তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া শেষ পর্ব 

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া শেষ পর্ব 
ফারহানা নিঝুম

“মামমু!”
“কি তুমি আমাকে মারবে? ফাইরোজ এবার কিন্তু বকা দেব!”
আড়াই বছরের ফাইরোজের হাত থেকে মেহেদীর প্যাকেট টা টেনে নিল ফারাহ। রাগে গজগজ করে বলল।
“কি করেছো এগুলো তুমি? দেখো জামাটায় কিভাবে মেহেদীর দাগ লাগিয়েছো?”
ছোট্ট ফাইরোজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ক্রমশ ঠোঁট উল্টে যাচ্ছে ,এই বুঝি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদবে।

“তুমি বুকছো কেন আম্মা।”
দুহাত কোমড়ে চেপে দাঁড়ালো ফারাহ। সে নিজেই পারছে না হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে।
“বকবো না তো কি করব? তুমি কবার জামা নোংরা করো হ্যাঁ? কবার আমি সেগুলো চেঞ্জ করব? এত অবাধ্য হচ্ছ কেন?”
ঠোঁট উল্টে মেয়েটা কেঁদে ফেলল ,চোখ কচলাতে কচলাতে রুম থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলো রুবেনা শেখের রুমের দিকে। যেতে যেতে কার্পেটে পা আটকে ধুম করে পড়ে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।‌ সহসা ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এলো রুবেনা শেখ নূপুর এবং রিজুয়ান শেখ।
ফাইরোজ কে কোলে তুলে নিল নূপুর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আম্মু পড়লে কি করে?”
মেয়েটা অঝোরে কেঁদেই চলেছে।রুবেনা শেখ হাত পা টেনে দিচ্ছে কোথাও ব্যাথা পেয়েছে সেটা বুঝতে।
মেয়ের কান্না শুনে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এলো ফারাহ।
“কি হয়েছে?”
রুবেনা শেখ ধমকের সুরে বললেন।
“তুই কোথায় ছিলি ফারাহ? আমার বুবুনটা পড়ে গেল!”
দু’হাতে ফাইরোজ কে কোলে তুলে নিল ফারাহ। মিনমিনে গলায় বলল।
“ও তো তোমার কাছেই যাচ্ছিল আম্মু।”

ফাইরোজ কে ঘুম পাড়িয়ে শোয়াতে শোয়াতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে ফারাহর। মনটা বড্ড খারাপ তার। তাশফিন কাল আসবে বলেছিল, অবশেষে ছুটি পেয়েছে।‌ অথচ কাল পুরোটা দিন অপেক্ষা করেও লাভ হলো না। এলো না তাশফিন। কাল না হয় এলো না কিন্তু আজকে? আজকেও কেন এলো না সে?
মাঝে মধ্যে খুব কষ্ট হয় তাশফিন চলে যাওয়ার পর। মাসের পর মাস সে থাকে সমুদ্রে। সমুদ্র নামক সতিন কে দুচোখে স’হ্য হয় না তার।‌ কেন সে তাড়াতাড়ি ফিরে না? যখন তাশফিনের সাথে ফোনালাপ হয় তখন তাশফিন তার জেলাসি শুনে বলবে।

“উফ্ মিসেস শেখ আপনি বললে এখুনি সমুদ্র কে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসব!”
সেই কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ফারাহ , কিন্তু ফোনালাপ শেষ হতেই আবারো একাকীত্ব ঘিরে ধরে তাকে। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সেটার খেয়াল নেই ফারাহর।
ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে বারোটায় ছুঁই ছুঁই। কলিং বেল বাজাতেই উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন রুবেনা শেখ। মা কে সামনে দেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো তাশফিন।
“আম্মু কেমন আছো?”

কেঁদে ফেললেন রুবেনা শেখ ,বছরের অর্ধেকটা সময় ছেলেটা থাকে না বাড়িতে, কষ্টে বুকটা ফেটে যায় উনার।
“ইশ্ আবার কাঁদছো কেন? বাড়ির সবাই তো জেগে যাবে।”
তাশফিনের সতর্ক বার্তা শুনে চুপ করে গেলেন রুবেনা শেখ। সবাই কে সারপ্রাইজ দিতে কাল না এসে আজকে এসেছে তাশফিন। শুধু রুবেনা শেখ জানতেন কথাটা। বাকিদের সকালে জানাবেন বলে ঠিক করেছেন।
“এত গুলো দিন পর মনে পড়ছে সবার কথা?”
ওষ্ঠো বাঁকিয়ে হাসলো তাশফিন , মায়ের গালে আলতো করে গাল ছুঁইয়ে বলে।
“আমার আম্মাজান, আমার কাজটাই তো ওমন। তোমার ছেলে যে একজন সমুদ্রের সৈনিক।”

ঘড়ির কাঁটার একটানা টিকটিক শব্দ ছাড়া রুমটা নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। বাইরে গত রাতের বৃষ্টির ঠান্ডা এখনো বাতাসে লেগে আছে, ফ্যানকে নিভিয়ে দিয়েছিল ফারাহ।
আলগোছে দরজার কপাট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো তাশফিন শেখ। নিঃশব্দে থমকে দাঁড়াল সে, যেন এই দৃশ্যের সৌন্দর্য চোখে বেঁধে রাখতে চায় আজীবন। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে তার দুই সুখপাখি এক আকাশের নীড়ে বাঁধা ভালোবাসার সোনালি ডানা।
ছোট্ট আড়াই বছরের কন্যাটি এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, শিশুর ঘুমের নির্ভার শান্তি নিয়ে। তার নরম শরীরের উপর সুরক্ষার ছায়ার মতো হাত রেখেছে মা তাশফিনের প্রিয় বাচ্চা বউ। অচেতন নিদ্রায় ডুবে থাকা সে যেন এক স্বপ্নময় চিত্রকল্প, যার পরণের ওড়নাটা ছুটে গিয়ে বিছানা পেরিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে আছে অগোছালো পরম সুন্দর।
দৃশ্যটা দেখে পুরুষের বুকের ভেতর হঠাৎ আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়ল। এই দুই প্রাণ তার সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত সুখ, সমস্ত সত্তা।

পা টিপে টিপে ফাইরোজের কাছে গিয়ে বসলো তাশফিন ,হাসি হাসি চোখ করে তাকালো মেয়েটার দিকে। গ্রীবা চুম্বন এঁকে দিলো তার ললাটে। ফিসফিসিয়ে আদুরে গলায় ডাকলো।
“আমার মা উঠুন। মা উঠে পড়েন আম্মু।”
সদ্য কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে মোচড়াতে লাগলো ফাইরোজ। তাশফিন ফিসফিসিয়ে বললো।
“মা উঠুন ,দেখুন আব্বু এসে গেছি।”
বাবার কথা স্মরণে আসতেই আঁখি মেলে তাকাল ফাইরোজ।
“আব্বু।”

এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠেই জড়িয়ে ধরে তাশফিন কে। সৈনিক বাবা কে দেখে ছোট্ট মনটা নেচে উঠল তার। এখনো সফেদ রঙা পোশাক জড়িয়ে আছে তাশফিন।
“আব্বু,,, আব্বু।”
“চুপ চুপ চুপ। আম্মু জেগে যাবে মা আস্তে কথা বলুন।”
আলগোছে ফাইরোজ কে কোলে নিয়ে সোফায় চলে গেল তাশফিন। আদুরে মুখটায় অসংখ্য আদর বুলিয়ে দিলো।
“আব্বু ইতু দিলি কলছো কিনু?”

মেয়েটা ভাঙ্গা কন্ঠে বলা কথা গুলো শুনে মৃদু হাসলো তাশফিন। দ্বিতীয়বারের মতো ললাটে চুম্বন এঁকে বলল।
“আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে আসছি মা। আপনি আপনার আম্মু কে বলবেন না কিন্তু।”
আম্মুর কথা বলতেই ঠোঁট উল্টে নিল মেয়েটা। ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় তাশফিন।
“কি হলো আমার মা? মন খারাপ কেন?”
ফাইরোজ আহ্লাদি কন্ঠে নালিশ জানালো।
“আম্মু মালছে। বুকা দিচে অন্নেক।”
ফাইরোজের ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো তাশফিন।
“আপনি কি করছেন আমার মা?”
ফাইরোজ আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে।
“মিন্দি দিচি।”

ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো তাশফিনের সামনে তুলে ধরে ফাইরোজ। মেহেদী দিয়েছে সে , এখনো জামায় মেহেদী লেগে আছে। লেগে আছে বললে ভুল হবে লেপ্টে আছে রীতিমত। ছোট আঙ্গুল গুলোতে চুমু খেলো তাশফিন।
“আমার মা টা মেহেদী দিয়েছে।”
“চুন্দল।”
“হুঁ অনেক সুন্দর।”
ফাইরোজ ঠোঁট উল্টায়।
“আমমু বুকা দিচে।”
তাশফিন কড়া কন্ঠে বলল।
“সকালে আম্মুর বিচার করব আমি।”
ফাইরোজ দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে আবারো মেহেদী টা নিয়ে এলো।
“আববু আমমুলে মিন্দি দি।”

তাশফিন ফিসফিসিয়ে বললো।
“আব্বু তো ইউনিফর্ম পরে আছি আমার মা। আব্বু শাওয়ার নিয়ে আসি?”
ফাইরোজ শুনলো না তার কথা ,কচি হাতটা দিয়ে তার রুক্ষ খসখসে হাতটা টেনে ধরে।
“আচো।”
ফারাহ গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে। সুখের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো তাশফিন।
“আমার সুখ , মিসেস শেখ আপনি যে আমার কতটা আপন আদতেও কি জানেন? থ্যাংকস একটা সুখ পাখি উপহার দেওয়ার জন্য।”
আলতো করে ঝুঁকে কপালে চুমু খেলো তাশফিন। তার দেখাদেখি ফাইরোজ এগিয়ে গিয়ে ছোট ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিলো মায়ের কপালে। পরক্ষণেই বাবার কপালেও ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাবার মতো কাজটা করতে পেরে ভীষণ খুশি মেয়েটা।

ঘুমন্ত রমণীর পায়ের আঙ্গুলে মেহেদীর প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে প্রেমিক পুরুষ। পাশেই ছোট্ট বাবু টা বসে আছে তার। বাবার দেখাদেখি মায়ের পায়ে একটু একটু এলোমেলো মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে।
“আমমু চুন্দল,আমমু চুন্দল আববু।”
ফাইরোজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে ,তাশফিন থামিয়ে দিলো মেয়ে কে।
“চুপ আমার মা , আম্মু জেগে যাবেন তো।”
সহসা দু আঙ্গুল ঠোঁটে চেপে ধরে ফাইরোজ শেখ।
“সুপ সুপ সুপ।”
ওষ্ঠো বাঁকিয়ে হাসলো তাশফিন। অতঃপর ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না তার সুখ ,সুখপাখির বাবা এসেছে বাড়িতে।

স্নিগ্ধ সকাল ,সবে ঘুমটা হালকা হয়ে এসেছে ফারাহর। উঠতে গিয়েও উঠতে পারছে না। অনুভব করলো ভারী কিছু তার দেহের উপর বিচরণ করছে।
আকস্মিক স্পর্শকাতর জায়গায় রুক্ষ খসখসে হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে গেল মেয়েটা।‌
“কে কে?”
“আপনাকে বাজে ভাবে ছুঁয়ে মেয়ের আম্মু বানিয়ে দেওয়া অবাধ্য লেফটেন্যান্ট সাহেব বলছি।”
ব্যস এটুকুই যথেষ্ট ছিলো ফারাহর বক্ষঃস্থলে ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য।
“আপনি? কখন এসেছেন?”

তাশফিন প্রত্যুত্তরে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলো না। নিজের অস্তিত্বের মাঝে আরো একটি অস্তিত্ব অনুভব করে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো মেয়েটা। কেঁপে কেঁপে উঠছে শীর্ণ বদন খানি। তাশফিন বুঝি বউ বলতে পাগল? হয়তো সে আসলেই বউ বলতে পাগল।
নিজের আদর মাখা স্পর্শ গুলো তার সুখের মাঝে ফলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে।
ফারাহ হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় তার ক্লিন শেভ করা গালে।
“আপনি আমাকে সবসময় কেন ভুলে যান?”
“সব ভুলতে পারি কিন্তু আমার সুখপাখির আম্মু কে ভুলতে পারি না।”
টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আঁখি হতে। চক্ষুদ্বয় আবেশে বুঁজে নিল ফারাহ। তাশফিন উন্মাদ হয়ে উঠে ,সকাল শুরু করে প্রণয়ের অনুভূতিতে।

খাবার টেবিলে বসে বসে দুষ্টুমি করে চলেছে ফাইরোজ। সবে খাবার বেড়ে দিয়েছে নূপুর আর ফারাহ। তাশফিন শাওয়ার নিয়ে একদম পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে এলো।
ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই হৈচৈ শুরু করে দিলো ছোট ফাইরোজ।
“আববু কোলে নে।”
ফারাহ ধমক দিয়ে বলল।
“না এখন বাবা খাবে , তুমি আমার কোলে এসো।”
ফারাহ তাশফিনের দিকে তাকাতেই দেখে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে তাশফিন। শুকনো ঢোক গিলে ফারাহ। অবাধ্য লেফটেন্যান্ট তাকেই এখন ধমক দেয়।
তাশফিন এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। পাশের চেয়ার টেনে দিলো ফারাহ বসার জন্য।
ফারাহ মিনমিনে গলায় বলল।

“আপনারা খেয়ে নিন ,ফাইরোজ এটা ওটা করে জ্বালাতন করবে। এরচেয়ে আমি ওকে রাখি।”
তাশফিন গম্ভীর স্বরে বলল।
“বসতে বললাম।”
ফারাহ বিনা বাক্যব্যয়ে বসে পড়ল। সে জানে এই লোকটার সাথে কথায় কাজে কোনো কিছুতেই পেরে ওঠবে না।
রুবেনা শেখ খেতে খেতে বললেন।
“তুই শুধু শুধু আমার বুবুন কে কথা শুনাস ফারাহ। দেখ তো বুবুন কি সুন্দর বসে আছে।”
মাহির আর ফাইরোজ এক পাশে বসে আছে। ছোট বোন কে একটু একটু মুখে খাবার দিচ্ছে মাহির। সে এখন বুঝতে শিখেছে।
আকস্মিক হাত বাড়িয়ে তরকারির চামচ ধরতে গিয়ে উলটে ফেলে দিলো সেটা। সব তরকারি টেবিলের উপর ছড়িয়ে গেল।
ধুম করে একটা ধমক দিলো ফারাহ।

“বেয়াদব কোথাকার , দেখুন আম্মু কি বলছিলে তুমি। সব তরকারি ফেলে দিছে।”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ফাইরোজ। অসহায় মুখ করে তাকালেন রুবেনা শেখ। হাতটা ধুয়ে ফেলল তাশফিন। ফারাহ রিনরিনে গলায় বলল।
“আপনি খাবেন না?”
তাশফিন মৃদু স্বরে বলল।
“আগে আমার মা খেয়ে নিক।”
আলগোছে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল তাশফিন ,অপর হাতে তুলে নিল খাবারের প্লেট টা।
“বাগানে যাচ্ছি ,একটু পরে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।”
তাশফিন ধুমধাম পা ফেলে বাগানের দিকে এগুতে লাগলো।
ছোট্ট দোলনায় ফাইরোজ শেখ কে বসিয়ে দিলো তাশফিন। দোলনা দুলে চলেছে। ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমা তুলে দিলো তাশফিন।

“আমার মা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন,না হলে যে বড় হতে দেরী হয়ে যাবে আপনার।”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ফাইরোজ , ঠোঁট দুটো ফাঁকা করে বাবার হাতের প্রথম লোকমাটা মুখে তুলে নিল।
ফারাহ গ্লাস হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো,সে দেখছে এক ধৈর্যশীল বাবা যে কি-না নানা বাহানা দিয়ে মেয়েটাকে খাইয়ে চলেছে।
মাঝে মাঝে নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয় ফারাহর। তার সুখপাখির আব্বু যে সে।

সন্ধ্যা নেমেছে নির্বিঘ্নে। ডায়রি খুলে আজ লিখতে বসেছে ফারাহ।
❝প্রিয় লেফটেন্যান্ট সাহেব,
আজ আপনাকে নিয়েই লিখতে বসেছি। জানেন, আপনি আসলে কেমন মানুষ? আমার কাছে আপনি শুধু একজন দায়িত্ববান সৈনিকই নন, বরং আপনি এক মহৎ চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।
আপনি একজন দায়িত্ববান ছেলে যিনি বাবা মায়ের প্রতি মমতা আর শ্রদ্ধা নিয়ে বেঁচে থাকেন।
আপনি একজন দায়িত্ববান জামাই যিনি শ্বশুরবাড়ির মানুষদের আপন করে নেন নিজের মতো করে।
আপনি একজন দায়িত্ববান ভাই যিনি ভাইবোনদের পাশে থেকে তাদের আস্থার সবচেয়ে বড় ভরসা।
আপনি একজন দায়িত্ববান বন্ধু যিনি সুখ দুঃখের ভাগীদার হতে জানেন।
আর সবশেষে, আপনি একজন দায়িত্ববান স্বামী এবং এক কন্যার স্নেহময় বাবা যিনি প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিজের পরিবারকে আঁকড়ে রাখেন।

জীবনে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় রহস্য আপনি যেন খুব সহজেই আয়ত্ত করেছেন। ধৈর্য ধরে মানুষের কথা শোনার অভ্যাস, মন দিয়ে ভালোবাসার সঙ্গী হওয়া, প্রয়োজনের সময় পাশে দাঁড়ানো এই সব গুণই আপনাকে করে তুলেছে আলাদা। ভালোবাসা আপনার কাছে শুধু মিষ্টি কিছু শব্দ নয়, বরং এক গভীর দায়িত্ববোধ আর সেই দায়িত্বই আপনাকে মানুষের হৃদয়ে অটুট স্থান করে দিয়েছে। যদি কখনো ভালোবাসার মেপে দেখা যেতে তাহলে বোধহয় আপনার ভালোবাসা আমার ভালোবাসার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি।
আপনার সঙ্গে থাকা মানেই এক ধরনের নিশ্চিন্ত অনুভূতিযেন কোনো ঝড় এলেও পাশে কেউ আছে, যে রক্ষা করবে, ভরসা দেবে, সাহস জোগাবে।

আপনার মতো মানুষরা সমাজে বিরল, কারণ আপনার প্রতিটি ভূমিকা আপনি পালন করেন নিষ্ঠা আর ভালোবাসা দিয়ে। এজন্যই আজ আপনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কলম থেমে যেতে চায় না। এই মূহুর্তে আমি আপনাকে নিয়ে লিখে চলেছি আপনারই দেওয়া ডায়রিতে। জানি না কখনো জানতে পারবেন কিনা , কিন্তু আমি সত্যি খুব ভাগ্যবতী যে কি-না আপনার মতো পারফেক্ট একজন মানুষ পেয়েছি।
ভালোবাসি অবাধ্য লেফটেন্যান্ট সাহেব।
ইতি আপনার সুখপাখির মা
সুখ❞

ডায়রির পাতাটা বন্ধ করে উঠে দাড়ালো ফারাহ।
দরজা ঠেলে সুখপাখি কে বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে রুমে এলো তাশফিন। ফারাহ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানা ঠিক করে দিলো। বাবার উষ্ণ আদরে ঘুমিয়ে গেছে ফাইরোজ। আলগোছে তাকে বিছানায় শুয়ে দিলো তাশফিন। শেষবারের মতো কপালে চুমু খেলো।
বুকে হাত গুঁজে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে ফারাহ। মেয়েকে রেখে উঠে দাঁড়ালো তাশফিন। ফারাহ কে দেখে মুচকি হেসে ফেলল।
হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো নিজের কাছে। ফারাহ নির্দ্বিধায় পা উঁচু করে চুম্বন এঁকে দিলো তাশফিনের কপালে।

“আপনি এত ভালো কেন লেফটেন্যান্ট সাহেব?”
তাশফিন নির্লিপ্ত শান্ত কন্ঠে বলল।
“আমি সুখের স্বামী আর সুখপাখির বাবা বলে তাই।”
আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ফারাহ। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাশফিন কে।
“আমার আপনিটা কখনো ছেড়ে যাবেন না,সইতে পারব না।”
তাশফিন চোখে হাসে। ধীরে সুস্থে কান্না ভেজা মুখখানি তুলে নিল। ওষ্ঠোয় ওষ্ঠো ছুঁয়ে বলল।
“ভালোবাসি সুখ।”

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫৯

লজ্জায় কুঁকড়ে যায় মেয়েটা, কুন্ঠিত হয় শীর্ণ বদন। অতঃপর ভালোবাসায় সিক্ত হয় আরো একবার। প্রণয় পুরুষের সহিতে প্রণয় কন্যার মিলন মূহুর্তের সাক্ষী হয় গৌধূলির সন্ধ্যা।
❝হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিলাম,
তোমার স্পর্শে সোনালি সন্ধ্যা সাজিয়ে নিলাম।
ভালোবেসে বন্দি বানালাম,
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পেলাম ❞

সমাপ্ত