তুমিময় আসক্তি পর্ব ১২ || Writer Mahfuza Akter

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১২
Writer Mahfuza Akter

-মেয়েটাকে কোনো ধরনের ট্রমাটিক সিচুয়েশনে ফেলতে নিষেধ করেছিলাম আপনাদের। এতো মেন্টাল প্রেশার ও সহ্য করবে কীভাবে?
ডক্টর বেশ রাগান্বিত ভাবে কথাটা বললেন। নির্জন চিন্তিত স্বরে বললো,
-ডক্টর, আমি ওকে কিছুই বলিনি। কীভাবে যে সেন্সলেস হয়ে গেল!! বাড়ি ফিরে দেখি আমার ঘরের ফ্লোরে পড়ে আছে।
ডক্টর থমথমে গলায় বললেন,

-ওর ব্রেনের ড্যামেজ সেলগুলো প্রায় এইটি পার্সেন্ট রিপেয়ার হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ ভাবে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ওর কিছু মনে পড়ার আশা ছেড়ে দিন। ভবিষ্যতে মনে নাও পড়তে পারে। কিন্তু আপনারা ওকে কিছু মনে করাতে চাইলে ওর কী কী ক্ষতি হবে, সেটা মনে আছে নিশ্চয়ই!
-জ্বি, ডক্টর! ব্রেইনে ইন্টার্নালি ব্লিডিং, ইনজ্যুরি, স্ট্রোক টু কোমায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে। আমি সব জানি, ডক্টর!
নির্জন হাতে হাত চেপে থম মেরে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও ওপর দিয়ে যথাসাধ্য শক্ত থাকার চেষ্টা করছে। ডক্টর ওর কাঁধে হাত দিয়ে নরম সুরে বললেন,

-আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়র কান্ডিশন, ইয়াং ম্যান! নিজের চোখের সামনে নিজের প্রিয়তমার এই অবস্থা সহ্য করাটা বুকে পাথর চাপা দেওয়ার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। বাট ইউ হ্যাভ টু এডমিট দ্য রিয়েলিটি, মাই বয়!
নির্জন মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বললো,
-আমি ঠিক আছি, ডক্টর। সবটা মেনেও নিয়েছি। গুঞ্জনের যদি কিছু মনে নাও পড়ে, তবুও আমি ওকে কখনো জোর করে কিছু মনে করাবো না। সত্যিটা কখনো জানাবো না। কারণ, সব শুনলে ওর ব্রেনে আবার চাপ পড়বে। গুঞ্জন সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক, এটাই আমি চাই।
-তুমি অনেক ধৈর্য্যশীল! মেয়েটাকে এতো ভালোবাসো বলেই সবকিছু হাসিমুখে সহ্য করে নিচ্ছো। সবাই এটা পারে না!
নির্জন তার প্রেয়সীর নিদ্রাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
-ওর জন্য সব করতে পারি আমি। সব!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকালাম। ঝাপসা অক্ষিপট ক্রমশ স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর হচ্ছে। সবটা পরিষ্কার দেখাতেই নিজেকে অপিরিচিত এক ঘরে আবিষ্কার করলাম। সামনের দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে মনে পড়লো, আমি বিকেলে নির্জনের ঘরে গিয়েছিলাম। তারপর! তারপর আর কিছু মনে নেই। এটাই কি নির্জনের ঘর?
হঠাৎ কারো পদধ্বনি কানে বাজতে লাগলো। তার মানে কেউ আসছে! খট করে দরজা খোলার শব্দ আসতেই চকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালাম। নির্জন এসেছেন। তার হাতে বেশ বড় একটা খাবারের ট্রে। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,
-উঠে গেছো? ঘুম ভেঙে গেছে তাহলে!

বলেই ট্রে টা টেবিলে রাখলেন। পাশে বসতেই গালে কপালে হাত রেখে পরখ করতে করতে বললেন,
-দূর্বল লাগছে এখন? সব ক্লিয়ার দেখতে পাচ্ছো তো!
কোনোরকমে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালাম। নির্জন বললেন,
-উঠে গেছো ভালোই হয়েছে! নয়তো ডেকে তুলতে হতো। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে না খেয়ে আছো।
অতিকষ্টে পূর্ণদৃষ্টিতে নির্জনের দিকে তাকালাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-এখানে কেন আমি? এখন কয়টা বাজে?
-এখন রাত আড়াইটা বাজে, ম্যাডাম! আর তুমি তো এখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে ছিলে! খাওয়া-দাওয়া তো করোই না ঠিক মতো! আমাকে সহ্য হয় না, ভালো কথা। কিন্তু সেজন্য নিজের অযত্ন কেন করছো?
ভ্রু যুগল একত্রিত করে নির্জনের দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনাকে কে বলেছে আমি নিজের অযত্ন করি? আমি তো……….

থেমে গেলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম যেন! আমি তো এই ঘরে কোনো ক্লু খুঁজতে এসেছিলাম! কিন্তু ঘরে ঢুকতেই বেডের ওপরের দেয়ালে চোখ পড়তেই………. তৎক্ষনাৎ দেয়ালটার দিকে তাকাই।
হ্যাঁ, এই তো সেই ক্যান্ডিডটা! একই ফ্রেমে বন্দী আমি আর নির্জন। আমি আর নির্জন কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নির্জন বাচ্চাদের মতো আমার গাল দুটো টেনে ধরে আছেন আর আমি শয়তানী হাসি দিয়ে ওনার চুল খাবলে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এই ছবিটাকে ঘিরে আরও অনেকগুলো ছোট ছোট ছবি ওয়ালে এঁটেছেন নির্জন। অবাক চোখে সেগুলো দেখছি। এসব কখন কীভাবে তোলা হলো?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-এগুলো, এই ছবিগুলো কীভাবে এলো? কখন তুললেন? কবে তুললেন?
নির্জন ক্রমাগত ইতস্তত করে চলেছেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে হাসফাস করছেন। আমতা আমতা করে বললেন,
-আসলে, গুঞ্জন। মানে হয়েছে কী…. আ….
-আসলে নকলে বাদ দিয়ে সত্যিটা বলুন। কী লুকাচ্ছেন? এসব ছবি কোত্থেকে এলো? আমি তো আপনার সাথে কখনো এভাবে মিশি নি! আর এগুলো তো এডিট করাও নয়! তাহলে?
-তুমি এই ছবিগুলো দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে?

নির্জন বিস্মিত চোখে তাকালেন। আসলেই তো! এসব ছবি দেখে আমি অজ্ঞান কেন হলাম? নিজের অজান্তেই মাথা ঘুরে উঠেছিল আমার। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই ছবিগুলো আমি আগেও দেখেছিলাম। সেদিন যে পার্সেলটা এসেছিলো, সেখানে থাকা এলবামে। কিন্তু নির্জনের পাশের মেয়েটার অবয়ব ব্লার করা ছিল। তার মানে ঐটা আমিই ছিলাম। কিন্তু যে পাঠিয়েছে, সে নির্জনের বিরুদ্ধে আমার ব্রেনওয়াশ করতে চেয়েছিলো!
-কী হলো? বলো!
নির্জনের কথায় হুশ ফিরলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম,
-জানি না। কিন্তু এই ছবিগুলো আমি আগেও দেখেছি। একজন আমায়……

-একজন তোমায় পাঠিয়েছিলো এন্ড তোমায় মিস-লিডেড করতে চেয়েছিলো। আর তুমি মিস-লিডেড হয়েও গিয়েছিলে! আজ সবকিছু নিয়ে মাথায় এক্সট্রা প্রেশার দিয়েছো। দ্যাটস হোয়াই, সেন্সলেস হয়ে গেছো। আই ওয়ার্ন ইউ, গুঞ্জন! আই ওয়ার্ন ইউ। ভবিষ্যতে যদি তুমি এসব নিয়ে আরেকবার মাথা ঘামাও, আমি তোমায় ঘরে আঁটকে রাখতে বাধ্য হবো। তোমায় একা ছাড়াটাই ভুল হয়েছে আমার!
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার এ ব্যাপারে কিছু জানতেই দেবেন না! অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
-কিন্তু এটা তো বলুন যে, এই ছবি গুলোতে আমি এলাম কী করে?
নির্জন চোখ পাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
-অ্যাগেইন! কী বললাম কানে যায়নি? খাবার গুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
বলেই নির্জন গম্ভীর ভাবে খাবার ঠিক করতে লাগলেন।

দমে গেলাম। এই ব্যক্তি প্রচন্ড চটেছেন! কিন্তু মাথার ভেতর প্রশ্ন গুলো কিলবিল করছে অনবরত। এসব কিছুর মানে কী? চোখ খিঁচে বন্ধ করতেই চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভাসতে লাগলো। সবটাই ঘোলাটে! একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। সমুদ্রের পাড়ে ছেলেটা মেয়েটার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। এরা কারা? মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হঠাৎই কানে তীক্ষ্ণ শব্দ বাজতে লাগলো। মাথা তুমুল বেগে ঘুরছে। দু’হাতে কানে হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করতেই নির্জন আমার দিকে তাকালেন। কাছে এসে বললেন,
-কী হয়েছে? এমন করছো কেন? মাথা ব্যথা করছে? খারাপ ল্……
-শ্ শব্দ! এমন শব্দ স্ সহ্য হচ্ছে ন্ না আমার!! আহহ্!!!!

নির্জন ঘাবড়ে গিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে নিতেই তাকে ঝাপটে ধরলাম। মাথায় ক্রমাগত ওষ্ঠ স্পর্শ করে বলে চলেছেন,
-কিছু হবে না তোমার! একটু শান্ত হয়ে বসো। একদম চুপচাপ। আস্তে আস্তে দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।
নির্জনের বুকে মাথা রেখে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে সবটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো উঠে বসছি না। ইচ্ছে করেই বসছি না। এই জায়গাটায় একটা পরিচিত স্বর্গসুখ পাচ্ছি। কেন যেন আসক্ত হয়ে পড়ছি ক্রমশ। হঠাৎ নির্জন বললেন,
-এবার কিন্তু তুমি এডভান্টেজ নিচ্ছো, গুঞ্জন! এখন তুমি ঠিক আছো, তবুও আমায় জড়িয়ে ধরে বসে আছো!
থতমত খেয়ে গেলাম। উনি কীভাবে বুঝলেন? নির্জন আবার বললেন,

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১১

-স্বাভাবিক না হয়ে গেলে এতোক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে না! আই নৌ। সো, উঠে বসো আর খেয়ে নাও।
কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছুই পেলাম না। অগত্যা না চাইতেও উঠে বসতে হলো। নির্জন খাবার সাজাতেই বললেন,
-ঠান্ডায় হয়ে গেছে সব! গরম গরম নিয়ে এলাম।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
-এতো রাতে গরম করে নিয়ে এসেছেন? সার্ভেন্ট করে দিয়েছে বুঝি?
-রান্না করে এনেছি। বাসি খাবার গরম করে এনে খাওয়াবো তোমায় ভাবলে কী করে? আর আমি এতো জল্লাদ না যে, সার্ভেন্ট দিয়ে মাঝরাতে রান্না করাবো! নিজেই রেঁধে নিয়ে এসেছি।
না চাইতেও ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কেন যেন মনে ভেতর অন্য রকম একটা আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে নির্জন বললেন,

-আবার বলছি গুঞ্জন! ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। নিজের ভালোর জন্যই অনেক সময় অনেক কিছু অজানা রাখতে হয়।
-কিন্তু আমি সবটা জানতে চাই!
-আজকে কেমন কষ্ট হলো, দেখোনি? জেদ ধরো না। এসব নিয়ে আর কোনো চিন্তা মাথায় আনবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা হেলিয়ে নির্জনের কথায় সায় দিলাম।

আজকের দিনটাই শুধু বাকি। কালই আমার নামটা নির্জনের নামের সাথে চিরকালের জন্য জুড়ে যাবে। সব তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বিয়ের ঠিক আগমুহূর্তে আমায় এখান থেকে বাসায় নিয়ে যাবে নির্জন। তার আগে না। সবটা ভাবতেই অবাকতা, আনন্দ, কষ্ট ; সবমিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। একবার মনে হচ্ছে, বিয়েটা আমি মানতে পারবো না, আরেকবার মনে হচ্ছে বিয়েটা না হলে সহ্যই করতে পারবো না।
ভাগ্য কী এমন নির্মম খেলা খেলছে, জানি না! তবে অজানা এক উৎকন্ঠা মনের মধ্যে দানা বেঁধে চলেছে। আদৌ বিয়েটা হবে তো!

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৩