তুমি রবে পর্ব ৫৩

তুমি রবে পর্ব ৫৩
Israt Jahan Sobrin

কানে এক জোড়া ছোট্ট টপ কানের দুল, ঠোঁটে হালকা রঙা লিপস্টিক আর চোখে লাইনারের চিকন টান। ব্যাস সাজটা কমপ্লিট করে মাহি চুলগুলো ছেড়ে দিলো। সাজ শেষে আয়নার মাঝে নিশ্চুপ মাহি কতক্ষণ নিজেকে দেখে নিজের বিবেককে বলল,
– “তোমার ভাবনাগুলো বড্ড যুক্তিহীন মাহি। আজ তুমি যার জন্য নিজেকে সাজালে সে তোমার প্রার্থনা করে চাওয়া সেই মানুষটি। সে তোমার স্বামী। তাকে তুমি দূরে রেখে বড্ড বেশি অন্যায় করছো, পাপ করছো।”

তীব্র যন্ত্রণার একটি শ্বাস ফেলল মাহি। সে মুহূর্তে আশফিকে নিয়ে এত নোংরা ভাবনাগুলো সে কী করে ভাবতে পারল? এক মাত্র আশফিই সেই পুরুষ, যে পুরুষের গাঢ় চাহনিতে সে কখনো পাপ খুঁজে পায়নি। ওই চাহনিতে তাকিয়ে বারবার বেহায়ার মতো হারিয়েছে সে। পাপী যদি কেউ এখানে হয়ে থাকে, তবে সে নিজে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেষ মুহূর্তে শরীরে গোলাপের সুগন্ধি মেখে সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু আবারও সেই একই ভয়। মাহি প্রচন্ড মুষড়ে পড়ছে। চোখদুটো চেপে বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবতে চায় না সে, আশফিকে মন্দ ভাবতে চায় না সে একেবারেই। কিন্তু তার দোষ কোথায়? কেন বারবার সেই দিনগুলোর দৃশ্য তার মস্তিষ্কে ঘুরছে ফিরছে? বারবার মনে পড়ছে তাকে দেওয়া সেই অপবাদগুলো। এ মুহূর্তে আরও একটি কথা তার কানে বাজছে বারবার। আশফি কেন তাকে রাতের রানি বলল? রাতের রানি কারা হয়ে থাকে তা কি সে জানে না? বউ আর সেই রাতের রানির মাঝে কতখানি ব্যবধান তা নিশ্চয় আশফি খুব ভালোভাবে জানে! তবে নিজের বউকে এমন দুটি শব্দে সম্বোধন করার অর্থ কী?

সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে নিজেকে টেনশান ফ্রি রাখার চেষ্টা করল মাহি। হঠাৎ এত কেন ভয় লাগছে তার, এর কোনো বিশেষ কারণ সে খুঁজে পেলো না। তবে তার ভয় লাগাটাও যে একদম বিনা কারণে তা সে বুঝতে পারছে। অডিও প্লেয়ারে চালু করল গতকাল রাতের সেই গানটি, ‘You call me senorita.” গানটা চালু করেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল আবার। মনে করতে থাকল আশফির সব থেকে আকর্ষণীয় হাসিগুলোর মুহূর্ত, মনে করতে থাকল মানুষটির সেই নিগূঢ় চাউনির মাঝে তাকে আটকে ফেলে আরও নিগূঢ়ভাবে তাকে কাছে টেনে নেওয়ার মুহূর্তগুলো।

আশফি দরজাটা খুলে ভেতরে এসে শুভ্র বর্ণের রাতের পোশাকে পরিহিতা তার বউকে প্রথম দর্শনে দেখেই এক অদ্ভুত হাসি হাসলো নীরবে। মাহি বুঝতেও পারল না তার উপস্থিতি। আশফি ধীর পায়ে হেঁটে এসে মাহির পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। এবার মাহি স্পষ্টভাবে আশফির নিঃশ্বাসের শব্দ পেলো। বুঝতে পারল, খুবই কাছে সেই মানুষটি। আশফি গানের ভলিউমটা আর একটুখানি বাড়িয়ে দিলো। মাহি চোখদুটো খুলল না তখনো। আশফি তার কাছে এসে তার সেই গাঢ় চাউনিতে মাহিকে দেখল মৃদু হাস্যে। মাহির বাহুদ্বয় ধরে তার চুলগুলোর মাঝে নাক ডুবিয়ে রাখল কিছু সময়। কাঁধের কাছ থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে তার কাঁধ আর গলার পাশটাতে নাক ডুবিয়ে তার শরীরের সুগন্ধিও টেনে নিতে থাকল। মাহি তখন মৃদুস্বরে বলল,

– “আমার ভয়টা একদমই বেমানান।”
কথাটা আশফির কানে গেলেও তার মগ্নতা দূর হলো না। যতটুকু দূরত্ব ছিল তাদের দুজনের মাঝে, ততটুকুও দূরত্ব আর রাখল না আশফি। মাহিকে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো সে। অন্তরের মাঝে কাঁপুনি ক্রমশ বাড়তেই আছে মাহির। দু হাতের বন্ধনে মাহির কটিদেশ জড়িয়ে ধরল আশফি। আশফির ওষ্ঠজোড়ার স্পর্শ পাওয়ার অপেক্ষাতে মাহি। তবু সে বলল সেই আগের সুরে,

– “আমি কেন সহজ হতে পারছি না আশফি?”
আশফি নীরব। তার বুকের ওপরের লম্বা ফালির বাঁধনটুকু সে এক টানে খুলে দিলো। ওপরের কোটির অংশটুকু কাঁধ থেকে নামিয়ে সেখানে খুবই আলতো করে চুমু খেল। মাহি আবারও বলল,
– “আমি বোধহয় অন্যায় করছি আপনার সঙ্গে। কিন্তু আমি…! আশফি? আপনি তো বলেছিলেন আমার ইচ্ছার মূল্যায়ন থাকবে আপনার কাছে।”

এবারও কোনো জবাব দিলো না সে। মাহির জামার ওপরের কোটি অংশটুকু তার গা থেকে খুলে নিয়ে তা ফেলে দিলো নিচে। মাহি তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল এবার। প্রচন্ড অসহায় মাহির চাহনি। কিন্তু আশফির ওষ্ঠে তখনো ঈষৎ হাসিটুকু লেপ্টে আছে। আশফি তার হাতটা বাড়াল মাহির দিকে। তার হাতে মাহি হাতটা রাখতেই আশফি তাকে বিছানায় বসিয়ে মাহির খুব কাছে এসে বসলো। এরপর সেন্টার টেবিলের এক কোণে রাখা একটি ছোট্ট বক্স হাতে নিয়ে তার মধ্য থেকে হোয়াইট গোল্ডের ছোট পেন্ডেল সমেত একটি হার বের করল। মাহি নীরব তখন আশফির দিকে চেয়ে। বিনাবাক্যে হারটা মাহির গলাতে পরিয়ে তার দিকে তাকাল গভীর দৃষ্টিতে। কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো তার কানের পিঠে গুঁজে তারপর তাকে বলল,

– “আমার সামনে এমন একটি মানুষ, যাকে যতবারই আমি কাছে পেয়েছি ততবারই আমি বেহায়া হতে বাধ্য হয়েছি। নিজের দখল নিজে হারিয়েছি বারবার। অত্যন্ত কষ্টদায়ক নিজেকে দূরে রাখা এই মানুষটার থেকে।”
কথাগুলো বলেই সে আচমকা এক তপ্ত চুমু খেয়ে বসলো মাহির ওষ্ঠে। এমন আকস্মিক ঘটনার মুখোমুখি মাহি এর আগেও কয়েকবার হয়েছে। তাই অবাক হলো না সে। কতক্ষণ সময় পর আশফি তাকে ছেড়ে বেশ অশান্তভাবে আর মৃদুকণ্ঠে মাহির গালটা স্পর্শ করে বলল,

– “সব থেকে যন্ত্রণাকর কী জানো? সব থেকে দামি মানুষটার বিশ্বাস না পাওয়া।”
আশফি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “সেই সময়টা একদিন আসবে মাহি। যেদিন স্বেচ্ছায় এই বেশে তুমি নিজে আসতে চাইবে আমার কাছে; আমি অপেক্ষাতে রইলাম সেই সময়টার জন্য।”
রুমে মৃদু আলো জ্বেলে দিলো সে আবার। বিছানাতে এসে মাহিকে ডেকে বলল,
– “এখানে এসো।”

মাহি এক ডাকেই আশফির কাছে এসে বসলো। আশফি বালিশদুটো ঠিক করে একটিতে শুয়ে পড়ে মাহিকে শোয়ার জন্য ইশারা করল। মাহিও বিনা দ্বিধাতে আশফির পাশে এসে শুয়ে পড়ল। চাদরটা টেনে নিয়ে আশফি বলল,
– “বেশি শীত করলে ঢুকে পড়তে পারো। পারমিশন আছে।”
উল্টো পাশ ফিরে আশফি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। মাহির এ মুহূর্তে ইচ্ছে করছে ছুটে দূরে কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য একা থাকতে। আশফি ইচ্ছা করলেই আজ তার কাছে আসতে পারত। সে তো খুব নার্ভাস হয়ে পড়ছিল বলেই কথাগুলো বলেছিল। সেই নাভার্সনেসটা কাটিয়ে দেওয়া কি তার দায়িত্ব ছিল না? সে কি বাঁধা দিতো তাকে?

প্রশ্নগুলো অনবরত জ্বালাতে থাকল মাহিকে। প্রশ্নের একটি উত্তর বারবার মাহিকে জানাল, হয়তোবা বাঁধা দিতো সে আশফিকে। এত কেন জড়তা তার মাঝে? কবে সে এই জড়তা থেকে মুক্তি পাবে? এই জড়তা থেকে মুক্ত করার জন্য সব থেকে বেশি সহায়তা প্রয়োজন তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার। খু্বই প্রয়োজন তার সহায়তা।
আশফি বুঝতে পারছে মাহির নির্ঘুম অবস্থা। এবং এই নির্ঘুম অবস্থার কারণও আশফি ধরতে পারছে। সে জিজ্ঞেস করল মাহিকে,
– “ফলাফল কী দাঁড়াল?”
মাহি আশফির আচমকা প্রশ্নে চকিতে তাকাল তার দিকে। অনেকটা রাগ নিয়ে সে বলল,
– “সাহায্য প্রয়োজন আমার।”
– “চাওয়ার থেকে বেশি কিছুই পাবে। সমস্যা নেই, ঘুমাও। আমি একজন হাজবেন্ড, কোনো বয়ফ্রেন্ড নই যে নিজের রাইট ছেড়ে দেবো।”

শহরের এই ব্যস্ততম সময়গুলোর মাঝে যতটুকু সময় থাকা যায় ঠিক ততটুকু সময় ঐন্দ্রী নিজেকে সেই ব্যস্ততম সময়গুলোর মাঝেই নিজেকে রাখতে চেষ্টা করে। চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরটার মাঝে ফিরলেই পৃথিবীর যেন সব হতাশা তাকে ঘিরে ধরে৷ নিজেকে এই হতাশার মাঝ থেকে মুক্ত করার উপায় কী? প্রতিনিয়ত ঐন্দ্রী সেই উপায়গুলোর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। আজ তার কর্মজীবনের ছুটি দিবস। সকাল সকাল কয়েক মাইল দৌঁড়ে, নাস্তাটাও বাহিরে করে ঘরে ফিরে সে এই সকল দিনগুলোতে। আজ সে প্ল্যান করেছে শরীরটা পুরোপুরি ক্লান্ত না হওয়া অবধি সে ঘরে ফিরবে না।

ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরলেই বিছানা তাকে ডাকবে। এরপর নিদ্রাতে ফিরতে পারবে সে কোনো চিন্তা ছাড়া। সকালের প্রাতঃকর্ম সেড়ে এখন বেরিয়েছে সে শপিংয়ের উদ্দেশে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে এখন নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে জ্যাম থেকে কখন মুক্ত হতে পারবে। চারপাশে নজর ঘুরছিল তার। এর মাঝে দুর্দান্ত একটি দৃশ্যতে তার নজর জোড়া আটকা পড়ল। তার ঠিক পাশের গাড়িটাতে একজন প্রতিযোগী বসে আছে তাকে লক্ষ্য করে। এই অসহ্যকর জ্যামের মাঝে সব থেকে বিনোদনের মুহূর্তে সে এখন। তার সেই প্রতিযোগী তার তুলনায় হাজার গুণ শ্রেয়। তার দৈহিক গঠন, তার সুশ্রী রূপ, তার বয়স আর তার গাড়িটাও। ঐন্দ্রীর দিকে চেয়ে আছে সে প্রচন্ড ক্রুর চোখে। ঐন্দ্রী তার ড্রাইভিং সিট ছেড়ে পাশের সিটটাতে এগিয়ে গেল। মুখে একটি হাসি টেনে বলল,

– “হ্যালো গার্ল। তুমি তো সম্পূর্ণই দেখছি আমার পোশাকে। ড্রাইভিংও কি তুমিই করছিলে?”
মেয়েটি সে মুহূর্ত ড্রাইভিং সিটে একা বসে। তাছাড়া গাড়িতে তাকে ছাড়া আর কাউকে ঐন্দ্রী দেখতে পেলো না। তার দিকে মেয়েটির দৃষ্টিভঙ্গি এমন যেন সে কার রেস যেতে চায় ঐন্দ্রী সঙ্গে। ঐন্দ্রীর প্রশ্নের মাত্র একটি উত্তর দিলে সে অনেকটা বৃটিশদের মতো ইংরেজি বলে।

– “আ’ম নট ইন ইয়্যোর ক্লোথস, ইয়্যু আর ইন মাই ক্লোথস।”
ঐন্দ্রী হেসে ফেলল তার আধো আধো কণ্ঠে কথাগুলো শুনে। আর সে তার কথা এবং চেহারা দেখে বুঝতে পারল সে প্রবাসী। শুভ্র বরফের মতো শুভ্র তার গায়ের রং, ঠোঁটটাও লাল আপেলের মতো টকটকে লাল আর চুলগুলো ব্রাউন। কিন্তু চেহারাতে সম্পূর্ণ বাঙালি সে। একদম সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা ডলের মতো দেখতে সে। ঐন্দ্রী তার সেই ক্রুর দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করল তাকে,

– “তুমি কি রেগে গেছো আমাকে দেখে?”
– “ইয়্যু কপিড মাই ক্লোথস!”
ঐন্দ্রী এবারও হেসে ফেলল তবে শব্দ করে। ঐন্দ্রীর পরনে ব্ল্যাক কালার একটি লং শার্ট আর সেই ছোট্ট মেয়েটার পরনেও সেম একটি ব্ল্যাক কালার শার্ট। আর এটাই তার রাগের প্রধান কারণ। ঐন্দ্রী হাসি থামিয়ে কানদুটো ধরে আদুরে স্বরে বলল,
– “ও সো স্যরি মাই ডামি বেব! আমি যদি জানতাম এটা তুমি পরেছো আমি তবে কখনোই পরতাম না।”
– “আ’ম নট আ ডামি। আ’ম মেহরিন মাহতীম।”

– “সো মাচ কিউট ইয়্যোর নেম অ্যান্ড ইয়্যু। বাট ইয়্যু লুকস লাইক আ ডল।”
এর মাঝে রেড সিগন্যাল কাটল। ঐন্দ্রী তাকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। ঠিক তখনই মাহতীম হাতে আইসক্রিম নিয়ে ঢুকল গাড়িতে। মেয়েকে ড্রাইভিং সিটে দেখে সে হেসে বলল,
– “মাম্মাম! তোমার ড্রাইভিং ভীষণ পছন্দ, না?”
– “ইয়া ড্যাড। বাট আ’ম আপসেট!”

মাহতীম মেয়েকে কোলে তুলে পাশের সিটে বসিয়ে সে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। তারপর তাকে আইসক্রিম খাইয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন সোনা? কী হয়েছে? কিছুক্ষণ আগেও তো তুমি অন্নেক হ্যাপি ছিলে!”
মেহরিন বাবার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। মুখটা ভার করে শুধু আইসক্রিম খেতে থাকল।

– “দুপুরের এই কড়া রোদে বের হওয়ার কোনো যুক্তি আছে?”
মাহি গাল ফুলিয়ে একদম চুপ। দিশান তার গম্ভীর চেহারা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “আমার ভাইজান কি তোমায় বকেছে?”
– “না।”
– “তো এমন মুখ করে আছো কেন?”
– “সে আমার সাথে কোনো কথায় বলছে না।”

– “তোমার সাথে কথা না বলে ওই ব্যক্তি কখনোই থাকবে না। হয়তো কিছু নিয়ে চিন্তিত।”
– “বাদ দাও ওই ফালতু লোকের কথা। সে এত বড় ছ্যাঁচড়া আমি ভাবতেও পারিনি!”
– “আমার কাছে আমার ভাইয়ের বদনাম!”
মাহি এবার দিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “সে বারবার আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার গিফ্টের কথা। এটাকে কী বলে?”
– “তুমি নিজে ছ্যাঁচড়ামো করছো বলেই তো সেও ছ্যাঁচড়ামি করে চাইছে।”
– “আমি তো সময় চেয়েছি, না?”
– “হুঁ, চেয়েছো তো।”

– “আমি টাকা পাবো কোথা থেকে তার দামি গিফ্টের জন্য?”
– “কী বলো তুমি! বরের অর্ধেক প্রর্পাটি তোমার! আর কিনা বলছো টাকা পাবে কই?”
– “সে যদি বলে তার টাকা দিয়ে তাকেই গিফ্ট করছি আমি? তখন আমার সম্মানটা যাবে কই?”
– “আমার ধারণা এটা বলবে না সে।”
কথাটা বলে একটু থামল দিশান। হঠাৎ বলল,
– “কিন্তু আবার বলতেও পারে।”
– “আমি শুনতে চাই না এ কথা।”
– “একটা হেল্প করতে পারি তোমাকে।”
– “কী?”

– “তুমি কী দিতে চাও তাকে আমি সেটা কালকের মধ্যেই ম্যানেজ করে দেবো। ওটার অ্যামাউন্টাও আমিই দেবো। সময় সুযোগ বুঝে তুমি ওটা আমাকে ব্যাক করে দিলে। তাহলেই তো হলো।”
মাহি দিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখ করে ভাবতে থাকল দিশানের প্রস্তাবের বিষয়ে। প্রস্তাবটা খারাপ না। এই মুহূর্তে নিজের সম্মান বজায় রাখতে এর চেয়ে ভালো অপশন সে আর পাবে না। ফোনটা বের করে সে ফোনের গ্যালারি থেকে দিশানকে একটা ছবি দেখাল। দিশান বলল,
– “ভালো সময়ে দেখিয়েছো। তবে এটা পেতে দু’দিন সময় লাগবে। আমার একটা বন্ধু আসছে জাপান থেকে। ওকেই বলব এটা আনার জন্য।”

– “অবশ্যই কাপলদের জন্য পারফেক্ট হতে হবে।”
– “নিশ্চয়ই। তো তোমরা মিট করছো এই দুপুরবেলাতে কেন?”
– “আমাদের মিট করার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই শুধু রাত বাদে।”
– “আমার থাকা কেন বারণ? আমি শুধু পাশে বসে এক মগ কফিই খেতাম।”
– “সারাদিন কথা বলো, ভিডিও চ্যাট করো তাও মন ভরে না?”
– “ঘরে না আনা অবধি মন ভরবে না ডিয়ার। কবে যে দেখব সেই দিনগুলো! আমার ভাইটা যেমন অফিস থেকে দৌঁড়ে বের হয় আমারও প্রচন্ড ইচ্ছা সেভাবে দৌঁড়ে বাড়ি ফেরার জন্য বের হওয়ার।”

দিশানের এমন অদ্ভুত আফসোস-আক্ষেপ শুনে মাহি হেসে উঠল। আধ ঘন্টা পরই তাদের গাড়ি এসে থামল একটা ছোট কফিশপের সামনে। মাহি গাড়ি থেকে নামলে দিশান তাকে বলল,
– “তোমাদের আড্ডা শেষ হলে অবশ্যই আমাকে ফোন করো। আমি চলে আসব গাড়ি নিয়ে।”
– “আচ্ছা ঠিক আছে।”
দিশান চলে যেতেই কফিশপের সামনে একটি পরিচিত বাইক দেখতে পেলো মাহি। বাইকটার দিকে এক মিনিট চেয়ে থেকে ভেতরে চলে এলো সে। দিয়া, হিমু তাকে দেখে ইশারা করল তাদের দিকে। প্রায় ঘন্টা দুই তারা তিন বান্ধবী মিলে কথাবার্তা, আড্ডা দেওয়া শেষে অনিক এসে পড়ল হিমুকে নিতে। হিমু বিদায় নিতেই দিয়া জিজ্ঞেস করল মাহিকে,

– “ও কিছু বলে গেছে?”
– “বলল তো কথা শেষ হলে ওকে ফোন দিতে। তাহলে ফোন দিই।”
– “হুঁ দে।”
দিশানকে কল করতেই দিশান ফোন রিসিভ করে বলল,
– “কাছাকাছিই আছি। পাঁচ মিনিট বসো।”
মাহি আর দিয়া কফি শপের সামনে এসে দাঁড়াল। দিশান গাড়ি নিয়ে আসতেই মাহি বলল,
– “আমি ট্যাক্সি করে চলে যাই। তোরা বরং একটু ঘুরে আয়।”

– “আরে না। কোনো দরকার নেই। কষ্ট করে ট্যাক্সিতে যাবি কেন?”
দিশান গাড়ি থেকে নেমে আসলো। মাহিকে বলল,
– “সিরাজকে কল দিচ্ছি। ও বোধহয় চলে এসেছে কাছাকাছি। তুমি ওর সঙ্গে চলে যাও গাড়িতে করে। আমরা একটু…”
দিশান চোখ টিপে হেসে বোঝালা তার আর দিয়ার কিছু সময় কাটানোর কথা। মাহি হেসে বলল,
– “আমাকে গাড়ি নিতে হবে না। আমি ট্যাক্সি ধরছি। তোমরা বের হও।”
দিশান দিয়া রাজি না হলেও মাহি তাদের জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়।

আজ আশফি ঠিক সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে। নিচে এই সময়ে বাসার সবাই এক সঙ্গে বসে নানানরকম গল্প, আড্ডা দেয়। কিন্ত মাহিকে সেখানে দেখা গেল না। রুমে আসার পরও মাহিকে পেলো না সে। দুপুরে যখন দিশানের সঙ্গে বাইরে বের হয় তখন দিশানের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। আর তার থেকেই জানতে পারে মাহি তার সঙ্গে বেরিয়েছে। তাহলে সম্ভবত বন্ধুমহলে আটকা পড়েছে। যেমনটা তার ক্ষেত্রেও হয়।

আশফি বাইরের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে বসে সময় কাটাতে থাকল ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে। এর ফাঁকে ঘড়িতেও সময় দেখে নিলো আশফি। সাতটা পাঁচ বাজে তখন। আশফি এবার ফোন করল তাকে৷ কিন্তু ফোনটা রিসিভ হলো না দেখে একটু চিন্তার ভাঁজ পড়ল তার কপালে। সাতটা দশে মাহি রুমে ফিরল। রুমে এসেই সে ফ্যানটা ছেড়ে বিছানার ওপর বসলো। আশফি ব্যালকনিতে বসেই তাকে লক্ষ্য করল খুব বিক্ষিপ্ত লাগছে তাকে। আশফি দ্রুত উঠে এসে মাহিকে ডাকতেই মাহি চমকে ফিরে তাকাল তার দিকে। তার চোখ মুখের চেহারা আরও খারাপ৷ চোখে তার স্পষ্ট আতংক ফুটে উঠেছে আর ভয়ে কিংবা লজ্জায় তার গালদুটো লাল হয়ে আছে। আশফি তার পাশে বসে পানির গ্লাসটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল তাকে,

তুমি রবে পর্ব ৫২

– “কোনো সমস্যা? কী হয়েছে?”
মাহি সেই আতংকিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল আশফির দিকে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নিলো পানির গ্লাসটি। কয়েক চুমুক খেয়ে তারপর বলল,
– “কিছু না, আমি একটু বাথরুমে যাব।”
– “গোসল নেবে?”
– “হ্যাঁ। খুব অস্থির লাগছে।”
কথাটা বলে মাহি ক্লোজেট থেকে শাড়ি, ব্লাউজ বের করে আর এক মিনিট দেরি করল না। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। পুরো শরীর তার এখনো কাঁপছে।

তুমি রবে পর্ব ৫৪