তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪২

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪২
হুমাইরা হাসান

ইরফান মাহমুদ আহান! গম্ভীর, শান্ত, রাশভারি স্বভাবের আহান বরাবরই পড়ুয়া ছেলে। পড়াশোনাটা তার জীবনে নেশার মতই কাজ করতো। স্কুল কলেজ সব জাগায় পড়াশোনার জন্য ব্যপক খ্যাতি। ভার্সিটি প্রাঙ্গণে সেই খ্যাতি আরও বেড়েছে যার দরুন লন্ডনের নামকরা ভার্সিটি থেকেই গ্র‍্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেছিলো। তবে পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ আর অনুসন্ধিত্সার কারণে আহান আর তার বন্ধুরা মিলে লন্ডনে থাকা অবস্থাতেই নিউইয়র্কের একটা ভার্সিটিতে স্টাডি রিসার্চের জন্য এপ্লাই করেছিলো।

আবেদন টা করেছিলো দেশে ফেরার কয়েকদিন আগেই। কিন্তু মা দিদুন সহ বাবা সকলের অস্থিরতার জন্যে সে দেশে আর বেশিদিন থাকতে পারেনি, একমাত্র ছেলেকে দূরে রাখার ইচ্ছে তাদের কখনও ছিলো না,শুধু লন্ডনে পড়াশোনা করার আহানের তীব্র ইচ্ছের কাছে হার মেনে রাজি হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের জন্যেই তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়েছে। ভালো ভার্সিটি থেকে ফার্স্ট গ্রেডে গ্রাজুয়েট হওয়ায় দেশে এসে অনতিবিলম্বেই প্রফেসরের পেশায় নিযুক্ত হয়েছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু সেই আবেদনটা পেন্ডিংয়েই ছিলো। দীর্ঘসময় পর নোটিশ এসেছে এপ্রুভিংয়ের। তাই আর এত বড় সুযোগ টা হাতছাড়া করেনি, প্রসেস টার ডিউরেশন দশ থেকে পনেরো দিন। এই ছোট সময়ের ব্যবধানেই স্বপ্নের স্টাডি রিসার্চ টা সম্পূর্ণ করতে পারবে বলে আহান আর দেরি করেনি।

-তুরা, মা খেতে আই বেলা হয়ে গেলো তো। আবার ভার্সিটিতেও তো যেতে হবে?
তহমিনার ডাকে ধ্যান ভাংলো তুরার। এতক্ষণ নির্জীব দৃষ্টিতে চেয়েছিলো দূরের মাঠের দিকে। বারান্দার গ্রিলে চেপে ধরে রাখা হাতটা আলগা করলো। হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো গালে লেপ্টানো উষ্ণজল। ঘরে এসে চুলগুলো ব্যান্ডে এঁটে ব্যাগটা হাতে নিয়েই বেরলো ঘর থেকে।

-বুড়ি, নয়টা বাজতে চলল। শিগগির নাস্তা করে নে,দেরি হয়ে যাবে তো।
তুরা মোলায়েম অধর বিস্তৃত করে সামান্য হাসলো জোরপূর্বক। এই মানুষ গুলোর সামনে মন খারাপ করে থাকা মানে নিজের সাথে দুটো মানুষের মনটাকেও খারাপ করে দেওয়া। চুপচাপ নাস্তা সেরে বেরিয়ে আসলো মাহিদের সাথে।
সেদিন রাতের পর আর আহানের সাথে থাকার সুযোগ হয়নি তুরার।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আহানকে পাশে না পেলেও ভেবেছিলো পরদিনই পাবে। চিন্তামোতাবেক আহান এসেও ছিলো পরের দিন। কিন্তু সেটা বিদায়ের খবর জানাতে। আহানের স্বপ্ন ওর ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিয়ে হাসি মুখে বিদায় দিলেও ভেতরে ভেতরে বেদনা,শূন্যতার দহনে পুড়ছে। আজ দুটো দিন হয়ে গেলো আহানের চেহারা টা দেখেনি, ভীষণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। সন্তপর্ণে ব্যস্ত হাতে মুছে নিলো তুরা মাহিদ দেখার আগেই।

-কি হলো, ওঠ?
মাহিদের কথায় ধ্যান ভেঙে গাড়িতে উঠে বসলো। রোজ তো আহানই তাকে নিয়ে ভার্সিটি আসতো,অথচ আজ অন্য কারো সাথে যেতে হচ্ছে। শূন্যতায় খাঁ খাঁ করা বুকটায় শূঁড়ের মতো বিধে উঠলো বেদনা। তবুও রিক্ত মুখশ্রী শান্ত রাখলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো, মানুষটা ফোন দেয়নি জেনেই অযথাই চেক করলো। না কল না মেসেজ, কোনো টাই পেলোনা আহানের থেকে। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো।

ফোনটা আহান দুদিন আগেই দিয়েছে তাকে, যেদিন আহানের ফ্লাইট ছিলো। স্যামসাং এর নিউ ভার্সনের একটা মডেল। সিম মেমোরি সবকিছু ঠিকঠাক করেই দিয়ে গেছে আহান। কিন্তু ফোনে তো এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মানুষটার নাম ভেসে উঠলো না এখনো। কোথায় আছে কি করছে, চিন্তায় উৎকণ্ঠায় নাভিশ্বাস উঠার জো তুরার।
গাড়িটা ভার্সিটি এসে থামলেই মাহিদকে বলে এগিয়ে গেলো ক্লাসের দিকে। সাদমান আজও আসেনি। মাকে হসপিটাল থেকে বাড়িতে নিয়ে সবটা সামলে আসতে পারেনি। তুরা নিস্ক্রিয় ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বসলো ফারিহার পাশে
আসতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ায় তুরা বসার পরপরই টিচার প্রবেশ করলো। আহানের ক্লাসের প্রক্সিতে অন্য স্যারকে দেখে তুরার বিষাদময় মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।

পরপর দুটো ক্লাস হলে ব্রেক টাইমে ফারিহা তুরাকে নিয়ে ক্যান্টিনে আসলো। দুটো কোল্ড কফি হাতে নিয়ে একটা তুরার সামনে রেখে ওর বরাবর বসে স্পষ্টত ভঙ্গিমায় বলল
-দুলাভাই স্যারের জন্যে মন খারাপ?
শব্দের ব্যবহারে প্রত্যুত্তর করলো না। মাথাটা দুলিয়ে না বোধক জানালো। ফারিহা কফিতে একবার চুমুক দিয়ে বলল
-কার সামনে নাটক করছিস তুই? স্যারের বিরহে বিরহবতী হয়ে গেছিস তোর ঠা ডা পরা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে
আ’সামীদের মতো করে ঘাড় নিচু করেই বসে রইলো তুরা। ফারিহা এক হাত তুলে তুরার হাতের উপর রেখে মন্থর কণ্ঠে বলল

-দেখ আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা,যে কারোর ই মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক, তা বলে তুই এমন করে থাকবি বল। টিনম্যান টাও আসেনি তার উপর তুই ও এমন মন মরা হয়ে থাকলে তো আমার তাল পুকুরে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করছে
স্বাভাবিক চোখে তাকালো তুরা। ফারিহা চোখে মুখে ক্লান্তিকর একটা ভাব নিয়ে এক গালে হাত রেখে বসে আছে।
-আমি মন খারাপ করছি না

ছোট ছোট শব্দে বলল তুরা, নির্লিপ্ত বাচনভঙ্গি, ওড়নার আঁচল টা আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে বলল।
-মন খারাপ করছিস না তো কেঁদে চোখ কেনো ফুলিয়েছিস।
ফারিহার কাঠকাঠ বাক্যে চুপ মেরে গেলো তুরা। ফারিহা খানিক থেমে আবারও বলল
-দেখ দুলাভাই স্যার তো উনার স্টাডি পারপাসেই গিয়েছে, এক প্রকার বাধ্য হয়ে।আবার কিছুদিন পরেই চলে আসবে।তুই এমন একটা চেহারা করে আছিস যেনো উনি তোকে ছেড়ে একা একা হানিমুন করতে গেছে
চোখ মুখ ছোট করে বলল ফারিহা। তুরা ফারিহার কথায় হাসবে না কাঁদবে বুঝলো নাহ। তবুও বাকা ভাবে বলল

-যাক না হানিমুনে, নিষেধ কে করেছে
-হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। স্টাডির জন্যে গেছে বলেই তুই ছ্যাকাভ্যাকা খাইয়া ঘুরছিস। হানিমুনে গেলে তুই নিশ্চিত কচু গাছে ফা’স লাগাতি
তুরা ফারিহার কথা শুনে কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-বয়েই গেছে আমার ওমন একটা গোমড়ামুখো ব’জ্জাত লোকটার জন্যে ফা’স লাগাতে। আমি আরেকটা বিয়ে করে নেবো
বলে কফিতে চুমুক দিলো, ফারিহা তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল

-একটা জামাইকেই পালতে পারোস না, আবার আরেকটা চাস লোভী মহিলা
-কিসের লোভী, জামাই যদি ওমন আহান দ্যা গ্রেট পাজি মাস্টার মশাই হয় তাহলে আরও একটা বিয়ে করার হক আমার আছে।
-তুই নিজেই অপদার্থ, বউধর্ম পালন করিস কিছু?
তুরা বিব্রতকর চেহারা করে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খানিক। চোখ বাকিয়ে বলল
-বউধর্ম আবার কি?
-তুমিতো এটাই জানো নাহ,আবার বলে আরেকটা বিয়ে করার হক আছে। এই যে স্যার দুদিন হলো নিউইয়র্ক গিয়েছে, একটা বার ফোন করেছিস বলতো?
ফারিহার কথায় বেশ দমে গেলো তুরা,সে তো আসলেই ফোন করেনি আহানকে, উল্টো নিজেই বসে ছিলো আহানের ফোনের অপেক্ষায়। তটস্থ হয়ে বলল

-না, কিন্তু উনিও তো দেয়নি
-তুই আসলেই গাধা,গাধার গাধা। বিদেশ তো নাচতে যাননি,এত দূর পথের জার্নি,ওখানে গিয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তার উপর ওখানকার ভার্সিটি যেমন স্ট্রিক্ট, দিন রাত এক ওদের। আর সময়ের পার্থক্যও প্রায় দশ ঘন্টা, ধরা যায় ওখানে যখন রাত এখানে দিন। তো স্যার তোর সুবিধার কথা ভেবেই হয়তো দেননি,আবার ব্যস্ততাও তো কম থাকবে নাহ। তোর কি উচিত ছিলো না উনাকে একবার ফোন করা,খোঁজ নেওয়া।

ফোনটা তোকে কি ঝুলিতে ভরে রাখার জন্য দিয়ে গেছে বলদি
একদমে হড়বড়িয়ে কথা গুলো বলল ফারিহা। কিন্তু তুরা সবটা শুনে ভাবল, তাই তো! এভাবে তো সে ভেবে দেখেনি। সে নিজেও তো ফোন করে দেখতে পারতো একবার। আহান তো বলেছিলো যে তার নাম্বার টা সেইভ করে দিয়েছে। এ পর্যায়ে এসে তুরার এবার নিজের উপরেই বিরক্ত লাগলো। আসলেই ষ্টুপিড সে,একটা বার নিজেও তো ফোন দিয়ে দেখা যেতো।
তবে ফারিহার সাথে আর কথা তেমন না বাড়িয়ে আবারও ক্লাসে গেলো। আরও তিনটা ক্লাস করে বাড়ি ফিরতে প্রায় দেড়টা বেজে গেলো।

পুরো বিকেলটা ব্যস্ত কাটলো তুরার,বাড়িতে এসে গোসল খাওয়া সেড়ে ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙার পরেও বই নিয়ে বসেছে। পরশু ক্লাস টেস্ট তুরার, সাজেশন শীটের অনেকটাই বাকি এখনো।
বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত একটানা পড়ল। এসবের মাঝে আহানের বিরহ মন অব্দি ছুঁয়েও যেনো ছুঁলো নাহ।পড়া শেষে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। একবারে ফ্রেশ হয়ে বেরলো। মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো, তোয়ালে খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলের উপর বসে চুল মুছতে লাগলো।

আনমনা হাতে চুল মুছতে মুছতে থপ করে কোলের উপর ভারি কিছু পরতেই ভাবনাচ্যুত হলো। ‘ম্যাও’ করে উঠলো টুনি, বিকেলের পর হয়তো কিছু খাইনি বলে এমন করছে। তুরা উঠে চুল গুলোতে হাতের আঙুল চালাতে চালাতে ছোট বাটিটা হাতে নিয়ে তাতে অল্প কিছু ক্যাটফুড ঢেলে টুনির সামনে রাখলো। টুনি মহা আনন্দে চপচপ শব্দ করে খেতে লাগলো।
টুনিকে গতকাল রুবি খাতুন এনে দিয়ে গেছে। তহমিনা যেহেতু বলেছিলো তুরাকে কিছুদিন নিজের কাছে রাখতে চাই তাই আর ও বাড়িতে ফেরেনি।

গতকাল ইনসাফ মাহবুব, রুবি আমেনা খাতুন এসেছিলো তুরাকে দেখতে চুমকিটাকেও এনেছিলো। টুনি নাকি সারা বাড়ি জুড়ে ম্যাও ম্যাও করে তুরাকে খুঁজে বেড়ায়, কিছু দিলেও খাইনা,আহানের শোবার জায়গা টাতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তাই ওকে সাথে করেই এনেছে। সকলে মিলে অনেক্ষণ ছিলো তহমিনার বাড়িতে, দিন কয়েক বাদে চুমকির ওমন ননস্টপ পকপক শুনে তুরার মনটা নিমিষেই হালকা হয়ে গেছিলো। এ বাড়িতে থাকলেও মানুষ গুলোকে ভীষণ মিস করছে তুরা।
জানালায় ধাম করে শব্দ হতেই উঠে গেলো তুরা, দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে, খানিক পরপর বিজলি চমকাচ্ছে, বৃষ্টি আসবে বোধ হয়। হুট করেই কারেন্ট চলে গেলো। কিন্তু তুরার কেনো জানি এবার ভয় করলো না।

মামনীর শরীর টা ভালো না তেমন,ঘুমাচ্ছে বোধ হয়,আর মাহিদ ও সন্ধ্যায় ফিরে খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্ত হওয়ায়।
অন্ধকার হাতড়ে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশ অন করলো তুরা, হুট করেই সেদিনকার কথা মনে পরে গেলো। টুনিকে ভূত ভেবে আহানের গলায় ঝুলে কেমন লাফিয়ে ছিলো। আনমনেই ফিক করে হেসে উঠলো তুরা, টুনি খাওয়া থামিয়ে টিপটিপ করে তাকিয়ে আছে, অন্ধকারে গোলগোল চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে ওর। তুরা ওকে এক হাতে কোলে তুলে নিয়ে খাটের উপর বসলো, মনটাতে কেমন বিষন্নতার ঝড় বয়ে গেলো আবারও। আহানের কথা খুব মনে পরছে, আচ্ছা বৃষ্টিকে তো রোমান্টিক ওয়েদার বলা হয়, এই সময় আহান থাকলে কি বলতো

-এই বৃষ্টিটা বেশি বাঁদারমি করছে, ঠ্যাং খোরা করে দেবো
ফিক করে হেসে উঠলো, আসলেই তার জামাইটা ব’জ্জাত গোমড়ামুখো। পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে আসলো। আহানকে কি ফোন দিবে? কিছুক্ষণ ভেবে ফোনটা হাতে তুলল। দেবে কি দেবে না ভেবেই পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেলো, কি আশ্চর্য লোকটা সামনে থাকলে তো একটার পর একটা অকাজ ঝগড়া করতেই থাকে,অথচ এখন কেমন বুক দুরুদুরু করছে শুধু ফোন দেওয়ার কথা ভেবে!

দোমোনা হয়ে খানিক ভেবে ফোনটা আবারও হাতে নিতেই হাত কাঁপিয়ে ভাইব্রেট করে উঠলো ফোনটা, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আহান নামটা। মুহুর্তেই ধক করে উঠলো হৃদপিণ্ড, হাতটা কাঁপুনি দিয়ে ফোনটা পরে গেলো বিছানার উপর, নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোনটা কেটে গেলো।

ফোনটা কেটে যেতেই হুস ফিরলো তুরার, ফট করে হাতে তুলে নিলো বুকের ভেতরটা মুচড়ে ধরল তুরার, এতদিন পরে লোকটা ফোন করেছে অথচ তুরা ধরতে পারলো না, চোখ ভরে এলো জলে, কিন্তু আহান আরেকবার ফোন দিলনা? রাগে কষ্টে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারতেই আবারও জ্বলে উঠলো স্ক্রীন। দুহাতে চোখের পানি মুছে ঝাপসা চোখ স্থির করলো। দুহাতে ফোনটা ধরে কিয়ক্ষণ বাজার পরপরই রিসিভ করলো তুরা। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে কানের কাছে ধরলো ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই, তুরা বুক ভরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পরনের জামা টা খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে, বিজলি চমকানির শব্দের মাঝে মাঝের নিরবতায় ওপাশ থেকে আহানের নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট কানে বাজছে তুরার। কিয়ৎকাল অতিবাহিত হলে সুনসান নিরবতা ভাঙলো আহামের ধীমি স্বরে

-তুরা?
চোখ খিঁচে ধরলো তুরা, কান্নার হিড়িক থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো সজোরে,তবুও মুখ থেকে একটা শব্দও করলোনা। বুকের দুরুদুরু কম্পন সারা শরীরে তিরতির করে ছড়িয়ে গেলো আহানের কণ্ঠে, দুটো দিন না যেনো দুটো বছর পর শুনছে মানুষটার কণ্ঠস্বর। তুরার নিরবতা বরাবরই আহানের অপছন্দ, মেয়েটার চুপ থাকা যেনো আহানের রাগ তরতর করে বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু আজ রাগ হলোনা। অদ্ভুত পীড়ন অনুভূত হলো বক্ষগহীনে। কণ্ঠের খাদ বহাল রেখে আবারও বলল
-কথা বলছ না কেনো তুরা?

কান্নার গুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো তুরার কামড়ে রাখা ঠোঁটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলো। এক হাত মুখে চেপে ধরে রইলো। কথা গুলো কণ্ঠনালীতে আটকে আছে,কিছুতেই কোনো শব্দ করতে পারছে না হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও।
-তুমিকি চুপ করেই থাকবে? এতদিন পরে ফোন দিলাম,অথচ হ্যালো বলার ইচ্ছে টুকুও তোমার নেই
অভিমান জমলো তুরার মনে,এতদিন পর কল করেছে,তবুও এভাবে ব’জ্জাতের মতো করে কথা বলছে। এতদিনে কি তুরার কথা একটুও মনে হয়নাই?একটুও মিস করেনি ওকে? এখন এভাবে বলতে পারলো লোকটা!

-আমি কি ফোনটা রেখে দেবো?
তুরার বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো, সত্যিই আহান ফোনটা রেখে দিবে। এতদিন পরেও একটু কথা বলবে নাহ। চোখের পানি মুছে হরবর করে বলল
-হ্যাঁ তা তো রাখবেনই, আমি কে,কি হই যে আমার সাথে কথা বলতে হবে, এতদিন যেমন ছিলো ওভাবেই থাকুক। কথা বলে দয়া দেখাতে হবে না। আমার সাথে কথা বলে কারো মহামূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না
একদমে কথা গুলো বলে দম ছাড়লো তুরা, হাজারো চেষ্টা করে শক্ত গলায় কথা বলতে গেলেও পারলো নাহ। ধরা গলায় বলতে গিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে দিলো।

আহান মৃদু হাসলো। সে জানে তুরাকে কিভাবে কথা বলাতে হয়! হেলান দিলো রকিং চেয়ারটাতে। একহাতে রাখা জিনিসটা নাচাতে নাচাতে বলল
-আমিতো মহামূল্যবান সময় নষ্ট করে কল করেছি, কেও একজন তো কল করা দূর রিসিভ করে কথা অব্দি বলছে না
রাগ অভিমান একসাথে হয়ে খিটমিট করে উঠলো তুরা,ঝাঝালো গলায় বলল
-আমি কি বলব। কেনো বলব। ওখানে তো বিয়ে করে দুই তিন বাচ্চার বাপ হয়ে গিয়েছেন,এখন আমার সাথে কথা বলে কি লাভ

আহান হাসলো বিস্তর,কিন্তু শব্দ হলো নাহ। এক হাত চুলের ভেতর চালিয়ে বলল
-হ্যাঁ এই জন্যেই তো কল করেছি, বাচ্চা দুটোর নাম কি রাখা যায় বলো তো
রাগে জ্বলে উঠলো তুরার শরীর। আহানের কথা গুলো যেনো শূ’লের মতো গায়ে বিঁধছে। খটমট করে বলল
-হাবা আর গোবা রাখেন দুটোর নাম,কারণ আপনার মতো জাঁদরেলের ভালো কোনো সন্তান হতে পারে না
আহান ভ্রু কুচকে বলল

-এই তুমি তো ভীষণ ঝগড়ুটে হয়েছ,কই ভাবলাম আমি নেই বলে কেঁদেকেটে বালথি ভরে ফেলেছ,আর তুমি কি না পারার চম্পা ভাবির মতো ঝগড়া শুরু করেছো!
রাগ যেনো তরতর করে বেড়ে গেলো তুরার,এবার আর সামলাতে না পেরে কেঁদে দিলো শব্দ করে,আহান চোখ বুজে অনুভব করতে লাগলো তুরার কান্নার শব্দ প্রতিশব্দ। ভেতরটা মুচড়ে উঠলো তুরার কান্না শুনে, ইস কাছে থাকলে তো এখন ঝাপটে ধরে থামানো যেতো,দু’হাতে মুছে দিতে পারতো ছোট্ট মুখ খানা

-হুসস,কাঁদে নাহ। আমি চলে আসব তো
আহানের আদর ভরা গলায় তুরার কান্না থামার বদলে আরও বেড়ে গেলো, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল
-আপনি খুব খারাপ, জল্লাদ, গোমড়ামুখো। একটুও ভালো নাহ। আমি আর আপনার কাছে কখনোই যাবো না।থাকুন আপনি ওখানেই, ওখানেই সংসার পাতুন। আমার কাছে আসতে হবে নাহ

দুচোখ ভরে বন্ধ করে নিলো আহান।পাগলী মেয়েটাকে কি করে বোঝাবে এখানে এসে এমন একটা মুহূর্ত যায়নি যেখানে ওকে মনে করেনি। রাতে ঘুমের মাঝে কেও হাত পা তুলে না দেওয়ায় ঘুমই আসেনা আহানের। ঘুমের মাঝে টি-শার্ট খামচে না ধরায় ইদানীং বুকটাও শূন্য শূন্য লাগে, রাতগুলো যেনো বছর সমান দীর্ঘ হয়ে যায়। হুটহাট তুরা নামটা ধরে ডেকে ফেলে, কাজের ফাঁকে তুরার দৈনন্দিন করা অকাজ গুলো বেশি মনে পরে, বকবক করা চটপটে মেয়েটা কেমন বশ করে ফেলেছে আহানের মন মস্তিষ্ক, সবটা ঘিরে এখন শুরু তারই বসবাস, আর কিচ্ছু ভালো লাগে নাহ।
এতগুলো কথা গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করলো আহান,তুরাকে এসব বলে আরও দূর্বল করে দিতে চাইনা। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলল

-সরি
তবুও তুরার কান্না থামলো নাহ,বরং হিড়িক দিয়ে বেড়ে উঠলো। আহান গমগমে গলায় বলল
-এক মিনিটের মধ্যে কান্না থামাও,না তো কামড়ের শোধের সাথে এটাও যোগ হবে, এ্যান্ড আই সুয়্যার তখন হাজারো অনুরোধ করলেও এক চুল ছাড় পাবে নাহ

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪১

তুরা এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। একে তো সেদিনের পর থেকে কামড়ের শোধ তুলব তুলব করে তুরার মাথা খারাপ করে দিয়েছে আহান এখন আবার এসব ও বলছে, সে তো কাঁদতে চাইনি কিন্তু তাও তো কান্না পাচ্ছে কি করবে।থামছে না তো!

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৩