তুই শুধু আমার উন্মাদনা পর্ব ৪৪
তাবাস্সুম খাতুন
অন্যদিনের তুলনায় আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। প্রতিদিন সকালে বাড়ির কর্তারা নাস্তা করেই নিজেদের অফিসে যাই। আজকে চৌধুরী ম্যানশনের কোন কর্তাই নাস্তা করেনি, খুব ভোরেই অফিসে চলে গেছে। এমনকি নিশান আর জিহান ও সকাল সকাল চলে গেছে। গিন্নিরা নিজেদের মতো নাস্তা শেষ করে কাজে লেগে পড়লো। মিহু, পিহু তাজ নিজেদের স্কুল – কলেজ গিয়েছে। আর তিহান বাইরে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্য গিয়েছে। ড্রইং রুমের সোফায় গোল করে বসে আছে রাত্রি জারা আর সামিয়া। রাত্রি মাথা নিচু করে আছে আর সামিয়া – জারা রাত্রির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এমন অবস্থা যে রাত্রি এক পলাতক আসামি আজ ধরতে পারছে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে পানি হীনা। এমতা অবস্থায় সিমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো ওদের কাছে গিয়ে বসে বললো,,,
“কিরে কি হয়েছে? এইভাবে বসে আছিস কেন তোরা?”
সামিয়া বলে উঠলো,,,
“রাত প্রেম করছে আজ তিন বছর ধরে।”
প্রেম করছে তিন বছর ধরে ‘ এইগুলো শুনে সিমি অবাক চাহুনিতে তাকিয়ে বললো,,,
“কিহহ!”
জারা — “হ্যা ও নাকি আমাদের ফ্রেন্ড অথচ, আমরা জানিই না ও কি আদাও আমাদের ফ্রেন্ড?”
রাত্রি জারার হাত জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,,,
“জান এমন বলিস না। তোরাই আমার ফ্রেন্ড উহুম বেস্ট ফ্রেন্ড।”
সিমি স্বাভাবিক ভাবে বললো,,,
“তোর ব আকার ল এর বেস্ট ফ্রেন্ড আমরা। শুন ছেমরি আমাদের সাথে আর কথা বলবি না যা তোর প্রেমিক কে নিয়ে থাক। যাই হোক ছেলেটা কে? আমি কি চিনি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সামিয়া — “অভি ভাইয়া।”
সিমি আবারো অবাক কণ্ঠে বললো,,,
“আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ নাকের ডগায় প্রেম ধরতে পারলাম না ছিঃ ছিঃ।”
রাত্রি ন্যাকা সুরে বললো,,,
“আমার দিক টা বোঝ তোরা। প্লিজ এমন করিস না আমি তোদের ছাড়া বাঁচবো না।”
জারা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,,,
“তোকে মাফ করবো একটা উপায়ে।”
রাত্রি দ্রুত জবাব দিলো,,
“কি উপায়?”
“তোর প্রেমের শুরুটা কিভাবে হয়েছে গল্প কর আমাদের সাথে।”
রাত্রি লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। সিমি আর সামিয়া ও সাই দিলো বলার জন্য। রাত্রি বললো,,,,
“আমার যখন ১৫ বছর বয়স। তখন আমার বার্থডে অনুষ্টিত হচ্ছিলো প্রতিবার হয়। এইভাবের বার্থডে তে ভাইয়া তার বন্ধুদের নিয়ে আসে একসাথে কাজ করে। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ভাইয়ার সব বন্ধুকে চিনি, কিন্তু হুট্ করে আমার চোখে একজনকে পড়লো আমি চিনতে পারলাম না কারণ ভাইয়ার সব বন্ধুকে চিনি আর তার মধ্যে এই ছেলে নেই তবে কে? ডেকোরেশন এর লোক। তবে হাস্যকর বিষয় ডেকোরেশন এর হোক আর যেই হোক ভাই প্রথম দেখায় টাস্কি খেয়ে গিয়েছিলাম একদম।আমি তো পুরো পাঁচ মিনিট ঐভাবেই তাকিয়ে ছিলাম। পরে ভাইয়া এসে আমাকে ধাক্কা দিলো। আমি ধ্যান ভেঙে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
“ওই ছেলেটা কে ভাইয়া?”
ভাইয়া তার দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“আমার ফ্রেন্ড অভি।”
“আগে দেখি নি তো?”
“ছিলো না এইখানে সেইজন্য।”
“কোথায় ছিলো?”
“বাংলাদেশ এ।”
তারপর আমি আর দাঁড়ায় নি রুমে গিয়েছিলাম।সেইদিনের পর থেকে চুরি করে হলেও অভি কে দেখতাম দিনে একবার করে। এইভাবে চুরি করে দেখার মিশন চলছিল আমার? বছর কেটে গেলো আমার ১৬ বছর হলো যত দিন গেলো অভি কে যেন আমি ভালোবাসতে লাগলাম। একদিন তাকে আড়ালে ডেকে সরাসরি বললাম,,,
“শুনেন আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনি আমাকে পছন্দ করেন হ্যা কি না?”
আমার কথা শুনে উনি বলে উঠলো “হ্যা “তারপর থেকে আমাদের চুটিয়ে প্রেম শুরু হলো সবার আড়ালে। পড়ে জনাতে পেরেছিলাম ও আমাকে ভালোবাসে। ভাইয়ার ভয়ে বলতো না আর যদি আমিও কিছু বলে দেই এইজন্য।কিন্তু আমার ভাই সব জানতো দুঃখ এইটাই।”
রাত্রির কথা শেষ হতে সিমি বলে উঠলে,,,
“বাহ্ বাহ্ রাত বাহ্ কি প্রেম করলি রে তুই?আমাদের বললে তো আমরা ভেঙে দিতাম এইজন্য বলিস নি।”
রাত্রি ন্যাকা সুরে বললো,,,
“জানুরা মাফ করে প্রমিস আর কোনদিন এমন লুকাবো na ভয় পেয়েছিলাম তো।”
সিমি উঠে দাঁড়ালো বললো,,,
“সামু, জারা ওর ক্লাস নে। আমি ফ্রিজ থেকে একটা চকলেট বাহির করে আনি।”
বলে যেতে নিলো কয়েক পা এগোতেই সিমির মাথা ঘুরলো সে নিজের ব্যালেন্স আর রাখতে পারলোনা মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে গেলো। জারা চিৎকার দিলো। ওর চিৎকার শুনে সেলিনা, রোজিনা, কিয়া, মেহেরিমা আসলো এসে সিমিকে পড়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে। গেলো দ্রুত সবাই ধরে তুলে সিমিকে রুমে নিয়ে গেলো। সামিয়া ডাক্তারের কাছে কল দিলো সাথে নিশান কেউ ফোন দিয়ে বললো সিমির হটাৎ মাথা ঘোরার কারণ। সিমির কোন হুস নেই শুয়ে আছে চুপচাপ মাথার মধ্যে ঘুরেই যাচ্ছে সয্য হচ্ছে না। পনেরো মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এসে হাজির হলো মহিলা ডাক্তার। তাকে সিমির পাশে বসতে দেওয়া হলো। এইদিকে সিমির অসুস্থতার খবর শুনে নিশান অনেক দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে আসছে জিহান ও আসছে। তারা দুইজন রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জারা রুম থেকে বের হতেই নিশান বলে উঠলো,,,
“কি হয়েছে ওর?”
“জানিনা একটু আগেই আমাদের সাথে বসে গল্প করছিলো। বললো চকলেট আনতে যাচ্ছি ফ্রিজ থেকে বলে কয়েক কদম যেতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।”
নিশানের তো রাগ হচ্ছে এই মেয়ের আজ দুইদিন ধরে এমন মাথা ঘোরা দেখছে সে। খাবে না কিছু তো কি হবে? অসহ্য এই মেয়ে উঠুক আগে তখন যে ও কি করবে নিজেও জানেনা। এইদিকে ডাক্তার সিমিকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করলো পরে মুচকি হাসি দিলো সবার দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“রুগী আপনাদের কি হয়?”
মেহেরিমা জবাব দিলো,,,
“আমার ভাইজি, আবার ভাইপো বউ। মানে এই পরিবারে ওর মা বাবা, শশুর শাশুড়ি ফুফা ফুফি সবাই আছে। কি হয়েছে আমাদের মেয়ের কোন খারাপ কিছু কি? ঐভাবেই মাথা ঘুরে পরে গেলো কেন?”
ডাক্তার উঠে দাঁড়ালো হেসে বললো,,,
“অভিনন্দন আপনাদের আপনারা নানু হতে যাচ্ছেন। রুগী এক মাসের প্রেগনেন্ট।”
সিমি প্রেগনেন্ট এই কথা শুনে সবাই কিছু সময় অবাক হলো পরোক্ষনে “আলহামদুলিল্লা আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলো। ডাক্তার রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সেইখানেই দুইটা ছেলেকে দেখলো বললো,,
“তোমরা রুগীর কি হও?”
জিহান উত্তর দিলো,,,
“আমি ফুফাতো ভাই হয়। আর ইনি রুগীর হাসবেন্ড।”
ডাক্তার নিশানের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,,,
“কংগ্রাচুলেশন আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েন এখন বাসায় গেলাম।”
বলে আর দাঁড়ালো না চলে গেলো।নিশান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এইটা কি শুনলো? সে বাবা হবে? সত্যি এইটা? ও ভুল। শোনে নি তো? বুকের ভিতরে কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার? খুশি লাগছে কেন? সত্যিই সে বাবা হবে? তার অংশ বেড়ে উঠছে একটু একটু করে? এত খুশি লাগার মধ্যেও নিশানের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে “ও প্রেগনেন্ট হলো কিভাবে?”
এইদিকে জিহান নিশান কে জড়িয়ে ধরে বললো,,,
“কংগ্রাচুলেশন জান বাবা হয়ে গেলি। আমার আগেই হলি দুঃখ একটাই। তবে এত ফার্স্ট বাহ্ বাহ্…!”
নিশান জিহানকে ঠেলে রুমের মধ্যে ঢুকলো সিমি বেডে হেলাম দিয়ে বসে আছে এখন একটু ভালো লাগছে। সে যে এক মাসের প্রেগনেন্ট এইটা শুনে এত খুশি লাগছে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেনা। বারবার পেটে হাত দিচ্ছে এইখানে ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে ইসসস কি সুন্দর অনুভূতি। সিমির পাশে গোল হয়ে সবাই বসে আছে সিমিকে এইটা সেইটা বলছে,,,
“বেশি হাঁটাচলা করা যাবে না, বারবার সিঁড়ি বেয়ে উঠা যাবে না, আর কোন কাজ তো একদমই করা যাবে না, সকাল সকাল উঠা যাবে না শীতকাল চলে আসছে।”
এইরকম আরো কথা। নিশান রুমে ঢুকে সবার উদ্দেশ্য বললো,,
“আমার প্রাইভেসি লাগবে সবাই এখন যেতে পারো।”
কেউ দাঁড়ালো না দুইজনের একা রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। নিশান দরজা লাগিয়ে দিলো।সিমির কাছে আসলো সিমির লজ্জা লাগছে তবুও সে চুপচাপ বসে রইলো নিশান ইনিয়ে বিনিয়ে খুশির কথা না জানিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,,,
“এত প্রটেকশন নেওয়ার পরেও,তুই প্রেগনেন্ট হলি কিভাবে?”
নিশানের উত্তর শুনে সিমি নিজেও ভেবাচ্যাকা খেয়ে গেলো তবুও সাহস জুগিয়ে বললো,,,
“May be প্রটেকশনের ডেট ওভার ছিলো।”
সিমির প্রশ্ন শুনে নিশান চোখ ছোট ছোট করে বললো,,,
“ভণ্ডামি করিস আমার সাথে?”
সিমি বিরক্তি কণ্ঠে বললো,,,
“তো কি আর বলবো? প্রেগনেন্ট হলি কিভাবে এইটা কেমন প্রশ্ন আপনার? আপনি না সাইন্স এর স্টুডেন্ট ছিলেন? তাও জানেন নাহ কিভাবে প্রেগনেন্ট হয়।”
“প্রশ্ন এইটা না, প্রশ্ন হলো আমি সতর্ক ছিলাম তারপরেও কিভাবে কি?”
সিমি এইবার সত্যি সত্যি বিরক্তের চরম পর্যায়ে চলে গেছে তাই বললো,,,
“আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করছিলাম, তাই আল্লাহ খুশি হয়ে আমার গর্ভে সন্তান দিয়েছি।”
নিজের অংশ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে এইটা নিয়ে খুশি অনেক নিশান তবে তার মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরছে এত সতর্ক থাকার পরেও এইসব কিভাবে হলো? আপাতত এইগুলো বাদ দিলো সিমির পাশে বসে শান্ত কণ্ঠে বললো,,,
“এখন কেমন লাগছে?”
সিমি মাথা নেড়ে বললো,,,
“ভালো লাগছে।”
নিশান সিমিকে শুয়ে ব্লাঙ্কেট টেনে দিয়ে বললো,,,
“চুপচাপ ঘুমা, আমি আসছি একটু পরেই। এসে যদি দেখেছি তুই বেড থেকে কোথাও গিয়েছিস তাহলে কিন্তু হাত – বেঁধে রাখবো।”
সিমি উপরে নিচে মাথা নাড়ালেও মনে মনে বললো,,,
“শালা বিদেশি কুত্তা!তুই কি অনুভূতিহীন বাবা হতে যাচ্ছিস। তাও কোন অনুভূতি নেই তোর মধ্যে। আবার আমাদের দুইজনকে মারতে পারবি হুউউউ।”
নিশান সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। সে দ্রুত নিচে নামলো জিহান কে ডেকে বললো,,,
“জিহান এতিম বাচ্চাদের খাওয়ার ব্যবস্থা কর। পুরো পাড়ায় মিষ্টি দে মসজিদে মিষ্টি দে। আমি আমি বাবা হতে যাচ্ছি।”
আসলেই নিশান বাবা হতে যাচ্ছে সে খুশি অনেক খুশি কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। সে এই কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো সোজা তারা গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো,তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে বাবা হওয়ার স্বাদ এমন অনুভূতি আজ পযন্ত হয় নি চোখের কোনায় যেন পানি ও জমা হচ্ছে। নিশানের গাড়ি থামলো শুনশান এক রাস্তায়। নিশান দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে করে চিৎকার দিয়ে উঠলো,,,
“শুনছো তোমরা? আমার আর্তনাদ কেউ শুনতে পারছো? মেঘ তুমি কি শুনছো আমার আর্তনাদ? এইযে গাছ – পালা, পাখিরা তোমরা কি শুনছো এই তানভীর চৌধুরী নিশানের আর্তনাদ সে বাবা হতে যাচ্ছে এত খুশি এত সুন্দর অনুভূতি বুজি বাবা হতে গেলো? তোমরা শুনছো আমি বাবা হচ্ছি আলাদা প্রশান্তির বাতাস আমার বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে তোমরা শুনছো? তানভীর চৌধুরী নিশান সে বাবা হতে যাচ্ছে তার অস্তিত্ব একটু একটু করে বেড়ে উঠছে যত্নে।”
তুই শুধু আমার উন্মাদনা পর্ব ৪৩
সম্পূর্ণ কথা নিশান চিৎকার দিয়ে বলছে সত্যি সে আজ। অনেক খুশি। এত খুশি হয়েছিল য্খন সিমিকে নিজের নামে লিখে ছিলো আর এখন বাবা হওয়ার কথা শুনে। নিশানের চোখে পানি টলমল করছে সে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে লাগলো। অদ্ভুত অনুভূতি অদ্ভুত ভালোলাগা। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো। শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিলো আবারো গাড়িতে উঠে বসলো সে তার ইশুর কাছে যাবে এখন। তার সবকিছুই তো ঐখানে তার উন্মাদনার উন্মাদ ইশু আর তার সন্তান। সে যতবার স্মরণ করছে ততবার মুখ দিয়ে মুচকি হাসি বাহির হচ্ছে। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সে বাড়ির উদেশ্য রওনা দিলো।
