তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৩

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৩
হুমাইরা হাসান

-ফারিহা?
চলার গতি মন্থর হলো, পা দুটো থামালেও পিছু ফিরে তাকালো নাহ। সাদমান এগিয়ে গেলো কয়েক কদম, খানিক উশখুশ করে ভরাট গলার কণ্ঠের খাদ নামিয়ে বলল
-আব..বাসায় যাচ্ছিস?
-তো শ্বশুরবাড়ি তো নেই যে সেখানে যাব

বাজখাঁই গলায় বলল ফারিহা। সাদমান থতমত খেলো। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ না করে খানিক জড়তা সমেত উশখুশ করে পকেট থেকে কতগুলো হাজার টাকার নোট বের করে ফারিহার সামনে ধরে বলল,
-আম্মু হসপিটালে থাকতে আমাকে টাকা ধার দিয়েছিলি, সেটা..
চমকপ্রদ চাহনিতে তাকাল ফারিহা, যেন চোখ থেকে অগ্নিবর্ষণ হবে। তার চেয়েও অধিক বেশি পীড়ন দেখতে পেল যেন সাদমান ফারিহার চোখে। এক মুহূর্তের জন্য ভেতর টা ধক করে উঠলো। থমকে গেলো সাদমান। কিন্তু পরমুহূর্তেই ফারিহার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেলো। আশপাশে নজর বুলিয়ে যেন ধাতস্থ করলো নিজেকে। সাদমানের জড়াতাপূর্ণ দৃষ্টিতে চোখ রেখে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-এই টাকা আমি নিতে পারব নাহ
-কেনো?
সাদমানকে পুরোপুরি তার বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই ফারিহা বলে উঠলো
-তোকে আমি টাকা দিয়েছিলাম কবে? কম হলেও মাস খানেক? আর যখন দিয়েছি তখন তোর প্রয়োজনের সময় ছিল। তখন তোকে দেওয়া একশ টাকার ভ্যালিউ ও হাজার টাকার সমান। তাই আমি এভাবে নেব নাহ
পুরো কথা টাই সাদমানের মাথার উপর দিয়ে গেলো। কি দিয়ে কি বলছে কিছুই বুঝল না সে। বিভ্রান্তিকর চেহারা করে বলল

-মানে?
-মানে তোকে আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। ইন্টারেস্ট সহ চাই আমার। দিন প্রতি ইন্টারেস্ট এ্যাড করে তবে দিতে আসবি। আর হ্যাঁ দিন প্রতি বাড়তে থাকবে অ্যামাউন্ট। এক চুল ছাড় দেব নাহ,মাইন্ড ইট!
বলেই হনহন করে হাঁটা ধরলো ফারিহা। সাদমান ওর যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে করতেই ফারিহা বেশ অনেকক্ষানি দূরে চলে গেছে।
-ফারিহা, দারা?

সাদমান উচ্চস্বরে পেছন থেকে ডাকল ফারিহাকে। ফারিহা একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো। রিকশা থামিয়ে তাতে উঠে নিমিষেই দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলো
সাদমান চলার দুরন্ত গতি থামালো,বড় বড় শ্বাস ফেলে স্থির দাঁড়িয়ে দেখল ফারিহার চলে যাওয়া। বুকের ভেতরে আচানক চিনচিন ব্যথার আবির্ভাব স্পষ্ট টের পেলো সে। হৃদবক্ষের প্রদাহ টা যেনো ক্রমেই ছড়াচ্ছে সর্বাঙ্গে। বারবার পলক ঝাপটালো। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরালো

-নাহ, যেই দেওয়াল আমি সর্বাত্মক চেষ্টায় গড়েছি,সেটা ভাঙতে পারে না। এটা অন্যায়! যা কিছু হোক,আমি কিছুতেই এরূপ ধৃষ্টতা দেখাতে পারিনা
আপনমনেই বিড়বিড়ালো সাদমান। হাতের টাকা গুলো মুষ্টিবদ্ধ হাতে মুছড়ে গেলো। এক পা এক পা করে পিছিয়ে গেলো দৃষ্টি সামনেরই স্থির রেখে। এক সময় পিছু ঘুরে হাঁটা ধরলো, চশমা খুলে ঝাপসা হওয়া চোখ ডলে নিলো, হয়তো রাস্তায় বিচরিত ধুলোবালি মুছতে,হয়তোবা অবাধ্য আবেগ!

দুপুরে লোক সমাগমে ভরা বাড়িটা, গুনগুন গল্পের কলরব, খিলখিলানি হাসি আর রান্নার মো মো গন্ধে মুখরিত বাড়ির উৎসবমুখর ব্যস্ত পরিবেশটা।
বৃত্তাকার আকৃতি নকশার বাড়িটার একদম মাঝখানে উঠোন। তার একদম মাঝ বরাবর মাদুর, পাটি বিছিয়ে বসেছে রুহি জায়মা,তনু,তুরা সহ সকলে। হাতে হাতে গায়ে হলুদের ডালা, ত্বত্ত্ব সাজাতে ব্যস্ত সকলে। শাড়ি,গহনা,ফুল আরও নানা রকমের ব্যাবহার্য সামগ্রিতে সাজানো বর্গাকার,গোলাকার ডালা গুলোতে একে একে রঙিন ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখছে সবাই

-আহ্ শুধু মানুষের বিয়ে দেখেই গেলাম। কবে যে নিজের বিয়ের ফুল ফুটবে আর সেই ফুল কানে তুলে আমি উড়াধুড়া লুঙ্গি ডান্স দেব
তনুর গায়ে হেলে পরে টেনে টেনে কথা গুলো বলল রুহি, তনু এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুহির বাহুতে চিমটি দিয়ে বলল
-নিজের বিয়েতে কে লুঙ্গি ডান্স দেয় বে? বিয়ে পাগলা হয়ে কি সব গুলিয়ে খেয়েছিস?
-আগে বিয়েটা হোক, পাবলিকে লুঙ্গি আর প্রাইভেটে অভদ্র প্রেম সব ডান্স দিব
বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো রুহি, ওর কথা শুনে উপস্থিত সকলে হেসে দিল উচ্চস্বরে। তুরা চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বলে ইশারায় মিনু ফুফুকে দেখালো।

-চুপ কর তোমরা, এসব ফুফু আম্মা শুনলে প্রত্যেকটাকেই কান মলা খেতে হবে বুঝলে
ফুলের মালা গুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল তুরা। রুহিও তুরার মতো করে গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল
-কি করব বলো। আমাকে তো কেও একটু পরপর বউ বউ বলে ডেকে পাঠাই না তোমার উনির মতো। তাই একটু উনির শখ হচ্ছে আরকি।
আবারও আরেক দফা হেসে উঠলো সকলে। তুরা রুহির কথায় লজ্জা পেলেও হাসি থামিয়ে রাখতে পারল নাহ। এর মাঝে তনু এগিয়ে এসে বলল
-ফুয়াদ ভাইয়ার বউয়ের বয়স খুব বেশি নাহ। ওই আমাদের মতই হবে শুনলাম।এত বড় পরিবারে এসে সংসার গোছাতে পারবে তো

-কেনো পারবে না? তুরা কি পারেনি? ওউ তো বাপের এক মেয়েই,আদরের দুলারি তো ওউ ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে, তাও হঠকারিতায়।ও কি মানিয়ে নেয়নি? এই তো লক্ষি মেয়ের মতো সংসার ও করছে,পড়াশোনাও করছে। না ওবাড়ির লোকের না আমার বাবুর কারোরই কোনো অভিযোগ নেই বউমাকে নিয়ে
মিনু এসে এক এক করে ডালা গুলো হাতে তুলে নিতে নিতে বলল। তুরা হাসলো স্মিত মিনুর কথায়। কিন্তু তার মাঝে ফোড়ন কেটে রুহি বলল

-হ্যাঁ তাই তো। আর তোমার বাবু অভিযোগ কি করবে সে তো বউকে দেখতে না পারলে এক ঘন্টায় ছয়বার ডাকে।
-সেটাই তো। তা ভাবিজান কি যাদু করিয়া দেওয়ানা বানাইলেন আমাদের প্রফেসর সাহেবকে একটু আমাদেরও বলুন
রুহির সুর ধরে তনুও বলল।তুরা বেশ শরম পেলো ওদের এহেন কথায়। তাও আবার বড়দের মাঝে। এর মাঝেই মিনুর জা অর্থাৎ সিয়াম,সায়মার মা এসে বলল

-হয়েছে, কখন থেকে মেয়েটাকে জালাচ্ছ তোমরা বলো তো। খুব দুষ্টু হয়েছ।ও কিন্তু সকলের বড় ভাবি, আর তুমিও বলিহারি দুটো বসিয়ে দাও এগুলোকে ঠিকই চুপ করে যাবে
তুরা জবাবে শুধু হাসলো। সকলে খোশগল্পতে মশগুল থাকলেও তুরার চোখ গেলো জায়মার দিকে। কাল এসে থেকেই লক্ষ্য করছে তুরা ব্যাপারটা,,মেয়েটা কেমন চুপচাপ থাকছে। কেমন একটা বিচলিত, অস্থির দেখাচ্ছে ওকে।

সকলের মাঝে থেকেও যেন নেই। ওর পায়ের দিকে তাকাতেই তড়িৎ চমকপ্রদ চাহনি দিল তুরা,বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকাল ওর পায়ের দিকে, জায়মার দিকে চেয়ে দেখল ও আনমনা হয়ে একটা গাঁদা ফুল হাতে নিয়ে পাপড়ি ছিড়ছে একটা একটা করে। তুরা এগিয়ে কিছু বলবে তার আগেই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে ছেলে গুলোর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই সেদিকে চোখ গেলো। সকাল বেলা করেই সব ছেলেগুলো একসাথে বেড়িয়েছিল বাজার করতে, সন্ধ্যায় ই ফুয়াদের গায়ে হলুদ। সেই সুবাদে বাজারে গেছিল সব ছেলেরা, আহান তো গেছিলই সাথে মাহিদ ও বাদ যায়নি

বাজারের ব্যাগ গুলো রেখেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকলো আহান। সকালে গোসল করেই বেড়িয়েছিল কিন্তু এমন ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘেমে গেছে বাজারের ভীড়ে। ওয়াশরুমে ঢুকে হাত পা ধুয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখল তুরা দাঁড়িয়ে, হাতে শরবতের গ্লাস। তোয়ালে টা হাতে নিতে গিয়েও নিলো না আহান, চোখ মুদে তাকালো তুরার দিকে।

পরনে গোলাপি রঙের একটা পাতলা সুতির শাড়ি। হুট করেই আহান উপলব্ধি করল,তুরা আর সেই কিশোরীদের মতো দেখতে নেই, তার চেহারায় কেমন পরিপূর্ণতার ছাপ পরেছে, গায়ের গড়ন চেহারার উজ্জ্বলতার বৃদ্ধি সব মিলিয়ে তাকে দেখলে বউ বউ লাগে,আহানের বউ! ধক করে উঠলো আহানের হৃদয়স্থল। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো, তবে এবার তুরা নিজেও এগিয়ে এলো। মাঝামাঝি দূরত্ব ঘুচিয়ে বা হাতে শাড়ির আঁচল তুলে আহানের কপাল মুছে দিতে দিতে বলল

-বাজার করার অভ্যাস তো নেই, নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পরেছেন। আপনি শরবত খান আমি খাবার আনছি
আহান প্রত্যুত্তর করলো নাহ। তুরাত হাত সমেত গ্লাসটা ধরে মুখে নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেকটা শরবত খেয়ে বাকিটা তুরার মুখের সামনে ধরলো
-এটা আমি আপনার জন্য এনেছি। আমাকে দিচ্ছেন কেনো
-চুপ, খাও চুপচাপ
বলে তুরা না চাইতেও জোর করে খাইয়ে দিলো আহান। গ্লাসটা পাশে রেখে দুহাতে তুরার কোমর বন্ধনে জড়িয়ে বলল
-স্বামীর সাথে শেয়ার করে খেলে পেয়ার মহব্বত বাড়ে,জানো নাহ?
পরক্ষণেই আবারও নিজেই বলল

-অবশ্য জানবেও বা কি করে, এখন তো আর আমাকে আগের মতো স্বামী স্বামী ও বলো নাহ
আমাকে তো চোখেই পরেনা তোমার
আহানের মেকি অভিমান মিশ্রিত মুখ দেখে হাসলো তুরা। হাত তুলে চিকন আঙুল গুলো চালিয়ে দিলো আহানের কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলোতে। নরম গলায় বলল
-আগে তো আমার স্বামীর মনেই থাকত না যে তার একটা বউ আছে,তাই বারবার ডেকে মনে করিয়ে দিতাম। এখন তো আর ভুলে যায়না তাই বারবার মনেও করিয়ে দিতে হয়না
আহান এগিয়ে এসে তুরার ললাটে অধর স্পর্শ করালো। বেশ খানিক সময় নিয়ে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রাখলো তুরার কপালে, পরম যত্নে ছোট্ট আদর দিয়ে তুরার গালে হাত রেখে বলল

-কি করব বলো,বউ আমায় এমন প্রেমে ফেলেছে যে বউ ছাড়া আর ভালই লাগে নাহ
ফিক করে হেসে দিলো তুরা, সাথে আহানও। আনন্দ আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো তুরা আহানকে। বুকের মাঝে মাথাটা চেপে আঁকড়ে ধরলো পিঠ। আহানও দু’হাতে আগলে নিবে তখনই
-এইই সরি সরি সরি,,রং টাইমে এন্ট্রি করে ফেলেছি। কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি হ্যাঁ? খালামনি ডাকছিল তোমাদের রোমান্স শেষ হলে চলে এসো
বলেই ঝড়ের বেগে এসে হাওয়ার বেগে উধাও হয়ে গেলো। তুরা মুখ তুলে চেহারাটা দেখার আগেই দৌড়ে চলে গেছে তনু। ভীষণ লজ্জা পেলো তুরা এহেন কান্ডে

-এ বাড়িতে এসে একটু বউকে আদর ও করতে পারিনা ছাতা। চুমু দিতে গেলে এ চলে আসে জড়িয়ে ধরলে ও চলে আসে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না, তা না হলে হাবা আর গোবা আসবে কি করে বলোতো বউ
গাল ফুলিয়ে বলল আহান। তুরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আহানের দিকে। লোকটা দিনদিন পাগল হয়ে যাচ্ছে, এর সামনেই থাকা যাবে নাহ। তাই কিছু না বলেই এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো তুরা

-কি হয়েছে, দরজা খুলবি তো! না হলে কি হয়েছে জানবো কি করে বলো তো?
-এই আপু দরজা খুলছিস না কেনো? কি হয়েছে বল নাহ
রিমঝিম আর তার মা অনিতা অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে ফারিহার ঘরের। খোলার নাম ও নিশান নেই মেয়েটার। দরজা খোলা তো দূর সাড়া পর্যন্ত দিচ্ছে নাহ। এ পর্যায়ে এসে অনিতার বেশ দুশ্চিন্তা হলো। বদ্ধ ঘরের ভেতর কোনো বিপদ হলো নাহ তো? মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যায়নি তো?
ভাবতেই আতংকিত হয়ে আরও জোরে কড়াঘাত করল দরজায়

-ফারু, মা খোল না দরজাটা। ছোট মা কে বল কি হয়েছে? সারাদিন খাসনি অসুস্থ হয়ে যাবি তো
-কি হয়েছে অনিতা?
ফিরোজ ইসলামের গলা শুনে ঘুরে তাকালো অনিতা। সবেমাত্র ফিরেছেন ফিরোজ অফিস থেকে, হাতের ব্যাগটাও এখনো রাখেনি। পায়ের জুতো খুলে এগিয়ে এলো ফিরোজ। অনিতার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে ঘন ভ্রু যুগল আরও কুঞ্চিত হলো তার।

-দেখুন না ভাই। কখন থেকে ডাকছি, দরজা খোলা তো দূর কথা অব্দি বলছে না মেয়েটা। কি হয়েছে কিছু তো বলবে। দুপুরের আগে বাড়ি এসে দরজা লাগিয়েছে,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ বেরোবার নাম নেই।
অনিতার বিরতিহীন কথাগুলো শুনে ললাটের ভাঁজ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো ফিরোজ ইসলামের। হাতের অফিস ব্যাগটা রিমঝিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজাতে তিনটে টোকা দিলেন। নরম গলায় বললেন

-ফারু, কি হয়েছে মা। দরজা কেনো খুলছিস না দেখ বাবা এসেছি
ফিরোজ সাহেবের কথার শেষ হওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই খুলে গেলো দরজা। অনিতা বেগম চিন্তিত হয়ে ঘরের ভেতরে তাকাতে দেখল ভার্সিটি থেকে এসে জামাটা অব্দি পাল্টাইনি। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দু’টোও কেমন ফোলা ফোলা

-ফারু কি হয়েছে তোর? এ অবস্থা কেনো?
জবাব না দিয়েই ঘরের ভেতর চলে গেলো ফারিহা। ফিরোজ চোখের ইশারায় অনিতাকে আস্বস্ত করলেন। নিজে ব্যাপারটা সামলে নেবে বলে ভেতরে গেলেন।ফারিহা চোখ মুখ কুচকে খাটের কোণায় বসে আছে, ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে বসলো পাশে, ফারিহার মাথায় হাত রেখে বললেন
-কি হয়েছে বল তো মা। কিসের জন্যে এত আপসেট তুই। কে তোকে রাগিয়েছে শুধু বল আজ তার একদিন কি আমার একদিন
ভীষণ প্রত্যাশিত বাবার এতটুকু আদরেই মিইয়ে গেলো মেয়ের মন। ঝট করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে,ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে বলল

-ও খুব খারাপ বাবা, আমাকে কষ্ট দিয়েছে। ও আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে
কপালে বলিরেখার ভাঁজ পরলো অসংখ্য, তবুও শান্তকণ্ঠে বললেন
-কে কষ্ট দিয়েছে তোকে? ওই ভদ্দরলোকের ছা? চশমা পড়া চেঙ্গিস টা তোকে বকেছে?
ধপ করে উঠে বসলো ফারিহা। বাবার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
-বাবা! আমি কিন্তু তোমার সাথেও কথা বলব নাহ

-আচ্ছা ঠিকাছে। আমি কিছুই বলছি নাহ,তুই বল তো কি বলেছে তোকে
ফারিহা চোখের পানি মুছলো গলার ওড়না দিয়ে। খানিক ধাতস্থ হয়ে বলতে আরম্ভ করলো।
পুরোটা শুনে ফিরোজ ইসলাম খানিক চুপ রইলো। পরমুহূর্তেই চেহারায় গুরুগম্ভীর ছাপটা গমগমে স্পষ্টরূপে প্রকাশ করে রাগান্বিত গলায় বলল

-বিটকেল টার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। ওর বুকের পাটা কত বড় হয়েছে যে আমার মেয়েকে কষ্ট দেয়,কাঁদায়। ওর হাড় আর মাংস আর আমি আলাদা করবো
-বাবা,,,আবারও বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তুমি যাও তো যাও। তোমার সাথে কথা বলাই উচিত হয়নি আমার।
চেঁচিয়ে উঠে বলল ফারিহা। ফিরোজ ইসলাম হাসলেন গা দুলিয়ে। বাবার হাসি যেনো রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো। আবারও উত্তেজিত হয়ে কিছু বলবে তার আগেই ফিরোজ বললেন
-ঠিকাছে মা আর বলছি নাহ। নিজে যখন চৌদ্দ গুষ্টির নাম তুলে আনে তখন কিছু নাহ। আমি বললেই দোষ,ভালো এখনতো বাবা কিছুই নাহ

ফারিহা আবারও তেঁতে গেলো।তবুও অসহায় গলায় বলল
-তুমি অন্তত এমন বলো না বাবা। আমার মা বাবা দুজনই তো তুমি।
এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

-তুই ই তো আমার সব মা। তোর মা ছেড়ে যাবার পর তোকে নিয়েই তো বেঁচে আছি। তোর চোখে পানি আমি একদম সহ্য করতে পারবো নাহ। আমি কালই যাব। তুই আর একটুও মন খারাপ করবি নাহ। এখন চল তো, ছোট মা পুডিং বানিয়েছে তোর জন্য,রিমঝিম ও তোকে ছাড়া খাবেনা বলছে। এখন শিগগিরি উঠে ফ্রেশ হয়ে আই কেমন?
ফারিহাও লক্ষি মেয়ের মতো বাবার কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ফিরোজ ইসলাম উঠে গেলে ফারিহাও ওয়াশরুমের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় এগারোটা বেজেছিল। খাওয়া দাওয়া গোছ গোছানো সকল পর্ব সেরে ঘরে যেতেই সকলে ঘুম। সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততা আর ধকলের উপর কাটায় ক্লান্ত শরীরে ঘরে যেতেই সকলে ঘুমিয়ে গেছে।

তুরা ঘরে এসে শাড়ি পালটে নিলো, গালে মুখে হলুদ মেখে ছিল অনেকখানি। রুহি আর জায়মা তাকে ভূত বানিয়ে ফেলেছে পুরো। তাই বাধ্য হয়েই রাত বারোটায় ও তাকে গোসল করতে হলো। আহান অবশ্য ঘরে এসেই গোসল করে নিয়েছে, প্রফেসর সাহেবের একটু কিছু গায়ে লাগতে না লাগতেই গোসল করা লাগে, রোজকার নিয়ম।
গোসল সেড়ে অন্য একটা সুতির শাড়ি পরে বেরোলো তুরা। শাড়ি পরতে না চাইলেও পরতেই হবে। কারণ আসার সময় মা দিদুন ব্যাগ ভর্তি শাড়ি দিয়েছে, এখানে আসার পর মিনুও তাকে উপহার স্বরূপ তিনটে শাড়ি দিয়েছে। সালোয়ার কামিজ ও আনা হয়নি।

আধভেজা গায়ে বেগুনি রঙের শাড়িটা কোনোমতে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো তুরা, আহান খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তুরা। তোয়ালেটা চেয়ারের ওপর মেলে দিয়ে খাটে বসলে আহান এগিয়ে এসে থপ করে তুরার কোলে মাথা রেখে পেট জড়িয়ে ধরলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
-একটু চুলগুলো টেনে দাওনা,মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ।

তুরা দ্বিমত না করে চুপচাপ শীতল হাতের স্পর্শে আহানের চুলে হাত গলিয়ে দিলো। বেশ অনেকখানি সময় ধরে চুল টেনে দিয়ে খেয়াল করলো আহানের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে।
কাছে এসে দেখল আহান সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। কোল থেকে মাথা টা তুলে খুব সাবধানে যত্নসহকারে বালিশে রাখলো যাতে আহানের ঘুম না ভাঙে।

ঘুমন্ত আহানের মায়া ভরা মুখটা খানিক তাকিয়ে থেকে ললাটে ছোট একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে সরে এলো। ঘরে পানির জগটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে পানি নেই। রাতে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে উঠে আহানের পানি খাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই দরজা ভিড়িয়ে জগটা নিয়ে বেরোলো রান্নাঘরের দিকে।
পুরো বাড়ি জুড়ে পৌড়বাড়ির নিঃস্তব্ধতা। অদূর থেকে চলা যানবাহনের শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া সামান্যতম শব্দের অস্তিত্ব নেই।

তুরা ও কোনো রকম শব্দ ছাড়া ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোতে লাগলো। হুট করেই অস্পষ্ট কিছু শব্দের উপস্থিতি কানে আসতেই হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালো তুরা। সজাগ কানে বুঝতে চেষ্টা করলো।
নাহ এটা তার মনের ভুল না স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে সে কারো ফিসফিসানির শব্দ। পা টিপে টিপে এগোতে লাগলো রান্নাঘরের পাশের ঘরের দিকটাতে যেদিক থেকে শব্দটা আসছে, ধপ করে কিছু পরার শব্দ হলো আচানক, খুব শীঘ্রই তা মিলিয়েও গেলো।

-কি করছ টা কি?কেও টের পেয়ে যাবে তো?
-আরে আমি খেয়াল করিনাই অন্ধকারে। তুমি আগে বলো এত রাতে কেনো ডেকেছ কেও দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে
পুরুষ কণ্ঠের ফিসফিসানি টা আবারও শোনা গেলো। চাপা গলায় বলল
-সে এমনিতেও টের পেয়েই যাবে সকলে। সব তোমার দোষ! তুমি আমাকে আগে কেনো বলোনি যে আহান তোমার মামাতো ভাই হয়
-আরে আমি কি করে জানব তুমি আহান ভাইয়ের ই শ্যালক হবে। তুমিই কি আমাকে বলেছিলে তুমি তুরা ভাবির ভাই হও?

-আমার মাথায় কি জট আছে যে আমি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে জেনে যাব তুমি তুরার ননদ।
-তো আমার মাথায় কি জ্বিন আছে যে কানে কানে বলে যাবে তুমি আহান ভাইয়ের শ্যালক
দুজনের চাপা স্বরের ঝগড়া চলতেই আছে। একজন আরেক জনের উপরে দোষ চাপাতে ব্যস্ত তখনি শোনা গেলো আরেকটা কণ্ঠস্বর

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫২

-ইয়াজ ভাই! জায়মা! তোমরা..তোমরা দুজন??
অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠের গলা শুনেও যেনো মাহিদের মাথায় বাজ পড়লো। চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো জায়মাও। দুজনে হতবিহ্বলতার শীর্ষে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে আবারও তাকালো তুরার দিকে।
উঠান থেকে আসা হলুদ লাইটের আলোতে তুরার বিস্মিত, চমকতৃত চেহারা স্পষ্ট।
-তোমরা দুজন!!

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৪