তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৪

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৪
হুমাইরা হাসান

-একি আপনি!!
এক হাত মাথায় চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আহান। তুরা ভূত দেখার মতো চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।অভিব্যক্তি হতবিহ্বলার শীর্ষে,দু তিনবার চোখের পলক ঝাপটালো। নাহ,স্বপ্ন তো দেখছে নাহ। তাহলে আহান? আহান এখানে! এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলে আহান চাপা স্বরে ধমকে বলল
-চেঁচামেচি বন্ধ করো ষ্টুপিড, জেগে যাবে তো সবাই!
তুরা চমকে উঠে ফুলদানি টা রেখে দিলো। শুকিয়ে আসা চোখ মুখে এগিয়ে আহানের কাছে গিয়ে বলল

-আপনার কি খুব লেগেছে?
আহান স্থুল দৃষ্টিতে তাকালো। এর জবাবে কি বলা উচিত তার? ফুলদানি দিয়ে মাথা ফা’টিয়ে এখন বলছে ‘আপনার কি খুব লেগেছে’। এক হাতে মাথা টা ডলে তুরার দিকে তাকিয়ে বলল
-সারারাত কি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি চাচ্ছো আমি চলে যাবো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুখ ফুলিয়ে সরে দাঁড়ালো তুরা,এবার আহানের উপর আরও রাগ হচ্ছে। চোর হলে তো পি’টিয়ে রাগ কমানো যেত। নিজের স্বামী চোর টাকে কি করে পি’টাবে সে? এমনিতেই তো ফুলদানি দিয়ে একটা বারি বসিয়ে দিয়েছে কপাল বরাবর। যদিও খুব জোরে লাগেনি কিন্তু কমও তো লাগেনি। আহান ঘরের ভেতর এগিয়ে গেলে তুরা সুইচ টিপে বড় লাইট গুলো জ্বালিয়ে দিলো। আহান কপাল থেকে হাত সরাতেই বৃত্তাকার ফোলা জায়গা টা চক্ষুগোচর হলো তুরার। আঘাত টা বেশ জোরেই লেগেছে যার দরুন তাৎক্ষণিক ভাবেই লালচে চিহ্ন বসে গেছে।

-তোমাকে আমি ভোলা ভালা ভেবেছিলাম। তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে।আজ আমার মাথার খুলিই উড়িয়ে দিতে। শেষে কাল খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন উঠতো ‘বউ কে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই নিহত হলো প্রফেসর ইরফান মাহমুদ আহান’
আহানের কথায় তুরার রাগ তিরতির করে বেড়ে উঠলো। এক তো লোকটা চোরের মতো এসে ভয় পাইয়ে দিয়েছে এখন আবার আবল তাবল বকছে। তুরা গাল ফুলিয়ে বলল

-তো রাত বিরেতে বারান্দায় চোরের মতো এসে দাঁড়িয়ে থাকলে কি আমি বরণডালা সাজিয়ে স্বাগতম করবো?
-করলে আপত্তি করতাম নাহ। আফটার অল স্বামী হই তোমার।
‘হুহ স্বামী হই তোমার ‘ বলে আহানকে মুখ ভেংচিয়ে এগিয়ে গেলো। দুহার মাজায় রেখে বলল
-আপনি না বিদেশ ছিলেন? এত রাত করে কিভাবে আসলেন? তাও আবার চোরের মতো বারান্দা টপকিয়েছেন কেনো?
আহান কপাল থেকে হাতটা নামিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বসলো। ধুসর বর্ণের শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলতে খুলতে বলল

-পুরো ২২ ঘণ্টা জার্নি করে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে দেশে পা রেখে বাড়িতে না গিয়েই সোজা চলে আসলাম এখানে।এতো রাতে যাতে কেও টের না পায় তাই বারান্দা বেয়ে উঠলাম।কিন্তু বাঁদর টাকে দেখতে এসে নিজেই তকমা খেয়ে গেলাম। এইকয়দিনেই দস্যি হয়েছে পুরো
আড়চোখে চেয়ে বলল।পকেট থেকে ফোনটা বের করে খাটের উপর রাখলো। তুরা আহানের কপালের দিকে তাকালে আঘাতের দাগটা দেখে ভীষণ খারাপ লাগলো। শেষে কিনা তার জন্য এতটা ব্যথা পেতে হলো লোকটার। কিন্তু সে তো আর জেনে বুঝে করেনি। আহানের কথার মর্মার্থ না বুঝেই অপরাধীর মতো মুখ করে এগিয়ে আহানের পাশে বসে হাত তুলে আহানের কপালে দাগ হওয়া যায়গাটাতে নরম আঙুলে বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলল

-খুব লেগেছে?
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নয়নে নিষ্পলক চেয়ে রইলো আহান তুরার আদুরে মুখ খানার দিকে। নিমিষেই সুদীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি অবসাদ মিলিয়ে গেলো। বুকের ভেতর শীতলতায় ছেয়ে গেলো। এই মুখটা দেখবার জন্যেই তো এসেছে সে,সুদূর পথ পারি দিয়ে, বিশ্রাম বা শরীরের পরোয়া না করে বাড়ির কাওকে না জানিয়েই এতো রাতে সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে এসেছে।
মৃদু হাসলো আহান,রুক্ষ শুষ্ক পুরু ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হলো। কপালের উপর অবস্থানরত তুরার ছোট্ট হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলল

-এখন আর লাগছে নাহ! তবে তুমি চাইলে পুরোপুরি সারিয়ে দিতে পারো ব্যাথাটা
তুরা কৌতুহলী হয়ে চাইলো। সে ব্যথা সারিয়ে দিতে পারবে? আগ্রহী স্বরে ঝিলিক দিয়ে বলল
-সত্যি? কি করলে সেরে যাবে বলুন। আমি এক্ষুণি সারিয়ে দেবো
মুঠোতে পুরে রাখা হাতের আঙুল নিজের বলিষ্ঠ হাতের আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরলো আহান। ধীমি গলায় সামান্য ফিসফিসানির মতো করে বলল

-তোমার নরম ঠোঁট দুটি যদি এখানে ছুঁয়ে দাও তাইলেই সব ব্যাথা সেরে যাবে
কথার সাথে গভীর চোখের চাহনি দিয়ে তুরার ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো আহান, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো তুরার সারা শরীর। আহানের কথায় যেনো কোনো মা’দকতা মেশানো ছিলো যা তুরার শরীরে নে’শার মতো অসাড়তা ধরিয়ে দিলো। চট করে ঢোক গিলল বার দুয়েক, কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-ছি ছি, মুখের কি ভাষা। বিদেশ থেকে অসভ্যতা শিখে এসেছে
তুরার বলার ধরনে আহান হাসলো। প্রত্যুত্তরে বলল

-সে আমার ইচ্ছে, আমি চাইলে শুধু অসভ্যতা কেনো আরও অনেক কিছুই করতে পারি
তুরা চোখ মুখ মুদে ফেলল। কিসব কথাবার্তার ছিরিছাঁদ। নাক ছিটকে বলল
-আপনি অত্যন্ত অসভ্য প্রজাতির একটা লোক। কথায় বলা উচিত না আপনার সাথে
বলেই উঠে দাঁড়ালো। আহানকে অপেক্ষা করতে বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো, দরজা খুলতেই ড্রয়িং রুমের অন্ধকারাচ্ছন্ন পিনপতন নীরবতার পরিবেশ টায় জহুরি দৃষ্টিতে চোখ বুলালো। চারপাশ টা মানবশূণ্য। অবশ্য হবেই বা না কেনো। মামনী আর মাহিদ অনেক আগেই তো ঘুমিয়ে পরেছে। রাত ও তো কম হলো না। ঘড়ির কাটায় একটা বেজেছ মিনিট বিশেক আগেই।

অন্ধকারে ড্রয়িং রুমে চুপি চুপি সাবধানী পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে ফ্রিজ খুলে কতগুলো আইস কিউব বের করে নিলো তুরা। ছোট একটা বাটিতে করে আইস কিউব গুলো নিয়ে আবারও চুপি চুপি পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।বুকের ভেতর এখনো লাফালাফি করছে,যদি মামনী বা ইয়াজ ভাই দেখে ফেলতো কোনোভাবে!

এগিয়ে এসে হাতের বাটিটা রেখে নিজের ওড়নার কাপড়ে একটা বরফের টুকরো পেঁচিয়ে আলতো স্পর্শে চেপে ধরলো আহানের কপালটাতে। ব্যথায় টনটনে জায়গাটাতে বরফের অত্যাধিক শীতল স্পর্শে নড়ে উঠলো আহান, ব্যথায় চোখ খিঁচিয়ে নিলো। তুরার ভীষণ খারাপ লাগলো আহানের এমন অবস্থা দেখে। অনুতপ্ততায় ভেতর টা মুছড়ে উঠলো। তুরার ছোট করে রাখা শুকনো মুখের দিকে অপলক তাকালো আহান, তুরার নির্বিন্ন চেহারা দেখে তার কারণ টাও আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো নাহ। ফট করে তুরার কোমর চেপে ধরে টেনে নিলো কাছে,তুরা হকচকিয়ে উঠে অপ্রস্তুত গলায় বলল

-ক্ কি করছেন? ছাড়ুন
-ছাড়ার জন্যে তো আর ধরিনি। চুপচাপ নিজের কাজ করো
তুরা বরফ লাগানোতে মনোযোগ দিতে গেলেও পারলো নাহ। মোচড়ামুচড়ি করতে গেলে বরফ গলার পানি ছিটে পরলো আহানের শার্টে। ভিজে গেলো অর্ধেকাংশ, তবুও আহান ওভাবেই স্থির রইলো।

পুরুষালি স্পর্শ কোমরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত থাকায় নিঃসাড় হয়ে আসছে শরীর, খাটে বসা অবস্থায় আহানের সামনে দাঁড়ানোই আহানের মাথার উচ্চতা ঠিক তুরার পেট বরাবর। গায়ে ভ্রম ধরানো অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিঃশ্বাসের ধার তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে তুরার পেট,নাভী আর তার আশেপাশে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে বরফ লাগিয়ে ছিটকে সরে এলো।
বিপরীতে মুখ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায়। হাতের বাটিটা টেবিলের উপরে রেখে পেছনে ঘুরতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম, দু’হাতে চোখ ঢেকে চরচরে গলায় বলল

-এই এই আপনি শার্ট খুলছেন কেনো
আহান শার্টের বোতামে হাত চালিয়ে আড়চোখে তাকালো তুরার দিকে। মন্থর গলায় বলল
-ভিজে গেছে শার্ট
-আ আপনি প্লিজ শার্ট খুলবেন না,ওভাবেই থাকুন
আহান এখনো ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে তুরার দিকে। বাকা হেসে এগিয়ে গেলো তুরার সামনে। কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল

-হাত সরাও,তাকাও আমার দিকে
তবুও তুরা দু’হাত চোখের উপর ঠেসে ধরেই রইলো। আহান ওর হাত দুটো তুলে চোখ থেকে তুরার হাত সরিয়ে দিলো। তুরা চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রাখলে আহান আবারও একই গলায় বলল
-আমার দিকে তাকাও তুরা

তুরা ঘাড় নামিয়ে নিলো। কিছুতেই তাকানো যাবে না,তা দেখে আহান ফিচেল গলায় বলল
-আমি শার্ট খুললেই উল্টা পালটা চিনতা করো কেনো। দিনদিন শেইমলেস হচ্ছো তুরা রাণী
ফট করে চোখ খুলে তাকালো তুরা, কড়া চাহনি দিয়ে বলল
-উলটা পালটা চিনতা মানে?
-মানে এই যে আমাকে এভাবে শার্টলেস দেখলে তোমার মনে ভুলভাল চিন্তাভাবনা আসে,নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারো না। তাই তো চোখ ঢেকে নাও

আহানের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই মুখে আসলো না তুরার,আমতা-আমতা করে চুপ করেই রইলো। তুরার অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে আহান ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে দূরে সরে গেলো। আধখোলা বোতাম গুলো ছড়িয়ে শার্ট টা পুরোপুরি খুলে ফেলল। লজ্জায় অপ্রতিভতায় তুরার গাল লাল হয়ে আসলো। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে। নাহ। দু’হাতে জামা খামচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আহান তুরার লজ্জা,বিমূঢ়তা আরও বাড়িয়ে বলল

-ওখানে দাঁড়িয়ে আমাকে স্ক্যান বন্ধ করো। আমারও তো লজ্জা শরম আছে নাকি। এভাবে নিশুতি রাতে যদি একটা মেয়ে এভাবে বেহায়াদের মতো তাকিয়ে চোখ দিয়ে গিলে খাই তাহলে আমার মতো নিরীহ পুরুষের কি করা উচিত!
তুরা পারছে না মাটি ফাঁক করে ঢুকে পরতে। লোকটা এতো ব’জ্জাত। শুকিয়ে আসা ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে কড়া গলায় বলল

-ছিহ্, বিদেশের হাওয়া গায়ে লেগেই এই অবস্থা আপনার। যা নয় তা বলে যাচ্ছেন
আহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল
-বিদেশের হাওয়া ইচ্ছে করেই গায়ে লাগিয়েছি। বউ তো বাচ্চা,আমিও ভদ্র হয়ে থাকলে বংশ এগোবে কি করে, তাই একটু আকটু অসভ্য হলে ক্ষতি নেই!
-আমি বাচ্চা? কোনদিক থেকে বাচ্চা মনে হয় আমাকে?
আহান চোখ ছোট করে তুরার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলালো। তুরা আহানের এরূপ কাজে বেশ অস্বস্তিতে পরলো। চোখ মুখ কুচকে বলল

-এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো?
-দেখছি
-কি?
-দেখতে পিচ্চি হলেও একেবারেও ছোট না,ঠিকঠাক ই আছে সব৷ শুধু বুদ্ধির বিকাশ দরকার
আহানের লাগামহীন বেলাজ কথাবার্তায় তুরার হৃদযন্ত্র থেমে গেলো। খামচে ধরে রাখা জামাটাও হাতের করপুট ঢিলে হয়ে খুলে গেলো। চোখ বন্ধ করে থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, খানিক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে এগিয়ে আসলো। সাদা রঙের একটা শার্ট আহানের সামনে ধরে বলল

-এটা পরে নিন।
আহান ভ্রু কুচকে তাকালো। এটা তো তারই শার্ট তুরার কাছে কি করে? এ বাড়িতে তো তার কোনো জিনিসই থাকার কথা নাহ!
-এটা এখানে আসলো কি করে?
-এতো জানতে হবে নাহ। এভাবে নির্লজ্জের মতো উদাম গায়ে না থেকে এটা পরুন আর আমাকে উদ্ধার করুন
আহান আর প্রত্যুত্তর করলো না। তুরা এগিয়ে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিলো, আহানকে খাবার কথা বললেও সে নাকচ করে দিলো। তুরা নিজেও জানে এতো রাত করে আহান কখনও খাবে নাহ। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এসে শুয়ে পরলো আহানের পাশে। বালিশ ঠিক করে মাথা রাখতে গেলেই আহান এক টানে নিজের বুকের উপর ফেলল তুরাকে।

-কি করছেন,ঘুমাতেও কি দিবেন নাহ
-হুসস,তোমার কি মনে হয় রাত বিরেতে চোরের মতো মই বাধিয়ে বারান্দা টপকে এসেছি তোমাকে দুই হাত দূরে শুয়ে থাকার জন্যে।
-কিন্তু..
বলেই নড়াচড়া করে আহানকে সড়িয়ে দিতে উদ্যত হলেই আহান আরও প্রগাঢ় ভাবে চেপে ধরলো তুরাকে বুকের উপর,,নেশাক্ত গলায় বলল

-উহুম,একচুল নড়বে না। নাহলে কিন্তু আমার এক মিনিট ও লাগবে না সংযমচ্যুত হতে। কিন্তু আমি তা চাইছি না এখন। তাই চুপচাপ ঘুমাও।
স্তব্ধ হয়ে গেলো তুরার সমস্ত বদন,শরীরে মৃদু বল টুকুও পেলো নাহ। চুপ করে আহানের বুকে মুখ গুঁজে পরে রইলো। হয়তো মনে মনে সেও চাচ্ছিলো আহানের এই আদরটুকু!

ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ছুটে গেলো তুরার। খানিক এপাশ ওপাশ করে আহানের কথাটা মনে হতেই ধপ করে চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু কই! আহানতো কোথাও নেই? কিন্তু কাল রাতে যে সে..তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিলো সে এতকিছু? নিমিষেই ভারাক্রান্ত হয়ে মনটা বিষিয়ে গেলো। প্রচন্ড মন খারাপ করে ঘাড় ফেরাতেই বালিশের উপর ছোট সাদা কাগজের একটা কিছু ভাঁজ করা অবস্থায় দেখতে পেলো। তড়িৎ গতিতে কাগজটা হাতে নিয়ে খুলতেই গোটা গোটা অক্ষরের লেখা দেখতে পেলো

“গুড মর্ণিং তুরা রাণী, আপনি উঠার আগেই চলে যাচ্ছি। সারারাত আমার বুকটা কব্জা করে ঘুমিয়ে সকালেও জেঁকে ধরেই ছিলে। ঘুমন্ত মুখটা দেখে আর ডাকার ইচ্ছে হলো না। তাই না বলেই চলে যাচ্ছি। আর এবার থেকে আমার শাশুড়ীকে বলবা নিচতলায় থাকতে এভাবে বারান্দা টপকে উঠতে গিয়ে কোনদিন পরে হাড় ভাঙবে তো!”
ফিক করে হেসে দিলো তুরা। স্বপ্ন দেখেনি সে,তার মাস্টার মশাই সত্যিই এসেছে। মাঝরাতে চোরের মতো এসে আবার ভোরের আগেই পালিয়েছে। সশব্দে হেসে উঠলো তুরা।

তহমিনার ডাক শুনেই খাট থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নাস্তা সেরে রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশে বেরিয়ে পরলো।
যথাসময়ে ভার্সিটি এসে ক্লাসে ঢুকলো হাসি মুখে। আজ সাদমান ও এসেছে। তবে ওদের দুজনের মুখভঙ্গি দেখে ভ্রু কুচকালো তুরা। কি ব্যাপার। সবসময়ই কোনো কিছু নিয়ে হাঙ্গামা করতে থাকা দুটো আজ দুদিকে ফিরে আছে কেনো?
ললাটে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গেলো। তুরা যেতেই ফারিহা সরে গিয়ে মাঝখানে জায়গা করে দিলো। ব্যাগ রেখে বসে সোজাসাপ্টা ভাবে জিজ্ঞাসা করলো তুরা

-কি ব্যাপার বলতো।দুজন এমন বাংলার পাঁচ করেছিস কেনো মুখ?
তুরার কথায় একবার আড়চোখে তাকালো সাদমান। কিন্তু জবাব দিলো নাহ। তুরা বেশ অবাক হলো,কেসটা জটিল ঠেকছে! কনুই দিয়ে ফারিহাকে গুঁতো দিয়ে বলল
-এই কি হয়েছে বল। দুটিতে এমম ভেটকাইছিস কেনো?
-সেটা আমাকে না জিজ্ঞাসা করে ওই ভেজাল টারে জিজ্ঞাসা কর। বেটা জলজ্যান্ত ভেজাল। সব কাজেই ভেজাল লাগায়
খটমট করে বলল ফারিহা। তুরা বেশ হতম্বিত হলো। ব্যাপার কি! দুজন আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছে। সাদমানকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ও নিজেই বলল

-আমি ভেজাল নই, তুই নিজে জালিয়াতি। তুই মানেই জাল
-এই দেখ একদম আমার নামে আজেবাজে বকবি না। এই জন্যেই বলে বাঙালির ভালো করতে নেই
ক্ষিপ্ত স্বরে বলল ফারিহা,প্রত্যুত্তরে সাদমান ও তেজিয়ান গলায় বলল
-কে বলেছিলো ভালো করতে, মিথ্যা বলে ভালো করার কোনো দরকারই ছিলো না
-আমি মিথ্যা বলেছি? আমি মিথ্যাবাদী?

-থামমম! দুজনই থাম,শান্ত হ। কি নিয়ে এতো ঝামেলা করছিস দুজনে?
তুরার ধমকে শান্ত হলো দুজন। সাদমান চুপ করে গেলে ফারিহা গাল ফুলিয়ে বলল
-ওর আম্মু অসুস্থ থাকায় ও পুরো পাঁচদিম টিউশনি করাতে যেতে পারেনি বলে ওই স্টুডেন্ট এর মা ওকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় আমি ওকে একটা টিউশনি জোগাড় করে দিলাম। কই আমাকে ধন্যবাদ বলবে তা না উল্টো আমাকেই কথা শোনাচ্ছে।
ফারিহার কথা পুরোটা শুনে তুরা সাদমানকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই ও নিজে থেকে বলে উঠলো

-কিন্ত ও আমাকে বলেনি যে স্টুডেন্ট ওর নিজেরই বোন।আমি কাল পড়াতে গিয়ে দেখি ও স্টুডেন্ট এর বাসায় বসে আছে। পরে এসে জিজ্ঞাসা করলে বলল যে ঝুমঝুম ওরই চাচাতো বোন
গাল ফুলিয়ে বলল সাদমান। ফারিহা কটমট করে বলল
-ঝুমঝুম না রিমঝিম। কে কার বোন কোনটা কার বাড়ি সে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে স্টুডেন্ট এর নাম মনে রাখ তাতেও লাভ।
বলেই মুখ ভেংচালো ফারিহা। এবার বুঝলো তুরা সবটা। ফারিহা সাহায্য করতে গিয়ে ওর নিজের চাচাতো বোনকে পড়াতেই সাদমান কে ঠিক করেছে, অন্যদিকে সাদমানের মতো ব্যক্তিত্বের মানুষ নিজের বান্ধবীর বাড়িতে টিউশনি করাবে এটাও তার কাছে লজ্জাজনক। দুজনের কথা শুনে তুরা বলল

-তো এখন তুমি কি চাও সাদমান। তুমিকি রিমঝিমকে পড়াতে চাও না?
-অন্য কোনো স্টুডেন্ট হলে আমার আপত্তি ছিলো না,কিন্তু,,এভাবে..
তুরা বুঝতে পারছে সাদমানের অস্বস্তিটার ব্যাপারে। কিন্তু তবুও সাদমানকে শান্তনা দিয়ে বলল
-দেখো টিউশনিটা তো তোমার দরকার। আর ওর বোন তো কি হয়েছে,স্টুডেন্ট তো স্টুডেন্ট ই হয়৷ আর ও তো তোমাকে জালাবেও না ওই সময়টাতে। তুমি অন্যসব স্টুডেন্টসদের মতই রিমঝিম কে পড়িয়ে চলে এসো
সাদমান ভাবুক মুখ করলেই ফারিহা ফটাফট করে বলল

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৩

-ওর ইচ্ছে না থাকলেও পড়াতেই হবে। ওর জন্য আগের টিচার টাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে বাদ দিয়েছি আমি আর রিম,এখন ও না পড়ালে ওকে বস্তায় ভরে তুলে নিয়ে যাবো
-দেখলে? শুনেছো কথার ধরন? ও যেমন ওর বোন তার চেয়েও এক কাঠি উপরে,তাহলে ভাবো আমার কি অবস্থা হবে দুটো ডাকাতের সাথে একসাথে ডিল করতে হলে!
ওদের কথা শুনে তুরা কি বলবে ভেবে পাইনা,তুরা আর কি বোঝাবে ওদের আবারও শুরু করেছে ননস্টপ ঝগড়া!

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৫