তুমি রবে পর্ব ২৪

তুমি রবে পর্ব ২৪
Israt Jahan Sobrin

দিশান মাত্রই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমেছে নাস্তা করার জন্য। হীরা সোফাতে বসে নাতনির চুলে তেল দিচ্ছে তখন। শাওন নাক বন্ধ করে দাদীবুকে বলছে,
– “এবার থামো দাদীবু। তেল আমার কপাল চুইয়ে নামছে। আর গন্ধটাও সহ্য করতে পারছি না আর।”
– “চুপ করে বসে থাক একদম। বছরে একদিন চুলে তেল নিস না। চুলের চেহারা বানিয়েছিস যা!”
– “তেল নিলে আমার প্রচন্ড গরম লাগে দাদীবু।”

দিশান হাসতে হাসতে নাশতার টেবিলের বসল। দিশানকে টেবিলে বসতে দেখে হীরা এসে দিশানকে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
– “খেতে বসে একদম মিথ্যা বলবি না তোজো। যা জিজ্ঞেস করব তার সত্যি উত্তর দিবি।”
দাদীর মুখ দেখেই দিশান বুঝতে পারছে বেশ সিরিয়াস কিছুই জিজ্ঞেস করা হবে তাকে। আর তা যে তার বড় নাতিকে নিয়েই তাও সে বুঝতে পারছে।”
হীরা দিশানকে খাবার বেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি বসল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– “বেলা দশটার সময় খেতে বসলি। আর তার তো এখনো ঘুমই ভাঙেনি।”
দিশান মাথা নাড়াল খেতে খেতে।
– “কাল ও নেশা করেছিল?”
দিশান জোরে জোরে মাথা নেড়ে না জানাল। হীরা চোখ গরম করে তাকিয়ে কড়াস্বরে বলল,
– “মিথ্যা বলতে নিষেধ করলাম না?”

– “তো মিথ্যা কখন বললাম? ও কি নেশা করে কখনো? ও তো মাঝে মধ্যে প্রেশারে থাকলে…”
– “কাল কী প্রেশারে ছিল সে? আর সে কাল কী পরিমাণ এলোমেলো ছিল তা কি আমি নিজে চোখে দেখিনি?”
দিশান মুখের ভাবটা শুকনো করে বিড়বিড় করে বলল,
– “এবার না প্রশ্ন করে কেন নেশা করেছে?”
দিশানের মুখের কথা মুখে থাকতেই হীরা বলল,

– “কেন সে এত বেশি নেশা করেছিল?”
– “শকড খেয়ে।”
– “কী?”
– “কিছু না। দাদীবু আমি এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সময় নিয়ে বসতে পারছি না। আমাকে দ্রুত বের হতে হবে।”
হীরাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সে ওপরে চলে গেল।
আশফির ঘরের দরজা ভেজানো। দিশান ঘরে ঢুকে দেখল সে খালি গায়ে শুধু একটা ট্রাওজার পরে উপুর হয়ে শুয়ে আছে। দিশান তার বিছানার এক পাশে বসতেই সে তার ঘুম কেটে যাওয়া ফোলা চোখদুটো মেলে তাকাল।

– “রাতটা দারুণ ছিল তাই না ভাই?”
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আশফি উত্তর দিলো,
– “কৌতুক করতে এসেছিস?”
দিশান ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল,
– “কালকের রাতের মতো কৌতুক কাহিনী আমি তো কোনোদিন ভুলব না ভাই।”
আশফি উঠে বসল। চুলগুলোর মাঝে আঙুল চালাতে চালাতে সে বলল,
– “আমাকে আমার বাসায় না নিয়ে গিয়ে এখানে কেন নিয়ে এলি?”
– “তো কাল তোমার বমি সাফ করতো কে?”

আশফি চুপ হয়ে রইল। এবার দিশান উত্তেজনাপূর্ণ মুখভঙ্গি করে বলল,
– “সিরিয়াসলি তুমি কাল একটা মেয়ের সম্মানহানি করার চেষ্টা করেছিলে! তাও আবার ওয়াশরুমে! আমি রীতিমতো শকড।”
দিশানের কথাগুলো শুনে আশফি বিস্ময়ে চোখদুটো বড় বড় করে তাকাল দিশানের দিকে। চিল্লিয়েই সে বলল,
– “কী? কী বললি তুই?”

– “ইস! কী নিষ্পাপ আর কী মায়াবী মুখটা ছিল মেয়েটার। তার সঙ্গে এত রুড কীভাবে হলে তুমি?”
– “সামলে কথা বল দিশান। সকাল সকাল আমার মাথা বিগড়ে দিলে পরিণতি কী হতে পারে তা তুই জানিস।”
– “আমি কি মিথ্যা বলছি? কাল তুমি ওয়াশরুমে একটা মেয়েকে একা পেয়ে তার শাড়ি খুলে ফেলেছিলে। তারপর সেটা ছিঁড়েও দিয়েছিলে। আর এরপর মেয়েটার চিৎকার থামাতে তার মুখ চেপে ধরেছিলে।”
কথাগুলো বলে দিশান আড়ালে মুখ টিপে হাসছে। আর আশফি মাথা নিচু করে কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে ভাবছে, কাল রাতে সে ঠিক কী করেছিল। কয়েক মিনিট পর সে গলার স্বর নিচু করে বলল,

– “সে মাহি ছিল?”
দিশান মাথা ঝাঁকাল শুধু।
– “কিন্তু আমি তার থেকে কোনো সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম নাকি? আমি তার মুখ কখনোই চেপে ধরিনি।”
– “তবে সে কি মিথ্যা বলেছে?”
– “আমার মনে পড়েছে। ও কাঁদছিল খুব। আমি তো…”
– “তুমি তো?”
আশফি মনে করল সে মাহির কাঁদার মুহূর্তে তার গালদুটো দু হাতের মাঝে রেখে বারবার কাঁদতে বারণ করেছিল। এরপর তার চোখের পানিও অসংখ্যবার মুছে দিয়ে বলেছিল,

– “অ্যাম স্যরি সোনা। আর কেঁদো না প্লিজ। কারণ তুমি কাঁদলে আমার নিজেকে সামলানো খুব কষ্ট হয়ে পড়বে।”
মাহি মুহূর্তের জন্য কান্না থামিয়ে আশফির দিকে তাকালে আশফি খুব আদুরে কণ্ঠে মাহিকে বলে,
– “তুমি কাঁদলেও তোমায় এত বেশি চার্মিং লাগছে যে তোমার স্নিগ্ধ গালদুটোর প্রতি আমাকে টানছে খুব।”
আশফির কথা বলার ধরন আর তার চেহারা দেখেই মাহি বুঝে যায় যে সে মাতাল আচরণ করছে সে মুহূর্তে তার সাথে। তখনই মাহির প্রচন্ড ভয় হতে থাকে আশফিকে দেখে। মাহি দূরে সরে আসতে চাইলে আশফি ঝটকায় নিজের কাছে এনে মাহির গালের ওপর আঙুল রেখে বলে,

– “আমি কি তোমার এই সুন্দর গালে একটা চুমু খেতে পারি?”
– “না! কখনোই না।”
আশফি আহত চোখে তাকিয়ে বলে,
– “আমি খুব কষ্ট পাবো।”
মাহি আশফিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মুঠো ভর্তি পানি নিয়ে আশফির মুখে ছিটিয়ে মারল। আশফি তার কান্ডে অবাক হওয়ারও সময় পায়নি। মাহি আশফির মাথায়ও পানি দিতে শুরু করে। এরপর যখন আশফি রেগে যায় মাহি তাকে ঠেলে ওয়াশরুমের বাহিরে বের করে দেয়।

এই লজ্জাজনক কথা সে কোনোভাবেই ছোটভাইকে বলতে পারবে না। দিশানকে উৎসুক চোখে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সে কড়া কণ্ঠে বলল,
– “কোনো হাবিজাবি কথা বলবি না কিন্তু। আমি তাকে একদমই মলেস্ট করিনি।”
– “এটা কি খুবই সত্য?”
আশফি বিরসমুখ করে বলল,

– “না। আমি জানি না আমার কী হয়েছিল? প্রচন্ড খারাপ আচরণ করে ফেলেছি আমি ওর সাথে। যেটা আমার দ্বারা কখনোই কাম্য ছিল না। কীভাবে করলাম কে জানে।”
– “তাহলে? এখন কী করবে?”
– “জানি না। আচ্ছা ও সবাইকে বলেছে না এইসব ব্যাপারে?”
– “খুব লাকি তুমি যে এই বিষয়ে সে কাউকে কিচ্ছু বলেনি। কিন্তু বেচারির খুব কষ্ট হয়েছিল কাল। শাওন ওই সময়ে ওয়াশরুমে না গেলে ও হয়তো কোনোভাবেই ওখান থেকে বের হতে পারতো না।”
– “তারপর?”
খুব চিন্তিত মুখ করে প্রশ্নটা করল সে।

– “তারপর রায়হানের বউকে ডেকে এনেছিল শাওন। যা হেল্প করার সেই করেছিল।”
– “আই থিংক আমার স্যরি বলা উচিত।”
– “তুমি ভাবছো কেবল? তোমার এটাই করা উচিত।”
– “আচ্ছা ওর নাম্বারটা দে। আমি টেক্মট করে বলব।”

– “ওহ ভাইয়া! তুমি এত ক্রুয়েল কেন? এভাবে স্যরি বলা আর না বলা সমান। আর আমার কাছে ওর নাম্বারও নেই। তুমি ওর সঙ্গে মিট করে স্যরি বলবে।”
আশফি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
– “অসম্ভব। ওই ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’ এমন ভাববিশিষ্ট মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার।”
– “ভাইয়া তুমি ভুল। মাহি কখনোই হামবড়া টাইপ মেয়ে নয়। অন্তত আমার মনে হয় না।”
– “গুড। বাট আমি পারব না।”

সাপ্তাহিক ছুটির দিবসে আলহাজ তার পুরো পরিবারকে দুপুরে খাবার টেবিলে পায়। এই একটা দিনে পরিবারের প্রত্যেকে দুপুরের সময়ে যেখানেই থাকুক, খাবার টেবিলে একত্র হবেই। তবে মাহিকে আজ খুব দেরিতে আসতে দেখল আলহাজ। কিন্তু কিছু বলল না তাকে। মাছের তরকারিটা মাহি প্লেটে বেড়ে নেওয়ার পর মমিন তাকে জিজ্ঞেস করল,

– “কাল থেকেই তো জয়েন করছিস না?”
– “হ্যাঁ বাবা।”
মাহির চাচা শামিম বলল,
– “এটা তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তাই না?”
– “হ্যাঁ।”
মমিন বলল,
– “সেলারিও বেশ হাই।”
এরপর আলহাজ বলল,

– “কাল আবরার খুব লজ্জিত ছিল ওর নাতির আচরণের জন্য। ওইযে ওকে খুব অপমান করে ফায়ার করেছিল তাই। আমাকে বলছিল ওদের কোম্পানিতে মাহিকে আবার জয়েন করতে এক্সিকিউটিভ পদে। সে নিজে মাহিকে নিয়ে যেতে চাইছিল কোম্পানিতে।”
সেইদিনের কথা মাহি আজও ভোলেনি আর বেঁচে থাকতে সে কোনোদিন ভুলবেও না সেই দিনটার কথা। খাবারের প্লেট থেকে হাত তুলে সে খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

– “আমাকে দুই লাখের পে-স্লিপ দিলেও আমি তো সেখানে ফিরব না দাদু। আমার আত্মসম্মানবোধ অবশ্যই আছে। আর আমি আমার নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। কোনো রেফারেন্স নিয়ে আমি কেন যাব কোথাও? আর প্যারোটে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আর আপনার বন্ধুর নাতির টেক্সটাইল কোম্পানির ম্যাটেরিয়ালের যোগান বর্তমান আমাদের কোম্পানি থেকেই নিতে হয় কিন্তু। আমাদের কোম্পানির সঙ্গে তাদের ডিল চলছে। তাই প্যারোটের চেয়ে কোনো অংশে বেশি ছাড়া কম নয় আমার কোম্পানি।”
– “না আমি তোকে বলছি না সেখানে ফিরে যেতে। শুধু বললাম আর কী আবরার এর কথাগুলো।”

খাবারগুলো আর মাহি গলা দিয়ে নামল না। কোনোরকমে কয়েক লোকমা মুখে পুরে পানি খেয়ে সে চলে এলো ঘরে। মিমিও কাল রাত থেকে মাহির এই রুক্ষ মেজাজ খেয়াল করছে। খাওয়া শেষ করে সে গেল বোনের ঘরে। বিছানায় পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে সে চোখদুটো বন্ধ করে।
– “খাওয়ার ওপর রাগ দেখালি কেন?”
– “সে দিনটাই ওর আচরণের কথা আমার মনে পড়লে রাগে এখনো গা জ্বলে ওঠে রে মিমি। চুপচাপ সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম।”
– “থাক, বাদ দে। এখনের তুই আর দেড় বছর আগের তুই এর মাঝে অনেক ফারাক। এখন তুই তোর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে তাকে জবাব দিয়ে দিবি। কিন্তু কাল কী হয়েছিল তোর?”

– “কাল যা করেছিল ও! ইচ্ছে তো করছিল কানের নিচে লাল করে দিই একশোটা থাপ্পড়ে। কিন্ত কেন যে পারলাম না সেটা ভাবতেই আফসোস লাগছে।”
– “কী হয়েছিল বলবি আগে?”
– “পরে বলব। এখন যা, আমার ভালো লাগছে না।”

মাহি শুয়ে পড়ল এক পাশ হয়ে। মনের আকাশে মেঘ গমগম করছে। যে কোনো মুহূর্তে তা বারি রূপে ভিজিয়ে দেবে মনের শহরটা। কিন্তু সেই সিক্ত শহরটা কাউকে দেখানোর কোনো আগ্রহ যে নেই তার। এক বছর চার মাস আগের সেই দিনটা। সোমকে ছায়ার মতো মাহির আশেপাশে দেখতে দেখতে আশফি এত বেশি ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছিল যে সে মাহির মুখটাও নিজের চোখের সামনে সহ্য করতে পারতো না যেন। সেদিন মাহির ভুলের জন্য আশফি সারা এমপ্লয়িদের সামনে তাকে ‘রিপ(অকর্মণ্য ঘোড়া), আনকুয়ালিফাইড’ এমন আরও অপমানসূচক বাক্য ছুড়েছিল তাকে। মুখের ওপর রেজিগনেশন পেপাড় ছুড়ে মেরেছিল সে। ‘আর যেন জীবনেও সে তার চোখের সামনে না আসে’ এই বাক্যটিও সে শুনেছিল আশফির মুখ থেকে। এতকিছুর পর শেষ দিনটাতেও মাহি কত দুরূহ ব্যাপার আশা করেছিল তার থেকে! কিন্তু সেদিনও সে বুঝিয়ে দিয়েছিল আর দেখিয়ে দিয়েছিল মাহির স্থান। মাহি কী করে ভুলবে সেই কথা আর সেই ব্যবহার!

‘মাহি’ এই নামটাই যথেষ্ট আশফিকে বাছবিচারশূন্য এক মানুষ করে তুলতে। কাল রাতের পর থেকে এই নামের অসুখটা তাকে সেই আবার চেপে ধরেছে। একদম মগজে স্থায়ীরূপে সে গেঁথে বসে আছে। যেন সে পণ করেছে,
– “আমি নড়ব না না না।”
অফিসে এসে তিন কাপ কফি খাওয়া শেষে এখন কাঁচের দেয়ালটা ভেদ করে বাহিরের শহর পানে তার দৃষ্টি বিচরণ করছে। কতগুলো মাস আগেও সে নতুন উদ্যমে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিল। সে জানে মাহির জন্য তার অনুভূতি কতটা গাঢ়ো। আর সে এও জানে যে সে চাইলেও ওই মানুষটি তার অনুভূতি গ্রহণ করবে না। তাহলে তার উচিত চিরকালের জন্য এই অনুভূতিকে চাপা দেওয়া। কিন্তু তার বদলে প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে তা যেন পুনর্জীবিত হচ্ছে। কী উপায় এই নাছোরবান্দা অনুভূতি নামক অসুখকে দমিয়ে রাখার?

তুমি রবে পর্ব ২৩

একটা ভারি নিঃশ্বাস ছেড়ে আশফি দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে চেয়ারে ফিরে আসার মুহূর্তে আকস্মিকভাবে তার নজর গেল সামনের বিল্ডিংটিতে। চতুর্থ ফ্লোরের পেছনের কাঁচে ঘেরা বারান্দাতে খুবই পরিচিত একজন মানুষকে দেখে থমকে গেল সে। তার পরনে টকটকে হলুদ বর্ণের শাড়ি। সিল্কি লম্বা চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে। কফি হাতে সে খুব খোশমেজাজে গল্প করছে একজন সুদর্শন, দীর্ঘ উচ্চতাসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে। তার মুখেও টানটান হাসি।

তুমি রবে পর্ব ২৫