তাজমহল পর্ব ৩
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
“আমি করব না এই বিয়ে। আমাকে ঘরে যেতে দাও। আজ নিশান পরাবে বলেছিল। আমাকে মিথ্যে বলেছে সবাই।”
বলেই শাইনা কাঁদতে লাগলো। সবাই বিষয়টা এমনভাবে নিল যেন বাপের বাড়ির মায়া ছাড়তে হচ্ছে বলেই সে কাঁদছে। অথচ বিষয়টা অন্য। একটা অপছন্দের মানুষকে কবুল বলার চাইতে শাইনার কাছে মৃত্যুটা অনেক সহজ ছিল।
কিন্তু তার পাঁচ পাঁচটা ভাই বোন, মা বাবা, নিজের দাদীমা, ফুপুরা এমনকি খালাম্মারা কেউ তার মনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করলো না।
সে অসুখী হলে এরাই আবার বলবে যে সে-ই সংসার করতে পারছেনা।
ভিডিও কলটা কেটে গেছে। তিতলি আর তাসনুভা ফোন নিয়ে ছোটাছুটি করছে। তারা ঘামছে। বোঝাই যাচ্ছে ওপাশ থেকে তাদের বাপ ভাই তাদের বকছে।
শাইনা তিতলির কথা শুনতে পেল। সে মুখ গোমড়া করে বলল,”আমি কি জানি? আমাকে বকছো কেন? আম্মা এসেছে। নাও কথা বলো।”
তিতলি তার মাকে ফোনটা দিল। রওশনআরা চোখের চশমা খুলে ফোনটা কানে চেপে ধরে বড় ছেলেকে বললেন,
“হ্যাঁ আমি দেখছি। তোর আব্বাকে মাথা ঠান্ডা করতে বল। মেয়েরা বিয়ের দিন অনেক ভয়ে থাকে তাই ভুলভাল বলে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে শাহিদা বেগমের উপর চড়াও হয়েছে আশরাফ। মসজিদের ভেতর দুই পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক লেগে যাচ্ছে। তাজদার উঠে চলে যাচ্ছিল। সবাই শান্ত করিয়ে রেখেছে। এতগুলো মানুষের সামনে কনে কবুল বলতে চায়নি বিষয়টা ভীষণ অপমানজনক।
রওশনআরা ফোন কেটে শাইনার পেছনে এসে বসলো। বলল,”ওসব কথা মুখে আনিস না। মসজিদে ঝামেলা লেগে যাবে। এমুহূর্তে এসে আর ঝামেলা করিস না।”
শাইনা জবাব দিল না। তিতলি ভিডিও কলটা আবারও বড় মামার সামনে রাখলো। সেখানে রওশনআরার বড় ছেলে রায়হান সাদা পাঞ্জাবি টুপি পরা। বড় মামাকে বলল,
“এদিকে ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। একটু তাড়াতাড়ি করুন মামা।”
বড়মামা আশ্বাস দিলেন।
“ও সবার আদরের তো। একটু কান্নাকাটি করছে। সমস্যা নেই। সবাইকে শান্ত থাকতে বলো।”
শারমিলা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে কাকে যেন বলছে, “কিছু হতে না হতেই সবার মাথা গরম হয়ে যায় কেন? ওকে জানাইছে নিশান পড়ানো হবে। এখন আকদ পড়ানো হচ্ছে শুনে ও কাঁদবে না? আশ্চর্য!”
পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাসনুভা এসে টিস্যু দিয়ে আলতো করে শাইনার চোখের পানি মুছে দিল। রওশনআরা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“এরকম ভরা মজলিশে কেউ বলে বিয়ে করব না? কত আয়োজন করেছে তোর আব্বু। তোর বড় মামা যা বলছে তাই বল। আশরাফের মা কোথায়?”
শাহিদা বেগম বললেন,”আমি এখানে ভাবি।”
“এদিকে আসো। মেয়ের পাশে থাকো। এমন সময় মাকে দরকার পড়ে। মেয়েকে একটু সাহস দাও। এমন দূরে দূরে কেন তুমি?”
বড় মামা ভিডিও কলে আছেন। শাহিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হয়েছে? নাকি ওকে সেখানে নিয়ে যাবে?”
শাহিদা বেগম বলল,”দাঁড়াও আমি দেখি।”
তিনি শাইনার পাশে বসে পিঠে আলতো করে হাত রাখতেই শাইনা গা ঝাড়া দিল। শাহিদা বেগম বললেন,”নইলে তোকে ওরা এসে নিয়ে যাবে। ওখানে বিয়ে পরাবে। সেখানে কিন্তু সবাই বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির পুরুষ মানুষ থাকবে। সবার সামনে কবুল বলতে হবে।”
শাইনা ফোঁপাতে লাগলো। বড় মামা বললেন,
“আচ্ছা ওকে আর জোরাজোরি করিস না।
আশরাফ আর রায়হান আসতেছে বোধহয়। আশরাফ সম্মতি নিয়ে মসজিদে চলে যাবে।”
শাইনার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। ভাইয়ার সামনে তাকে কবুল বলতেই হবে। তার কান্নার বেগ আরও বাড়লো। কেউ তাকে রাজী করাতে পারলো না। শাহিদা বেগম বলল,
“তাইলে তোর ভাই ভাসুরের সামনে বলিস কবুল। পৃথিবীতে নিখাঁদ ভালো মানুষ আছে? তোকে আরেক জায়গায় বিয়ে দিলে ওখানে সুখ থাকবি সেটা কেউ বলতে পারবে? হতেও তো পারে তুই এই বিয়েতে আরও বেশি সুখী হবি। আর কিছু বলব না তোকে। তোর বড় ভাইয়ের সামনে বলিস এবার।”
আশরাফ এসে সবার উপর গর্জন শুরু করে দিল।
“সমস্যা কি এখানে? তোমাদের কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে কখনো? সবাই বের হও ঘর থেকে। আমি সম্মতি নিয়ে চলে যাব।”
রায়হান শান্তভাবে বলল,”সবাই একটু ঘরটা খালি করে দিন। দুলাভাই আসেন।”
বোনের জামাই আর দুই ভাই ঘরে প্রবেশ করলো। মহিলারা ঘরের বাইরে পা রাখলো। আশরাফ বসলো শাইনার একপাশে। অন্যপাশে বড় মামা আছেন। ওই বাড়ির জামাইও আছে। শাইনার বড় দুলাভাইও এসেছে।
রায়হান কাবিনমামাটা এগিয়ে দিল। আশরাফের হাতে ফোন। ভিডিও কল চালু হতেই বড় মামা ইজাব পেশ করলেন। আশরাফ ভারী গলায় বলল,
“সবাই অপেক্ষা করে আছে। বল।”
বড়মামা বললেন,”মোছাম্মদ শায়না মমতাজ আপনি তাজদার সিদ্দিকী সাহেবকে এই মোহরানায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হলে বলুন,”বিসমিল্লাহ..
শাইনা মুখের উপর ঘোমটা টেনে দিয়েছিল তাসনুভা। মাথাটা নীচু করে রাখা। চোখের জলে তার কোলে রাখা হাতটা ভিজে যাচ্ছে। আশরাফ আবারও তাড়া দিল।
শাইনা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, “বিসমিল্লাহ।”
বড়মামা বললেন,”আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
শাইনার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এল। সে সশব্দে কেঁদে উঠে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ কবুল..
তার কান্নার বেগ আরও বাড়লো। তার কান্না দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারাও চুপ হয়ে আছে। আশরাফও চুপচাপ হয়ে গেছে। শাইনা গা দুলিয়ে কাঁদতে লাগলো।
বড় মামা আবারও বললেন। শাইনা কাঁদতে কাঁদতে শেষবারের মতো কবুল বললো। সবাই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। ফোনের ওপাশে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো। ভিডিও কলটা কেটে দেয়া হলো তারপর।
আশরাফ কাবিননামাটা এগিয়ে দিয়ে কোথায় কোথায় স্বাক্ষর করবে তা দেখিয়ে দিল। শাইনার হাতে থাকা টিস্যুটা ভিজে গিয়েছে। বড় দুলাভাই তাকে আরেকটা টিস্যু দিল। চোখের পানিতে ভেজা হাতটা মুছে নিল শাইনা। রায়হান কলম বাড়িয়ে দিল। ভিডিও ক্যামেরা অন করলো। শাইনার হাত কাঁপছে। আশরাফ বলল,” আস্তে আস্তে লিখে দে।”
শাইনা এলোমেলো ভাবে স্বাক্ষর করে দিল। ইচ্ছে করলো এই কাগজ, এই কাগজে তার পাশে থাকা নামটা মিথ্যে করে দিতে। কাগজটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করতে। চিৎকার করে বলতে যে বিয়ের সম্মতি মন থেকে আসেনা সেটা বিয়ে নয়। সে মানেনা।
কাবিননামায় স্বাক্ষর নিয়ে ভাইয়ারা চলে গেল। শাইনাকে ঘরে নিয়ে আসা হলো।
ইতোমধ্যে নানান কথা রটে গেছে চারপাশে। আপারা সব শুনে মা চাচী খালাদের বকছে। সব কথা কানে নিতে হবে কেন?
রটে যাওয়া কথাগুলো এরূপ যে শাইনা এই বিয়েতে রাজী নেই কারণ তার অন্য কারো সাথে কিছু আছে। অন্য কোথাও পছন্দ আছে। তার মা বাবা ওই ছেলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে তাজদারের সাথে বিয়ে দিচ্ছে বলে কাঁদছে। আরও হাজারটা কথা। নইলে তাজদারের মতো ছেলেকে বিয়ে করতে এত অনীহা থাকবে কোন? তাজদার এরচেয়ে আরও ভালো ঘরের মেয়ে আনতে পারতো। আরও বড়লোক, আরও স্মার্ট, আরও সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়ে ডিজার্ভ করে সে।
তিতলির ফুপুরা শাইনার ফুপুদের কথা শোনাচ্ছে। তাজদারকে কত বড় খান্দানি পরিবারের, শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়ে মেয়ে দিতে বলেছিল। মেয়েটার ছবিও দেখালো। বলল,
“একদম আমাদের বাড়ির মেয়েদের সাথে মিলে যেত এই মেয়েকে বউ করে আনলে। কিন্তু ভাবি জেদ ধরেছে শাইনাকেই বউ করবে। কিন্তু সেই মেয়ে এত নাটক করে কেমনে? তাজদার তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে এই তো বেশি। আমার ভাইপো লাখে একটা। ওর মাকে কীসের ভূতে ধরেছে আল্লাহ জানে। কারো কথাবার্তা শুনলো না।”
শাইনার খালাম্মা বলল,”আপা এসব শুনলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। আমার বোনঝিও কম কীসে? ও পড়াশোনাটা শেষ করতে চেয়েছে। এখনো সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়েছে। বয়স বাইশ তেইশে চলছে। দেখতে টেখতে তো মন্দ না। ওকেও আমরা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম। আনিসের এক বন্ধু তো নিয়ে যেতে চাইছিল। শ্বাশুড়ির বদনাম শুনে আমার আপা আর কথাবার্তা আগায়নি।”
“ভালো ঘরে দিতে পারতেন আপনাদের মেয়েকে। কিন্তু তাজদারের মতো ছেলে পেতেন না। আপনারা তর্ক করতে পারবেন কিন্তু সত্যি সত্যিই।”
“থাক আপা কথা বাড়ালে কথা বাড়বে। বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন আর কথা না বাড়ানোই ভালো।”
সব শুনে গা জ্বালা করছিল শাইনার। ঘরে যেতে না যেতেই সে ঘোমটা খুলে ছুঁড়ে ফেললো। সাজটাজ সব মুছে ফেলতে লাগলো। বড় ফুপু বলল,
“কি করছিস? অনুষ্ঠান তো বাকি আছে এখনো। সাজ নষ্ট করছিস কেন?”
শাইনা চেঁচিয়ে উঠে বলল,”সবাই বের হও আমার ঘর থেকে। বের হও বলছি। আর কোনো অনুষ্ঠানে আমি থাকব না।”
মা বললেন,”তাহলে ওরকম পাগলের মতো যাস জামাইয়ের সামনে। তোর বাপ ভাই ওর বাপ ভাইয়ের হাতে তোকে তুলে দেবে না? জামাইয়ের হাতে তুলে দেবেনা? তুই শাড়ি খুললি কেন?”
শাইনা অগ্নিতুল্য হয়ে বলল,”কারো সামনে যাব না আমি। তোমাদের আমি কখনো ক্ষমা করবো না আম্মা। আমার জীবনটা শেষ করে দিলে সবাই মিলে। আমি তোমাদের শান্তি দেব না। আল্লাহ আমাকে মেরে ফেলুক। এই বাড়ির মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েই ভুল করছি আমি। লোভীর গুষ্টি।”
শাহিদা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। রান্নাঘরে গিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। শারমিলা বলল,”তোমারা মা মেয়ে এবার থামো। তুমি কেন কাঁদতেছ আবার?”
“কোনো মা মেয়ের খারাপ চায়? ওই মেয়ে কি বলছে শুনতে পাচ্ছিস না?”
শাবরিন বলল,”আশ্চর্য! ওর কষ্ট লাগতেছে। ও বলবে না? তোমাকে সেসব কানে তুলতে হবে কেন?”
আকদের খোরমা-খেজুর, মিষ্টি, আর নাশতার প্যাকেট চলে এসেছে। শাওন আর আনিস সব গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়িতে ভেতরে পা রাখলো। তাসনুভা আর তিতলি দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে। শাইনা সাজ নষ্ট করে দিয়েছে শুনে তাসনুভার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। এখনো একটা কাপল পিক তোলা হয়নি। এটা কোনো আকদরে অনুষ্ঠান হলো? শাওন আর আনিসকে দেখামাত্রই তাসনুভা বলল,
“আনিস ভাই আপনারা কি ফটোগ্রাফার ঠিক করেছেন?”
আনিস বলল,”শাওনকে জিজ্ঞেস করো।”
শাওন বলল,”তৌসিফ ভাই করছে।”
তৌসিফ তিতলির চাচার ছেলে। তিতলি খুশি হয়ে বলল,”তাহলে কিছুক্ষণ পর আসবে বোধহয়। কিন্তু শাইনা তো সাজগোছ নষ্ট করে ফেলেছে।”
আনিস বলল,”ছবি ভিডিও বিয়ের সময় হবে। এখন দরকার নেই।”
তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,”দরকার নেই মানে? বারো হাজার টাকা দিয়ে সাজিয়েছি কেন তাহলে? ভাইয়ার টাকাগুলো নষ্ট করার কি দরকার ছিল?”
শাওন বলল,”আমাদের বলে লাভ কি? তোমাদের বাড়ির বউ কেন সাজ নষ্ট করলো সেটা আমরা কি করে জানব?”
তাসনুভা হনহনিয়ে চলে গেল। শাওন আর আনিস খোরমা-খেজুর আর মিষ্টি বিলি করলো। মসজিদে কি কি হয়েছে সব ফুপু খালাকে বলতে লাগলো। শাইনার শ্বশুর, চাচা শ্বশুর, ফুপুশ্বশুররা রেগে গিয়েছিল ও না বলায়। তাজদারও উঠে গিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
মহিলাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল যদিও। কিন্তু দেরী হওয়াতেই সবাই আকদ পড়িয়ে ফেলার তাড়া দিয়েছিল তাই বরের লোকজন খাওয়া দাওয়া হয়নি। যারা খাওয়াদাওয়া করেনি তারা খেয়েদেয়ে উঠোনে একটা বৈঠকে বসলো। বিয়ের অনুষ্ঠান কখন হবে, কিভাবে হবে সব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা চললো। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী প্রস্তাব দিলেন ছেলে মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান একসাথে হবে যেহেতু একবাড়িতেই হচ্ছে। এতে অনুষ্ঠানও সুন্দর হবে। টাকাপয়সাও দুই পক্ষের বেঁচে যাবে। প্রস্তাবটা সবার পছন্দ হয়েছে।
ফটোগ্রাফারও চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। পড়ন্ত বিকেলে আউটডোর ফটোগ্রাফি করার পরিকল্পনা ছিল তাসনুভার। কিন্তু বর কনে দুজনেই বেঁকে বসে আছে। ভাইয়া মসজিদ থেকে সোজা ঘরে গিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার বউও গোসল নিয়ে সেলোয়ার-কামিজ পরে ফ্যান ছেড়ে, গায়ে কাঁথা জড়িয়ে কপাল কুঁচকে ঘুমাচ্ছে। সে কারো মুখও দেখতে চায় না।
অবশ্য এসব শুনলে মুরব্বিরা খারাপ কিছু বলবে তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ওরা দুজনেই একটু আরাম করে নিক। তারপর রাতে ওই বাড়ির ছাদে সুন্দর করে ছবি টবি তোলার আয়োজন করা হবে। ছেলেমেয়েরা আনন্দ উল্লাস করবে ওদের ভাই আর ভাইয়ের বউ নিয়ে। শাইনাকে শাড়িটা পরিয়ে সাদামাটা ভাবে সাজিয়ে দেবে তাসনুভা।
শাইনা বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। মা তাকে ডেকে তুললো। খালি পেটে শুধু ঘুমালে হবে?
ঘুম থেকে উঠে শাইনা আবিষ্কার করলো সে আর এই বাড়ির মেয়ে নেই। এরা সবাই মিলে তাকে পর করে দিয়েছে।
মা তার জন্য ভাত নিয়ে এল। আকদের অনুষ্ঠানেও আব্বা চমৎকার আয়োজন করেছেন। মাংস দিয়ে ভাত মেখে লোকমা তুলে শাহিদা বেগম বললেন,
“আংটিটা পরানো হয়নি। ওরা নাকি ওদের ছাদে আয়োজন করতেছে। না করিস না। এই দিনগুলো আর ফিরে পাবিনা।”
শাইনা লোকমা মুখে নিয়ে চুপ করে রইলো। গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে। ভাতের এত দাম!
শাহিদা বেগম হাঁ করে চেয়ে রইলো। শাইনা লোকমা মুখে রেখে একটু একটু ফোঁপাতে লাগলো। চোখে জল ভরে উঠতে লাগলো। বাপের বাড়ির ভাত ফুরিয়ে যাচ্ছিল তার জন্য যে তাকে এভাবে বিয়ে দিতে হলো? এরচেয়ে তো বিষ দিলে ভালো ছিল।
শাহিদা বেগম বললেন,”মুখে ভাত নিয়ে কাঁদতে নাই। তুই এরকম ঘুমাচ্ছিস শুনে মানুষ একেক কথা বলতেছে। আকদের পর বর বউয়ের এখনো চেহারা দেখাদেখি হয়নি। বরের হাতে কেউ বউ তুলে দেয়নি। কি আশ্চর্যের কথা!”
শাইনা ভাতটা চিবিয়ে বলল,”ওই মুখ আমি দেখতেও চাইনা। আমার হাত কারো হাতে তুলে দিতে হবে না। আমাকে ভালো রাখার জন্য আমিই যথেষ্ট। ওইসব মানুষ আমার অসুখের কারণ হবে আরও। আর খাবনা। যাও।”
শাহিদা বেগম আর জোরাজোরি করলেন না। চুপচাপ চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর তিতলি এসে বলল,”শাইনা তোমাকে আপু সাজিয়ে দেবে। মুখটুক ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
শাইনা বিছানা থেকেই নামলো না অনেকক্ষণ। মুখটা ফুলে গেছে।
কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে নামলো। মুখে ঘনঘন পানির ঝাপটা দিল। বড় আপা, মেঝ আপা, ভাবি, চাচীরা সবাই শাড়িটাড়ি পরে প্রস্তুত। তাসনুভা এসে শাইনাকে শাড়ি পরিয়ে দিল। সে আর কোনো হ্যাঁ না করলো না। সাজানোর পর তিতলি তাসনুভা আর তাদের কাজিনরা এসে শাইনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
নতুন বউ যেভাবে বাড়িতে প্রবেশ করে শাইনার পা রাখার সময় সেইসব আয়োজন করে বাড়িতে প্রবেশ করানো হলো। শাইনা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। রওশনআরা বলল,”মুখ এভাবে গম্ভীর করে রাখতে নেই। একটু হাসিমুখে থাক। মানুষে বলবে আমি কি বউ আনলাম। একটুও হাসেনা।”
দাদীমা বলে উঠলেন,”ছেলের বউকে তুই করে বলতে নেই। ও এখন পাশের বাড়ির মেয়ে নেই।”
রওশনআরা হাসলেন।
“আচ্ছা আর বললাম না। তিতলি যা ওকে নিয়ে যা।”
ছাদে ছেলেমেয়েতে ঠাঁসা। সবাই কাজিন। বউ আসামাত্রই সবাই একসাথে হৈচৈ করে উঠলো। স্প্রে ছুঁড়লো। ফুলের পাপড়ি ছুঁড়লো। বউয়ের প্রবেশ পথটি সবাই মিলে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল।
শাইনা ফুলের পাপড়ির উপর হেঁটে ছাদে পা রাখলো। হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে তার মুখে পড়লো। গরম লাইটের আলোয় সে চোখ কুঁচকে ফেললো। লাইটটা আরও কাছে আসতেই শাইনা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। শক্ত করে তিতলির হাত চেপে ধরে বলল,
“লেন্সটা খুলে ফেলবো তিতলি। আমার চোখ জ্বলছে।”
তিতলি কিছু বলবে তার আগেই সবাই হো হো করে উল্লাসে ফেটে পড়লো। তৌসিফ পেছন থেকে বলল,
“পার্ফেক্ট টাইমে এন্ট্রি!”
শাইনা ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিয়ে চোখ খুলে তাকালো। সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে তাজদার সিদ্দিকী। সেই অহংকারী, দাম্ভিক চেহারা! চোখদুটো নিস্পন্দ অথচ তীক্ষ্ণ। শক্ত চোয়াল, ঠোঁটের কোণে একটা হালকা বাঁক। এটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের একমাত্র চিহ্ন। এমন চেহারা দেখে হাসতে ভয় হয়, আর কাঁদতে লজ্জা। এই লোকটা বেশ ভালো করে জানে সে কতটা ঘৃণার চোখে দেখে তাঁকে। না জানলেও শাইনা এখন যেভাবে তাকিয়ে আছে তাতে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
সে সব যন্ত্রণা ভুলে গেছে এক লহমায়। তার চোখেমুখে তখন বিস্ময়ের চেয়ে বেশি ক্ষোভ কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাই তার জীবনের বড় যন্ত্রণা! চোখের যন্ত্রণা অনেকটা কম এর কাছে।
ফটোগ্রাফার সাথে সাথে কয়েকটা ক্লিক করলো। তাজদার সিদ্দিকীর চোখ ঘুরে গেল। তাকে আর আপাদেরকে যেভাবে আঙুুল তুলে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলতো টিভির ঘর থেকে ঠিক সেভাবে একই ভঙ্গিমায়, একই আঙুল তুলে সাথে সাথে ভারী গলায় আদেশ ঝাড়লো ক্যামেরাম্যানের উপর,
তাজমহল পর্ব ২
“ক্যামেরা অফ। আগে পারমিশন নেবে ছবি তোলার জন্য রেডি কিনা। এই তিতলি এদিকে আয়। লেন্স খুলে নে।”
তিতলি ছুটে এল। শাইনাকে বলল,”লেন্সে প্রবলেম হচ্ছে?”
শাইনার চোখ অসম্ভব জ্বলছে। তবুও সে শক্তকণ্ঠে বলল,”নাহ।”