তাজমহল পর্ব ৪৬
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনা কাপড়চোপড় গোছগাছ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তিতলি এসে বলল,”আর কখন আসবে? তুমি না থাকলে ভালো লাগেনা।”
শাইনা একটু ভেবে বলল,”অনেকদিন পর গিয়েছি। কিছুদিন থাকবো।”
“তাড়াতাড়ি চলে এসো। ব্যাগটা আমাকে দাও।”
“না থাক, আমি পারবো।”
শাইনা তিতলিকে ব্যাগটা দিল না। নিজেই নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় রওশনআরা দেখা করে যেতে বলেছে। শাইনা রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দাদীমা তাকে দেখে বলল,
“এসো।”
শাইনা ভেতরে গেল। রওশনআরা তার দিকে ফিরে বলল,”তাজ তোমাকে ফোন করেছে?”
“না।”
“তুমিও করোনি?”
প্রশ্নটা জোহরা বেগম করলেন। শাইনা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,”না।”
“তুমি আইইএলটিএস পরীক্ষা ঠিকই দিয়েছ বরের কথায়, পাসপোর্টও বানাতে দিয়েছ, ভিসাও হয়ে যাচ্ছে। তলে তলে সব তো ঠিক করেই রেখেছ। যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত। আবার তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে অন্য কথা বলেছ কেন? মানে বরকে এককথা বলে রেখেছ, আবার শ্বশুর শ্বাশুড়ির মন পাওয়ারও চেষ্টা করছো। এখন হুট করে যাবে না বললে তাজ রেগে যাবে না তো কি করবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাইনা রওশনআরার দিকে তাকালো।
উনি মশলা কষাচ্ছেন একমনে। শাইনা জোহরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমি যাব না একথা বড়আম্মুকে কখনো বলিনি।”
“কি আশ্চর্য কথা! তুমি পড়াশোনা ছাড়তে পারবে না বলেছিলেনা? আবার যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছ। তোমার কোন কথাটা বিশ্বাস করবো?”
শাইনার ভেতরে ভেতরে খুব রাগ হচ্ছে। সে দাদীমার দিকে তাকাতেই দাদীমা বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও।”
তবে শাইনা একটা জবাব দিয়েই দিল।
“আপনাদের ছেলের কথা বিশ্বাস করবেন। আমি যাব না বলেছিলাম। কিন্তু সেই কথাটা আপনাদের ছেলে মূল্যায়ন করেনি। উনি আমাকে এখানে পড়তে দিতে চান না। পরে ভাবলাম ওখানে গিয়ে কিছু একটা করবো তাই পরীক্ষাটা দিয়েছি। বড়আম্মু চায় না আমি যাই তাই আমি বড়আম্মুকে সরাসরি কিছু বলিনি। ভেবেছি আপনাদের ছেলেই বলবে। কিন্তু এই বাড়ির মানুষ নিজেরাই নিজেদের সাথে কথা বলেনা ভালো করে। আপনারা বলছেন এককথা, আপনাদের ছেলে বলছে এককথা। আমি কোনদিকে যাব?”
রওশনআরা এবার মুখ খুললেন। বললেন,
“তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। আগে যাবে ভেবেছিলে ভালো কথা। এখন বাচ্চা চলে এসেছে আর যেতে পারবে না।”
“সেটা আমাকে না বলে উনাকে বললে ভালো হয়।”
“তুমি বলবে কারণ তোমার অসুবিধা হবে ওখানে থাকতে।”
শাইনা আর কিছু বললো না। শুধু অসুবিধা কেন, যদি ওখানে তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে থাকে তাহলে মৃত্যুর স্বাদটা নেওয়ার জন্য হলেও সে সেখানে যাবে।
ব্যাগটা নিয়ে সে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলো,
কি সেয়ানা মেয়ে। তলে তলে সব ঠিক রেখে এখন আমাদের দেখাচ্ছে সে যেতে চায় না। সবাইকে হাতে রাখতে জানে।
দাদীমা বললেন, বাদ দাও। এসব আর বলো না। ও এখনো যায়নি শুনলে আবার তাজের কানে উঠবে।
বাড়ি গিয়ে শাইনা ব্যাগটা বিছানায় রেখে শুয়ে পড়লো ফ্যানটা ছেড়ে। পুরো শরীর ঘেমে উঠেছে। শাহিদা বেগম এসে ডাকাডাকি করলেন,
“আলু ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খাবি বলেছিলি। খাবি না? ও শানু?”
শাইনা ওভাবে শুয়ে থেকে বলল,”যাচ্ছি, তুমি যাও।”
শাহিদা বেগম চলে যেতে গিয়েও আবার থামলেন। বললেন,”ওই বাড়ি গেলি। কেউ কিছু বলছে?”
“না।”
“আচ্ছা তাহলে আয়। জামাই ছিল না বাড়িতে?”
“না।”
“ওহ, শুনলাম ভিসার কাগজপত্র নিয়ে দৌড়ের উপরে আছে। আচ্ছা আয়।”
শাইনা কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে গেল। আলু ভর্তা চটকে পান্তা ভাত খেল। ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেগুলো উগরে দিল বাড়ির পেছনে বের হয়ে। দাদীমা বললেন,
“খোদা গোটা এলাকা কাঁপছে তোর ওয়াক ওয়াক শুনে।”
শাহিদা বেগম বললেন,”আম্মা ফালতু কথা বইলেন না তো। মেয়েটা দম নিতে পারতেছেনা।”
শাইনা পুকুরঘাটে নেমে মুখে পানির ঝাপটা দিল। কুলি করলো। মাথায় পানি দিল। পুকুর পাড়ের থাকা লেবুগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিল। শাহিদা বেগম বলল,”ভেতরে আয়।”
শাইনা গেল না। ঘাটে বসলো। ঠান্ডা বাতাস আছে এখানে। ভালো লাগছে। শাহিদা বেগম বললেন,
“এভাবে চুলের আগা খোলা রেখে ওখানে বসে থাকিস না শানু।”
শাইনা পুকুরের পানির দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ তুলে শাওন ঘাট বেয়ে নেমে এল। শাইনার পাশে ধপ করে বসে পড়লো। হাতে কতকগুলো আচারের প্যাকেট।
শাহিদা বেগম চেঁচাচ্ছেন,”ওকে দোকানের আচার খেতে দিবিনা শাওন। ফ্রিজে আছে আচার।”
শাওন বলল,”বার্মিজ বরই আচার। এগুলো ভালো। তুমি বেশি কথা বলো আম্মা। চুপ থাকো।”
শাইনা আচারের প্যাকেটগুলো নিল। শাওন বলল,”দে ছিঁড়ে দেই।”
শাইনা দিতে চাইলো না।
“তুমি খেয়ে ফেলবে।”
শাওন কেড়ে নিয়ে দাঁত দিয়ে প্যাকেট ছিঁড়ে দিতে দিতে বলল,”তোর জন্য একটা সুখবর আছে।”
শাইনা প্যাকেট কেড়ে নিয়ে বলল,”কি?”
শাওন দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল,”তোর জন্য একটা ভাবি ঠিক করেছি।”
শাইনা মুখ হাঁ হয়ে গেল।
“কি?”
শাওন চোখ টিপে বলল,”হ্যাঁ।”
শাইনা ধুম করে কিল বসিয়ে বলল,”মিথ্যে কথা।”
“আহা মারছিস কেন? সত্যি। সুন্দর আছে। ছবি দেখবি?”
“মেঝ ভাইয়া এখনো বিয়ে করেনি আর তুমি…
“বিয়ে তো এখন করছিনা। আজব আর কতদিন সিঙ্গেল থাকবো?”
“ছবি দেখাও।”
শাওন ছবি দেখালো তাকে। শাইনা ছবিটা দেখে হাসলো। বলল,
“সুন্দর! আমার বয়সী?”
“হ্যাঁ।”
“আম্মাকে বলবো?”
“সোজা ঘর থেকে বের করে দেবে। মেঝ বিয়ে করুক তারপর ওকে নিয়ে আসবো।”
“অ্যাহ শখ কত? চাকরি ছাড়া ওর বাবা তোমার হাতে মেয়ে দেবে?”
“আমার বউ কি গোটা দুনিয়া খাবে? ওর ভাতের অভাব হবে না। শোন ওকে বলে দিয়েছি। তোমার বাপকে বলে দেবে যৌতুক হিসেবে আমার বাইক চাই। আর কিচ্ছু লাগবে না।”
বলেই হা হা করে হাসলো শাওন। শাইনা তার সাথে সাথে হাসলো। বলল,”তুমি বেকার জেনে কিছু বলেনি?”
“বেকার আবার কি? যারা সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমায় তাদের বেকার বলে। আমি সারাদিন দৌড়ের উপর থাকি। ঘরের বাজার সদাই করি। বোনের সেবা করি। বাপ ভাইদের কথা মেনে চলি। এগুলো কি কাজ নয়?”
শাইনা ফিক করে হেসে উঠে বলল,”পাগল। শোনো তোমার বিয়েতে আমি খুব মজা করবো। আমাদের বাড়ির শেষ বিয়ে তোমার। চাকরি বাকরি কখন হবে?”
“তোর বরকে বলিস আমাকে একটা চাকরি বাকরি দিতে।”
শাইনা চুপ হয়ে গেল। শাওনা তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,”ওই?”
শাইনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসলো। ছোট ভাইয়ার চোখে সব কত সহজ। সে কেন এত সহজ করে সব ভাবতে পারেনা? ও ভাবে বিয়ের পর বউ ওর এইসব অভাব স্বভাব মেনে নেবে। কিন্তু আসলেই মানবে? শাইনা চায় তার ভাই সবসময় এমন হাসিখুশি, ছটফটে থাকুক।
“কিরে মুড অফ হয়ে গেল কেন? আচ্ছা এসব কথা বাদ দে। তুই বিদেশ চলে যা। ওখান থেকে বাইক পাঠাস একটা।”
বলেই আবারো হো হো করে হাসলো শাওন।
শাইনা এবার রেগে গিয়ে বলল,”এভাবে হাসবে না সবসময়। এত বেশি আশা রাখা ভালো না। আমি কত কি ভেবেছিলাম। কিছুই হয়নি। তুমি যা ভেবে রাখছো তার কোনোকিছুই হবে না।”
শাওন হাসি থামিয়ে বলল,”চাকরি হবে না বলছিস? আচ্ছা বেশ তোর বড়লোক বরকে বলিস আমাকে কয়েক লাখ মামু দিতে। ব্যবসা করবো।”
শাইনা আশ্চর্য হয়ে বলল,”তুমি কি বলছো তুমি নিজেও জানো না। আমি কোনোদিন উনার কাছ থেকে একটা টাকাও চাইনি।”
“চাসনি কেন?”
শাইনা জবাব দিতে পারলো না। শাওন বলল,
“চেয়ে নিবি। মুখে বলতে লজ্জা লাগলে কাগজে লিখে দিবি। মাসে মাসে হাত খরচ নিয়ে নিবি। বড় ভাই ভাবিকে দেয় দেখিস না? তোর যেটা মন চায় সেটা বলে দিবি।”
“কথার দাম না পেলে তখন? যদি লজ্জা দেয়?”
“বউয়ের কথার দাম দেবেনা তো কার কথার দাম দেবে? নিজ থেকে না দিলে নিজেই নিয়ে নিবি। আর তোর বরের পয়সা বেশি। সবাই তাই তোকে তাদের কথায় নাচাতে চাইবে। হাতে রাখতে চাইবে। নিজে যেটা ভালো মনে করবি ওটা করবি।”
“আমি যদি তোমার মতো হতাম হেলেদুলে বেড়াতাম। কোনোদিন বিয়েশাদি এইসব করতাম না। তোমার জীবনটাই আনন্দের।”
“তোর মাথা। যদি কেউ আমার দায়দায়িত্ব নিতো আমি তার কোলে উঠে বসে থাকতাম। পুরুষ মানুষের জীবন অনেক কঠিন। আমি এভাবে চাকরি বাকরি না পেলে দেখবি একটা সময় গিয়ে নিজেকে নিজের বোঝা লাগবে। তাজ ভাই তোকে ফোন দেয়নি?”
“না, সামনে যেতে বারণ করেছে। বাদ দাও। এগুলো নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।”
“তুই চলে আসায় রেগে গেছে মনে হয়।”
“রাগ করেনা কখন? পায়ের নখ থেকে মাথার চুল রাগ দিয়ে ভর্তি। এত উগ্র মানুষের হাতে তোমরা আমাকে কি করে তুলে দিলে জানিনা।”
“তোকে তো পছন্দ করে বিয়ে করেছে। বহুত খাটুনি করেছে। তৌসিফ বলেছে আমাকে। কেউ রাজী ছিল না ওই বাড়িতে। বড় আব্বা নাকি বলেই দিয়েছিল এই বাড়ির মেয়ে ওই বাড়িতে তুলবে না। পরে বড়আম্মুর ভাইরা বুঝিয়েছে ছেলের কথা না শুনলে হাতছাড়া হয়ে যাবে। ছোটবেলায় ও কেমন যেন ছিল। আমাদের সহ্য করতেই পারতো না, তাই না?”
শাইনা আস্তে করে বলল,”হু।”
“তোকে কখনো ওসব বলেছে?”
“না।”
“এখন মহিষ কিনতে গিয়েছে মেজবানের জন্য। ও নাকি পছন্দ করে মহিষ কিনবে। রায়হান ভাই আবারো চটে গেছে ওর শর্ত শুনে। পাগল করে ছাড়বে সবাইকে।”
“ফর্সা মহিষ কোথায় পাবে?”
শাওন হেসে উঠলো হো হো করে। শাইনাও তার সাথে সাথে হাসলো। শাওন হাসতে হাসতে বলল,
“তুই ওভাবে পচাস সেটা আমি বলে দেব।”
“বেশ ভালো করেই জানে। তুমি খবরদার এসব কথা বলবে না।”
“তুই বিদেশ যাচ্ছিস তাহলে?”
শাইনা কিছু বলার আগেই শাহিদা বেগম শাওনকে ডাকলেন।
“ও শাওন একটু এদিকে আয় তো।”
তিনি কেমন অস্থির হয়ে উঠেছেন। শাওন ঘাট বেয়ে উঠে গেল। শাহিদা বেগম তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”আনিসকে একটা ফোন দে তো।”
“কেন?”
দাদীমা এসে বললেন,”ওই ব্যাটাকে নাকি মহিষে মারছে। ব্যাটা জানেনা বউয়ের মতো মহিষকে গুঁতা মারতে নেই। বউয়ের শিং না থাকলেও মহিষের শিং আছে।”
শাহিদা বেগম বললেন,”এমন সময় আপনার হাসি পাচ্ছে আম্মা?”
দাদীমা হাসি থামিয়ে দিলেন। উনি ভেবেছেন বেশি আঘাত হয়নি। কিন্তু আফসার সাহেব খবর পাঠালেন খাদ্যনালী পর্যন্ত শিং গেঁথে গেছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। রক্ত লাগবে। শাইনাকে তেমন কিছু বললো না কেউ।
সে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলো তার লিস্টেরই একজন ভিডিও ছেড়েছে একটা পাগলা মহিষ কি বাজেভাবে মারছে একটা লোককে।
শাইনার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। কি আশ্চর্য মানুষ। একটা মানুষকে এভাবে মারছে আর মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটার ভিডিও করছে। সাদা শার্টটা পুরো রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে ভিডিওতে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি দূর থেকে করা তাই লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে স্বভাববশত কমেন্ট বক্সে ঢুকলো। সবাই জিগ্যেস করছে, লোকটা বেঁচে আছে নাকি। গতবছর একটা মহিষ পাগল হয়ে রান্নাঘরে ঢুলে গৃহবধূকে মেরে ফেলেছিল। ওই ঘটনার কথা মনে পড়তেই শাইনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল।
শাইনা ভিডিওটা দেখে শাহিদা বেগমকে ডাকলো,
“আম্মা মেঝ ভাইয়া কি হাঁটে গিয়েছে ওদের সাথে?”
শাহিদা বেগম এলেন,”কেন?”
“ওখানে একটা মহিষ নাকি পাগল হয়েছে। একজনকে মেরেছে খুব বাজেভাবে।”
“আমি ফোন দিয়ে বলছি। তুই ঘুমা। তোর ফোনটা একটু দে তো।”
শাইনা বলল,”দাঁড়াও।”
সে তাজদারের ইনবক্সে রিলসের ভিডিওটা পাঠিয়ে ছোট করে বলল, সবাইকে নিয়ে চলে আসেন।
তারপর ফোনটা দিয়ে দিল মায়ের হাতে।
আনিস ব্লাড ডোনেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান। সে কয়েকজনকে হাসপাতালে আসতে বলেছে রক্ত দেওয়ার জন্য। শাহিদা বেগমকে জানাচ্ছে আপডেট। রক্ত বন্ধ হয়নি এখনো।
কোনো দুঃসংবাদ পেলে যা হয় গ্রামে তাই হয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যে। উঠোন ভরে গেছে মানুষে। একেকজন একেক কথা বলছে। কেউ কেউ বলছে ওই ছেলেটা মা বাপকে বেশি আঘাত দিয়ে কথা বলে তাই বেশি বিপদে পড়ে। এইদিনও নাকি একটা এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গিয়েছিল। মা বাপকে বেশি জ্বালায় ছেলেটা। একদম ছোট থেকে দেখছি। রায়হানের মা এই ছেলেকে নিয়ে শান্তি পায়নি একদম।
কেউ কেউ বলছে শানুকেও দুইদিন পরপর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এজন্যই বলে কথা বলার সময় সংযত হতে হয়। হুঁশ রাখতে হয়। আর ছেলেটা গরিব দুঃখী পছন্দ করেনা। দান সদকা দেয়া পছন্দ করেনা। এইসব না দিলে বিপদ বাড়ে।
কেউ কেউ বলছে, আশরাফের মা’র মেয়েটা অলক্ষুণে। বউ এমন হলে ছেলেদের জীবনটা শেষ।
আবার তাদের মধ্যে তর্কও লেগে যাচ্ছে। শাইনার চাচীরা শাইনার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে। তাজদারের পক্ষের লোকজন তার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে। একজন বৃদ্ধা ধমকে উঠলেন,
“তোমাদের এইসব কথা রাখো। বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকতে হয়। একই বাড়িতে বিয়ে হলে অনেককিছু হয়। এসব শুনলে আশরাফের মা তোমাদের উপর খেপে যাবে। বউ জামাইয়ের মধ্যে যাইহোক। কেউ কখনো কারো খারাপ চায় না। বিপদআপদও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। তোমাদের মুখ বন্ধ করো। আল্লাহকে ডাকো।”
সবাই ক্ষণিকের জন্য চুপ হলেও আবারও নিন্দায় জড়িয়ে পড়লো। রওশনআরা বাড়ির পেছনে বের হয়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে কান্নাকাটি করছেন। তিতলিও কান্না মুছতে মুছতে একের পর এক ফোনে কথা বলছে। শাহিদা বেগম খোঁয়াড়ের মুরগী সদকা দিয়ে দিলেন। এটা ওটা মানত করলেন। সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো তার মেয়েটার হবে।
তিনি বাড়ির বাইরে এসে চোখের জল ফেললেন। দাদীমা ঘরে এসে দেখলো শাইনা ঘুমোচ্ছে। ও সময় অসময়ে ঘুমোয়। দাদীমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
বাড়ির সামনে পেছনে বিয়েবাড়ির মতো আলো জ্বলছে। বাড়ির সামনে দলে দলে মানুষ আসছে খবরটা পেয়ে।
পেছনে রওশনআরা, জোহরা বেগমের শাহিদা বেগমের একদফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। জোহরা বেগম বলল,
“কেমন ত্যাদড় মেয়ে। জামাই ওইদিকে বাঁচে মরে এই নিয়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে সে ঘর থেকে পর্যন্ত বের হলো না। ওর কিছু হলে ওই মেয়েই বেশি খুশি হবে। চোখের সামনে কতকিছু তো দেখলাম।”
শাহিদা বেগম কপালে হাত চেপে ধরে বসে তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,”ওর মাথাটা গিলে খেয়েছে সবাই। জামাইয়ের সাথে শান্তিতে থাকতে দেয়নি কেউ। দুটো কথা বললেও সবাই নজরে নজরে রাখে। আমি জানি সব। কুবুদ্ধি দিয়ে দিয়ে শেষ করে দিয়েছে ওর সংসারটা। ওদের বউ জামাইকে একা বিদেশে যেতে কারা দিচ্ছে না সেটা তো আমি ভালো করে জানি।”
তাজমহল পর্ব ৪৫
রওশনআরা চোখ মুছে নিয়ে বললেন,”আশরাফের মা কি বললে?”
দাদীমা বললেন,”আহা এখন এইসব নিয়ে তর্ক করার সময়? কি শুরু করলে তোমরা?”
শাহিদা বেগম বললেন,”ঠিকই বলছি ভাবি। আপনি ও আপনার কথামতো চলছে তাই জামাইয়ের সাথে এতকিছু হয়ছে। আপনারা তো মা ছেলেরা ঠিক নেই। নিজেদের সম্পর্ক ঠিক নেই আবার আমার মেয়ের দোষ দেয়।”