তাজমহল পর্ব ২
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
“তোর আক্কেল জ্ঞান হবে কবে? তুই দেখছিস গাড়ি এসে থেমেছে। তুই ঘরে চলে আসবি না? ফেরিওয়ালার সামনে তর্ক করছিলি চুল নিয়ে। লজ্জা শরম নেই তোর? আমার যখন বিয়ে ঠিক হয়ছে তখন আমি মানুষের সামনেই যেতাম না লজ্জায়। আর তুই যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ছে তার সামনে দাঁড়িয়ে ফেরিওয়ালার সামনে তর্ক করছিস? ওরা এখন কি মনে করবে? ছেলেটা তোর দিকে কেমন করে তাকিয়েছে তুই দেখেছিস? মনে মনে হয়তো ভাবছিল কোন ফকিন্নিকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আল্লাহ জানে।”
মা শাহিদা বেগম মুরগীকে খাওয়াতে খাওয়াতে বকবক করছেন। দাদীমা মায়ের কথা শুনে হেসে বললেন,”তোমার মেয়ে এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকেনি। তারে দেখার জন্য দাঁড়িয়েছিল। কতদিন পর দেখলো।”
শাইনা ব্যঙ্গ করে বলল,
“কতদিন পর দেখলো! তোমরা এসব ভাবো কি করে? তোমরা যে আমাকে বিয়ে দিচ্ছ আমি রাজি আছি কিনা জিজ্ঞেস করেছ একবারও?”
মা মুরগীর খাবারের বাটিটা ধপ করে রেখে চলে গেল। যেন কথাটা কানে তোলার মতোই নয়।
দাদীমা হাসতে হাসতে মোড়া ছেড়ে দাঁড়ালেন। বয়স হয়েছে উনার। তবুও তিনি কর্মঠ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাকে অনেক কাজে সাহায্য করেন। উনার এতগুলো ছেলের বউ থাকতেও উনি বড় বউয়ের কাছে থাকার জন্য পাগল। অবশ্য বউ শ্বাশুড়ির মধ্যে দিনের ভেতর হাজার বার ঝগড়া হয়। আবার মিটমাট হতেও বেশিক্ষণ সময় লাগেনা। তিনি দাঁত খেলিয়ে হেসে শাইনাকে বললেন,
“তোরে ইঞ্জিনিয়ার সাব কিছু কিনে দেইনাই?”
শাইনা আকাশ থেকে পড়লো।
“পাগল নাকি?”
“পাগলের কি আছে? বউকে জিনিস কিনে দেবেনা তো কাকে দেবে?”
শাইনা রাগত স্বরে বলল,”ফালতু কথা বলবে না। বিয়েতে আমি মত দিয়েছি? তোমরা আমাকে যার তার সাথে বিয়ে দেবে আর আমি ধেইধেই করে বিয়ে করে নেব নাকি? মানুষ অমানুষ দেখবেনা। টাকা দেখলেই সবকটা পাগল হয়ে যাবে। শোনো আমি পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করব। তারপর বিয়ে। তোমার ফুতের বউকে থামতে বলো। কয়েকদিন পরপর তোমাদের এসব নাটক আমার ভালো লাগেনা।”
দাদীমা হাসতে লাগলেন।
“তোর দুই বোনকে টাকা দেখে বিয়ে দিছি?”
“না ভালো মানুষ দেখেই দিয়েছ। আমার বেলায় ভালো মানুষ চোখে পড়ছেনা? আমাকে জাহান্নামে ঠেলে দেয়ার ধান্ধা সবার।”
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,”আস্তে কথা বল। মানুষে শুনবে। বৃষ্টি থামছে। ভেজা কাপড়গুলো বের করে দে রশিতে। আর আজ তুই আর সামনের উঠোনে বের হবিনা। যদি বের হোস তোর ঠ্যাং কেটে রেখে দেব আমি।”
“বৃষ্টি আবার শুরু হবে কিছুক্ষণ পর। কাপড় একবার বের করো। আরেকবার তোলো। কাপড় নিয়ে এত ডিউটি করতে পারব না।”
মা কোমরে একহাত চেপে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো। দাদীমাকে বলল,
“এই মেয়ে কি ত্যাড়ামো শুরু করছেন দেখছেন আম্মা?”
“তোমার মেয়ে তোমার মতোই হয়ছে।”
মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,”দেখলি? দোষ করবি তোরা। আর তোর জাতগুষ্ঠি কথা শোনায় আমাকে।”
দাদীমার কপাল কুঁচকে গেল।
“তুমি ভালো কথাকেও ঝগড়ার দিকে টেনে নিয়ে যাও কেন?”
মা ভেতরে চলে গেলেন। শাইনা দাদীমাকে বলল,
“যাও ভেতরে গিয়ে জোরসে একটা ঝামেলা লাগাও। তোমাদের বউ শ্বাশুড়ির কাজই তো সেটা।”
বলেই সে পুকুরঘাটে নেমে পা’টা ধুয়ে নিতে লাগলো। ঘাট থেকে উঠতেই চাচাতো ভাই বোনরা তাকে ঘিরে ধরলো। সবার হাতে চকোলেট। শাইনা বলল,”কার পকেট মারা হয়েছে?”
মেঝ চাচার মেয়ে সানজু বলল,”দুলাভাই দিয়েছে।”
শাইনা ভাবলো বড় আপারা আসছে। সে খুশি হয়ে জানতে চাইল,”দুলাভাই আসছে?”
“তোমার দুলাভাই না। আমাদের দুলাভাই।”
শাইনা কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো চুপচাপ। দুদিন আগে তাদের বাড়ির পেছনে গাছ কাটা হয়েছিল। সেখান থেকে ফুলগাছের একটা লাকড়ি নিতেই সবাই ভোঁ দৌড়। ছোট চাচার ছেলে ইবরান বেশিদূর যেতে পারলো না। তার বয়স চার হবে। শাইনা তাকে ধরে তার হাত থেকে অর্ধেক চকলেট মুখে নিয়ে নিল।
সাথে সাথে সে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তার কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে এল। শাইনা ততক্ষণে লাপাত্তা। মুখ থেকে চকলেটটুকু থুহ করে ফেলে দিল মাটিতে, চকোলেট কে এনেছে সেটা মনে পড়ার পর। বড় ভাবি এসে বলল,
“শাইনা তোমার জন্য ওই বাড়ি থেকে চকলেট পাঠিয়েছে। লন্ডন থেকে এসেছে। ফেলে দিওনা আবার।”
শাইনা চুপ করে রইলো। বড় আপা আর মেঝ আপার ছেলেমেয়ে আসুক। ওদের দিয়ে দেবে সব।
বড় ভাবির কোলে দেড় বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। ওটা শাইনার কলিজা।
ভাবি শহুরে মেয়ে। সবাই প্রথম প্রথম শহর থেকে বউ এনেছে। ওই মেয়ে এত বড় পরিবারে মানিয়ে নিতে পারবেনা। আলাদা হয়ে যাবে কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। মা ভাইয়াকে আলাদা থাকতে বললেও ভাবি রাজী হয়নি। অবশ্য মেঝ ভাইয়া বিয়ে করলে মা আলাদা করেই দেবে। বাড়িটা ওভাবেই তুলেছে বাবা। যাতে তিন বউ একসাথে না থাকতে চাইলে আলাদা রান্নাবান্না করে খেতে পারে।
বিকেলে বড় আপা আর মেঝ আপা এল। শাইনা ছয় ভাইবোন সবার ছোট। তার তিন ভাই বড়।
তারপর বড় আপা আর মেঝ আপা জমজ। বড় আপার জন্মের আধঘন্টার মাথায় জন্ম নিয়েছিল মেঝ আপা। তাদের দুই বছর পর শাইনার জন্ম। বয়স এখন একুশ চলছে।
আপাদের আঠারো উনিশ বছর বয়সে বিয়ে হ’য়ে গেছে। শাইনাকেও মা বিয়ে দিয়ে দিত কিন্তু ভাইয়ারা রাজী ছিল না। মেঝ ভাইয়া বলল, ও সবার ছোট। পড়াশোনা করতে চাইলে করুক। ভালো পাত্র পেলে পরে বিয়ে দিয়ে দেব। যদিও শাইনার ইচ্ছে ছিল সে পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করবে। কিন্তু মায়ের বিশ্বাস ভাইরা বিয়ে করে নিলে, তাদের সংসার হয়ে গেলে বোনদের আর দেখার সময় নেই। তাই তিনি চান ছোট দুই ছেলে বিয়ে করার আগেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হতে।
বড় আপা আর মেঝ আপা এলে শাইনার খুব আনন্দ হয়। কিন্তু এবার হচ্ছে না। সবাই এসেছে তার বিয়ের কথাবার্তা বলতে। তাদের কথা শুনে শাইনার মন আরও খারাপ হয়ে গেল।
বড় দুলাভাই একদম মাটির মানুষ। আম্মা যা দেবে তাই খাবে। লবণ মরিচ দিয়ে পাটিতে বসিয়ে খেতে দিলেও কোনো অভিযোগ করবে না। খুব শান্ত গোছের ভদ্রলোক। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। আপার শ্বশুরের গাড়ি গ্যারেজ আর কাপড়ের দোকান ছিল। দুলাভাই এখন সেইসব সামলায়। আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল। আপাকে সুখী রেখেছে।
মেঝ আপার স্বামীও ভালো। পেশায় একজন ব্যাংকার। উনার মতো এত মিশুক, হাসিখুশি মানুষ আর দুটো হয় না। অবশ্য আপা আর দুলাভাইয়ের বিয়েটা যখন হয়েছে তখন দুলাভাই একটা সু ফ্যাক্টরীতে চাকরি করতো। ওদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আব্বা প্রেমট্রেম বোঝেন না। ছেলের মা বাবাকে ডেকে এনে আপাকে তুলে দিয়েছেন কিছু লোকজন খাইয়ে। আপার সংসারটা আব্বাই গুছিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে। এখন দুলাভাই যথেষ্ট ভালো পদে চাকরি করে। মাইনেটা বেশ ভালোই পায়। আপা বিলাসিতা করতে পারে।
সবাই মিলে রান্নাঘরে বসে কথাবার্তা বলছিল। রান্নাঘরটা বড়সড় আছে বেশ। সবাই মোড়া, পিঁড়ি, চেয়ার, মাদুর যা পেরেছে সব নিয়ে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। শাইনা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবার কথা শুনতে লাগলো। শাইনার অবাক লাগলো এই ভেবে আপারা ভুলে গেছে ওই বাড়ির ছেলে তাদের কত হেয় করে বেড়াতো। তাদের কত ছোট করতো। কত অপমান করতো। আজ তাদের সব হয়েছে। কিন্তু ওই ছেলে তাদের ভিখারির মতো দূরছাই করতো। এমনকি তাদের দেখলেই গলা পরিষ্কার করে থুতু ফেলতো শব্দ করে।
শাইনার গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে রইলো। ভাবি তাকে দেখামাত্রই বলল,
“ভেতরে আসো।”
বড় দুলাভাই বলল,”কিরে শানু ভেতরে আয়। তুই তো একটা সালাম দিয়ে কোথায় পালিয়ে গেলি। তোর জন্য সন্দেশ এনেছি। আয়।”
মেঝ আপা বলল,”আয় বোস এখানে।”
শাইনা বলল,”আমার গোসলের সময় হয়ে গেছে।”
বড় আপা বলল,”বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে শুনে তুই তো দেখছি অনেক শুকিয়ে গিয়েছিস।”
মা তার দিকে তাকালো। আবার চোখ সরিয়ে নিল। শাইনার বড় দুঃখ হলো। তার চোখমুখ দেখে কেউ কি বুঝতে পারেনা তার কতটা কষ্ট হচ্ছে? দরকার পড়লে একটা রিকশাচালকের সাথে তার বিয়ে দিক, দিনে এনে দিনে খাবে তবুও ওই ছেলেটা নয়। ওই ছেলেকে সে কত ঘৃণা করে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। এত ঘৃণা নিয়ে সে কিভাবে সুখী হওয়ার ভান করবে?
আব্বু এল বাজার থেকে। থলে ভর্তি বাজার করতে পারলে আব্বুর আনন্দের শেষ নেই। মেয়েরা আসবে শুনে বাজার করতে গিয়েছিল দশটা নাগাদ। আপা আর দুলাভাইরা এসে আব্বুকে সালাম করলো। আব্বু মেয়ে আর মেয়ের জামাইদেরকে দেখে খুশিতে কথা হারিয়ে ফেলেছে। আপাদের পেয়ে আব্বু গল্পগুজবে মজে গেল। দাদীমা হঠাৎ করে বলল,
“ওই দেখ বড় দুটোকে নিয়ে গল্পে মজে আছিস দেখে ছোটটা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
আফসার সাহেব শাইনার দিকে তাকালো। সাথে সাথে সে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। আব্বু সশব্দে হাসছেন এটা বলে,
“মেয়েটার এত রাগ!”
শাইনা ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইলো। বড় আপা এল কিছুক্ষণ পর। তারও কোলেও একটা দুধের বাচ্চা। আপার দ্বিতীয় সন্তান।
শাইনা বড় আপাকে দেখে চোখদুটো ওড়না দিয়ে চেপে মুছে নিয়ে বিছানায় শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। আপা বাচ্চাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বাবু বুকের দুধ খাচ্ছে। শাইনা ফ্যানটা ছেড়ে দিল। আপা তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাইনা আলনা থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাবে ঠিক তখুনি আপা বলল,
“তুই নাকি গাইগুই করছিস বিয়ে নিয়ে?”
শাইনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বড় বোনের প্রশ্নে হয়তো একটু প্রশয় পেয়েছে। বলতে লাগলো,
“জেনেশুনে আগুন ফেলে দিচ্ছ তোমরা আমাকে। তোমরা রাজী না হলে কথাবার্তা এতদূর এগোতো না।”
বড় আপা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বড়আম্মা তোকে চেয়ে বসেছে। আম্মা না করবে কিভাবে?”
“বড় আম্মা কি সারাজীবন বেঁচে থাকবে? আমি সংসার বড় আম্মার সাথে করবো? তোমরা জানো না ওই লোকটার খাসিয়ত কেমন? মানুষকে দুই পয়সার মূল্য দেয় না। নিজেকে একটা কিছু মনে করে। ছোটবেলায় আমাদের সাথে কত কি করেছে সবাই ভুলে গিয়েছ? বড় ভাইয়ার গায়ে হাত তুলতে চেয়েছে, মেঝ ভাইয়াকে মেরেছে, মসজিদ থেকে ফেরার সময় সেঝ ভাইয়াকে ধাক্কা মেরে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছিল। চাচ্চুর দিকে তেড়ে এসেছিল লাকড়ি নিয়ে। আমরা কেন তার বাড়ির মানুষই তো তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে যায়। বড় আম্মার সাথেও তো ওই ছেলে ভালো করে কথাবার্তা বলেনা। মা ছেলের সম্পর্ক ওরকম হয়?
সেই ছেলের সাথে তোমরা আমার বিয়ে কি করে ঠিক করলে?”
বলতে বলতে শাইনার গলার আওয়াজ বড় হয়ে গেছে। তার গলার আওয়াজ শুনে মেঝ আপা এসে গেছে ঘরে। মেঝ আপার পেছনে আম্মা এসে দাঁড়িয়েছে। একহাত কোমরে রেখে কপাল কুঁচকে তার কথা শুনে যাচ্ছিল। কথা বলা শেষ হতেই শাইনা মাকে দেখলো। বলল,
“ওই দেখো কেমন করে তাকাচ্ছে। আমি কিছু বলতেই পারিনা। এভাবে তাকাবে তারপর আমাকে চুপ করিয়ে দেবে। আমি সবার ছোট তাই সবাই যা বলবে তাই সঠিক শুধু আমি ভুল।”
মা মেঝ আপাকে ডিঙিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলল,”ওই প্রস্তাব আমি দিছি? তোর বাপ দিছে? ওরা দিছে প্রস্তাব। তোর বড় আম্মা আর বড় আব্বা দিছে। আমি মানুষগুলোর মুখের উপর না বলব কেমনে? তোর সাহস থাকলে তুই গিয়ে বলে আয়।”
মেঝ আপা বলল,”আম্মা শান্তভাবে কথা বলো। তোমার ছোট মেয়ে না? ও ভয় পাচ্ছে এটা স্বাভাবিক। ওর কথায় তো ভুল নেই। শানু কাঁদিস না। আমরা কথাবার্তা বলতেই এসেছি।”
শাইনা ঝাড়ি মেরে বলল,”বিয়ে ভাঙার জন্য তো আসোনাই? আরও পাকাপোক্তভাবে কথা বলার জন্য আসছো সবাই। কে আসতে বলছে তোমাদের? আমাকে নিয়ে তোমাদের এত মাথা ঘামাতে কে বলছে? দিনে এনে দিনে খায় এরকম কারো সাথে বিয়ে দাও দরকার পড়লে। তবুও আমি ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবো না। দরকার পড়লে বিয়ে না করে বুড়ি হবো। তবুও করবো না। বোঝা হয়ে গেলে বের করে দাও বাড়ি থেকে। গার্মেন্টসে চাকরি করে খাব।”
আম্মা এসে গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল। শাইনা ফুঁপিয়ে উঠলো। মেঝ আপাকে আম্মাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শাইনা বড় আপার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। তারপর তার টেবিলের উপর রাখা চকোলেটগুলো ফেলে দিল ছুঁড়ে। আপা বলল,
“শান্ত হ। এভাবে রাগ দেখালে কিছু সমাধান হবে না।”
আম্মা এল কানের পাশে ওড়না গুঁজতে গুঁজতে। বলল,
“আমি কি জানিনা ওই ছেলে কেমন? আমি তো সব জানি। কিন্তু এখন মানা কেমন করতাম? মানা করলে কি করবে জানিস? জানিস?”
শাইনা প্রশ্ন করলো,”কি করবে? মেরে ফেলবে আমাকে?”
মা তার মাথায় হাতের ঢুসা মেরে বলল,
“তাবিজ করে বিয়ে আটকে রাখবে। জীবনেও আর তোর বিয়ে হতে দেবেনা। বিয়ে হলেও তাবিজ করে মেরে ফেলবে। এভাবে চাইলে দিয়ে দিতে হয় বুঝেছিস? দুনিয়াদারির হিসাব বুঝিস তুই? দুনিয়ায় আমি আগে আসছি নাকি তুই?”
শাইনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। জেনেশুনে ওরকম একটা ছেলের হাতে তাকে তুলে দিচ্ছে এটা জেনেও যে তারা তাবিজ করার মতো লোক?
“তাবিজ করবে?’
“হ্যাঁ করবে। এখন যদি বলি মেয়ে দেব না তোমাদের ছেলেকে। তাহলে তাবিজ করবে। তোর বাপ চাচার সাথে নানান ঝামেলা বাঁধবে। কবরস্থানের জমি নিয়ে এমনিতেই হাজারটা ঝামেলা চলতেছে তোর বাপ ভাইয়ের সাথে। আবার এখন যদি আমরা বেঁকে বসি ওরা তোর বাপ ভাইকে কুপিয়ে মারবে। তুই আমার ছেলেগুলোকে মেরে ফেলতে চাস?”
শাইনা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বড় আপা বলল,
“আম্মা ওকে এসব বলো না। তুমি এমনিতেই একটু ভীতু। তাবিজ করা এত সহজ না। যাও এখন এখান থেকে। শানু তুই গোসল করে নে।”
শাইনা সাহস সঞ্চয় করে বলল,”এই বিয়ে যদি করতে হয় তাহলে আমি গলায় ফাঁস দেব।”
বলেই মাকে কিছু বলতে না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো সে।
দুপুরে খাবার টেবিলে দুলাভাই আর ভাইদের সাথে খেতে বসে গেল শাইনা। খেতে খেতে বড় দুলাভাই বললেন,”আমরা চা আর ভাতের দাওয়াত পেয়েছি আশরাফ।”
বড় ভাইয়া চোখ তুলে তাকালো। জানতে চাইল,”কোথায়?”
মেঝ দুলাভাই বললেন,”আপনাদের নতুন কুটুম বাড়িতে।”
বড় ভাইয়া আলতো হাসলেন। মেঝ ভাইয়া গম্ভীরমুখে তাকালো শাইনার দিকে।
“কি রে তুই শুকনো ভাত খাচ্ছিস কেন?”
“তোমার বোন অন্য চিন্তায় ডুবে গেছে আনিস।”
বড় দুলাভাইয়ের দিকে চট করে তাকালো শাইনা। দুলাভাই হেসে উঠে বললেন,”আচ্ছা খা তুই। আমি আর কিছু বলছিনা।”
বাবা দুলাভাইদের উদ্দেশ্যে বললেন,”জামিল, ইমতিয়াজ শোনো তোমরা। আমার ছোট মেয়ের বিয়ে আমি অনেক বড় করে দেব। গোটা এলাকাবাসী দেখবে। তোমাদের যাকে যাকে বলার দরকার বলে দিও।”
ভাইয়ারা আছে তাই শাইনা কিছু বললো না। শাইনার ছোট ভাই শাওন বলল,”ওরা কাবিন কতটুকু দিচ্ছে?”
আফসার সাহেব বললেন,”আমি পনের লাখ বলেছি। এর কম হবে না। একহাজার বৈরাতী, চার পদ ফার্নিচার। ওরা ফার্নিচার চায়নি। আমার মেয়ে ওদের পালঙ্কে ঘুমাবে কেন? আমি যখন অভাবগ্রস্থ ছিলাম তখনও দুই মেয়েকে ফার্নিচার দিয়েছি। তাই বলেছি ফার্নিচারও দেব।”
আনিস বলল,”ওরা যখন বলছে ফার্নিচার নেবেনা তখন তোমাকে ফার্নিচার দিতে হবে কেন? ওদের কি টাকাপয়সার অভাব যে বউকে ফার্নিচার দিতে পারছেনা?”
বড় আপা বলে উঠলো,”আরেহ না সব আছে। আমি বড় আম্মার সাথে দেখা করতে গেলাম না? তখন বড় আম্মা আমাকে শাইনার রুমটা দেখালো। ওখানে ফার্নিচার দিয়ে ঠাঁসা। আব্বু শুধু শুধু বাড়াবাড়ি করতেছে। ফার্নিচার না দিলেও চলবে। এটা যখন আমাদের শেষ বিয়ে, তখন আত্মীয় স্বজনকে ভালো করে খাইয়ে দাও ফার্নিচারের টাকাটা দিয়ে।”
আফসার সাহেব বললেন,”পরে ওরা যদি আমার মেয়েকে খোঁচা দেয়? না থাক। না চাইলেও দেব।”
আনিস সোজা কথাবার্তার মানুষ। কাঠকাঠ গলায় বলল,
“তোমাদের মতো মানুষের জন্য অন্যদের বাধ্য হয়ে এসব দিতে হয় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। যখন ওরা বলছে কিচ্ছু লাগবেনা তখন তোমাকে দিতে হবে কেন জোর করে?”
“না দিতে বলছিস?”
শাওন বলল,”হ্যাঁ দিওনা। ওই টাকা আমাকে দিয়ে দাও। বাইক কিনবো।”
বড় ভাইয়া ধমকে উঠলো,”তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে বাইক দিলে?”
আনিস বলল,”ওর কথা কানে নেওয়ার দরকার নেই। জরুরি কথার সময় ফালতু কথা বলবি না শাওন।”
শাওন অবাক হয়ে বলল,”আমি তো দেখছি কোনো কথাই বলতে পারব না।”
“না পারবি না।”
দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি লেগে গেল। বড় ভাইয়া ধমকে উঠলেন,
“তোদের সমস্যা কি?”
আনিস চুপচাপ খেতে লাগলো। ওদের কথাবার্তার মাঝে শাইনা ভাতটুকুই ভালো করে খেতে পারলো না।
বিকেলে ওই বাড়িতে চায়ের দাওয়াত পেয়েছে আপা আর দুলাভাইরা। শাইনাদের বাড়িটার পর তার মেঝ চাচার বাড়িটা। তার পাশে সাদা রঙের যেই চার তলা বড় বাড়িটা তার নাম কলতান নিবাস।
কিছুক্ষণ আগে বড় ভাইয়া আর আব্বাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন তাজউদ্দীন সিদ্দিকী।
শাইনা দাদীর পাশে জায়নামাজে বসা ছিল। আছরের নামাজ আদায় করছিল। মেঝ আপা আসামাত্রই দাদীমা জিজ্ঞেস করলো,”কি কথাবার্তা হচ্ছে রে?”
মেঝ আপা বলল,”ওরা শানুকে মনে হয় নিশান দেওয়ার কথা বলতেছে।”
“কখন?”
“কাল।”
শাইনা জায়নামাজ থেকে উঠে গেল। মাথার হিজাব খুলতে খুলতে রান্নাঘরে গিয়ে শাহিদা বেগমকে বলল,
“আম্মু আব্বুকে বলো আমি বিয়েটা করতে পারব না। আমি কোনো নিশান নেব না।”
শাহিদা বেগম গরুর মাংসে মশলা মাখাচ্ছে সরিষার তেল দিয়ে। মাটির চুলায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। গ্যাসের চুলায় হালকা পাতলা রান্না হলেও বড় পাতিলের রান্নাবান্না আম্মা মাটির চুলায় করে। ভাতের মাড় টগবগ করছে ভাতের ডেগচিতে। আম্মা তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো।
“তোর বাপকে গিয়ে বল। আমাকে বলছিস কেন?”
শাইনা মায়ের পাশে পিঁড়িতে বসে পড়লো। মিনমিন করে বলতে লাগলো সে বিয়েটা করবে না। এই বিয়েতে সে সুখী হবে না। মা চুপচাপ কাজ করছেন। বড় আপা আর মেঝ আপা কাটাকুটির ধোঁয়া বাছার কাজ করে দিয়েছে। আপারা এলে শাইনাকে কাজ করতে হয় না। শাহিদা বেগম চুপচাপ কাজ করতে লাগলেন। কোনো জবাব দিলেন না।
শাইনা একটা সময় মায়ের হাত ধরে ফেললো।
“আম্মু আব্বুকে একটু বলো। আমি ওই লোকটাকে পছন্দ করিনা। আমার ঘেন্না লাগে।”
মা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো পিঠ দিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দিল। শাইনা গালে হাত চেপে বসে রইলো। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।
কিছুক্ষণ শক্ত হয়ে বসে থাকার পর সে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ করতেই বড় আম্মার গলার আওয়াজ শোনা গেল।
“আশরাফের মা কই? মেহমানের আজকে আমার বাড়িতে দাওয়াত না? তুমি রান্না করতেছো কার জন্য?”
বলতে বলতে রান্নাঘরের চলে এল। সাথে করে কাকে নিয়ে এসেছে কে জানে? কিছুক্ষণ পর শাহিদা বেগমের গলা শোনা গেল।
“বসতে বলো ভাবি। আমার চা নাশতা রেডি আছে।”
“না না ওরা খেয়ে আসতেছে। তাড়াহুড়ো করো না। আমাদের বউকে ডাক দাও। ওকে দেখতে চাচ্ছে। কতবার এল এখানে। ওকে নাকি কখনো খেয়াল করেনি।”
শাইনা বুঝে ফেললো বড় আম্মার ভাইয়ের বউ এসেছে। শাহিদা বেগম মেহমানকে বসার ঘরে বসিয়ে দরজা ধাক্কালো।
“আল্লাহর ওয়াস্তে একটু দরজাটা খোল। একটু ওদের সামনে যা। শুনতে পাচ্ছিস? শানু?”
শাইনা দরজা খুললো। মা বলল,
“আল্লাহ চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলছে কেঁদেকেটে। আমি ওদের কি বলবো এখন? তুই আমার মানসম্মান রাখবি না? মুখে পানি দে। তারপর একটু পাউডার দে। মাথায় কাপড় দিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আয়।”
শাহিদা বেগম চা নাশতা নিয়ে গেল। গল্প জুড়ে দিল।
দরজা ধাক্কার শব্দে শাইনা দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে দেখলো বড় আম্মা দাঁড়িয়ে আছে। শাইনা একটু ভড়কে গেল। বড় আম্মা হেসে বলল,
“শ্বাশুড়ি ডাকার ভয়ে লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছিস নাকি? আয় এত সাজগোছ করতে হবে না। তোকে একটু দেখবে।”
শাইনাকে নিয়ে গেল বড় আম্মা রওশনআরা। শাইনাকে দেখে উনার ভাইয়ের বউ এক হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিল। বলল,
“হয়েছে দেখে ফেলেছি বউ। জোড়াগাঁথার দিন আমি থাকব না তাই আগেভাগে দেখে চলে যাচ্ছি। তাজদারকে বলতে পারব তোমার বউ দেখে যাচ্ছি। রাগটাগ করে লাভ নেই। তাহলে আসি আপা।”
শাহিদা বেগম বললেন,”আরেকটু বসেন না।”
“না না, আমার বাড়িতেও মেহমান এসে বসে আছে। চলে যেতে হবে।” বলেই তিনি শাইনার থুতনি ধরলেন।
“আসি আম্মু। তুমি তাজদারের সাথে যাবে আর কি আমাদের বাড়িতে। এখন দাওয়াত করে ফেললাম। আমি বিয়েতে থাকব। কাল থাকতে পারব না বলে চলে যাচ্ছি।”
শাইনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এত ভালো মিষ্টি ব্যবহার দেখে শাইনার মন কিছুক্ষণের জন্য ভালো হয়ে গেল। শাহিদা বেগম হাসিমুখে কিছুদূর এগিয়ে দিল তাদের। তারপর ঘরে ঢুকে বলল,
“সবাই কত হাসিখুশি এই বিয়ে নিয়ে। তুই এইসবে জল ঢেলে দিবি?”
শাইনা চুপ করে রইলো। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আর কাউকে কিচ্ছু বলবে না। সোজা ওই লোকটাকে বলবে। তারপর তার গায়ের জ্বালা, অপমানের শোধ নেয়া হবে। তখন সে সন্তুষ্ট হবে। এর আগে তার শান্তি নেই। কাল নিশান পরাতে এলে সে বলবেই।
অর্ধেক রাত অব্দি দুই বাড়ির মধ্যে আনাগোনা চললো। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বর কনের বাপ চাচা, ফুপা, খালুরা সবাই উপস্থিত থাকবে। আর সমাজের কিছু মান্যগণ্য লোক থাকবে। বরপক্ষ নিশান হিসেবে মেয়েকে আংটি আর একটা চেইন দেবে। আরও অনেক কথাবার্তা চললো সারারাত। শাইনা কানও দেয়নি। সরে সরে থেকেছে।
রাতারাতি বাজার সদাইয়ের লিস্ট নিয়ে মেঝ দুলাভাই, মেঝ ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া বাজারে চলে গিয়েছে।
গোটা রাত শাইনা একটুও ঘুমায়নি। মাথা ব্যাথা করছিল খুব। টেনশন করলে তার মাথাব্যথা হয়। খিদে চলে যায়। ঘুম হয় না। মাথার তালু গরম হয়ে গিয়েছিল। সে নারিকেল তেল ঢেলে চুবিয়ে রেখেছে চুলগুলো। তবুও ঘুম আসেনি।
সকাল ন’টার দিকে তার জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছে ওই বাড়ির মেয়েরা। শাইনার সমবয়সী মেয়েটার নাম তিতলি। সে সম্পর্কে শাইনার ননদ হবে। তিতলি আগে ঘনঘন তার সাথে কথা বলতে আসতো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর থেকে সেও আসাযাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। শাইনাকে লজ্জায় ফেলতে চায়নি বলে হয়তো। সে শাড়িটা রেখে বলল,
“পার্লারের মেয়ে আসবে সাজানোর জন্য। চাচীমা ওদের এখানে আসতে বলব নাকি আমাদের বাড়িতে? কারণ আমরাও সাজগোছ করব। আমার ভাবিরাও করবে।”
শাইনা চুপ করে রইলো। শাহিদা বেগম বলল,
“শারমিলা আর শাবরিন কি বলে দেখো।”
বড় বোন শারমিলা বলল,”তোমাদের বাড়ি বউ। তোমাদের সিদ্ধান্ত।”
মেঝ বোন শাবরিন হেসে বলল,”আমাকেও সাজতে দিলে আমার বোনকে ছাড়তে রাজী আছি।”
তিতলি বলল,”টাকা তো ভাইয়া দেবে। সমস্যা নেই। তাহলে আমরা শাইনাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
শাইনা শর্ত দিল,”বাড়ির পেছনে দিয়ে যাব। সামনে দিয়ে যাব না।”
তিতলি হেসে বলল,”ওকে। পেছনে মানুষ আরও বেশি।”
বলেই সে ফিক করে হাসলো। শাইনা গোসল করেই বসেছিল। তিতলি তাকে নিয়ে গেল কলতান নিবাসের পেছন দিয়ে।
“বউ এসেছে, বউ এসেছে” রব পড়ে গেল। বাচ্চাগুলো এভাবে বলে বলে চিল্লাচিল্লি করছে। বড় আম্মা এসে বলল,
“মুখ এমন শুকনো কেন? কিছু খাসনি?”
শাইনা বলল,”খেয়েছি।”
বড় আম্মার মেঝ মেয়ে তাসনুভা এল। সে একটু গম্ভীরসম্ভীর। অনেকটা অহংকারীও। মানুষের সাথে কম মিশে। ভাইয়ের চাইতে কম না। সে
মেঝ আপার সমবয়সী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ভাইয়ের বিয়ের পর তারও বিয়ে।
শাইনাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,
“ফেসিয়াল করা নেই?”
শাইনা সাথে সাথে জবাব দিল,”না। ফেসিয়াল করলে আমার ব্রণ হয়।”
“লোকাল পার্লারে করালে ব্রণ তো হবেই। এখন সাজ বসবে?”
বড় আম্মা বলল,”আজ তো হালকা করে সাজবে।”
তাসনুভা সাথে সাথে বলল,”একটা গ্লাসি লুক আনার জন্যই তো ফেসিয়াল করা লাগে আম্মু। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না।”
তিতলি বলল,”আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা বকরবকর করো।”
সে তার ঘরে নিয়ে গেল শাইনাকে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে বলল,”চুল শুকিয়ে নাও।”
শাইনা চুল শুকিয়ে নিল। পার্লারের মেয়েরা এসে তাদের কাজ শুরু করে দিল। শাইনার শাড়ির রঙ পেঁয়াজি রঙের। তাসনুভার পছন্দে শাইনাকে সাজানো হলো। শাইনা অপেক্ষা করছে কবে তাজদার সিদ্দিকীর সাথে তার দেখা হবে। জীবনেও সে কথা বলেনি ওই লোকটার সাথে। এবার বলবে। আর একটা কথা দিয়েই সে তার সারাজীবনের অপমানের শোধ তুলে নেবে। নেবেই।
বাবুর্চি এনেছে আফসার সাহেব। উঠোনের একপাশে বড় বড় পাতিলে খুন্তি নাড়ছে বাবুর্চিরা। চট্টগ্রামের ভাষায় তাদের বর্সি বলে। এত রান্নার আয়োজন বাড়িতে করা সম্ভব নয় বলে আশরাফ বলেছে বাবুর্চি ডাকতে। সকাল থেকেই তাদের রান্নাবান্নার কাজ শুরু হয়েছে।
হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেককে দাওয়াত করতে পারেনি শাহিদা বেগম। তবে শাইনার ফুপা ফুপু, মামা মামি, খালা খালুরা এসেছে। এতেই বাড়ি ভরে গেছে।
বড় আম্মা শাইনাকে মিষ্টি দই খাইয়ে গেছেন সাজগোজের পর। তাসনুভা এতেই খেপেছে। শাইনার লিপস্টিক নাকি সরে গিয়েছে তাই।
বাড়ির অন্যান্য বউরাও শাইনার মতো করে সাজলো। সবাই সাজগোছ নিয়ে এত আগ্রহী! বিষয়টা অবশ্য শাইনার মন্দ লাগেনি। কিন্তু মেজাজ খারাপ থাকায় সবটা বিরক্ত লাগছে।
সাজগোজ করার পর তিতলির ঘরে বসিয়ে রাখা হলো তাকে। ঘরে বসেই সে তিতলির দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি দেখছে। বেচারি ভালো করে সাজতেও পারছেনা কারো পাঞ্জাবি, কারো ঘড়ি, চশমা খুঁজে দেয়ার জন্য। তাসনুভারও বড় বোন আছে। তার নাম তাসনীম। উনি আপাদের অনেকটা বড় হবে। দু একবার এসে শাইনাকে দেখে গেছেন। শাইনা যা বুঝলো উনি আর তাসনুভা একদম রাজি নেই এই সম্বন্ধে। শাইনা এটাও বুঝে গেল এই বাড়িতে বউ হয়ে এলে সে নূন্যতম সম্মানটুকুও পাবে না। এই বিয়ে সে মরে গেলেও করবে না।
আফসার সাহেব বাইরে প্যান্ডেল করেছেন। সেখানে ছোটখাটো খাবার-দাবারের আয়োজন হয়েছে। বেলা তিনটের দিকে শাইনাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। মেহমানরা এসে তার সাথে দেখা করছে। খালাম্মারা বলছে, তোকে তো এখন ওই বাড়ির বউয়ের মতোনই লাগছে।
ছোট খালাম্মাকে দেখে শাইনা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। কারণ ছোট খালাম্মা তার আরেকটা মা। খালাম্মা তাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল,
“কাঁদিস না। বিয়ের পর ইউরোপ আমেরিকা ঘুরতে পারবি। ছক্কা মেরে দিয়েছিস।”
শাইনা ফোঁপাতে লাগলো। শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তোমরা সবকটা লোভী। এই লোভে আমার জীবনটা শেষ।”
ছোট খালাম্মা হকচকিয়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পর বড় মামা এসে মাকে ডাকলেন। মা সাড়া দিয়ে বলল,”বলতেছি ভাইজান।”
তিতলি ভিডিও কল নিয়ে ছোটাছুটি করছে।
“মসজিদ থেকে কল এসেছে। শাইনাকে নিয়ে আসো এখানে।”
জায়নামাজ বিছিয়ে বড় মামা বসে আছেন দাদীমার ঘরটাতে। শাইনাকেও সেই ঘরে আনা হলো। মামীরা মামার পাশে বসিয়ে দিল তাকে। মামা তার মাথায় হাত রাখলেন।
মামার সামনে একটা ফোন। সেখানে ভিডিও কলে টুপি পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে। মামা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহ্র নামে শুরু করছি। তিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। আজ এই পবিত্র দিনে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও শরিয়তের বিধান মোতাবে তাজউদ্দীন সিদ্দিকী ও রওশনআরা চৌধুরীর যোগ্য দ্বিতীয় পুত্র তাজদার সিদ্দিকী সাহেবের সাথে আফসার সিদ্দিকী ও শাহিদা খাতুনের আদরের কনিষ্ঠা কন্যা মোছাম্মদ শায়না মমতাজ-কে পনের লক্ষ টাকা দেনমোহর নির্ধারণপূর্বক শরিয়ত মোতাবেক এবং সাক্ষী ও অভিভাবকদের সম্মতিতে বিবাহ দিলাম।
মোছাম্মদ শায়না মমতাজ আপনি তাজদার সিদ্দিকী সাহেবকে এই মোহরানায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হলে বলুন,
তাজমহল পর্ব ১
“বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
শাইনা ভিডিও কলটার দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও তাকে দেখা যাচ্ছে না সেখানে। শুধু বড় মামাকে দেখা যাচ্ছে। ভিডিও কলে কাজী, বরের পিতা আর বরকে দেখা যাচ্ছে।
মসজিদে অবস্থানরত সবাই। জোড়াগাঁথার নাম করে সবাই আকদ পরিয়ে দিচ্ছে। শাইনার নিঃশ্বাস ফেঁপে উঠলো। ওদিকে ভিডিও কলে সবাই অপেক্ষারত। কাজী সাহেব তাড়া দিচ্ছেন।
বড় আপা পেছনে এসে শাইনাকে ধরামাত্রই শাইনা হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,
“আমি এই বিয়ে করব না।”