তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৭ || Writer Mahfuza Akter

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৭
Writer Mahfuza Akter

-ম্যাম, ৩০২ নাম্বার কেবিনের পেশেন্ট আবার পাগলামি শুরু করেছে। কিছুতেই হ্যান্ডেল করতে পারছি না!
বইয়ের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। নিউলি ইন্টার্নড্ জুনিয়র একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
-ঘুম এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল কীভাবে? দশটা তো এখনো বাজনি!
-জানি না, ম্যাম। কী করবো বুঝতে পারছি না!
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
-ওকে দেন, চলো। আজ আবার কী শুরু করলো মেয়েটা?

কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ কপালে উঠে গেল। পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটাও বেশ অবাক হয়েছে। কারণ কেবিনের ভেতরে ভয়াবহ তান্ডব শুরু করেছে শায়ন্তী। প্রতিটা জিনিসপত্র ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছে তো ফেলছেই! জানালার পাশে উল্টো ঘুরে টেবিলের সব জিনিস ফেলে দিতে যাবে এমনসময় পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরে ফেললাম। শায়ন্তী মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। কঠোর স্বরে বললাম,
-শায়ন্তী, এটা আমি। থামো!

কন্ঠস্বর শুনেই শায়ন্তী নড়াচড়া একদম বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। ধীর গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো। ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
-কী শুরু করেছো তুমি এসব? আর কতো দিন এমন পাগলামি করবে? প্লিজ, এসব ইরিটেটিং কাজকারবার বন্ধ করো!
শায়ন্তী কেঁদে দিলো। নাক টেনে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-মম! মম প্রতিদিন কেন আমার কাছে আসে? কেন বারবার আমায় খুনি বলে? আমার সহ্য হয় না! মমকে তুমি বলো না আমায় যেন আর খুনি খুনি না বলে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। এসব যে একটা ভ্রম, সেটা ওকে বোঝানো কোনোদিন সম্ভব না। এই হ্যালুসিনেশনের জন্যই ওর মানসিক অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, বদ্ধ পাগলের উপাধি নিয়ে বসে আছে।
-আচ্ছা বলবো। এখন খেয়ে নেবে চলো। না খেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে!
আমার এমন কথায় শায়ন্তী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-না, না, আমি কিচ্ছু খাবো না। আমি অসুস্থ হবো। তারপর মরে যাবো। মরে যাবো আমি! বাঁচতে চাই না। মরে যেতে চাই আমি!!!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আবার পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। উপায় না পেয়ে আবার ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলাম। শায়ন্তী বিছানায় ঢলে পড়লো। স্যালাইন চালু করে দিতেই ওর মুখের দিকে নজর গেল। কী অবস্থা হয়েছে মেয়েটার? সেদিন নির্জনকে গুলি করার পর ওকে পুলিশ এরেস্ট করলেও কোনো আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কারণ তিনদিনের মাথায় ও মেন্টালি ডিজঅর্ডারড্ হয়ে যায়। তারপর থেকে পাঁচ বছরে তেমন কোনো ইম্প্রুভমেন্ট দেখিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, শায়ন্তী যদি এমন জঘন্য খেলা শুরু না করতো, তাহলে এতোগুলো জীবন নষ্ট হতো না। আমি, নির্জন, শুভ্রব, শুভ্রবের মা, শৌভিক আঙ্কেল, আমরা সবাই ওর খেলার গুটি ছিলাম বলেই আজ আমার অসুখী। শুভ্রব আর শৌভিক আঙ্কেল তো ঐ ঘটনার পর আজ পর্যন্ত শায়ন্তীর মুখও দেখেনি। কিন্তু এজন্য শায়ন্তী দায়ী থাকলেও ওকে দায়ী করতে পারি না আমি। বিবেকের কোথাও না কোথাও বাঁধে। এজন্যই বেশি বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ গুলো সুখের মুখ খুব কম দেখে। ওর ট্রিটমেন্ট আমিই করছি। ইগনোর করতে পারতাম। কিন্তু ঐ যে বললাম না! বিবেকের কাছে হেরে যাই।

শায়ন্তীর কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে শুভ্রবকে কল দিলাম। লাস্ট টাইম কনভেন্স হয় কিনা দেখি! একবার রিং হতেই শুভ্রব কল রিসিভ করলো,
-হ্যাঁ, গুঞ্জন। বলো!
-ব্যস্ত আছেন? অসময়ে কল দিলাম তো মনে হয়!
শুভ্রব খানিকটা হাসলো যেন! বললো,
-পেশেন্ট দেখছিলাম। তুমি আর নির্জনের চেয়ে কি আর ব্যস্ততার মূল্য বেশি হবে? বলো কী বলবে?
ইতস্তত করে বললাম,
-আসলে আমি বলছিলাম যে, কীভাবে যে বলি!
-তুমি এমন হ্যাজিটেশন ফিল করছো কেন বলো তো! আমার সাথে অলওয়েজ ফ্র্যাঙ্ক থাকতে বলেছিলাম তোমায়।
একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বললাম,
-আমি বলছিলাম যে, আপনি আর আঙ্কেল একবার শায়ন্তীকে দেখতে আসুন। তাহলে ওর মানসিক অবস্থা একটু হলেও ইম্প্রুভ করবে।

একদমে কথাটা বলে উত্তরের আশায় থামলাম। ওপাশে পিনপতন নীরবতা। ফোনে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, কল চলছে। কিন্তু শুভ্রব কথা বলছে না কেন? কিছুক্ষণ পর ফট করে কল কেটে দিলো। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। পরমুহূর্তেই একটা মেসেজ এলো। শুভ্রব পাঠিয়েছে,
‘ওর মুখ দেখার ইচ্ছে নেই। ও বেঁচে থাকুক এটাও চাই না। ওকে ওর শাস্তি পেতে দাও। তিলে তিলে শেষ হতে দাও। তোমার মতো উদার মানসিকতা আমার নেই। সো, ফারদার ওর নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। আই ব্যেগ টু ইউ। ”
কিছুই বলার নেই। শুভ্রব কোনোদিন রাজি হবে না। শৌভিক আঙ্কেলকে বলার সাহস আমার নেই। তাই হাল ছেড়ে দেওয়াটাই একমাত্র পথ।

সকাল সকাল হসপিটালে গিয়ে নির্জনের সাথে দেখা করে দিন শুরু করাটা অভ্যাস আমার। পাঁচ বছরে যাই ঘটুক না কেন, নির্জনের সাথে দেখা করিনি এমন একটা সকালও নেই। সেদিন গুলিটা নির্জনের মাথায় লেগেছিল। গুলি বের করা সম্ভব হয়েছিল। ওনাকে বাঁচানোও সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু উনি অনির্দিষ্টকালের জন্য কোমায় চলে গেছেন। পাঁচটা বছর চলে গেলেও নির্জন চোখ মেলে তাকায়নি। প্রথম প্রথম অনেক পাগলামি করেছিলাম, অনেক ডাকতাম ওনাকে জেগে ওঠার জন্য। কিন্তু উনি শোনেননি। তাই এক রাশ অভিমান জমিয়ে রেখে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু একবার দেখা করে আসি। কারণ এটাই তো সম্বল! না হলে যে মরে যাবো আমি!

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৬

কেবিনের দরজার কাছাকাছি যেতেই শুভ্রবের কন্ঠ ভেসে এলো। শুভ্রব কথা বলছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম, নির্জনের সামনে বসে বসেই আপনমনে বলছে,
-আর কতো, ইয়ার! আর কতো? এবার উঠ না। তোর এই ঘুম কবে ভাঙবে বল তো! তোর বউ তো তোর ওপর রেগে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে! এবার আমিও বন্ধ করে দিবো কিন্তু! শুনতে পাচ্ছিস তুই? দোষ তো আমি করেছি! সেটা স্বীকারও করলাম। এবার আমাকে মার-ধর, যা ইচ্ছে কর। একটুও বাঁধা দিবো না। তবুও ফিরে আয় আমাদের কাছে। এই এভাবে শুয়ে থাকতে তোর বোরিং লাগে না। পাঁচ বছর ধরে এভাবে শুয়ে থাকলে তো পিঠ ব্যথা হয়ে যাওয়ার কথা!
শুভ্রবের বাচ্চামো দেখে মুখে হাসি চোখে জল চলে আসার মতো অবস্থা আমার। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্রব কিছুক্ষণ থেমে এবার রাগী স্বরে বললো,

-শুনবি না তুই? আর কতো শাস্তি দিবি আমাদের? সবার কথা বাদ দিলাম। কিন্তু গুঞ্জন? তোর শ্যামাঙ্গিনী! তোর শ্যামাঙ্গিনী যে একটুও ভালো নেই তোকে ছাড়া! আমার বর্ষণবিলাসি যে অনেক কষ্টে আছে! ওকে কষ্ট দিয়ে তুই কী মজা পাচ্ছিস? প্লিজ উঠ না, ইয়ার! শুনছিস আমার কথা? শুনবি না তুই, তাই না?
নির্জন বরাবরের মতোই চোখ বন্ধ করে আরামে ঘুমিয়ে আছে। কোনো রেসপন্স নেই। শুভ্রব বসা থেকে দাঁড়াতেই রাগে গজগজ করতে করতে চেয়ারটা লাত্থি মেরে ফেলে বেরিয়ে গেল।
দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। অশ্রু সিক্ত দৃষ্টিতে নির্জনের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকালাম। সবার এতো এতো অভিযোগ শুনেও তিনি নিশ্চুপ! নিশ্চিন্ত! পা ঘুরিয়ে নিজেও চলে এলাম সেখান থেকে।
এদিকে নির্জন যে পাঁচ বছর পর হাতের তর্জনী নাড়িয়ে চাদর খামচে ধরলো, সেটা কেউ খেয়ালই করলো না!!!

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৮