তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১১

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১১
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

শাইনা আর তাজদার বাড়ি ফিরেছে একেবারে ডিনার সেড়ে। বাড়ি ফেরামাত্রই রওশনআরা জেরা করলেন,”কোথায় গিয়েছ দুজন? বাইরে কি ঠান্ডা!”
শাইনা কি বলবে বুঝতে পারলো না। পেছন থেকে তাজদার বলল,”ওখান থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়েছি। ডিনার করে তারপর ফিরেছি।”
ব্যাপারটা খুব সহজেই সে সামলে নিল। শাইনা তার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। নিজেই ঝামেলা বাঁধিয়ে আবার নিজেই ঝামেলা সামলাতে তাজদার সিদ্দিকী ওস্তাদ একথা স্বীকার করতেই হয়। ঘরে এসে বোরকা পাল্টে সে সোজা শুয়ে পড়লো। এতটাই ক্লান্ত লাগছে যে আর কোনোদিকে তাকাতেই ইচ্ছে করছে না তার। তাজদার এসে তাকে বার কয়েক ডাকলো।

“হ্যালো! কোনো সমস্যা?”
শাইনা মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদের মতো শব্দ করলো হালকা। তাজদার বলল, “ওকে। তাহলে শুয়ে থাকুন।”
তার ফোনটা বাজছে। কল এসেছে। কল রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। শাইনার চোখে ঘুম নেমে এল। তিতলি এসে দেখলো সে ঘুম। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আজ তার মন ভালো নেই। কাল সকালে ভাইয়া চলে যাবে। বাড়িটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। সবাই এতদিন চেয়েছিল সে চলে যাক। ওখানেই সে ভালো থাকে। দেশে আসার পর থেকেই একেকটা ঝামেলা আর বিপদ। কিন্তু যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই সবার মন খারাপ হচ্ছে। যেদিন প্রথম দেশে এসেছিল সেদিন সে কি আনন্দ বাড়িজুড়ে। উৎসব লেগে গিয়েছিল। দিনগুলো কত দ্রুত চলে যায়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রওশনআরা আর আনোয়ারা বেগম বসে বসে পুঁটলি বাঁধছে একটার পর একটা। সবগুলো তাজদার সিদ্দিকীর সাথে যাবে। পুঁটলিগুলোতে হরেক রকমের শুকনো খাবার দাবার। শাইনাদের বাড়ি থেকেও অনেককিছু এসেছে।
রাত তখন দেড় বা দুইটা। হঠাৎ শাইনার ঘুম ভাঙল। গলা শুকিয়ে কাঠের মতো, শরীর ভার হয়ে আছে। একপাশে যেভাবে শুয়েছে, সেভাবেই একনাগাড়ে ঘুমানোর কারণে ঘাড়ে চোট ধরে গেছে। সে কোনোমতে উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে গলা ভিজিয়ে নিল, তারপর আবারও শুয়ে পড়ল।

তাজদার সিদ্দিকী ঘরে নেই। এমনিতেই রাত করে ঘুমোয়। শাইনা ততক্ষণে একগাদা ঘুম সেড়ে ফেলতে পারে। কুটকুট শব্দ করে জেগে জেগে কি করে শাইনা নিজেও বুঝতে পারেনা। মাঝেমধ্যে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সেটা খুব কমই হয়েছে। শাইনা সেইসব ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণ পর ঘরে কারো পায়ের শব্দ শুনতেই শাইনা বুঝলো তাজদার সিদ্দিকী এসেছে। সে বুঝতে পারলো কিন্তু চোখ খুললো না। এভাবে এভাবে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। তার ঘুমিয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আবার ঘুম ভাঙতেও বেশি সময় লাগে না। আগে ঘুমের মধ্যে কিছু টের না পেলেও ইদানীং আশেপাশে কি হচ্ছে তা মোটামুটি টের পায়। অর্থাৎ আগের মতো ঘুম হচ্ছে না। সামনে হয়তো ঘুম আরও উঠে যাবে। আপাদের দেখেছে এমনকি বড়ো ভাবিকেও দেখেছে বাচ্চার জন্য কতো রাত জাগতে হয়।
কানে টুকটাক শব্দ আসছে। পাশ ফিরতেই দেখলো তাজদার সিদ্দিকী এখনো বসা। এই লোক কি আজ ঘুমাবে না? শাইনা উঠে বসার চেষ্টা করলো। তাজদার তখনই তার দিকে তাকালো।

“ব্যাপার কি?”
শাইনা তার সামনে রাখা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ঘুমজড়ানো চোখে।
“এতগুলো ছবি কি করবেন?”
“এখানে অনেক আছে। কয়েকটা নিয়ে যাব। তারপর ফ্রেমে বাঁধিয়ে নেব।”
বলেই সে এক এক করে ছবি বাছাই করতে লাগলো। শাইনা শুয়ে শুয়ে তার কাজ দেখতে লাগলো। একটা ছবি হাতে নিতেই তাজদার বলল,”দেখি কোনটা?”
সে শাইনার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে ফেললো। দেখলো কক্সবাজারের সমুদ্রে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা। নুভা নয়তো আনিস তুলেছিল। ছবিটা সুন্দর। শাইনার শাড়ির আঁচল উড়ছে। তাজদার সিদ্দিকীর প্যান্ট গোঁড়ালির উপর গুটানো। শার্টটা বাতাসে গায়ের সঙ্গে আরও ঘেঁষে বসেছে।

“এটা নিই?”
শাইনা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,”এটা সুন্দর?”
“নয় বলছো?”
ভুল সময়ে তোলা ছবিটি। শাইনার মনে তখনকার বিশ্রী ঘটনাগুলো ঝলসে উঠছে বারবার। তাজদার সিদ্দিকীও আড়ালে দীর্ঘশ্বাসটা লুকিয়ে ফেললো। তবুও সে খেয়াল করল শাইনার মন খারাপ হয়ে গেছে। নরম কণ্ঠে বলল, “তোমার মন খারাপ হচ্ছে ওই সময়গুলোর কথা মনে করে?”
শাইনা দুপাশে মাথা নাড়লো।
“আমাদের জীবনে হয়তো হাজারটা ভালো সময় আসবে কিন্তু এই সময়গুলো নয়। তাই ওটাকে আফসোস বলা চলে। আফসোস হচ্ছে।”

তাজদার হাসলো। শাইনা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। হাসছে?
সে কিছু বললো না। তবে মনের মধ্যে উঁকি দিল কিছু প্রশ্ন। তাকে ওভাবে বিয়ে না করলে হতো না? একটু সময় দিতে পারতো না? বিয়েটা অন্যভাবেও তো করা যেত। তার নিজেরও অনেক ভুল হয়েছে। সে পালিয়ে না বেড়িয়ে বলতে পারতো তার সময় চায় কিছুদিন। তাজদার সিদ্দিকী নিশ্চয়ই অপেক্ষা করতো! কিন্তু সময় দিলেও কি তাজদার সিদ্দিকীর প্রতি কখনো মন বসতো? তাজদার সিদ্দিকী যা করেছে তা তো ভুলই। কি অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার! কেন এমন একটা মানুষের সাথেই জীবনটা জড়িয়ে পড়ে?

“কি ভাবছো এত? এত ভেবে লাভ নেই। ক্যালকুলেশন করে তুমি কিচ্ছু মিলাতে পারবে না।”
শাইনা তার দিকে তাকালো। কঠোরভাবে বলল,”আপনি শুয়ে পড়ুন।”
“তুমি টেনেটুনে শুইয়ে দিলেই তো পারো।”
শাইনা এবার হালকা হেসেই ফেললো।
“সবসময় ফাইজলামি!”
ঠোঁটের কোণা টেনে হাসলো তাজদার সিদ্দিকী।
“ফাইজলামি করার জন্য তাহলে তো আরেকটা বিয়ে করতে হবে।”
শাইনা তার কলার টেনে পাশে শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর ঝুঁকে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই থামেন। আগে একটামাত্র বউকে সামলান। তারপর ভেবে দেখবেন।”
তাজদার মাথার নিচে দুইহাত হাত ভাঁজ করে রেখে বলল,”তোমার কাছ থেকে অনেক কেয়ার পেয়েছি হাজবেন্ড হিসেবে। কিন্তু ওটা পাইনি।”

শাইনার চোয়াল ঝুলে পড়লো।
“বলে কি এই মিয়া! ওটা আবার কি?”
“লাভ লাভ।”
“অ্যাহ!”
“তুমি অস্বীকার করবে তুমি আমাকে কখনো পাগলের মতো ভালোবাসতে পারবে?”
শাইনা থতমত খেল। এক বাচ্চার বাপ হয়ে যাবে কিছুদিন পর। আবার খুঁজে পাগলের মতো ভালোবাসা!
তাকে চুপ থাকতে দেখে তাজদার বলল,”পারবে না। তুমি আমার স্ত্রী হয়ে উঠেছ। স্ত্রী দায়িত্ব পালনও করেছ ঠিকঠাক। হয়তো আমাকে কিছুটা চিনেছও। কিছুটা ক্ষমাটমাও করেছ। আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া চেয়েছ। এখনো চাও। এটাও চাও আমি লন্ডনে সুস্থভাবে ফিরে যাই।ওখানে গিয়ে ভালো থাকি। আমার কোনো বিপদ না হোক। এটা যেকোনো স্ত্রীই চাইবে। তুমি চাও। স্বাভাবিক।”

শাইনা একের পর এক অবাক হচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড়ও করছে হঠাৎ।
“আপনি বাড়তি কথা না বলে প্লিজ ঘুমান।”
বলেই তাজদারের মুখের উপর হাত চাপা দিল সে। তাজদার তার হাতটা নিজের ঘাড়ের পেছনে রাখলো। শাইনা তখন আরও কাছে এসে পড়েছে।
“এতদিন যা বলতে পারিনি। তা আজ বলতে দাও। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি যা হয়তো তোমার বৃদ্ধকালেও মনে পড়বে। পুরোপুরি ক্ষমা হয় কি হয় না আমি জানিনা। আমি যা মানুষ আমি হয়তো তোমার হাত পা ধরে ক্ষমা চাইবো এমনও না। আমি জানি তুমিও সেটা চাওনা। এখনো যখন তুমি রিমোটটা নিজ হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টাও তখন আমার নিজেরই ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে। তোমার হাতে খাওয়ার সময়ও ব্যাপারগুলো মনে পড়ে। তোমারও মনে পড়ে?”

শাইনা চুপ!
“আমি জানি পড়ে। তখন নিশ্চয়ই তোমার খুব ঘৃণা হয়। আমি জানি হয়। কিন্তু একটা কথা কি জানো? পৃথিবীর কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম আছে। আমরা সবসময় আমাদের বিপরীতধর্মী মানুষগুলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই। যেদিন আমি ডিসিশন নিলাম তোমাকেই বিয়ে করবো। সেদিন গোটা রাত আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি তুমি কেন আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে? আমি কোনো কারণ পাইনি। একটা কারণও না। এটাও ভেবেছি তোমাকে বিয়ে করতে না পারলে আমার আহামরি কোনো ক্ষতি হবে না। আমি তোমার প্রতি অবসেসড। কিন্তু তোমাকে না পেলে সাময়িকভাবে কষ্ট হবে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নিজেকে বোঝানোর পরও আমি নিজ সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারলাম না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটি আমি তোমাকে ভুলভাবে বিয়ে করেছি। কিন্তু এটাও মানতে কষ্ট হয় যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনাটা ভুলভাবে এসেছে আমার জীবনে।”
“আপনার কাল ফ্লাইট। আমরা কেন এসব কথা বলছি? কি দরকার এইসব নিয়ে কথা বলার?”

“দরকার আছে। তুমি আমাকে হাজারবার ভালোবাসা কিংবা ওই যেটা বলে, যা হয় দুজন মানুষের মধ্যে, যা হলে মানুষ একে অপরকে ছেড়ে বাঁচতে কষ্ট পায়, মরে যায় ওই ধরনের কিছু তুমি আমার জন্য এখনো অব্দি ফিল করো না। যেটা করো সেটা দায়িত্ববোধ, যত্ন, কর্তব্য। তুমি চেষ্টা করছো কিন্তু হচ্ছে না। পৃথিবীতে কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যা আমরা ইচ্ছে করলেই মনের উপর জোর খাটিয়েও পারিনা। একটা মানুষকে আমি ভালোবাসতে চাইছি। কিন্তু আমার মধ্যে আসছে দয়া, সহানুভূতি, দায়িত্ব। ভালোবাসাটা আসছে না। তখন কষ্টের পরিমাণটা অনেক বেশিই হয়। তখন অপরজন আমাকে ভালোবাসলেও সেটা আমরা নিতে পারিনা। তোমার ক্ষেত্রে ঠিক সেম।”
“আপনি এগজ্যাক্টলী কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছিনা।”

“সবকথার এক কথা তুমি চাইলেও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। আর আমিও তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে পারব না, কারণ তুমি সেটা চাও না। আমাদের এই সম্পর্কের জায়গায় ক্ষমা, অনুশোচনা, ভুল স্বীকার এসব বেমানান লাগছে খুব। আমরা সেইসব নিজেরাই নিতে পারছিনা। কিছু সম্পর্ক এমনই হয় যেখানে যুক্তির কোনো মূল্য থাকে না। তাই বলছি তুমি সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো না। তুমি ভুলে যেতে, ক্ষমা করতে এতটা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছ যে না নিজে আমাকে ভালোবাসতে পারছো, না আমি তোমাকে ভালোবাসছি এটা সাবলীলভাবে নিতে পারছো। তোমার মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে ঋণী হয়ে পড়ছো। তাই নিজের উপর জোর খাটাচ্ছ। এটা ভুল হচ্ছে। তোমাকে ভালোবাসতে হবে না।

শুধু আমাকে ভালোবাসতে দাও।”
শাইনা অবাক হয়ে গেল। এমন কথা সে কখনো শোনেনি। তাজদার সিদ্দিকী একথা বলছে?
“আমি আপনাকে কোনোদিন পাগলের মতো ভালো না বাসলে আপনার কষ্ট হবে না বলছেন?”
তাজদার সিদ্দিকীর স্পষ্ট জবাব,
“না হবে না। তুমি আমাকে এতটা ভালোবাসতে দাও যে যাতে তোমার নিজেরই কখনোই মনে না আসে তুমি আমাকে ভালোবাসো না।”
“যাকে পেটে নিয়ে ঘুরছি সে কি?”
“ওই যে বললাম একটা দায়বদ্ধতা। ওটাকে তুমি যখন ভালোবাসার ডেফিনেশনে রাখতে চাচ্ছ তখনই তোমার সব হিসেব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তুমি সব হিসেব করা ছেড়ে দাও। আমাকে তোমাকে ভালোবাসতে দাও। আমাকে জোর করে ভালোবাসা আর ক্ষমা করার চেষ্টা ছেড়ে দাও।
দেখবে তোমার মনের সব অসুখ রাতারাতি সেড়ে গেছে।”
বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

শাইনার মনে হলো এতদিনের এই তিক্ত সম্পর্ক, এই অদ্ভুত বিয়ে, পুরোনো ঘৃণা আর না-বলা কথার সব হিসেব আজ মিলে গেছে। তার চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু তাজদার সিদ্দিকীর গালে এসে পড়ল।
তাজদার সিদ্দিকী হার মেনে, নিজের পরাজয় ঘোষণা করেও অদ্ভুতভাবে জিতে গেল। এতকিছুর পরও শাইনা মমতাজ ভালোবাসতে অক্ষম এটা প্রমাণ করেই সে শেষ পর্যন্ত জিতে গেল।
পরদিন সকালে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য রওনা দেওয়ার জন্য তাজদার সিদ্দিকী প্রস্তুত হয়ে বাড়ির উঠোনে বের হয়ে এল। উঠোন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পুরো বাড়ির মানুষ। তাজদার সিদ্দিকী একে একে সবার সাথে কথাবার্তা বলে এল। শাহিদা বেগম আর আফসার সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো শাইনার ব্যাপারে। ঘনঘন শাইনাকে দেখতে যেতে বললো।

তারপর আবারও বাড়িতে এল। রওশনআরাকে এসে জড়িয়ে ধরলো। ছেলে জড়িয়ে ধরামাত্রই রওশনআরা কান্নায় ভেঙে পড়লেন একবাড়ি লোকের সামনে। উনার কান্না দেখে বাকিদের চোখও ভিজে উঠলো। একে দাদীমা বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বলল,”শাইনাকে..
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,”ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
রওশনআরা বললেন,” ওকে দেখে রাখার মানুষের অভাব হবে না তাজ। আমরা তো আছি।”
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বললেন,”সবাই আছে ওর জন্য। কোনো চিন্তা নেই। সবাই দেখে রাখবে ওকে। ও কোথায়?”
ঝিমলি বলল,”কি যেন আনতে গিয়েছিল ঘরে।”
তাজদার নিজেই ঘরে চলে গেল।

শাইনা ড্রয়ার থেকে তার ঘড়িটা বের করে নিল। এটা সে শাওনকে দিয়ে কিনে আনিয়েছিল ওই এক্সিডেন্টের পরে। লজ্জা লাগছিল। ঘটা করে দিতে পারেনি। আজ লজ্জা ভেঙে দিয়ে দেবে ভেবে ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখুনি তাজদার সিদ্দিকী ল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অপ্রস্তুত শাইনা ভারসাম্য রাখতে না পেরে পিছিয়ে গেল দু’পা, কিন্তু হাত ছাড়াতে পারল না। বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
তাজদার সিদ্দিকী তার দুই গালে অবিরাম চুমু খেয়ে বুকের ভেতর চাপা দীর্ঘশ্বাস গিলে বলল,
“চলে যাচ্ছি।”

শাইনার থুতনি স্থির হয়ে রইল তার কাঁধে।
চোখদুটো জ্বলছে। মনে হচ্ছে কেউ মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে চোখদুটোতে।
সে তাজদারের হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিল। বলল,
“সরি এতদিন লজ্জায় দিতে পারিনি। আমাকে কতকিছু দিয়েছেন তার বদলে আমি…
তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। তাজদার বলল,”খুশি হয়েছি। জুনিয়রের যত্ন নিও। যাই। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
তাজদার দরজার কাছে গিয়ে আবারও থামলো। ফোন বের করে ক্যামেরা অন বের করে বলল,”দাঁড়াও। এটা মেমোরেবল। হাসো।”

শাইনা অল্প করে হাসার চেষ্টা করলো। তাজদার কয়েকটা ছবি নিল। তারপর তার গালটা টেনে দিয়ে ফোনটা পকেটে ভরতে ভরতে বেরিয়ে গেল। তাদের গাড়িগুলো উঠোন ছেড়ে মিলিয়ে যেতেই শাইনা সবার পেছন থেকে সরে ধীরেধীরে হেঁটে ঘরে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানায় তাজদার সিদ্দিকী পরা কাপড়চোপড়। বাড়িতে পরা জুতোগুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১০

সারাঘর এলোমেলো হয়ে আছে। শাইনা ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে মেঝেতে বসে গেল। প্রায়সময় সে মেঝেতে শুয়ে থাকে এভাবে ঘরের আলো নিভিয়ে। এভাবে শুয়ে থাকতে কেন যেন ভালো লাগে। অনেকবার এমন হয়েছে সে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাজদার সিদ্দিকী এসে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়েছে। আজ শুয়ে পড়লো না। তবে বসে রইলো। গা দুলছে আস্তে আস্তে। কান্নায় ভিজে উঠলো গাল, চোখ, বুক। নিজের ভেতরের সব কথাগুলো অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ঠোঁট কাঁপছে, বুকের ভেতরটা কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে সবসময় একাই মনে হয়েছে তার। তাহলে আজ আবার নতুন করে নিজেকে একা আবিষ্কারের কারণ কি?

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here