তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫১

তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫১
আমেনা আক্তার

তখনি হঠাৎ আব্রাহামের বুকের দিকে বন্দুক তাক করে রাখা গুন্ডার হাতে তীব্র বেগে একটি গুলি এসে লাগলো। গুলিটি লাগতেই বন্দুক টি পরে গেল গুন্ডা টির হাত থেকে। আব্রাহাম ও বাকি গুন্ডা গুলো সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো আদিত্য বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে গুন্ডা টির দিকে।ওর চোখ মুখে যেনো খেলা করছে হিংস্রতা। আদিত্যর সাথেই দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যর বডিগার্ড। আদিত্য কে এই সময় এখানে উপস্থিত দেখে গুন্ডা গুলোর চোখ মুখে আতংক এসে হানা দিলো। গুন্ডা গুলোর মধ্যে কেউ আদিত্য কে এখানে আসা করে নি। আদিত্য কে চিনে না এমন কোনো গুন্ডা মাস্তান এই শহরে নেই।গুন্ডা ও মাস্তানদের কাছে আদিত্য চৌধুরী একটি আতংকের নাম।সেই আদিত্য কে এখানে দেখে তো ভয় পাওয়ারই কথা।

এদিকে আব্রাহাম আস্তে আস্তে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল আয়নার কাছে। এবং ধপ করে বসে পড়লো আয়নার মাথার কাছে। আব্রাহাম বসেই একহাত দিয়ে আয়নার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। এবং আরেক হাত দিয়ে আয়নার মাথার রক্ত আটকানোর চেষ্টা করতে থাকলো।
আদিত্য ইশারা করতেই বডিগার্ড ঝাঁপিয়ে পড়লো গুন্ডা গুলোর উপর।গুন্ডা গুলো নিজের সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা করার পরেও পেরে উঠলো না আদিত্যর শক্তিশালী বডিগার্ডদের সাথে।
রাজদের গাড়ি এসে থামলো মেলার সামনে। এবং সকলে দৌড়ে মেলার ভিতরে প্রবেশ করলো। মেলার ভিতর প্রবেশ করতেই ওরা দেখতে পেলো আদিত্যর বডিগার্ড ও গুন্ডা গুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।আর একপাশেই আব্রাহাম আয়নার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। আব্রাহাম ও আয়নার অবস্থা দেখে সকলের পা যেনো সেখানেই থেমে গেল।নিজেদের সামলে সকলে এগিয়ে গেল আব্রাহামের কাছে। তারপর ওদের সকলে মিলে ওদের হসপিটালে নিয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাজ এইটা খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে নূর যে আব্রাহামের প্রিয়সির কথা বলেছে তা আর কেউ না আয়না। কারণ আব্রাহাম অনেক পাগলামো করছিল আয়না কে নিয়ে ওকে কিছুতেই ছেড়ে অপারেশন থিয়েটারে যেতে চাইছিল না।ও বারবার বলছিল যেই পর্যন্ত আয়নার অপারেশন সঠিক ভাবে না হয়ে যায় সেই পর্যন্ত ও ওর অপারেশন করাবে না। শেষ পর্যন্ত আব্রাহাম কে ইনজেকশন দিয়ে বেহুঁশ করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বর্তমান…
অপারেশন শেষ হতেই ডাক্তার বের হয়ে আসে অপারেশন থিয়েটার থেকে। ডাক্তার কে বের হতে দেখে সকলে উন্মাদের মতো ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। আব্রাহামের মা কাঁদতে কাঁদতে বলল।
ওরা এখন কেমন আছে, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে তাই না।আয়না ও আব্রাহাম ঠিক আছে না। ওদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো। প্লিজ বলুন।
শান্ত হোন আপনারা অপারেশন হয়ে গিয়েছে এবং দুজনেরই জীবন বেঁচে গিয়েছে।
ডাক্তারের কথা শুনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু তখনি আবার ডাক্তার বলে উঠলো।

কিন্তু,
কিন্তু কি,
কিন্তু আব্রাহামের এখনো পা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।ওর যেই পায়ে গুলি লেগেছে সেই পায়ে কিছু সমস্যা হয়েছে।তাই আব্রাহামের আরো ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার যা এখানে হবে না।ওর ট্রিটমেন্ট করার জন্য বিদেশ নিয়ে যেতে হবে।আর আয়না। ওর মাথায় অনেক গভীর ভাবে আঘাত লাগার কারনে ওর শরীর প্রায় প্যারালাইজ হয়ে গিয়েছে।ও আপনাদের কথা শুনতে পারবে। আপনাদের দেখতে পারবে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারবে না।
ডাক্তারের কথা শুনে সকলের মাথায় যেনো বজ্রপাত ঘটলো। রাজের মা ডাক্তারের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বলল।
আমার মেয়ে কি সারাজীবন এমন থাকবে।ও কি কখনো ঠিক হবে না।
জ্বী ও অবশ্যই ঠিক হবে কিন্তু কবে কখন তা আমি বলতে পারব না।এমন ও হতে পারে ও আজই সুস্থ হয়ে যায়। আবার এমনও হতে পারে ও সারাজীবন এমনি থাকবে।
ডাক্তারের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো আয়নার বাবা মা।রাজ যেনো পাথর হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।কোনো ভাই কি সহ্য করতে পারে নিজের আদরের বোনের এমন পরিনতি। আরশাদ এসে রাজকে কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরশাদ জড়িয়ে ধরতেই শক্ত পোক্ত খোলশ ছেড়ে বেড়িয়ে রাজ হু হু করে কেঁদে উঠলো।ও কিভাবে মেনে নিবে ওর বোন ওকে আর ভাই বলে ডাকবে না।ওর কাছে আর আবদার করবে না।আদৌ কি আয়না সুস্থ হবে নাকি সারাজীবন রাজ নিজের বোনের মুখে ভাইয়া ডাক শোনার জন্য জ্বলতে থাকবে।এই উত্তর কারও জানা নেই।

আস্তে আস্তে আব্রাহাম নিজের চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করল। হঠাৎ নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে আব্রাহাম কিছুই মনে করতে পারে না যে ওর সাথে কি ঘটে ছিল। আব্রাহাম ঠিক ভাবে নড়াচড়া ও করতে পারছে না। ওষুধের প্রভাবে আব্রাহামের তীব্র মাথা ব্যথা করছে। একজন নার্স আব্রাহাম কে চোখ মেলে তাকাতে দেখে বাইরে আব্রাহামের বাবা মা আর ওর বন্ধুদের খবর দেয়।
আব্রাহামের বাবা মা ও ওর বন্ধুরা ছুটে আসলো আব্রাহামের কাছে। আব্রাহাম নিজের বাবা মা ও বন্ধুদের দেখে দুর্বল কন্ঠে প্রশ্ন করলো।
আ..আমি এখানে কি করছি?

আব্রাহামের প্রশ্নে সকলে কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু পরের মুহূর্তে সকলে বুঝতে পারে ওষুধের প্রভাবের জন্য হয়তো আব্রাহামের কিছু মনে নেই। আব্রাহামের কথা শেষ হতেই আব্রাহামের মা বলল।
তুই এখন ঠিক আছিস বাবা, তুই জানিস আমরা কত ভয় পেয়ে গেছিলাম। আল্লাহর রহমতে তুই সুস্থ হয়ে গেছিস।
কিন্তু আ.. আমার কি হয়েছে আমি তো মেলা..
কথাটি বলতেই থেকে গেল আব্রাহাম ওর যেনো মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু মনে পরে গেল।সব কিছু মনে পরতেই আব্রাহাম যেনো পাগলের মতো হয়ে গেল। এবং উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
মা আয়..য়না কোথায়,আয়না কোথায় মা ও ঠিক আছে তো বলো মা ও ঠিক আছে না।
ছেলের কথায় কি জবাব দিবে আব্রাহামের মা বুঝতে পারছেন না। এখন আব্রাহামের শরীরের যেই অবস্থা এতে আয়নার কথা আব্রাহাম কে জানানো ঠিক হবে না। আব্রাহামের মা আব্রাহাম কে কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে রাজ বলে উঠলো।
আয়না একদম ঠিক আছে।

আব্রাহাম দূর্বল চোখে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রাজ দাঁড়িয়ে আছে। রাজ কে দেখে আব্রাহামের মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। এখন আব্রাহাম আর কারও কথা বিশ্বাস না করলেও রাজের কথা বিশ্বাস করে নিলো ও নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না।
আব্রাহাম রাজের উদ্দেশ্যে বলল।
আমি কি ওকে একবার দেখতে পারবো।
না তোর আর ওর শরীর এখনো অসুস্থ, ডাক্তার আমাদের এখন তোর সাথেও দেখা করতে না করেছিল। কিন্তু আমরা জোড় করে এসেছি। এখন ওর সাথে কেউ দেখা করলে ওর শরীর আরো অসুস্থ হয়ে যেতে পারে তাই ওর সাথে এখন দেখা না করাই শ্রেয়।
রাজ আব্রাহাম কে কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বললেও ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলেছে তা কেবল রাজ জানে। কিন্তু এখন এ ছাড়া আর কোনো উপায় ও নেই। আব্রাহাম কে এই মুহূর্তে সত্য কথা জানালে ওর শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে তাই ওকে কিছুদিন পর জানানোর কথা ভেবেছে ওরা।

কেটে গিয়েছে দুদিন,এই দুদিনে সকলের বাড়ি হয়ে গিয়েছে যেনো হসপিটাল। রুদ্র ও নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে এখন হসপিটালে পরে থাকে।এতে সিরাতের অবশ্য কোনো সমস্যা নেই।সিরাত খুব ভালোভাবে জানে রুদ্রের জন্য ওর বন্ধুরা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।সিরাত ও অবশ্য অনেকবার হসপিটালে যেয়ে এসেছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে রুদ্রের দাদি।
রুদ্রের দাদি যেনো সিরাত উঠতে বসতে কথা শুনাতে ছাড়ছে না।সিরাতের সকল বিষয়ে ওনার নাক গলানো বোধহয় প্রয়োজন হয়ে পরেছে।সিরাত এখন কিছু বলতেও পারছেনা কারণ রুদ্রের দাদি নাকি দু বার হার্ট অ্যাটাক করেছেন।তাই রুবেল মির্জা সিরাত কে রিকোয়েস্ট করেছেন যেনো সালেহা মির্জা কিছু বললে চুপ করে থাকতে।সিরাত এখন এখান থেকে যেতেও পারছেনা কেননা রুদ্র ওর বন্ধুদের সামনে থেকে ওদের সাহস বাড়ালেও দিন শেষে ওদের অবস্থা দেখে নিজেই যেনো দিন শেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। তখন সিরাত রুদ্রকে সামলায়। নিজের স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করছে।

কিন্তু এখন যেনো সালেহা মির্জা নিজের সকল সীমা পার করে ফেলেছে।আজ যখন সিরাত এর ক্ষুধা লাগার কারনে সকলের আগে খেতে বসেছিল তখনি সালেহা মির্জা সিরাতের সামনে থেকে খাবার সরিয়ে ফেলে।
সিরাত অবাক হয়ে তাকায় সালেহা মির্জার দিকে। সালেহা মির্জা সিরাতের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল।
স্বামী কাজ করে না,আর বসেছিস আমাদের আগে খেতে। লজ্জা করে না তোর এভাবে বসে বসে শ্বশুড়ের ঘাড়ের উপর খাচ্ছিস।
সালেহা মির্জার কথা শুনে সাহানারা মির্জা এগিয়ে এসে বলল।
মা কি বলছেন আপনি,সিরাত খাবার খাচ্ছে ওর প্লেট আপনি সরালেন কেনো।সিরাত কে খেতে দিন।আর রুদ্রের বাবার কষ্টে উপার্জন করা খাবার সিরাত খাবে না তো কে খাবে।
তুমি চুপ করো বউমা, রুবেল তোমার স্বামী হওয়ার আগে আমার ছেলে।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিবো ওর করা উপার্জন কে খাবে আর কে খাবে না।

সাহানারা মির্জা আর কিছু বলার আগেই সিরাত শক্ত গলায় বলল।
থাক মা আমার জন্য আপনার কিছু বলতে হবে না। দাদির যখন এতই সমস্যা ওনার ছেলের উপার্জিত খাবার খেলে,তাহলে আমি খাবো না।
কথাটি বলেই সিরাত রুমে চলে যায়। সাহানারা মির্জা এত ডাকার পরেও সিরাত আর রুম থেকে বের হয়নি।আর না সারাদিন এক ফোঁটা পানিও নিজের গলা দিয়ে নামিয়েছে।
রুদ্র সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়িতে ফিরেছে। আব্রাহাম কে সামলানো আজ অনেক কঠিন হয়ে পরেছিল। আব্রাহাম শুধু আয়নাকে এক নজর দেখতে চায়। এখন ওকে কি করে আয়নার কথা বলবে ওরা,ওরা তো জানে আয়নাকে কত ভালোবাসে আব্রাহাম।তাই এত মানুষ মিলেও আব্রাহাম কে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
আজ রুদ্র বাড়িতে ফেরার পর রুমে প্রবেশ করলো।রুমে প্রবেশ করতেই রুদ্রের ভ্রু কুঁচকে উঠলো। কারণ সিরাত এই কদিন রুদ্রের বাসায় ফিরার অপেক্ষা করেছে। এবং রুদ্রের সাথে খাবার খেয়েছে কিন্তু আজ সিরাতের আগে শুয়ে পরা রুদ্রের হজম হলো না।সিরাতের শরীর খারাপ করলো নাকি কথাটি ভেবে রুদ্র এগিয়ে গেল সিরাতের কাছে এবং ওকে ডেকে বলল।

তোমার কি শরীর খারাপ,
সিরাত চোখ বন্ধ করেই বলল।
না ঠিক আছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে আসো।
সিরাতের কথা শুনে রুদ্র কিছু না বলে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে যায় খাবার খেতে। রুদ্রের প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে এই দৌড় ঝাপটায় ঠিক ভাবে খাবার খাওয়া ও হয়নি।মাথাও যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। রুদ্রের মা ওর জন্য খাবার আনতেই রুদ্র একে বাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করলো খেয়েছে কিনা। সাহানারা মির্জা প্রতি উত্তরে বলল।
খেয়েছে,

সবার শেষে রুদ্র সিরাতের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলো।তখন রুদ্রের মা বলল।
ও সকাল থেকে এক ফোঁটা পানিও খায়নি।
রুদ্র খাবার মুখে তুলছিল, মায়ের কথা শুনে ওর হাত থেমে গেল। রুদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ও খায়নি কোনো?
রুদ্রের প্রশ্ন শুনে, সাহানারা মির্জা ওর দাদির করা আচরণের কথা রুদ্র কে খুলে বলল।
রুদ্র রাগে কাঁপছে মায়ের কথা শুনে। এবং ওর মাকে উদ্দেশ্যে করে বলল।

তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫০

এই খাবার যখন আমার স্ত্রীর গলা দিয়ে নামেনি তখন আমারও এই খাবার গলা দিয়ে নামবে না।
কথাটি বলেই রুদ্র হনহনিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। রুদ্র বেড়িয়ে যেতেই সাহানারা মির্জা একটি লম্বা শ্বাস ফেলল।উনি জানেন না ছেলের খাবারের সময় কথা গুলো বলে ঠিক করেছেন কিনা। কিন্তু সাহানারা মির্জা এটা খুব ভালোভাবে জানেন রুদ্র যদি সিরাত কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাহলে সিরাতের আত্মসম্মান কারও সামনে কমতে দিবে না।

তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫২