তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৪

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৪
Jannatul ferdosi rimi

মেহেভীনের আর্তনাদ কানে আসতেই,আরহাম আশিককে ছেড়ে দিয়ে,নীচের দিকে ছুটে যেতে থাকে। মেহেভীনের কান্নার আওয়াজটা নীচ থেকেই আসছে। আরহাম নীচে সদর দরজার কাছে আসতেই,বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মেহেভীন পেটে হাত দিয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তার পেট দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত। আরহামের পা যেন চলছে না মেহেভীনকে এই অবস্হায় দেখে। আরিয়ানের চিৎকারে আরহামের হুশ আসে। আরিয়ান মেহেভীনের দিকে ছুটে এগিয়ে যায়। মেহেভীন কাপা কাপা হাতে আরহামের দিকে হাত নাড়িয়ে কম্পিত গলায় বলে,
‘ আরহাম সাহেব! আমার বাচ্ছা। ‘
আরহামের এক মুহুর্তেও দেরী করে না,মেহেভীনের কাছে গিয়ে মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
‘ কিচ্ছু হবে না বাচ্ছার। আমি আছি তো মেহেভীন। ‘
মেহেভীন ঠোট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করছে। আরিয়ান চিন্তিত সুরে বলে,

‘ ভাই মেহুকে নিয়ে আমাদের এখুনি হসপিটালে যেতে হবে। আমি যা দেখছি মেহেভীনকে এই মুহুর্তে হসপিটালে শিফট না করলে,বড় ধরণের ক্ষতি হবে। মেহেভীনের ব্লিডিং হচ্ছে যা বাচ্ছা এবং মেহু দুজনের জন্যেই বিপদজনক। ‘
আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে আরিয়ানের সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন ঠোট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করে যাচ্ছে। তার মনে শুধু একটা ভয়েই উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে তার সন্তানের কিছু হবে না তো? আরহাম মেহেভীনের এমন অবস্হা দেখে একপ্রকার অস্হির হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্হায় আরহামের ড্রাইভ করা ঝুঁকিপূর্ন।তাই আরিয়ানই ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে। আরহাম মেহেভীনকে একপ্রকার নিজের সাথে মিশিয়ে মেহেভীনের হাতজোড়া আকড়ে ধরে রেখেছে। এই সময়ে সে শুধু আরহামকেই ভরসা করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাড়ি হসপিটালের কাছে আসতেই আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসে। ডক্টর জেসমিন যিনি প্রেগ্ন্যাসির সময় মেহেভীনকে চেকাপ করছিলেন তিনি মেহেভীনের এই অবস্হা দেখে ভয় পেয়ে যান। তিনি দ্রুত মেহেভীনকে এডমিট করে নেয়। জেসমিন আরহাম এবং আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
‘ আপনাদের বলা হয়েছিলো মেহেভীন এবং বাচ্ছাটা যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছে। মেহেভীনের এখন পাঁচ মাস শেষ হয়ে ৬মাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির। প্রেগ্ন্যাসির এই ৬মাস টা কতটা ঝুঁকিপূর্ন।তার মধ্যে মেহেভীনের পেটে কাচ ঢুকে গেলো এইটা কতটস রিস্কি আপনারা তো বুঝতে পারছেন তাইনা? এই অঘটন ঘটলো কী করে?’
আরহাম কিছু বলার আগেই, আরিয়ান দ্রুততার সাথে বললো,
‘ আসলে সেইটা অনেক বড় ঘটনা। আপনি আগে মেহুর ট্রটমেন্ট শুরু করুন ডক্টর জেসমিন। মেহু এবং বেবীর যেন কিচ্ছু হয়না। ‘
জেসমিন চশমাটা ঠিক করে বললো,
‘ আপনিও তো একজন ডক্টর আরিয়ান। পেশেন্ট এর যা অবস্হা তাতে কেউ ঠিক থাকবে বলে আমার মনে হয়না। ‘
ডক্টরের কথায় আরিয়ান চুপ করে যায়। আরহাম কথাটি শুনে একপ্রকার উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘ এইসব কথা বললে তো হবে না। আপনি যে করেই হোক বেবী এবং মেহুকে বাঁচান। ওদের যেন কিচ্ছু না হয়। কিছুটা নয়।

আরহামকে দেখেই মনে হচ্ছে সে এখন স্বাভাবিক অবস্হাতে নেই। তাই ডক্টর জেসমিন কথা বাড়ালেন না। মেহেভীনের কেবিনের দিকে পা বাড়িয়ে দেয়।আরিয়ানও কেবিনে চলে যায় মেহেভীনের অবস্হা দেখার জন্যে। আরহাম কাঁচের জানালা দিয়েই স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহেভীন ব্যাথায় কতটা কাতরাচ্ছে। ডক্টররা মিলেও রক্ত পড়া থামাতে পারছে না। মেহেভীনের এমন করুন অবস্হা নিজের চোখের সামনে দেখে আরহামের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা তার প্রেয়সী তার ভালোবাসার মানুষটির করুন পরিনতিতে। যে বা যারা মেহেভীনের এই অবস্হার জন্যে দায়ী তাদের সে কিছুতেই ছাড়বে না। তখনি পুলিশ স্ট্যাশন থেকে জানায় আশিক নাকি পালিয়ে গেছে কেননা এই ঘটনার পিছনে যে মূল রয়েছে তার নাম সে কিছুতেই বলবে না।কথাটি শুনেই আরহামের আখিজোড়া রক্তবরণ ধারণ করছে।

শরীরে রাগ রক্ত যেন টগবগ করছে। আরিয়ান মেহেভীনের অবস্হা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে, নিজের ভাইকে দেখে ঘাবড়ে যায়। কারন রাগে আরহামের হাতের রগ একবারে ফুলে উঠেছে রাগে। আরহাম সহজে রেগে যায়না। যথেষ্ট ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে তার,কিন্তু একবার যদি রেগে যায় তাহলে আরহামের থেকে ভয়ংকর আর কেউ হতে পারেনা। একপ্রকার হিংস্র হয়ে উঠে সে। আরহামকে এই রুপে আরিয়ান ছোটবেলায় একবার দেখেছিলো।আরিয়ানকে কয়েকজন বখাটে ছেলে মেরেছিলো যার ফলে সেদিন ছোট্ট আরিয়ানের একপ্রকার জ্বর হয়ে গিয়েছিলো। তখন আরহাম এতোটাই রেগে গিয়েছিলো সে সেদিন মাটির টপ দিয়ে বখাটে ছেলেদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো। বখাটে ছেলেগুলোর সেদিন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অবস্হা ছিলো। আরহাম তখন বয়সে ছোট হলেও হিংস্র হয়ে উঠেছিলো। সেদিন আরহামের বাবা ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছিলো অনেক বকেও ছিলো আরহামকে। সেদিনের পর আরহামের সেই রুপটা আর কেউ দেখতে পায়ন, কিন্তু আজ আবারো আরহামের সেই আগের রুপ দেখে আরিয়ানের বুঝতে বাকি থাকেনা আরহাম আজও বিরাট ভয়ংকর কাজ করবে। আরিয়ান এগিয়ে তার ভাইকে আটকাতে নিলে, আরহাম হাত দিয়ে আরিয়ানকে আটকিয়ে সে শান্ত গলায় বলে,
‘ আমি আপাতত তোর কোন কথা শুনতে চাইনা। আমি আসছি। তুই শুধু মেহেভীনের খেয়াল রাখিস। ‘
আরহাম বেড়িয়ে যায়। আরিয়ান চাইলেও বাঁধা দিতে পারে না।

আশিক একপ্রকার পুলিশের চোখে ধূলো দিয়েই কোনরকম পুলিশের গাড়ি থেকে তার লোকদের সাহায্য পালিয়ে একটা পুরনো কুঠিরে ঠায় নিয়েছে।
কুঠিরে আশিক আপাতত একাই রয়েছে। সে ভেবেছে আজকের রাতটা সে এখানে কাটিয়ে, কাল রুক শাদেহের যোগাযোগ করে দূরে কোথাও চলে যাবে,সে কিছুতেই পুলিশের কাছে ধরা দিবে না।
কিন্তু সে জানতো না একজন এর চোখ সর্বক্ষন তার উপর রয়েছে, সে আর কেউ নয় স্বয়ং আরহাম। কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আশিক ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আরহাম বাঁকা হাঁসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরহামকে দেখেই ভয়ে কাঁপাকাপি অবস্হা হয়ে যায় আশিকের। আরহাম আশিকের দিকে ঝু্ঁকে বলে,
‘ আরহাম হাসান তালুকদার কখনোই কাঁচা কাজ করেনা। তোর ভাবনা যেখান থেকে শেষ আরহাম হাসান তালুকদার এর ভাবনা সেখান থেকেই শুরু।
আমি ধারণা করেই নিয়েছিলাম তুই ঠিক পালাবি। তাই তোর শার্টে আমি লুকিয়ে একটা ট্রেকার ফিক্সড করে রেখেছিলাম। তাই তুই যেখানেই যাবি আমি সব জানতে পারবো। এখন তুই বলবি এইসব এর পিছনে কে আছে নাকি আমি…’
আরহাম তার সম্পূর্ন কথাগুলো শেষ না করেই, আরেকদফা বাঁকা হাঁসলো। আশিক ভয়ে ঢুগ গিললো।

দেয়ালের এক কোণে রক্তাক্ত অবস্হায় আশিক বসে আছে। নড়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। তার সামনেই টুলে হাতে রড নিয়ে বসে আছে। আধাঘন্টা ধরে নির্মমভাবে আশিককে মেরেছে আরহাম। আরহাম রডের দিকে তাকিয়ে আলতো সুরে বলে,
‘ তোর জন্যে আজ আমার মেহেভীনের এই অবস্হা।
তোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে জাস্ট। এখন তুই বলবি তোর পিছনে কে আছে?নাহলে কিন্তু এখুনি মেরে ফেলবো তোকে।’
শেষের কথাটি একপ্রকার গর্জন দিয়ে বললো আরহাম। আশিকের এতোটাই খারাপ অবস্হা, সে মুখটাও খুলতে পারছে না তবুও সে অনেকটা কষ্টে বলে দেয় এর পিছনে মূল মাস্টারমাইন্ডের নাম।

মায়রার বাবা রুক শাহেদ জেনে গিয়েছেন আশিককে পুলিশ ধরে ফেলেছে। আশিক এইবার নিশ্চই তার নাম বলে দিবে। কথাটি ভেবেই রুক সাহেদ তর তর করে ঘামতে থাকে। এই শীতের মধ্যেও তার প্রচন্ড অস্হিরতা কাজ করছে। তাকে যা করেই হোক প্রথমত অফিস থেকে বেড়োতে হবে। রুক শাহেদ তার কেবিন থেকে বেড়োতে নিলে,কেউ তার বুক বরাবর লাত্থি মারে। সে ধপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ে। সে তাকিয়ে দেখে আরহাম। আরহাম রুক শাহেদের কলার চেপে ধরে বলে,
‘ এতো সহজে পালালে হবে? এখনো তো অনেক কিছু বাকি আছে রুক শাহেদ। এতেটা খারাপ আপনি। কতটা নিষ্ঠুর হলে নিজের মেয়ের বয়সী আরেকজন মেয়ের সন্তানকে মেরে ফেলার জন্যে লোক ভাড়া করে নেয়। শুধুমাত্র নিজের মেয়ের সুখের জন্যে ছিহ। অথচ আপনাদের মতোই জঘন্য মানুষেরা সমাজের নামি নামি পদে অবস্হান করছে।’
কথাটি বলেই আরহাম রুক শাহেদকে মারতে থাকে,তখনি পুলিশরা এসে আরহামকে কোনরকম ছাড়িয়ে নেওয়া চেস্টা করে,কিন্তু ব্যর্থ হয়। আরহাম রুক শাহেদের কলার চেপে ধরেইবলে,

‘ এই জঘন্য লোকটাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না। ওর জন্যে আমার মেহেভীন এতোটা কষ্ট সহ্য করছে।
আমার মেহেভীনের এবং বাচ্ছার কিছু হয়ে গেলে তখন আমি করবো? আপ্নারা বলতে পারেন?’
পুলিশ অফিসার আরহামের কাছে গিয়ে বললেন,
‘ আপনি উনাকে ছেড়ে দিন। একটু শান্ত হোন প্লিয।
আইনের উপর একটু ভরসা রাখুন। আইন ঠিক রুক শাহেদকে তার সঠিক শাস্তি দিবে। ‘
আরহাম ঘৃণিত দৃষ্টিতে রুক শাহেদের দিকে তাকিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। রুক শাহেদকে পুলিশ গ্রেফতার করে নেয়। সমস্ত মিডিয়ার লোকেরা জানতে পেরে একপ্রকার ছুটে এসে রুক শাহেদকে গ্রেফতার করার ছবি তুলে, নিউজ বানিয়ে দেয়,
‘ বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী রুক শাহেদ সবে মাত্র পুলিশ হাতে
আটক হলেন,নিজের কুকৃর্তির জন্যে।’
রুক শাহেদের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সে

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৩

এমন একটা জঘন্য কাজটি করে ফেললেন তার ফল তাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে।
টিভিতে নিজের বাবার এইসব কৃর্তির কথা শুনে মায়রা চোখের জল ফেলতে থাকে।
রুক শাহেদকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, আরহাম থানার থেকে বেড়োতেই তার ফোনটা বেজে উঠে। সে তাকিয়ে দেখে আরিয়ানের ফোন। ফোন রিসিভ করে সে যা শুনে তাতে সে একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে যায়। সে একপ্রকার ছুটে হসপিটালে চলে যায়।

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৫

3 COMMENTS

Comments are closed.