতা, আবেশে চোখ বুজে নেয় ফারাহ। তামাটে ওষ্ঠো পুট স্পর্শ করে তার লাজে রঙা গাল। মনিকোঠায় থাকা মনি দু’টো খিঁচিয়ে ভেতরে যেতে চাইলো,হাতের ওড়না ছেড়ে দিল আলগোছে।

“মিসেস শেখ ,আই হ্যাভ অ্যারাইভড টু ট্র্যাপ ইউ।”
শিরশিরানি অনূভুতি টুকু বেড়ে গেল মূহুর্তের মাঝে। বুকের বাঁ পাশে থাকা মাংসপিণ্ড টা লাফিয়ে উঠছে বারংবার।
“আপনি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ?”
প্রশ্নে চমৎকার হাসলো তাশফিন।এদিক সেদিক তাকিয়ে ফের বলল।
“জ্বি আগগে।ঠিকই ধরেছেন। আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ,ওরফে আপনার লেফটেন্যান্ট সাহেব।”
মস্তক নত হয় আপনাআপনি। শুকনো ঢোক গিললো ফারাহ। ভেতর টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, একটু পানি পেলে বোধহয় ভালো হতো।

চঞ্চল আঁখি দয় এলোমেলো লাগছে। নেত্র পল্লব ভারী হয়ে আসছে, এদিক সেদিক তাকিয়ে আকস্মিক ছুট লাগালো ফারাহ। কনুই টেনে ধরে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে।থামতে হলো ফারাহ কে।
“পালাচ্ছো কোথায়? ডিরেক্ট শু’ট করব কিন্তু! জানো কোথায় শু’ট করব, এখানে।”
বুকের বাঁ দিকে ইশারা করে তাশফিন। চোয়াল ঝু লে গেল ফারাহর। ছটফটানি বেড়ে গেল তার। তিরিক্ষি মেজাজে গম্ভীর স্বরে ফের বলল তাশফিন।
“একবছর ধরে দূরে থেকেছো মন ভরেনি? আবার পালাতে চাইছো!এবারে আর তা হচ্ছে না,পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করতে এসেছি।”
সহসা কনুই ছেড়ে দিল তাশফিন। তৎক্ষণাৎ পা বাড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। অস্থির কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো স্নেহা।
“ফারাহ, ফারাহ।”

ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো স্নেহা। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল।
“আমি চিনে গেছি।ওই যে লেফটেন্যান্ট? উনি কে জানিস? উনি তোর এক বছর আগে চলে যাওয়া স্বামী।”
চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে ফারাহর।কান টেনে ধরে স্নেহার।
“তুই বলার আগে সে নিজেই বলে গেছে বুঝেছিস?”
তব্দা খেলো স্নেহা। মাথা চুলকে আওড়ালো।
“তোর জামাই তো নেভি।বারে বা ভাগ্য হো তো তুজ জেসি।”
“ভুলভাল হিন্দি বলা বন্ধ কর।সর চোখের সামনে থেকে।”
গঢগঢ করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল ফারাহ।

ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা।একে অপরের সম্মুখীন হয়েছে তাশফিন অনেক দিন পর। জয়নাল আহমেদ এবং আরিফা আহমেদ দু’জনেই তাকিয়ে আছে তার দিকে।এতে খুব একটা ভাবান্তর নেই তাশফিনের।সে তো তার বউ কে খুঁজতে ব্যস্ত।
রিজুয়ান শেখ কথা শুরু করে বললেন।
“বলছিলাম যে আরিফা আপা আপনার কথা অনুযায়ী তাশফিন সশরীরে এসেছে ফারাহ কে নিয়ে যেতে।”
আরিফা আহমেদ খ্যাক করে উঠলেন।
“এক বছরের উপরে হয়ে যাচ্ছে ভাইজান। এখন এসে কী হবে?আর এখন যে আমরা মেয়ে দেব তা ভাবলেন কি করে আপনারা?”

মোটা ভ্রুদয় কুঁচকে এলো তাশফিনের। মুখের কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে বলল।
“বিয়ে করা বউ আমার। আমার রাইট আছে নিয়ে যাওয়ার। এত দিন ইচ্ছে হয়নি নিয়ে যায়নি,এখন বউ লাগবে তাই নিয়ে যাচ্ছি।বাকিটা বোঝার কথা।”
লজ্জায় হাঁসফাঁস করলেন রুবেনা শেখ।এই ছেলের মুখে কিছুই আটকায় না।কই ক্ষমা টমা চাইবে তা না করে বড় বড় লেকচার দিচ্ছে? আরিফা আহমেদ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশফিনের দিকে। জয়নাল আহমেদ চাই ফারাহ সংসার করুক, এমনিতে তিনি দেখেছেন রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ দু’জনেই ফারাহ কে মেয়ের মতো ভালোবাসে।
“দেখো রিজুয়ান আমরা তো আর মেয়ে দিতে তখন মানা করিনি তবে এখন তো ফারাহ সব কিছু বুঝে।ও যদি রাজি থাকে তাহলে অবশ্যই মেয়ে দেব।”
আরিফা আহমেদ একই সুরে বলল।
“যদি ফারাহ রাজিও থাকে তারপরেও আমি মেয়ে দেব না।”
চোকা চোখে তাকায় তাশফিন।বউ তার সে দরকার পড়লে ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে,কার ক্ষমতা আছে তাকে আটকানোর?

জয়নাল আহমেদের আদেশে স্নেহা গেল ফারাহ কে নিয়ে আসতে।
স্নেহা আদেশ মতো ফারাহ কে নিয়ে নিচে এলো।নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। ধুকপুক ধুকপুক শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে। দৃষ্টি তুলে তাকানোর সাহস নেই তার। সামনেই তো বসে আছে স্বামী নামক আ’সামী।
রুবেনা উঠে গিয়ে হাত মুঠো করে ধরলো ফারাহর।
“আম্মু তুই যাবি না? আমরা তোকে নিতে এসেছি।”
নেত্র পল্লব কেঁপে উঠল ফারাহর। স্থির থাকতে কষ্ট হচ্ছে তার।নয়ন তুলে তাকালো এক পল।তাশফিনের দৃষ্টি স্বচ্ছ, অপেক্ষায় আছে জবাবের। ফারাহ রিনরিনে কন্ঠে বলল।
“আমি যাবো না।”
বাঁকা হাসলো তাশফিন,সে বোধহয় আগে থেকেই জানতো এমন উত্তর আসবে।আরিফা আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তৃপ্তি নিয়ে বললেন।

“হয়েছে এবার শান্তি?”
উপরের দিকে পা বাড়ায় ফারাহ।সহসা উঠে দাঁড়ালো তাশফিন।
“ওই আমার কথা আছে তোমার সাথে।”
অনেক গুলো চোখ তাকিয়ে আছে তাশফিনের দিকে।এক পলক পিছন ফিরে তাকালো ফারাহ।ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তার।আর দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পেলো না।এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে গেল।তাশফিন টেবিলের উপর রাখা প্যাকেট তুলে এগিয়ে যেতে লাগলো উপরের দিকে।আরিফা আহমেদ তব্দা খেলেন।
“তাশফিন তুমি দাঁড়াও।”
কে শুনে কার কথা?তাশফিন চলেছে উপরের দিকে। জয়নাল আরিফা কে থামিয়ে বলল।
“তুমি দাঁড়াও আরিফা। ওদের কথা বলতে দাও ‌।”
রুবেনা শেখ মনে মনে আল্লাহকে ডাকছেন।বউ না নিয়ে যেনো ফিরে।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে পাশের ঘরের দিক দৌড়ে যেতে লাগল ফারাহ।মাথায় দেওয়া ওড়না নেমে গেল দুদিকে।সফেদ পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে।হাতে টান পড়তেই কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। থামতে হলো ফারাহ কে।
“আমার কথা আছে।”

হাস্কি টুনে বলা শব্দ গুলো কর্ণ কুহু হওয়া মাত্র থমকায় ফারাহর হৃদয় স্পন্দন।প্রথমবারের মতো হাত ধরাতে, যেনো সময় স্থির হয়ে গেছে।আঙুলের উষ্ণতা সারা শরীরে এক ধরনের শিহরণ জাগিয়ে তোলতে সক্ষম।হাতের তালুর উষ্ণতা ধীরে ধীরে মিশে যায় হৃদয়ের গভীরে। আঙুল গুলো একে একে ছুঁয়ে দিচ্ছে ফারাহর আঙ্গুল গুলো। টুকরো টুকরো ছোঁয়া গুলো গভীর হচ্ছে। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে। চুলের খোঁপা টেনে দিল তাশফিন।ঝরঝর করে চুল গুলো নেমে গেল কোমড় বেয়ে, আলতো হাতে সরিয়ে দিল কাঁধ হতে। খিঁচিয়ে আঁখিদয় বুঁজে নিল ফারাহ, আঁক’ড়ে ধরে নিম্নাষ্ট।

এখানে যদি অন্য কেউ হতো তবে উচিত শিক্ষা দিতো সে।অথচ আজ পারছে না কিছুই বলতে আর করতে।চুপ করে স’হ্য করছে অস’হ্যকর ছোঁয়া গুলো।কানের লতিতে স্পর্শ করেছে কানের লতি। হাতের প্যাকেট ছিঁড়ে ফেলল তৎক্ষণাৎ। বেরিয়ে এলো অলংকার।ধীর গতিতে কানের লতিতে থাকা ছোট্ট টপস রিং গুলো খুলে ফেলল তাশফিন। কম্পিত হলো কিশোরী হৃদয়।সেই কম্পন অনুভব করছে তাশফিন, নৈঃশব্দ্যে হাসলো সে। ঝুমকা জোড়া আলগোছে পড়িয়ে দিল।এবারে ধীরে ধীরে কাঁধের চুল গুলো ডান দিকে সরিয়ে দেয়। পাশের ফুলদানিটায কাছে প্যাকেট টা রাখলো আলতো হাতে। ফের বেরিয়ে এলো একটি পাথরের নেকলেস।এটা কি ডায়মন্ড? গলায় নতুন একটি অলংকার আবি’ষ্কার করলো ফারাহ।চমকালো তৎক্ষণাৎ,হাত উঠাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সে। পাথর বসানো এক জোড়া চুড়ি পড়ানো হলো তাকে। নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বাড়ছে দু’জনের।সাহস করে চোখ দুটো মেলে তাকালো ফারাহ,তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই কাঁধে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে সহসা কেঁপে উঠলো সে। খিঁচিয়ে বুঁজে এলো আঁখিদয়।

“এটাই যেন শেষ না হয়। পরের বার যেনো আর না শুনতে না পাই। বিয়ে করা বউ আমার, আমার যখন ইচ্ছে হবে নিয়ে যাবো।”
মস্তিষ্ক তড়াক করে ,হাত মোচড়াতে লাগল ফারাহ। ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করলো উদরে, বলিষ্ঠ হাতের চাপে ব্যথাটা বেড়ে গেল হুড়োহুড়িয়ে।
“একটা গয়নাও খুললে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
অশ্রু কণায় আঁখি ভরে উঠেছে ফারাহর।
“নেক্সট টাইম জিজ্ঞাস করা হলে বলবে যাবো ঠিক আছে?”
চাপটা তীব্র হলো,”ইস্” শব্দটি বেরিয়ে এলো অধর ফাঁক হতে।মাথা দোলায় ফারাহ। উত্তর টা পছন্দ হলো না তাশফিনের। হিসহিসিয়ে বলল।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৯

“ইউজ ইউর ওয়ার্ড’স।”
“হ..হুম।”
ছেড়ে দিল তাশফিন,সরে এলো ফারাহ। হাতের স্পর্শ করা জায়গায় হাত রাখলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাশফিনের পানে।
“কচু বলব।যাবো না আমি দেখব কি করেন!”
তৎক্ষণাৎ পালায় ফারাহ।ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো তাশফিন।
“দূর থেকে সাহস?”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১১