তাজমহল পর্ব ৪১

তাজমহল পর্ব ৪১
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

এরিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। শাইনা একটু একটু করে আইইএলটিএস প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এতে তার দায়সারাভাব দেখা যায়নি। সে সিরিয়াস ছিল।
তার কেন যেন মনে হচ্ছিল দেরী করলে আইইএলটিএস প্রস্তুতিটা নেওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। মেন্টর হিসেবে তাজদার সিদ্দিকী বেশ অবদান রাখছে। শাইনাকে ফুলটাইম সাপোর্ট দিচ্ছে। আর তার বিশ্বাস মমতাজ ভালো করবে।
রওশনআরা আর তাজউদ্দীন সিদ্দিকী এতে অবশ্য খুশি নেই। উনারা চান শাইনা তাদের সাথে থাকুক। কয়েকটা বছর যাক। তারপর না হয় যাবে।

শাইনার হয়ে তিতলি বলেছে, ও আইইএলটিএস দিচ্ছে মানে এই নয় যে চলে যাবে।
শাইনা তেমন কিছু বলেনি। কোনো আশ্বাস দেয়নি, হতাশজনকও কিছু বলেনি।
তাজদার সিদ্দিকী BJIT সফটওয়ার ফার্মে ক্লাউড প্রোজেক্টে কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেছে সম্প্রতি। যতদিন দেশে আছে ততদিন সেখানে কনসালটেন্ট হিসেবে সেখানে থাকবে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। শাইনাকে গাইড করে। সে আসার আগেই শাইনা রান্নাবান্নার কাজবাজ সেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। নইলে ওই লোকটা আসার পর থেকে শুরু করে ডাকাডাকি। শাইনা এটা দাও, ওটা দাও, এটা করো, ওটা করো। এত ডাকাডাকি শুনলে সবাই বাঁকা চোখে তাকায়। শাইনার খুব লজ্জা লাগে। তারা তাদের ছেলেকে তো কিছু বলেনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঝিমলি যেহেতু বেশি অসুস্থ। রান্নাটা শাইনাকেই করতে হয়। তিতলি সাহায্য করে মাঝেমধ্যে। তাসনুভা রান্নাঘরেই আসে না। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ঘরে বসেই সব তিতলিকে অর্ডার করে। সে চট্টগ্রাম শহরে একটা বুটিক শপ দিয়েছে। ওটা নিয়ে এখন বেশ ব্যস্ত। টিম নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
দুই ভাই আর বাবার কাছ থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা নিয়ে বিজনেসটা শুরু করেছে। রায়হান আর তাজদার খুশি আছে। ও নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে যখন বিয়ে করবে বলছে তখন তাই হোক। তাসনুভা এতে ভীষণ খুশি। সে চেষ্টা করছে নিজেকে সংযত রাখার। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে তার কাজে বাঁধা আসে। খুব সতর্কতা অবলম্বন করে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলছে সে। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বরাবরই ছেলেমেয়েদের নিয়ে গর্ব করেন। এখন তো মেয়েকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই।

তিতলি উনার আদরের। উনি বলেন, আমার ছোট মেয়ে রাজকন্যা। ওর কিচ্ছু করতে হবে না। কেউ রাণীর হালে রাখবে বললে বিয়ে দিয়ে দেব। তিতলির উপর কোনো প্রেশার নেই। জীবন নিয়ে বিস্তর ভাবনা নেই। বিয়ে করে সে সংসারী হবে।
তৌসিফও আর কিছুদিন পর হয়তো দেশ ছাড়বে। ক্যারিয়ারে মনোযোগী হবে। মা বাবা এখন জোর করলেও সে অতটা মনোযোগী হতে পারছেনা। জীবনটা এভাবে হেসেখেলে পার করা গেলে কতইনা মজা হতো! কর্পোরেট জবের ব্যস্ততা তার ভয় লাগে। রোবোটিক জীবনযাপন তার পছন্দ নয়।
শাইনাদের বাড়িতে আনিসের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় চলছে। শাইনাকে নাইওর দেওয়ার কথা বলেছিলেন শাহিদা বেগম। তাজদার বলেছে ওর মনোযোগ সরে যাবে। আইইএলটিএসটা দিক আগে। তারপর যা করার করবে।

দুপুরে একটু ভাতঘুম দিয়েছিল শাইনা। স্টুডেন্টরা পড়তে আসে আছরের নামাজের পরপর। শাইনার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। সে চোখ খোলামাত্রই দেখলো সবাই ভালো ছেলেদের মতো পড়ছে। শাইনা অবাক!
সে একটু সরলেই যারা মাছের বাজার বসিয়ে ছাড়ে তারা আজ এত ভালো কি করে?
পরক্ষণেই তার ভুলটা ভাঙলো একটু দূরে রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে বসে থাকা তাজদার সিদ্দিকীকে দেখে। অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ভেসে উঠলো। সবাই ঠিক মাস্টারের হাতে পড়েছে দেখছি!
তাজদার হঠাৎ চোখ মেললো। শান্ত ভাবে তাকালো শাইনার দিকে। শাইনা ততক্ষণে চোখ বুঁজে ফেলেছে। তাজদার একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। শাইনা কিছুক্ষণ পর বামচোখটা ধীরেধীরে খুললো ডানচোখটা বন্ধ রেখে। ধরা পড়ে গেল সাথে সাথে। তাজদার সিদ্দিকী ঠোঁটের কাছে হাত রেখে হাসলো বোধহয়! শাইনার এত লজ্জা হলো যে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ধুর!

তাজদার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো। সবার খাতা দেখলো। পড়া দাগিয়ে দিল। ওরা সবাই চলে যেতেই তাজদার শাইনার পাশে এসে বসলো। শাইনা আঁড়চোখে তাকে দেখলো। তাজদার তাকে ডাকলো না। শুধু বসে রইলো। শাইনা তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। মায়া লাগলো। নিশ্চয়ই এখনো কিছু খায়নি। আহারে বেচারা!
নিজের ঘর অথচ নিজে রান্নাঘর থেকে এনে খেতে পারেনা। কি অসহায় পুরুষ মানুষ। শাইনার ভারী মায়া হলো।
সে ধীরেধীরে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে শুলো। তাজদার তার দিকে তাকালো। শাইনা বলল,

“কখন এসেছেন?”
তাজদার বলল,”অনেক আগে।”
“কত আগে?”
“যত আগে এলে খিদে লাগে।”
যেটা ভেবেছে ঠিক সেটাই। শাইনা আরও খোঁচালো।
“দুপুরে খাওয়া হয়নি?”
“খেয়েছি। সেগুলো পেটে থাকার কথা না।”
“তিতলিকে ডেকে বলুন কিছু নিয়ে আসতে।”
“তিতলি নেই।”
“আপনি একবারও ডেকেছেন? আন্দাজে বলছেন না?”
তাজদার মাথার পেছনে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“তিতলিকে আমি বলতে পারবো না।”
“কেন পারবেন না?”
“তিতলি আমার কাজ করবে কেন?”
“কারণ আপনি ওর ভাই।”

“বউ থাকলে বোনরা ভাইয়ের সেবা করে না। তিতলি তার ব্যতিক্রম হবে কেন?”
শাইনা ঠোঁটের কোণা হাসির রেখা টেনে বলল,”তিতলিকে আমি গিয়ে বলছি কিছু নাশতা পাঠাতে।”
বলেই শাইনা বেরিয়ে যাচ্ছিল। দরজার কাছে এসে ঘাড় ফিরিয়ে তাজদারের দিকে তাকালো। মুখটা দেখে এত হাসি পেল শাইনার। হায় হায় এটা কোন তাজদার সিদ্দিকী?
তিতলিই নাশতা নিয়ে এল। ঘরে ঢুকে বলল,”কফিটাও নিয়ে আসি ভাইয়া? শাইনার নাকি হাঁটতে ভালো লাগছেনা।”
তাজদার মাথা নাড়লো। তিতলি ট্রে রেখে চলে যাচ্ছিল তখুনি তাজদার জানতে চাইল,
“শাইনাকে বলবে জরুরি কথা বলার জন্য ডাকছি। কষ্ট করে হলেও যেন আসে।”
শাইনা তার কফিটা নিয়ে এল। টেবিলে মগটা রেখে শক্ত হাতে চেপে ধরে রাখলো। চোখ বুঁজে রাখলো। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। হাত পা কেমন অবশ অবশ লাগছে। কানের ভেতর অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। পেট গুলিয়ে বুকের কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আছে।
তাজদার কপাল কুঁচকে তাকালো তার দিকে। ধীরেধীরে ডাকল,

“শাই…না?”
শাইনা ওভাবে মগটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাজদার আবারও ডাকলো,
“মমতাজ?”
সে এবার দাঁড়িয়ে পড়লো। শাইনার পেছনে এসে দাঁড়াতেই শাইনা হঠাৎ করে তার দিকে ফিরে বুকের সাথে মাথাটা লেপ্টে দিল। তাজদার হকচকিয়ে গেল! শাইনা গায়ের ভার ছেড়ে দিয়েছে! তাজদারের আপাদমস্তক জমে গেল।
তাজদারের কথা অনুযায়ী ডাক্তার নিয়ে এল তৌসিফ। ডাক্তার তাজদার ছাড়া ঘরে কাউকে অ্যালাউ করেনি। কারণ তাজদার চায়নি।

ডাক্তার তাকে ইনিয়েবিনিয়ে বার্তা দিল যে, আপনার ওয়াইফ সন্তানসম্ভবা হতে পারে। কাল একবার চেকআপ করিয়ে আনবেন। অন্য কোনো অসুস্থতা দেখছিনা।
তাজদার সিদ্দিকী ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল কেন যেন। সে অবশ্যই খুশি হয়েছে এতে। কিন্তু আর কাউকে খুশি হতে দেয়নি। সে ডাক্তারকে বলেছে বিষয়টা গোপন করতে। উনার অভিজ্ঞতা তো আর ভুল হতে পারেনা।
ডাক্তার চলে যেতেই তাজদার ঠোঁটের কাছে হাত রেখে ভাবুক দৃষ্টিতে শাইনার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

তাজমহল পর্ব ৪০

যদি সত্যি সত্যি এটা হয় তাহলে একথা কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু নিজের গর্ভে একটা বীজ বেড়ে উঠছে সেটা শাইনা বুঝতে পারবে না? না, তাকে কিছু একটা করতে হবে। বুঝতে দেওয়া যাবে না। শাইনাকে সে শর্ত দিয়েছিল। বেবি নয়তো লন্ডন যাত্রা।
তাকে কিছু একটা করতে হবে। শাইনা না জানার জন্য তাকে যা যা করতে হয় সে তাই তাই করবে।

তাজমহল পর্ব ৪২