তাজমহল পর্ব ৩২
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনা রুটি বেলছে পিঁড়িতে বসে। এতগুলো রুটি কখন বানিয়ে শেষ করবে সে নিজেও জানেনা।
ময়দার রুটি বাড়িতে সে খেত না। মা যখন বানাতো তখন সে বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে রাখতো। আটার রুটি তো একদমই পছন্দ ছিল না। সে খেলে ওই নান রুটিটা খায় তাও ডাল কিংবা মাংসের ঝোলঝাল দিয়ে। পাউরুটিও খায় জেল দিয়ে কি’বা ডিম দিয়ে।
রওশনআরা আলু ভাজি করেছেন। আলু ভাজি দিয়ে রুটি দিয়ে খাবে সবাই। কয়েকটা ডিম পোচ করেছেন।
শাইনা রুটি বেলছে আর ঝিমলি পুড়ছে। রওশনআরা দোকানের নানরুটি খায় না। উনার নাকি ইস্ট আর সোডার গন্ধটা খুব বাজে লাগে। উনারা সবাই ময়দার নরম নরম রুটি খেতে পছন্দ করে।
শাইনা প্রায় ত্রিশটার উপরে রুটি বেলে নিল। ঝিমলি বেশিক্ষণ চুলার সামনে দাঁড়াতে চায় না। স্কিনের ক্ষতি হয় বেশ। সেও বিরক্তি দেখালো রুটিগুলো পুড়তে গিয়ে। জোহরা বেগমকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“দোকান থেকে কিনে আনলেই ভালো। সকাল সকাল রুটি বানানো ঝামেলার কাজ।”
জোহরা বেগম কিছু বললেন না। আজকালকার মেয়েরা একদম কাজকর্ম করতে চায় না।
শাইনা রুটি বানিয়ে শেষ করে ফেলেছে। ঝিমলি এখনো একটা একটা পুড়ছে। জোহরা বেগম শাইনাকে বলল,
“ওই চুলায় আরেকটা তাওয়া বসিয়ে দাও।”
শাইনা তাই তাই করলো। হাই হিটে তাওয়া গরম করে চুলার আঁচল একটু কমিয়ে দিয়ে রুটিগুলো পুড়ে নিল।
পোড়া শেষে শাইনা পাউরুটি আর ডিম পোচ নিল প্লেটে করে। সে যেহেতু ময়দার রুটি খায় না। তাসনুভা এসে বলল,
“আমি প্লেটটা নিয়ে যাচ্ছি। তুমি আরেকটাতে নাও প্লিজ। আমার খিদে পেয়েছে।”
ডিম পোচ আর একটাই অবশিষ্ট ছিল। ঝিমলি নিজের খাবার নিয়ে টেবিলে বসে আস্তে আস্তে খাচ্ছে। শাইনাকেও আসতে বললো। শাইনা ফ্রিজ খুলে দেখলো ডিম নেই।
জোহরা বেগম বলল,”কি খুঁজছো?”
শাইনা জানতে চাইল,”ডিম আর নেই?”
“না। শেষ হয়ে গেছে। আনতে হবে। কার জন্য?”
শাইনা লজ্জায় বলতে পারলো না। জোহরা বেগম যদিও বুঝে গেছেন।
শাইনা প্লেটে একটু ভাজি নিল। দুটো রুটি নিয়ে ঝিমলির পাশে বসে খেতে লাগলো।
ঝিমলির পেট উঁচু হয়েছে। সে বোধহয় ছ’সাত মাসে পড়েছে। দেবরের বিয়ে উপলক্ষেই এসেছিল। নইলে এর আগে বাপের বাড়িতে ছিল।
তার বাপের বাড়ি ঢাকায়। সে চট্টগ্রামে প্রথম প্রথম এসে মানিয়ে নিতে পারেনি। এখানকার কথাবার্তাও তেমন বুঝতো না। যদিও এই বাড়িতে বড়রা একে অপরের সাথে চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বললেও ছোটরা চলিত ভাষায় কথা বলে। বড়রাও ছোটদের সাথে চলিত ভাষায়ই কথা বলে। তাই ঝিমলির খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু এখানকার রীতিনীতি, খাবারদাবার, সংস্কৃতি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে তার অনেকটা সময় লেগেছে।
শাইনা তার অনেকটা ছোট বলা যায়। সে মাস্টার্স পাশ করার পর বিয়ে করেছে।
শাইনার পাতে ডিম পোচ না দেখে সে জানতে চাইল,”তুমি না রুটি খাওনা?”
শাইনা ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ছে যদিও। ভীষণ রাগ হচ্ছে কেন যেন। বাড়িতে এমন হলে সে মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে একদম ঘরে গিয়ে বসে থাকতো। মা মুখের সামনে প্লেট ধরে রাখতো। এখানে এইসবের মূল্য নেই। একটা ডিমই তো!
রওশনআরা এসে বলল,”ডিম পোচ কার কম পড়েছে?”
জোহরা বেগম বলল,”শাইনার।”
তিনি কার প্লেট থেকে যেন ডিমপোচটা চামচে তুলে শাইনার প্লেটে দিয়ে প্লেটটা সিংক এর উপর রেখে চলে গেল।
শাইনার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে উঠে গেল মুখে বাকি রুটিটা গুঁজে দিয়ে। ডিমটা কড়াইয়ে রেখে দিয়ে সিংকে থাকা প্লেটগুলো ধুয়ে ঘরে চলে এল। ঘরে এসে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেল।
তাজদার সিদ্দিকী আসছে মনে হতেই পালঙ্কের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পিঠ ঠেকিয়ে। চোখদুটো সিলিংয়ের দিকে। আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে করে শাড়ির আঁচলে চোখের কোণার জল মুছে নিচ্ছে।
রওশনআরা কড়াইয়ে ডিমটা দেখে বলল,”এটা কার?”
জোহরা বেগম বলল,”শাইনা খায়নি। কার প্লেট না কার প্লেট থেকে দিয়েছ তাই হয়তো খায়নি। বাপরে!”
রওশনআরা ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।
তাজদার ঘরে আসতে আসতে তিতলিকে ডাকছে।
তিতলি দৌড়ে দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল,”জি ভাইয়া।”
“শাইনাকে ডেকে দাও।”
“শাইনা তো কিচেনে নেই।”
তাজদারের কপাল কুঁচকে গেল।
“তাহলে কোথায় যাবে? তুমি দেখে এসেছ নাকি আন্দাজে একটা বলে দিলে?”
তিতলির মুখ চুপসে গেল।
“আমি ওকে কিচেনে দেখিনি।”
“খুঁজে দেখো। বলো আমি ডাকছি। যাও।”
তিতলি দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল আবার। শাইনা পালঙ্কের পেছন থেকে বের হলো তখুনি। তাজদার কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালো। বলল,
“আপনি ওইদিকে লুকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ?”
শাইনা বলল,”হু।”
“লুকোচুরি খেলার ইচ্ছে হচ্ছে?”
শাইনার হাসার অনর্থক চেষ্টা করলো। বলল,
“আপনার সাথে লুকোচুরি খেলে লাভ নেই। কারণ আমি লুকিয়ে পড়লে কারো সাধ্য নেই আমাকে খুঁজে বের করার।”
তাজদার সিদ্দিকী কপালটা আরও কুঁচকে বলল,
“চ্যালেঞ্জ করছো?”
শাইনা তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,”আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না। কপালটা মসৃণ করুন। এভাবে কুঁচকে রাখতে রাখতে কপালটা কুঁচকে যাবে।”
তাজদার নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ওকে ফাইন।”
শাইনা বলল,”আমি আপনার সাথে কোনোপ্রকার চ্যালেঞ্জ নিতে চাই না।”
“নিলে তুমি হারবে।”
শাইনা কুঁচকে থাকা বিছানার চাদর ঠিক করে নিতে নিতে বলল,
“আপনি হারবেন। লুকোচুরি খেলায় আপনাকে আমি জীবনেও জিততে দেব না।”
তাজদার সিদ্দিকী তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
“মানে তুমি বলতে চাইছো তুমি লুকিয়ে যাবে আর আমি তোমাকে খুঁজে পাব না?”
শাইনা তার দিকে ফিরে বলল,”আমি চাইনা এইসব খেলায় জড়াতে। আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
তাজদার এবার ভ্রু বাঁকা করে বলল,
“প্রশ্ন?”
শাইনা সরাসরি প্রশ্নটা করলো,”আপনি কাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন?”
“অফকোর্স নিজেকে। আই লাভ মাইসেল্ফ।”
শাইনা বলল,”আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন যে আপনি ছাড়া অন্য কেউও নিজেকে ভালোবাসতে পারে?”
“অফকোর্স।”
“তাহলে এটাও মাথায় রাখুন আই লাভ মাইসেল্ফ অলসৌ। তাই আমাকে আমার মতো করে থাকতে দিন।”
তাজদার তাকে সমর্থন করে বলল,”এটাই উচিত। মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারেনা।”
শাইনা তার কথাটায় অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। ভেজা কাপড়গুলো হাতে তুলে নিতে নিতে প্রশ্ন করলো,
“মা বাবা তার সন্তানকে, ভাই তার বোনকে, বোন তার ভাইকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারে না বলছেন?”
“পারেনা। স্বার্থ যতক্ষণ ততক্ষণ ওইসব ভালোবাসা মায়া মহব্বত। চোখের সামনেই তো জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আছে।”
শাইনা চট করে তার দিকে ফিরে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“একদম আমার দিকে আঙুল তুলবেন না। আপনি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবেসেছেন যে অন্য কারো দিকে আঙুল তুলে ফেলছেন? আপনাকে ভালোবাসার কথা আসছেইনা এখানে। কিন্তু আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমার মা বাবা ভাইবোন সবাইকে ভালোবাসি। তাদের কষ্ট দিয়ে কথা বললে সেইরাতে আমার ঘুম হয় না। তাদের কথা বাদ দিলাম। আপনার সাথে একটু রুঢ়ভাবে কথা বললে আমার খারাপ লাগে এটার কারণ ভালোবাসা না। মনুষ্যত্ব। যেটা আপনার নেই। আপনার একটা মুখ আছে। ওটা দিয়ে আপনি যাকে তাকে যা ইচ্ছা বলে দিতে পারেন। আপনি ভেবে নিয়েছেন যে আপনি সারাজীবন এভাবে গর্জন তর্জন করে সবাইকে সোজা করে রাখতে পারবেন। আপনি মনে করেছেন এটা আপনার জিত। আসলে এটা আপনার হার। আপনি প্রতিনিয়ত সবার কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে গেছেন, যাচ্ছেন, ভবিষ্যতেও যাবেন।”
তাজদার খুব সাবলীলভাবে প্রশ্ন করলো,
“আমার মনুষ্যত্ব নেই?”
শাইনা বলল,”অভাব আছে।”
“মনুষ্যত্ব নেই তাই আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসিনা?”
শাইনা বলল,”আমি আপনার সাথে এই টপিকে আর কোনো কথা বলতে চাইনা।”
তাজদার তার হাত ধরে ফেলে বলল,”ভালোই তো লাগছে। এসো আরও কথা বলি।”
বলেই শাইনার হাত থেকে সব কাপড়চোপড় নিয়ে বিছানার উপর রেখে দিল। শাইনা বলল,
“আরেহ কাপড়গুলো ভেজা।”
“হোক।”
বলেই শাইনাকে নিজের মুখোমুখি বসিয়ে দিল সে। বলল,”অলরাইট, কথা ছিল ভালোবাসা নিয়ে।”
শাইনা বলল,”কচু নিয়ে। আপনার মুখে একদম যাচ্ছেতাই লাগছে শব্দটা। কারো মুখে একটা শব্দ এত বিচ্ছিরি শোনাতে পারে আপনাকে না দেখলে সেটা বুঝতাম না।”
তাজদার তাকে ধমকে বলল,”শাইনা মমতাজ চুপ করে বসো। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।”
শাইনা চুপ করে বসে বলল,”বলুন। সময় বিশ মিনিট।”
তাজদার তাকে প্রশ্ন করলো,
“আমি তোমাকে চাই এইটা কি?”
শাইনা সোজাসাপ্টা বলল,”মোহ। যা খুব শীঘ্রই শেষ হতে যাচ্ছে।”
তাজদার জানতে চাইল,”তারপর ফলাফল?”
“আমাকে খুব বিরক্ত লাগবে। যারা কাউকে ভালোবাসেনা তারা অন্যের প্রতি বেশিদিন মুগ্ধতা ধরে রাখতে পারেনা।”
তাজদার তার দিকে সরু চোখে তাকালো। শাইনা বলল,”একদম এভাবে তাকাবেন না। আমি এইসব পছন্দ করিনা।”
বলেই সে চলে যাচ্ছিল। তাজদার তার হাত ধরে তাকে মুখোমুখি এনে বলল,
“আমার কি মনে হয় জানো শাইনা মমতাজ? তোমার প্রতি আমার মুগ্ধতা কমার বদলে আরও বেড়ে যাবে। এটা অবশ্য আমার জন্য খুব খারাপ হবে।”
শাইনা বলল,”আমাকে কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় আর সাদাচুলে দারুণ দেখাবে তা আমি জানি।”
“ওহ নো শাইনা মমতাজ, তুমি বুঝতে পারছো না। এখানে একটা ক্রিটিক্যাল ব্যাপার আছে।”
শাইনা ব্যস্ত স্বরে বলল,”আপনার মতো আইনস্টাইনের সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। আমার অনেক কাজ।”
তাজদার এবার রেগে গিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”
শাইনা শান্ত হয়ে বসে বলল,”বলুন।”
তাজদার সোজাসাপটা তার জবাব তার বক্তব্য পেশ করলো,”আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
শাইনা রেগেমেগে বলল,”তো এতক্ষণ কার সাথে বলছেন বাবুমশাই?”
তাজদার সিদ্দিকী ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
শাইনার নাকে ঠোকা মেরে বলল,
“তুমি একদিন বুড়ি হবে। লাঠি হাতে নিয়ে ঠকঠক করে হাঁটবে। সেদিনও আমায় বাবুমশাই বলে ডাকবে। ফাইনাল।”
শাইনা বলল,”কি চালাক! আপনার কি মনে হয় আমার অত ধৈর্য হবে আপনাকে অতদিন ধরে সহ্য করার? আমার তো মনে হয় আপনার অত্যাচারে অত্যাচারে আমি অকালেই মরে যাব।”
তাজদার ভাবুক হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। মরে যাওয়া এত সহজ? এত বড় একটা কোন লজিকে, কোন এঙ্গেল থেকে এই ধরণের কথা উচ্চারণ করে?
সে চট করে তাকালো শাইনার দিকে। চোখ সরু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“শাইনা মমতাজ তুমি আমায় এখনো চেনো না।”
শাইনা সাহসী হয়ে উঠলো। বলল,”কি চিনিনা?”
তাজদার বলল,”তাজদার সিদ্দিকী চায় না তাকে কেউ ভালোবাসুক কারণ সে কাউকেই ভালোবাসেনা।”
“তারপর?”
“কিন্তু সে যদি চায় কাউকে সে ভালোবাসবে। এবং তাকে কেউ ভালোবাসুক। তাহলে এটা অসম্ভব কিছু নয়। মেজারমেন্ট হবে ইকুয়াল ইকুয়াল।”
শাইনা বলল,”ভালোবাসলে সব উজাড় করে দিতে হয়। ক্যালকুলেট করে ভালোবাসা হয় না বাবুমশাই। এটা আমার কথা না। এটা চরম সত্য। আপনার এই মেজারমেন্টের ভালোবাসাকে আমি নিকুচি করি।”
তাজদার চ বর্গীয় শব্দ করে বলল,
“তোমাকে আমি অন্যভাবে বোঝাই। শোনো ভালোবাসা একতরফা হলে সেটা লেটেন্সি। অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু দু’জনের মধ্যে যখন ভালোবাসা মিলে যায় তখন সেটা হাই অ্যাভেইলেবিলিটি কানেকশন হয়ে যায়।
যদি একজন চায় সে কাউকে ভালোবাসবে আর সেই মানুষটিও চায় তাকেও ভালোবাসা হোক তাহলে এটা কোনোভাবেই অসম্ভব নয়। কারণ সত্যিকারের প্রেমের আর্কিটেকচারে, সম্পর্কের মেট্রিক্স শুধু তখনই পার্মানেন্ট হয় যখন দু’জনের ফিলিংস ইকুয়াল ইকুয়াল হয়। ধরো দুজনেই ভালোবাসছে সেই মুহূর্তেই লোড ব্যালেন্স হয় সমানভাবে, দুজনের মনেই ডাটা রিপ্লিকেট হয়, আর প্রেম একেবারে ফেইলওভার-প্রুফ।
শাইনা তার এত লজিকের আগামাথা না বুঝে চলেই যাচ্ছিল।
তাজদার তার বেণীটা ধরে ফেললো। শাইনা মাথার পেছনে হাত চাপলো। বলল,”এগুলো রীতিমতো টর্চার মিস্টার তাজদার সিদ্দিকী।”
“যতদিন না মোহ কাটবে ততদিন পর্যন্ত এই টর্চার চলতে থাকবে। বলেই সে শাইনার বেণীটা তার শার্টের বোতামে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে মুড়িয়ে দিল। শাইনা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কাজ দেখতে লাগলো।
তাজদার নিজের কাজ শেষ করে সোজা শুয়ে পড়লো। শাইনা তার বুকের উপর ঝুঁকে চুলগুলো ছাড়াতে লাগলো। তারপর রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনার এইসব বাঁদরামিগুলো যদি সবাইকে দেখাতে পারতাম!”
তাজদার মাথার পেছনে দু-হাত রেখে আরাম করে শুয়ে বলল,
“সবাই বলতো এমন স্বামী ঘরে ঘরে হোক।”
শাইনা বলল,”জি না। বলতো, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।”
তাজদার ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,”অবশ্যই বলতো কারণ তাজদার সিদ্দিকীকে তো একমাত্র শাইনা মমতাজই ডিজার্ভ করে। অন্যরা না।”
শাইনা বলল,”এইসব কথায় মোটেও আমি খুশি হচ্ছিনা।”
“আমি খুশি হওয়ার মতো কোনো কথাই এখনো বলিনি মমতাজ। তুমি আমার ডেডিকেশন লেভেল সম্পর্কে জানো না। আমি যদি তোমার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগে পড়ি না? তোমার বাঁচার সুযোগ নেই। অল্পতেই তুমি হাঁপিয়ে উঠেছ।”
শাইনা বিরক্ত হয়ে বলল,”আমি কিন্তু বোতামগুলো সোজা ছিঁড়ে নেব।”
তাজদার বলল,”তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি ঘুমাই।”
শাইনা চুলটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাজদারকে জোরে একটা চিমটি কেটে নেমে যাচ্ছিল দ্রুত। তাজদার তাকে একটানে নিচে ফেলে দিয়ে গায়ের উপর উঠে এসে বলল,
“আমি তোমাকে লন্ডনে নিয়ে যাবই।”
শাইনা বলল,”যদি কখনো মেজারমেন্ট ইকুয়াল ইকুয়াল হয় সেদিন আপনি নিজেই এই সিদ্ধান্ত থেকে নিজেই সরে আসবেন।”
তাজদার বলল,”তুমি আমাকে খুব এড়িয়ে চলতে চাও শাইনা মমতাজ।”
শাইনা বলল,”যাতে এড়িয়ে না চলি তার জন্য রিসার্চ করুন। দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।”
তাজদার তাকে বলল,”আমার রিসার্চ কখনো ফেল হয়নি। এবারও হবে না।”
শাইনা বলল,”অল দ্য বেস্ট।”
তাসনুভা ফিটফাট হয়ে সেজেগুজে বেরোচ্ছিল। উঠোনে তাজদারকে দেখে আর বের হলো না। তিতলিকে বলল, ভাইয়া চলে গেলে আমাকে এসে বলবে।
তিতলি বলল, ভাইয়া এত সহজে যাবে না।
তাসনুভা ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। বন্ধু বান্ধব সবাই ফোনের উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে। তৌসিফ এসে তার ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
“সেজেগুজে এটা যাচ্ছে কই?”
তাসনুভা বলল,”একটু দেখো না মেঝ ভাইয়া সরেছে কিনা।”
তৌসিফ তার হাতের ফুটবলটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলল,”আমরা সবাই ফুটবল খেলছি। ভাইয়া ওখানেই থাকবে।”
তাসনুভা রওশনআরাকে গিয়ে বলল,”আম্মু একটু নিচে আসো। আমি উঠোন পার হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে।”
রওশনআরা প্রথমেই শুনলো না কথা। তাসনুভা জোরাজোরি করে নিয়ে এল। তাসনুভা ভয়ে ভয়ে উঠোনে পা রাখলো।
গোটা বাড়িজুড়ে বাচ্চা কাচ্চা ছেলে পেলে যারা আছো সবাইকে নিয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলছে তাজদার। প্যান্ট গোড়ালির উপর তুলে পায়ে পায়ে ফুটবলটা গোল দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখুনি তাসনুভাকে দেখলো সে। আঙুল তুলে ডাকল,
“এই এই নুভা!”
তাসনুভা চমকে গেল। মনে মনে বললো, উফ! সে ভাইয়ের দিকে ফিরলো ধীরেধীরে। তাজদার ফুটবলটা তৌসিফের দিকে ঠেলে দিয়ে হেঁটে হেঁটে এল তার সামনে। বলল
“তুমি যাচ্ছ কোথায়?”
“গেট টুগেদারে।”
“ঝড়ের দিনে তোমাকে বেরোতেই হবে?”
তাসনুভা মৃদুস্বরে বলল,”সন্ধ্যার আগেই চলে আসবো ভাইয়া।”
তাজদার কাঠকাঠ গলায় বলল,”নো ওয়ে। তোমাকে বিকেলে থাকতে হবে। আমার একটা স্যার আসবেন।”
“স্যার?”
“কোনো প্রশ্ন না। যেটা বলছি সেটা করো। ভেতরে যাও। তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। যাও!”
শেষের কথাটা গর্জে বলল তাজদার। তাসনুভা সোজা ছাতাটা বন্ধ করে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ব্যাগ ছুঁড়ে মারলো একদিকে, গায়ের ওড়না ছুঁড়ে মারলো অন্যদিকে, চুলের উপর আটকানো চশমাটা ছুঁড়ে মারলো একদিকে, ছাতা ছুঁড়ে মারলো অন্যদিকে। চেঁচাতে চেঁচাতে বলল,
“ঘরবন্দী করে রাখবে সবাই আমাকে। অসহ্য! আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি বিয়েশাদি করবো না। আমাকে যদি এইসব ব্যাপারে ফোর্স করা হয় আমি সোজা বাড়ির বাইরে চলে যাব।”
শাইনা তার কান্ডকারখানা দেখে হতভম্ব! তিতলি তার ব্যাগ, চশমা, ওড়না খুঁজে নিতে নিতে বকছে।
“কাজ বাড়াবে সে। আর করতে হবে আমাকে।”
তাসনুভা রাগে দুঃখে চেঁচাচ্ছে রওশনআরার উপর। রওশনআরা তাকে কষে একটা চড় মারলো। বলল,
“বিয়ে তোমার হবেও না। বেয়াদব হয়েছ। সোজা ঘরে যাও।”
তাসনুভা রাগে, অপমানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রওশনআরা শাইনাকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“ডিমটা খাওনি কেন তুমি? ওটা তাজদারের ছিল।”
শাইনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অন্যের না খাওয়া ডিম কেন সে খাবে? সেটা তাজদার সিদ্দিকীর না হয়ে অন্য কারো হতে পারতো। তার জন্য বরাদ্দ থাকবে তাহলেই সে খাবে। নয়তো নয়।
এই ডিম না খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে দশটা কথা রটেছে। সেটা শাইনাদের বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে যে বউ ত্যাড়ামি করে ডিম খায়নি।
সেদিন শুক্রবার ছিল। অফডে থাকায়
আনিসও বাড়িতে ছিল। রান্নাঘরে বসে সে মা দাদীর সাথে কথা বলতে বলতে চা খাচ্ছিল। দাদীর মুখে শাইনার ব্যাপারে সবটা শুনে সে বলল, বেশ করেছে।
শাহিদা বেগম বলল, এসব বলে ওকে লাই দিস না আনিস। তুইও বউ আনতে যাচ্ছিস। তোর বউ আমার সাথে এসব করলে তোর ভালো লাগবে?
আনিস পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তুমি এসব করতে যাবে কেন? ডিম সবার পোচ করবে। না খেলে সেটা পড়ে থাকবে। একজনের না খাওয়া ডিম কেন অন্যজন খাবে? তোমরা মেয়েমানুষরা সহজ কথাটা কেন বোঝোনা?”
অল্প কথায় সে বিরক্তিতে তেঁতে উঠে সেখান থেকে চলে গেল।
আশরাফ এসে মোড়ায় বসলো। সাবিনা জানতে চাইল,”আপনাকে চা দেব?”
“দাও।”
তারপর মাকে বললো,”আনিস ওই মেয়েটার ব্যাপারে কি বললো?”
দাদীমা বলল,”মেয়ের ছবি দেখে বলল বেশি ফরসা। এরকম ফরসা মেয়ে কি করবে। ওই মেয়ে নাকি এখানে এলে সবাইকে বাছবে।”
আশরাফ বলল,”মেয়ের বাপ তো আমার পেছনে চিনেজোঁকের মতো লেগে আছে। ওকে দেখেছে নাকি কোথায়। ছেলের সম্পর্কে খোঁজটোজ নিয়েছে অলিরহাঁটে এসে। সবাই নাকি বলেছে আগে ছেলে ভালো। অনেক কষ্টে বড় হয়েছে। স্বভাব চরিত্র ভালো। এখন আমাকে ফোনের পর ফোন করেই যাচ্ছে…
শাহিদা বেগম বলল,” আনিসকে এইসব বলছি আমি। ও বললো বেশি আহ্লাদ দেখানো মানুষ বিপজ্জনক। মানুষের কথায় সহজে গলে যেওনা আম্মা। আমি আর কি বলব? ওরকম মেয়ে নাকি এই ঘরে এসে সংসার করবে না।”
আশরাফ কথাটাব শুনে হেসে ফেললো। সাবিনাও তার সাথে সাথে হাসলো। বলল,
“মেঝ ভাই মানুষকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মেয়ে আরও বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে।”
শাহিদা বেগম বলল,”ও আশরাফ এটা বাদ দে। একটা মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যামলা চেহারার মেয়ে দেখ। একটু লম্বা চওড়া, চেহারায় শ্রী আছে, দেখতে আদর লাগে অনার্স ডিগ্রি পড়তেছে এরকম কোনো মেয়ে হলেই হবে।”
আশরাফ বলল,”ওকে জিজ্ঞেস করেছ কোনো পছন্দ টছন্দ আছে কিনা?”
“সেকথা তো বলিনি।”
“বলে দেখো। হয়তো মুখে বলতে পারছেনা।”
দাদীমা বলল,”ধুর ওই ব্যাটাকে দিয়ে ওইসব কাজ হবে না। মেয়েমানুষ মানেই ঝামেলা বলা ছেলের কোনো মেয়ে পছন্দ করা থাকবে এইটা আমি মানব না।”
শাইনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঠোনে খেলাধূলা দেখছিল। খেলতে খেলতে তাজদার দেখামাত্রই হাত নেড়ে ডাকল,
“এই মমতাজ!”
তাজমহল পর্ব ৩১
সবার চোখ শাইনার দিকে ঘুরে গেল। শাইনা লজ্জা পেয়ে গেল। তাজদার হাতের ইশারায় বলল,
“নেমে এসো। তোমাকে একটা গোল খাওয়াই।”
শাইনা রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল।