তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৮

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৮
হুমাইরা হাসান

পিচ ঢালা রাস্তায় ছোট ছোট পা ফেলে এগোচ্ছে তুরা, তাপমাত্রা খুব বেশি না হলেও বেশ অনেকক্ষণ হাঁটার ফলে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠে ঘাম মুছে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে গিলে আবারও হাঁটা ধরলো।
হাত ঘড়িতে সময় সকাল আটটা বেজে ছত্রিশ, এখনো অনেকখানি সময় আছে ক্লাস শুরু হতে,তুরা আনমনা হয়েই ধীরে সুস্থে হাঁটতে থাকে।

সকালে আহানের ঘুম ভাঙার আগেই উঠে বেরিয়ে পরেছে,তবে তুরা বের হওয়ার আগেই রুবি আর আমেনা খাতুন ফিরেছে, সঙ্গে রাইমা কেও সাথে এনেছে।
ওদের সাথে কথা বলেই বেরিয়েছে তুরা। কাল অর্ধেক রাত পর্যন্ত টেবিলে বসে একের পর এক ম্যাথ সলভ করেছে, আহানের কড়া নির্দেশ..ক্লাসে দেওয়া সাজেশন শেষ না হওয়া অব্দি ওর ছুটি নেই। বিষন্ন মনে বসে ম্যাথ করতে করতে টেবিলেই কখন ঘুমিয়ে গেছিলো খেয়াল ই হয়নি, সকালে ঘুম ভাংলে দেখলো খাটের উপর আর আহানের শরীরে ঘেষে শুয়ে আছে, আহানের ঘুমন্ত চেহারা টা দেখলেই তুরার অপ্রতিভ মন গহীনে বারবার উঁকি দিচ্ছে সেদিনের দৃশ্য, আহানের স্পর্শ। তাই লজ্জা ঢাকতে এক প্রকার আহানকে এড়িয়েই চলে এসেছে তাড়াতাড়ি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরও বেশ কিছুদূর হাঁটার পরে হুট করেই মার্কেটের ভেতরের রেস্টুরেন্টের কাঁচের ফাঁকে চোখ যেতে ভ্রু কুচকে এলো তুরার। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠাওর করার চেষ্টা করলো
-ওটা ইয়াজ ভাই না!

আপনমনেই বিড়বিড়ালো তুরা,ললাটে অসংখ্য ভাঁজ পরলো আনজানেই। তুরার ঠিক সামনে রাস্তার ওপাশে রেস্টুরেন্টে সামনাসামনি বসে মাহিদ আর একটা মেয়ে৷ মাহিদের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেলেও মেয়েটা তুরার দিকে পিঠ করে বসে থাকায় একেবারেই দেখা যাচ্ছে নাহ। তুরা বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করার প্রচেষ্টা করেও মেয়েটাকে দেখতে পেলো না। ঘাড়ে থাকা ব্যাগের হাতা টা এক হাতে আঁকড়ে ধরে রাস্তার দুপাশে তাকিয়ে এগোতে নিলেই খপ করে বাহু চেপে টেনে নিলো একটা শক্তপোক্ত হাত।

তুরা হকচকিয়ে তাকালেই এক জোড়া রেষপূর্ণ গম্ভীর চোখ দু’টো খুব কাছে আবিষ্কার করলো
সরে যেতে গেলে প্রশস্থ হাতের বন্ধন আরও দৃঢ় হলো, তীক্ষ্ণ গলায় বলল
-কি করছিলে তুমি,রাস্তা পার সময় ধ্যান থাকে না যে গাড়ি চলে আসতে পারে? এক ধাক্কা লাগলেই তো বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পরবা

ছ্যাৎ করে উঠলো বুকের ভেতর, তুরাকে সরিয়ে আনার সাথে সাথেই ওদিক দিয়ে একটা দ্রুতগামী ট্রাক চলে গেলো। ভাগ্যিস আহান হাত টেনে ধরেছিলো! শ্রবণযন্ত্রে আবারও আসলো একই কাঠ কাঠ কণ্ঠস্বর
-ঠিকঠাক চলা ফেরাও তো করতে পারো না, তাও পাকনামি কমেনা,কতবার বলেছি একা একা আসবে নাহ। এতো কিসের পারা তোমার ভার্সিটিতে আসার?

নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো তুরা, অন্য সময় হলে হয়তো সেও ফটাফট কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু এখন তো দোষটা তারই। কি উত্তর দিবে,আর তাছাড়াও আহানের মুখের দিকে তাকানোর নূন্যতম হিম্মত নেই তুরার।
নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই হঠাৎ মাহিদের কথাটা মনে পরতেই চকিত নজর ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো মাহিদ যেখানে বসে ছিলো যায়গা টা ফাঁকা এদিক ওদিক জহুরি নজর বুলাতেই চোখে পরলো ধূসর বর্ণের গাড়িটার ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য।

-ধ্যাতত্
হাত ঝামটা দিয়ে বলল তুরা,একটুর জন্যে দেখতে পারলো নাহ মেয়েটাকে। মাহিদ তো এ দেশে ফিরেছে বেশিদিন হয়নি আর কারো সাথে খুব একটা মিশতেও দেখা যায়না। তাহলে মেয়েটা কে? পেছন থেকে খুব চেনা চেনা লাগছিলো তুরার!
-কাকে খুঁজছো তুমি?
অকস্মাৎ গম্ভীর কণ্ঠেস্বরের তীক্ষ্ণ প্রশ্নে সচকিত হয়ে তাকালো তুরা,আহান যে এখানেই আছে কথাটা নেহাৎ ভুলেই বসেছিলো। নিজের বোকামির উপর এখন নিজেই চড়াও হচ্ছে, নিজেই মনে মনে ভাবছে ‘এই লোকটা ঠিক ই বলে আমি আসলেই ষ্টুপিড’

কথাটা মনে মনে বললেও মুখ ঝুকিয়ে রেখেই মন্থর গলায় বলল
-না আমার মনে হলো ওখানে ফারিহা আছে তাই আর কি..
বিরক্তি সুলভ চাহনিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আহান, কালো রঙের প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা হাতটা বের করতে করতে ধীমি গলায় বলল
-গাড়িতে বসো
বলেই চাবি বের করে গাড়িতে উঠে বসলে তুরাও ধীর পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলে চলতে শুরু করলো চার চাকার গাড়িটা।

পাঁচ মিনিটের মাথায় ভার্সিটির গেইটের কাছে এসে দাঁড়ালে তুরা আহানের দিকে না তাকিয়েই নেমে গেলো গাড়ি থেকে, তুরার চলে যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আহান,বিড়বিড়িয়ে বলল
-যখন চাইতাম না তখন চোখের সামনেই ঘুরে নেচে বাড়াতো, এখন যখন ছেড়ে থাকতে পারিনা তাই পালাই পালাই করে।যে যন্ত্রণা টা দিচ্ছ তো…তুরা রাণী!

ফোস ফাস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আহান, মেয়েটাকে ধরলেই লজ্জায় মিইয়ে যায়।গত পরশুর পর থেকে তো তাকিয়ে কথা অব্দি বলছে না ঠিক করে,আহান যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তুরার সবসময় দূরে পালানোর চিন্তায়। কিন্তু আহান তো এখন একটুও থাকতে পারেনা আদুরে চেহারা টা দেখতে না পারলে,,এখন নিজেরই আফসোস মনে হচ্ছে, সেদিনই ওর সবটা ধরা দেওয়া উচিত হয়নি।এর চেয়ে আগেই ভালো ছিলো অন্তত ছটফট করে সবসময় আহানের আশেপাশেই তো থাকতো। ক্লান্ত ভঙ্গিমায় ঘাড় দুদিকে নাড়িয়ে গাড়িটা পার্ক করে আহানও ভেতরে প্রবেশ করলো।

-তা নয়তো কি। ও নিজে তো ইঁচড়েপাকা হয়েছেই,সাথে ওর বোনকেও একই পথে টেনেছে,ক্লাস সেভেনে পড়া একটা পিচ্চি মেয়ের মাথায় কিনা বিয়ের চিন্তা ঘোরে,ভাবা যায়!
-কেনো ভাবা যাবে নাহ,ভাবলেই ভাবা যায়। সবাই তো তোর মতো ইন্ট্রিগেশন আর ফাংশন নিয়ে পরে থাকবে না সারাদিন, লেখাপড়ার বাইরেও কিছু আছে

সদা সর্বদার মতো দায়সারা ভাবেই বলল ফারিহা। সাদমান এসে থেকে তুরাকে রিমঝিমের কার্যকলাপ শোনাচ্ছিলো,ওর কথার মাঝেই বা হাত ঢুকিয়ে বলে আবারও চুইংগাম চিবাতে ব্যস্ত হয়ে পরে ফারিহা। তুরা গাল টিপে হাসলো,আগ্রহ দেখিয়ে সাদমানকে জিজ্ঞাসা করলো
-শুধু এসব আজগুবি কথা বলেই সময় পার করে দেয় নাকি পড়াশোনাও করে?
তুরার প্রশ্নে যেনো আরেকটু চকিত হলো সাদমান। সোজা হয়ে বইটা হাত থেকে রেখে বলল

-পড়াশোনা? ওকে হোমওয়ার্ক করতে দিলে বলে ঘুমিয়ে ছিলাম,মন ভালো ছিলো না,অমুক সিরিয়ালে নায়িকার সাথে নায়কের ঝগড়া হয়েছে, অমুক বান্ধবীর সাথে শপিং করতে গেছিলো।
আর যদি আমি সামনে বসেও করতে দি তাহলে খাতা ভরে আঁকিবুঁকি করে রাখে। আমি ভাবতেও পারিনা ওর মাথায় কিসব চলে। সাথে বড় বোন ও তো একটা জুটিয়েছে।কই শাসন করবে তা না আগের টিউটর বেশি পড়া দেয় বলে ওকে ভূতের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে
হাহা করে হেসে উঠলো তুরা সাদমানের বলার ভঙ্গি দেখে, বেচারা বিশাল বিপাকে পরেছে বোঝাই যাচ্ছে। এদিক ফারিহা আবার ক্ষেপে বলল

-তো ও পড়াশোনা করে নাহ ওকে বক।তোর স্টুডেন্ট তুই যা মন বল,আমায় টানছিস কেনো? আমি কি বলেছি ওকে যে তুই বিয়ের চিন্তাভাবনা কর
-বড় বোন বিয়ের জন্য দিনরাত নাচানাচি করলে ছোট বোন ও তো তাই করবে
আড়চোখে চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল সাদমান, ফারিহা ওর দিকে তীক্ষ্ণ ক্ষ্যাপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-হ্যাঁ অবশ্যই করবো,নাচবো গাইবো যা খুশি করবো। বিয়েই তো করতে চেয়েছি রুম ডে’ট না, এতে এতো রিয়েক্ট করার কিছু নেই। বিয়ে না করলে বংশবৃদ্ধি করবে কি করে।

চোখ মুদে ধরলো সাদমান,তুরা ফারিহার মুখ চেপে ধরলো। এই মেয়ের মুখে কোনো দিন ও লাগাম হবে নশ,যা মন বলে দেয়।
সাদমান বিড়বিড় হিপোক্রিয়েট বলে আবার কলম দিয়ে বই দাগিয়ে পড়া শুরু করলো,তুরা প্রশ্ন গুলো দাগাচ্ছে আর একটু পরপর খুচিয়ে যাচ্ছে ফারিহাকে পড়ার জন্য, কিন্তু সেসবকে পুরোদমে অগ্রাহ্য করে আরামে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।

খানিক বাদেই আগমন ঘটলো আহানের। এসেই ডেস্কে দাঁড়িয়ে লেকচার শুরু করলো। লেকচারের মাঝে মাঝে বোর্ডে লিখছে আর বুঝাচ্ছে। আড়চোখে একবার আহানের দিকে তাকিয়ে নোট করায় মনোনিবেশ করলো তুরা,কিন্তু নিজের অজান্তেই পূনর্বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আহানের দিকে, শরীর জুড়ে ঠান্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেলো, অন্তঃস্থল দ্রিমদ্রিম শব্দে কেঁপে উঠলো, সম্পূর্ণ দৃষ্টি মেলে স্থির তাকিয়ে আছে আহানের ঘাড়ে তিনটা আঁচড়ের দাগে,ফর্সা ঘাড়ে তিনটা নখের আঁচড়ের গাঢ় দাগ অত্যাধিক তাজা দেখাচ্ছে। মাঝখানে একদিন কেটে গেছে অথচ দাগ টা এখনও তাজা দেখাচ্ছে,এতো জোরে খামচে ধরেছিলো সে? কই আহান তো টু শব্দ পর্যন্ত করেনি!

লজ্জা শরমে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরচ্ছে তুরার,শুকনো ঢোক গিলে ফারিহার দিকে তাকালো একবার, এই মেয়ে যদি একবার লক্ষ্য করেছে ওকে পচাতে পচাতে ঘেটে ফেলবে।
পুনশ্চ তাকালো সামনে,ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে হা করে চেয়েই রইলো আহানের দিকে। আহান লেকচারের মাঝেই তাকালো একবার তুরার দিকে,পুনরায় তাকালে চোখাচোখি হলো দুজনের,আহান বিব্রত হলো খানেক,
তুরা এভাবে কেনো তাকিয়ে আছে তার দিকে? সেসব অগ্রাহ্য করে আবারও লেকচারে মনোযোগী হলেও তুরার স্থির দৃষ্টি বারবার তার চিত্তবিক্ষেপ ঘটাচ্ছে।

ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তুরার দিকে তাকালো সকলের অগোচরেই, তুরা লজ্জায় মূর্ছা গেলেও দাঁতে দাঁত চেপে আলতো ভাবে নিজের ঘাড়ে হাত ইশারা করলো আহানকে।সেদিকে লক্ষ্য করে নিজের ঘাড়ে হাত দিলে আহান এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তবুও সে বিজড়ন গায়ে না মেখে বরং তুরার ত্রপার পাল্লা আরও ভারি করে কিঞ্চিৎ হাসলো।
ক্লাসে উপস্থিত অনেকেই লক্ষ্য করলো আহানের মুখের ছোট হাসির আভাস টুকু। সকলেই যেনো স্তম্ভিত, বিস্মিত। আহানের হাসিটা যেনো ডুমুর ফুল দেখার মতই,,ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে গম্ভীর মুখচোরা স্যারকে আনমনেই হাসতে দেখে সবার মাঝে ফুসুরফাসুর লেগে গেলো। তুরা আশেপাশের সকলের গুঞ্জনে কান না দিলেও আহানের হাসি দেখে বিমূর্ত হয়, অবিন্যস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকায় যেনো কেও দেখে ফেলল কি না।

সারা টা ক্লাস এভাবেই কেটে গেলো। তুরা কুণ্ঠিত লজ্জিত হয়ে মুখশ্রী আনত করে রাখলেও আহান দিব্যি ক্লাস নিয়েছে, আর তুরাকে ওর দুষ্টুমিপূর্ণ চোখে বিব্রত করেছে।
ক্লাসের পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে এলো তুরা,সাদমান আর ফারিহা ঝগড়া করে দুজন দু রিকশা নিয়ে চলে গেছে। ভার্সিটি থেকে তহমিনার ফ্লাটের দূরত্ব কিঞ্চিৎ কয়েক মিনিটের পথ,জামা কাপড় গুলোও আনতে হবে। তাই অনতিবিলম্বে আহানের নাম্বারে দু লাইনের মেসেজ টুকে ফুফুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল তুরা। মিনিট দশেক বাদে পৌঁছেও গেলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুবার বেল চাপতেই একটি গোলগাল সুশ্রী মুখ খুলে দিল দুয়ার, তহমিনাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো তুরা,দু’হাতে ঝাপটে ভদ্রমহিলা আদর ভরা গলায় বলল

-দুদিন বাদে তাহলে মনে পরলো মামনীর কথা?
-তোমাকে রোজ ই মনে পরেছে মামনী শুধু আসার সুযোগ হয়নি।
মুখ তুলে তুরা বলল,তহমিনা তুরাকে এক হাতে আগলে ধরে বলল
-এখন তো হয়েছে, আই ভেতরে আই। তোর পছন্দের বিরিয়ানি করেছি। খেয়ে যাবি কিন্তু
-তোমার হাতের বিরিয়ানি মিস করবো এমনটা তো হতেই পারেনা মামনী। তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

বলে ব্যাগ টা রেখে ফ্রেশ হয়ে আসলো। তহমিনা খাবার বেড়ে প্লেট নিয়ে আসলো তুরার সামনে, ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল
-রাজিয়ার সাথে কি আর দেখা বা কথা হয়েছিলো তোর?
তুরার মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তহমিনা, তুরা ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে খানিক জড়তা ভরা চেহারায় না জানালো। খাবার চিবাতে চিবাতে বলল
-না তো,কেনো কিছু হয়েছে?

-কাল রাতে ফোন করেছিলো আমাকে, ইমতিয়াজের শরীরের অবস্থা নাকি আরও খারাপ করেছে,যত দ্রুত সম্ভব হৃদপিণ্ডের সার্জারী করাতে বলেছে ডাক্তার, চিকিৎসার জন্য লাখ খানেক টাকার প্রয়োজন।
শান্তসুলভ ভঙ্গিতে বললেও চোখ মুখ জুড়ে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট দেখতে পেলো তুরা,গ্লাস তুলে পানি গলাধঃকরণ করে বলল

-তুমি কি বলেছো?
-আমি রাজিয়াকে তেমন কিছু বলিনি, কিন্তু না বললেও ইমতিয়াজ তো আমারই ভাই। ওর এই বিপদের দিনে তো মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারিনা। তাই আমার নিজের কাছে বেশ কিছু টাকা আছে জমানো। সেটা নিয়ে কাল আমি যাবো।
তুরা দমলো,খানিক ক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিরবতা ভেঙে বলল
-মামনী তুমিতো জানো বাবার ব্যাবসার বাইরে যা কিছু ছিল সব আমার জন্যেই রেখে গেছে, বাবা প্রয়াত হওয়ার কিছুদিন আগেও আমার নামে লাখ খানেকের বেশি টাকা ব্যাংকে ডিপজিট রেখেছিলো। তাই আমি চাচ্ছি তুমি চাচাকে সেই টাকা টাই দাও

-একদম নাহ, ভাই তোর জন্যে যা রেখেছে ওটা তোরই থাক। এতো কিছুর পরেও ওকে কেনো দিতে চাচ্ছিস। আর আমিতো দেব বলেছিই
তুরা জানতো তহমিনার অভিব্যক্তি ঠিক এমনটাই হবে, তাই বিচলিত হলোনা। শান্ত ভাবেই তাকালো, অতঃপর তহমিনার হাত ধরে বলল

-মামনী,বাবা তো কত কিছুই রেখে গেছে। আর তার মাঝে সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে তুমি আর তার এত ভালো বন্ধুকে রেখে গেছে যে আর যার পরিবার কখনো আমাকে নূন্যতম অভাব বোধ টুকু বুঝতে দেয়না। আমার প্রয়োজনের আগেই সবটা দিয়ে ভরিয়ে দেয়। এত গুলো মানুষের দোয়া, ভালোবাসা, ছায়া, আদর পাওয়ার পর আর কি লাগে বলো। আর চাচা অথবা চাচীর উপর আমার কোনো আক্ষেপ বা অভিযোগ নেই, মানুষ মাত্রই ভুল। এখন তার বিপদের সময় টাকা গুলো উনাকে দিয়ে আমি সন্তান ধর্ম টুকুই পালন করতে চাই মামনী। বাবা থাকলেও তো ঠিক এমনটাই করতো তাই না? তাই উনার সন্তান হিসেবে এটা আমার দ্বায়িত্ব, কর্তব্য

তুরার সমস্ত কথা টুকু শুনে তহমিনার চোখ ছাপিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো, এক হাতে তুরার মুখ খানা বুলিয়ে আদর ভরা ধরা গলায় বলল
-ভাই চলে গেছে তো কি, নিজের প্রতিচ্ছবিটা ঠিকই তোর মাঝে রেখে গেছে মা,ও থাকলেও ঠিক এমনটাই করতো।
তুরা হাসলো বিস্তর,আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললে তহমিনা রাজি হলো। খাওয়া শেষে জামা কাপড় গোছাতে গোছাতে তহমিনা কে জিজ্ঞাসা করলো

-ইয়াজ ভাই কোথায় মামনী, এসে থেকেই তো দেখছি না?
-ও তো সকালেই বেড়িয়েছে কোনো কাজ আছে বলে
চিন্তিত হলো তুরা,ললাটে ভাঁজ ফেলে ভাবলো কি এমন কাজ যে মামনী কেও বলে যায়নি? আজকে ভার্সিটিতেও দেখেনি মাহিদকে, সকালে রেস্টুরেন্টে যে ওটা মাহিদ ছিল এব্যাপারটাতেও তুরা সুনিশ্চিত। বেশ খানিক কিছু একটা ভাবার পর ললাট প্রসারিত করলো, ঠোঁটে বাকা হেসে আবারও জামা কাপড় গোছানোতে ব্যস্ত হলে টুং করে দরজার বেল বেজে উঠলো।

-তুরা মা দেখ মাহিদ এসেছে হয়তো,আমি থাল গুলো ধুচ্ছি খুলে দে তো
তুরা জামা কাপড় রেখে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই হাস্যজ্বল চেহারা মিলিয়ে গেলো, অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে তটস্থ হয়ে হা করেই রইলো
-এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?
পলক ঝাপটালেও হেলদোল হলো না,এই লোকটা এখানে কেনো এসেছে? তুরা তো মেসেজ ও করে দিলো সে বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে যাবে।

-আপনি? এখানে
বোকা বোকা মুখ করে প্রশ্ন করলো তুরা,আহান পকেট থেকে এক হাত বের করে কপাল চুলকালো, এক ভ্রু উচিয়ে দায়সারা ভাবে বলল
-বউ যেখানে আমিও সেখানে।
খুকখুক করে কেশে উঠলো তুরা, দরজার হাতলে হাত রেখেই কিঞ্চিৎ সরে দাঁড়াতে গেলে পেছন থেকে তহমিনার গলা শুনতে পেলো

-আরে আহান যে, এসো এসো ভেতরে এসো বাবা। দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
তুরার ধ্যান ভাঙলে সরে দাঁড়ালো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই।আহান প্রশস্ত হেসে সালাম দিলো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
-ঢুকতে দিলে তবে তো ঢুকবো।
তহমিনা ভ্রু জড়ো করলো, খানিক শাসানির গলায় তুরাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-এ কেমন কথা তুরা, তুই জামাইকে এভাবে দরজায় দাঁড় করিয়ে কেনো রেখেছিলি
তুরাকে জবাব না দিতে দিয়ে আহান নিজেই বলল

-ও বাড়িতেই তো দরজা আটকে বসে থাকে,আমার ঘরে আমাকেই ঢুকতে দেয়না, আর এটা তো ওরই ফুফুর বাড়ি।
যেনো অভিযোগ দিল তুরার নামে,তহমিনার মুখ দেখেই স্পষ্টত বোঝা গেলো সে অসন্তুষ্ট হয়েছে এরূপ কথা শুনে, দুঃখবোধক গলায় বলল
-এসব কেমন কথা শুনছি। দিন দিন সব সহবত ভুলতে বসেছিস তুই?
তুরা অতিকায় অবাক হলো। চমকপ্রদ চাহনি নিক্ষেপ করলো আহানের দিকে, তুরা তাকাতেই আহান টুস করে চোখ টিপে দিলো। তুরা স্থির নেত্রেই তাকিয়ে থাকলো। অবাক বিহ্বলতার চূড়ান্তে গিয়ে অভিব্যক্তি হারিয়ে ফেলেছে,
লোকটা পাগল টাগল হলো না তো? এমন ছিচকেপনা করছে কেনো। নজর সরিয়ে নিলো তুরা,দরজা আটকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসলে তহমিনা বলল

-আহানকে ঘরে নিয়ে যা, ওর কি লাগবে দেখ
বলে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। আহান তুরাকে ইশারায় ঘরে আসতে বলে নিজে ঘরের দিকে গেলো। তুরা ধীরস্থির ভঙ্গিতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো।
-ওখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে আসো। স্বামী সেবা করো
পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সুঠাম সৌষ্ঠব গড়নের মানুষ টার দিকে, আহান খাটের উপর বসে আছে দুহাত পেছনে রেখে ভর করে। তুরা এগোতেই মেরুদণ্ড সোজা করে বসে বলল

-পানি দাও
পাশে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে নিলো তুরা,তটস্থ পায়ে এগিয়ে গেলো আহানের কাছে।ভীষণ জড়তা কাজ করছে,কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না আহানের সামনে।
তার উপর আহান যেসব আচরণ শুরু করেছে। মাঝখানে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বজায় রেখে হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা ধরলো আহানের সামনে, হাতের কম্পনের সাথে তাল মিলিয়ে গ্লাসটাও সমানতালে কেঁপে উঠছে। আহান স্থৈর্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তুরার হাতসহ গ্লাসটা ধরে বলল

-সামান্য পানি দিতে এতো কাঁপা-কাঁপির কি আছে? আমি তো কিছুই করিনি? নাকি চাচ্ছো এমন কিছু করি যাতে কেঁপে ওঠো?
বড্ড রসাত্মক শোনালো কণ্ঠটা, কানে ঝংকার তুলল তুরার,লজ্জায় নেতিয়ে গেল তুরা। তবুও অস্পষ্ট মিহি স্বরে প্রতিবাদ করতে বলল

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৭

-আমি তো..
-তুমি তো কি? ভরা ক্লাসে ভুলভাল ইশারা করে কিসের ইঙ্গিত দিতে চাও তুমি?

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪৯