তুমিময় আসক্তি পর্ব ৭ || Writer Mahfuza Akter

তুমিময় আসক্তি পর্ব ৭
Writer Mahfuza Akter

-একটা বিবাহিত ছেলের সাথে তোর বাবা কী করে তোর বিয়ে দিতে চাইছেন, গুঞ্জন?
কান দুটো ভোঁ ভোঁ করছে। নির্জন বিবাহিত! এটা কীভাবে সম্ভব? বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দটা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে কাপা কাপা গলায় বললাম,
– একদম ওনাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবি না! নির্জন বিয়ে করেছে!! এটা হতেই পারে না। বাবা আর নির্জন দুজনের উপরই আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখতে পারি।
সারা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

– বিশ্বাস করা ভালো, কিন্তু সেটা যেন অন্ধবিশ্বাস না হয়! শুধু আমি না, সবাই-ই জানে যে, নির্জন ভাইয়া বিবাহিত তাও তিন বছর আগে থেকেই।
থমকে গেলাম। হাত পা থরথর করে কাঁপছে আমার। তিনবছর আগেই নির্জন বিয়ে করেছে? বিশ্বাস হচ্ছেই না আমার। কিন্তু সারা কেন মিথ্যা বলবে? কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-ত্ তুই কীভাবে চিনিস নির্জনকে?

-ওনাকে কে-ই বা না চেনে! আমাদের ভার্সিটি থেকেই তো স্টাডি কমপ্লিট করেছেন নির্জন ভাইয়া। তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি। একদিন শুনলাম নির্জন ভাইয়া নাকি আমাদের সমবয়সী একটা মেয়েকেই বিয়ে করেছেন। তুই তো সেকেন্ড ইয়ারে এসে এডমিশন নিলি! এজন্য জানিস না।
-ম্ মিথ্যে বলছিস তুই! নির্জন ম্যারেড হলে আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছে? তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, সারা।
সারা জোর গলায় বললো,
-আমার কোনো ভুল হচ্ছে না, গুঞ্জন। ইন ফ্যাক্ট, তুই সত্যিটা মানতে চাইছিস না। এতো বছরের বন্ধুত্ব আমাদের! আমি তোর খারাপ চাই না বলেই সত্যিটা জানিয়ে দিলাম। আবেগে ভেসে ভুল সিদ্ধান্ত নিস না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুই চাইলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারিস। এমন ক্……..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিলাম। আর কোনো সমস্যা শোনার ইচ্ছে নেই। সারার প্রতিটা কথাই বুকের ভেতর ছুরিকাঘাত করছিলো ক্রমাগত। সারার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সত্যিই আমার মন মানতে চাইছে না সত্যটা। এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিজের ঘরে চলে গেলাম।
এখন আমাকে একজনই এই গোলকধাঁধার সমাধান দিতে পারেন। নীলিমা ম্যাম। বর্তমানে আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে পুরাতন শিক্ষক, আমাদের ডিপার্টমেন্টর হেড। নির্জনের ব্যাপারে উনি আসল সত্যিটা জানেন। ফোন হাতে নিয়ে কল দিলাম ম্যামকে। তিন বার রিং হতেই রিসিভড হলো। ওপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ম্যাম বললেন,

-আফরাহ্ সেহরীশ, রাইট?
গলা কাঁপছে আমার। তবুও মলিন হেসে বললাম,
-ইয়েস, ম্যাম। কেমন আছেন?
-আছি। তোমার ভয়েসটা কেমন যেন শোনাচ্ছে! ইজ দেয়ার এনিথিং রোঙ্?
জোরপূর্বক হেসে বললাম,
-ম্যাম, আই নিড ইয়র হেল্প। ইট’স আর্জেন্ট! একজনের ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দিতে হবে আপনাকে।
-কার ব্যাপারে জানতে চাও? বলো!
-ম্যাম, আফ্রান জোহায়ের নির্জন। উনি কি বিবাহিত? তিন বছর আগে নাকি………
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ম্যাম বললেন,

-এই বিষয়টা আমার কাছেও ধোঁয়াশা, গুঞ্জন। তিন বছর আগে নির্জন স্টাডি কমপ্লিট করার পরপরই ঘরোয়া ভাবে একটা মেয়েকে বিয়ে করে। মেয়েটার বয়স কম ছিল। তাই মেয়েটার ক্যারিয়ার এস্টাবলিশমেন্টের পরই নির্জন তাকে প্রকাশ্যে বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল। তাকে আমরা কেউ কখনো দেখিনি। কিন্তু তুমি এসব কেন জানতে চাইছো?
হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কিন্তু কান্না যেন থামছেই না! কেন আমার সাথে এমনটা হলো? কেন আমাকে এভাবে ঠকালেন, নির্জন? আমি তো প্রথম থেকেই আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি! আপনি নিজে এগিয়ে এসে আমাকে আপনার সাথে জড়ালেন। শেষে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন। ধ্বংস করে দিলেন আমায়।

-আর কতো ওয়েট করতে বলবি, আপি? নির্জন যখন গুঞ্জনকে বিয়ে করে সংসার করা শুরু করবে তখন অপেক্ষা শেষ হবে আমার, তাই না?
শুভ্রবের কন্ঠে আক্রোশ! রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে আছে শায়ন্তীর দিকে। শায়ন্তী বিরক্তি নিয়ে বললো,
-তোর কি মনে হচ্ছে না, তুই একটু বেশিই ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছিস ঐ মেয়েটার জন্য?
-হ্যাঁ! হ্যাঁ!! আই ডেস্পারেটলি ওয়ান্ট হার। অনেক হারিয়েছি আমি জীবনে! নির্জন আমায় যা দিয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু গুঞ্জনকে এবার ও বিয়ে করতে পারবে না। আমি হতে দিবো না।
-ওদের বিয়েটা অনেক আগেই হ….

-জাস্ট শাট আপ! ওসব কথা আমার সামনে ফারদার মুখে আনবি না।
ধমক খেয়ে শায়ন্তী হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
-ওকে, বলবো না। তোকে আমি অনেক আগেই বলেছি না! ভরসা রাখ আমার ওপর। এখনো কোনো স্টেপ নেওয়ার সময় আসেনি। রাগের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সবটা ভেস্তে দিস না।
শুভ্রব দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
-তাহলে সঠিক সময়টা কখন?
-দেরি আছে। একটু ধৈর্য্য তো ধরতেই হবে, মাই ডিয়ার ব্রাদার!
-গো টু হেল উইথ ইয়র ‘ধৈর্য্য’!
শুভ্রব ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। শায়ন্তী গভীর মনযোগ সহকারে নিজের পরিকল্পনার ছক কষতে লাগলো, যেন তার নিজের স্বার্থটা সবার উর্ধ্বে থাকে।

বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বললাম,
-বাবা, আমি কোনো বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না!
আমার কথা শুনে বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। হাতের পেপারটা টেবিলে রেখে আমার দিকে এগিয়ে এসে হতভম্ব হয়ে বললেন,
-বিবাহিত মানে? কে বিবাহিত?
বাবার কথা শুনে অবাক হলাম। তার মানে, উনি জানেন না কিছুই! নির্জন সবকিছু নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আমায় বিয়ে করতে চাইছে। এতোটা জঘন্য উনি!! আমার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখান! ভালোবাসার মানেটা কি আদৌ জানেন তিনি?
-কী হলো? বল!

বাবার কথা শুনে তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। কীভাবে বলবো আমি? কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই বুকের ভেতর ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! নির্জনের কথা ভাবলেই ক্ষতটা তরতাজা হয়ে উঠছে বারবার। চোখ ফেটে আবারও পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এতোটা গভীরভাবে জড়িয়ে গেছি আমি নির্জনের সাথে! কিন্তু নির্জন আমার অনুভূতির কোনো মান রাখলো না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-ব্ বাবা, আমি ঠ্ ঠকে গেছি!

কান্নার গতি বেড়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আমার কান্না দেখে বাবা যে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেছেন সেটা তার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছি আমি। মুখ উঁচিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বাবা বললেন,
-কীসব বলছিস তুই, মা? আমি তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না!
কান্নার তোড়ে ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠতেই নাক টেনে বললাম,
-বাবা, নির্জন…….. নির্জন ম্যারেড! ওর নাকি আরো তিন বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে!! ওর স্ত্রী আছে। তাকে ছেড়ে এখন আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি একটা স্বস্তির হয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙবো, বাবা? বলতে পারো! আমি নির্জনকে কখনো বিয়ে করতে পারবো না।

কাঁদো কাঁদো চোখে বাবার দিকে তাঁকিয়ে আছি। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই বাবার চোর মুখ কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেল। উল্টো ঘুরে কয়েক পা এগুতেই জানলার সামনে থেমে গেলেন। বাইরে দৃষ্টি রেখে থমথমে গলায় বললেন,
-নির্জন বিবাহিত না কী, সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না! বিয়ে তুমি নির্জনকেই করছো এন্ড দিস ইজ মাই ফাইনাল ডিসিশান।
একেবারে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছলাম। বাবা একদম স্বাভাবিক আচরণ করছেন। তার মানে তিনি সত্যিটা আগে থেকেই জানতেন। অথচ সবাই মিলে সেটা লুকিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো! এটা কি আমার স্বপ্ন নাকি কল্পনা? বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন! অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,

তুমিময় আসক্তি পর্ব ৬

-বাবা, তুমি আগে থেকে সবটা জানতে? আর সব জেনেই……………
-শুধু আমি না, সবাই-ই জানে! সত্যটা তোমাকে মানতে হবে, গুঞ্জন। পরিস্থিতি মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় বলা যায় না। তাই নিজের ভাগ্যকে মেনে নাও!
রাগ লাগছে। শক্ত স্বরে বললাম,
-ভাগ্য! কীসের ভাগ্যের কথা বলছো তুমি? তোমরা নিজেরাই আমার ওপর সবটা চাপিয়ে দিতে চাইছো। আমাকে কি পুতুল মনে হয় তোমাদের যে, যেভাবে নাচাবে, সেভাবেই নাচবো? আমার কি নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা মতামত নেই?
বাবা কঠিন স্বরে বললেন,

-যা ইচ্ছা, বলতে থাকো! আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে দিয়েছি। মানবে কিনা………..
-কেন মানবো? আমি কি তোমার কাছে এতোটাই বোঝা হয়ে গিয়েছি, বাবা? একে তো বিয়ের জন্য প্রথম থেকেই প্রেশার দিচ্ছো! তার ওপর নির্জনকেই বিয়ে করতে হবে। এবসার্ড!!!
হনহনিয়ে পা চালিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। না আমি এই বিয়েতে রাজি হবো আর না দরজা খুলবো! মরে গেলেও নির্জনের মুখদর্শন করবো না। একজন প্রতারককে আর যাই হোক; বিয়ে করা যায় না!!

তুমিময় আসক্তি পর্ব ৮