তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫২
আমেনা আক্তার
দীর্ঘ এক রাত পেড়িয়ে সকালের সূচনা ঘটলো। আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ।সিরাতের মুখে এসে আলো পড়তেই ও ভ্রু কুঁচকে ফেললো। নিজের দূর্বল শরীর কে টেনে যখনি উঠতে যাবে তখন অনুভব করলো পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ক্ষিদের চটে যে এই যন্ত্রনা হচ্ছে তা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে সিরাত।সিরাত পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলো রুদ্র বিছানায় নেই।
সিরাত ভাবলো হয়তো রুদ্র হসপিটালে চলে গিয়েছে।কাল রাতে ক্ষুধার চটে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে সিরাত বুঝতেও পারলো না রুদ্র যে কাল সারারাত আর রুম আসেনি এবং ও বাড়িতেও ছিল না।
সিরাত দূর্বল শরীর টেনে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করলো।ওর এখন এখানে বসে থেকে কাজ নেই।আর না সিরাত এত দূর্বল যে ওর উপর হওয়া অন্যায় ও মেনে নিবে।কাল রাগের বসে ও কিছু খায়নি কারন কাল সালেহা মির্জা সিরাতের আত্মসম্মানে আঘাত হেনে কথাগুলো বলেছিল।কাল সিরাত সব চুপচাপ সহ্য করলেও এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আর ও চুপ থাকবে না। যদি প্রতি উত্তর করার পর ওই বুড়ি হার্ট অ্যাটাক এ মরেও যায় তবুও কিছু যায় আসবে না সিরাতের। সিরাতের মানুষের ধার ধারা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। শুধু এই বাড়িতে এসে নিজের শশুর শাশুড়ির আদর স্নেহ পেয়ে ওর মন কিছুটা নরম হয়ে উঠেছিল।
এই জন্য আবেগে প্রবণ হয়ে রুবেল মির্জার কথা অনুযায়ী সকল কিছু চুপচাপ সহ্য করে গিয়েছে।সিরাত কখনো নিজের অধিকার না ছেড়েছে না ছাড়বে। প্রয়োজন পরলে ও যুদ্ধ করে হলেও নিজের অধিকার আদায় করে নিবে।এর মানে এই নয় সিরাত বড়োদের সাথে বেয়াদবি করবে বেয়াদবি বিহীন কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় সিরাত বেশ ভালোভাবে জানে। কিন্তু এখন মূলত কিছু খাওয়া প্রয়োজন তাও নিজের টাকায় কিনা খাবার।
কথাগুলো ভেবে সিরাত বিছানা থেকে উঠতেই দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করল কেউ।সিরাত দরজার দিকে তাকাতেই রুদ্র কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সিরাত। এবং ওর মনে খেয়াল আসে কারও কিছু হয়ে যায়নি তো।সিরাত উত্তেজনায় নিজের শরীরের অবস্থা ভুলে আগে বাড়তে নিলেই দূর্বল শরীর নিয়ে পরে যেতে নেই সিরাত তখনি রুদ্র এসে সিরাত কে নিজের বাহু ধরে আগলে নিলো। এবং সিরাত কে হঠাৎ পাজা কোলো নিয়ে বসিয়ে দিল বিছানায়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সিরাত প্রশ্ন বিদ্ধ নজরে রুদ্রের দিকে তাকাতেই রুদ্র জাপটে ধরলো সিরাত কে এবং অপরাধী গলায় বলল।
সরি বউ, আমাকে মাফ করে দাও।আমি নিজের স্বামী হওয়ার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পূর্ণ করতে পারিনি।আমার ব্যর্থতার জন্য তোমার কথা শুনতে হয়েছে। খাবার সামনে নিয়ে অপমানিত হতে হয়েছে। তোমার মুখের থেকে খাবার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।এই সকল কিছু আমার ব্যর্থতা। আমার জন্য তোমাকে কালকে সারাদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে আর আমি এমন স্বামী তোমার খোঁজ খবর নেওয়ার ও প্রয়োজন বোধ করিনি।
কথাগুলো বলেই রুদ্র সিরাতের দিকে তাকায়।তখনি সিরাত নিজের দূর্বল কন্ঠে রুদ্র কে বলল।
তুমি তোমার বন্ধুদের জন্য চিন্তিত তাই আমার খবর নিতে পারও নি। এবং তাই বাবার সাথে আফিসেও যেতে পারছ না।এতে তোমার কোনো দোষ নেই।
না এতে আমার দোষ আছে,আমি যতই ব্যস্ত থাকিনা কেনো। আমার উচিত ছিল তোমার খোঁজ খবর নেওয়া। আমার উচিত ছিল যেই মেয়ে আমাকে সামলাচ্ছে সেই মেয়ে কেমন আছে সেই সম্পর্কে জানা। আমার উচিত ছিল তোমার সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে খেয়াল রাখা।
কথাগুলো বলে রুদ্র কিছুক্ষণ সিরাতের দিকে তাকিয়ে থেকে সিরাতের উদ্দেশ্যে বলল।
তুমি বসো আমি আসছি,
কথাটি বলেই রুদ্র রুম থেকে বাইরে চলে যায়। এবং ফিরে আসে প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে।
রুদ্র খাবারের প্লেট নিয়ে সিরাতের সামনে বসতেই সিরাত নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেই। এবং কঠোর কন্ঠে বলল।
আমি খাবো না এই খাবার,
রুদ্র সিরাতের কথায় মুচকি হেসে বলল।
এই খাবার সালেহা মির্জার ছেলের টাকাই কিনা খাবার না।এই খাবার তোমার স্বামীর সারারাত ভোর কষ্ট করে কাজ করার টাকায় কিনা খাবার।এই খাবার খাওয়ার কারণে তোমার কারো কাছ থেকে কথা শুনতে হবে না। এবং আমি ওয়াদা করছি আজকের পর যদি আমার রিকশা চালিয়েও টাকা উপার্জন করে তোমাকে খাবার খাওয়াতে হয় এবং তোমার ভরণ পোষণ করতে হয়। তবুও তুমি তোমার স্বামীর করা রোজগারের খাবার খাবে। এবং তোমার স্বামীর দেওয়া কাপড় পরবে।
রুদ্রের কথা শুনে সিরাত অবাক হয়ে বলল।
তুমি পুরো রাত বাড়িতে ছিলে না, তুমি সারারাত বাড়ির বাইরে কাজ করে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছ।তাই তোমার এই অবস্থা। তুমি কিছু খেয়েছ।
সিরাতের কথায় রুদ্র আবার মুচকি হেসে বলল।
আমি এখনো এতটা অপদার্থ হয়নি যে, আমার কাজ না করার কারনে আমার স্ত্রীর সামনে থেকে খাবারের প্লেট সরিয়ে ফেলবে আর আমি বসে বসে খাবার খাবো। যেখানে আমার স্ত্রীর গলা দিয়ে খাবার নামেনি সেখানে আমার গলা দিয়ে কি করে খাবার নামবে।
রুদ্রের কথা শুনে সিরাত আশ্চর্য হয়ে তাকায় ওর দিকে।সিরাত কখনো ভাবেনি রুদ্র ওকে এতটা গুরুত্ব দিবে নিজের জীবনে। রুদ্র ও সিরাত একজন আরেকজনকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। রুদ্র ও সিরাত কে একজন আরেকজনকে খাবার খাওয়াতে দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাহানারা মির্জা।
আব্রাহাম ওর মায়ের পায়ের উপর মাথা রেখে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। আব্রাহাম খুব ভালোভাবেই জানে নিজের পায়ের অবস্থার কথা। কিন্তু এ নিয়ে আব্রাহামের সামান্য পরিমাণও কষ্ট হচ্ছে না। আব্রাহামের কষ্ট হচ্ছে আয়নাকে এখন পর্যন্ত না দেখতে পাওয়ার কারনে।ওর ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে একটু খানি আয়নাকে দেখার আশায়। কিন্তু আব্রাহাম এই কথাটি কাওকে বুঝাতে পারছে না।আর বুঝাবেই বা কি করে আব্রাহাম তো আর জানে না আয়নার অবস্থার কথা।
আব্রাহাম ওর মাকে আবদারের স্বরে বলল।
মা আমাকে এক নজরের জন্য একটু আয়নাকে দেখতে দিও না।আই প্রমিস আমি শুধু ওকে দূর থেকে দেখে চলে আসবো।আমি ওকে একটুও বিরক্ত করব না। শুধু একবার দেখতে দাও না মা। আমার ভালো লাগছে না মা ওকে একবার দেখতে দাও মা একবার।
কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো আব্রাহাম।
আব্রাহামের মায়ের আব্রাহামের এই অবস্থা সহ্য হচ্ছে না। আব্রাহামের মা প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না কেনো আব্রাহামের বন্ধুরা আয়নার অবস্থার কথা আব্রাহাম কে বলতে না করেছে। কিন্তু এখন আব্রাহামের অবস্থা দেখে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছেন কেনো ওরা আব্রাহাম কে আয়নার অবস্থার সম্পর্কে বলতে মানা করেছেন। আব্রাহাম আয়নাকে প্রচুর পরিমাণে ভালোবাসে এইটা খুব ভালোভাবে ওনি বুঝতে পেরেছেন। সাথে এটাও বুঝতে পেরেছে ওইদিন রাতে আব্রাহাম নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আয়নার কাছে মাফ চাওয়ার কথা বলছিলো।
এবং নিশ্চয় আব্রাহাম ও আয়নার মাঝে এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে আয়না ওদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।ও আব্রাহাম কে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
রাজ বসে আছে আয়নার সামনে আয়নার হাত ধরে।আয়না ওপরের দিকে চেয়ে আছে। আয়নার দৃষ্টি ওপরের দিকে স্থির।রাজ বোনের হাত ধরে আকুল কন্ঠে বলল।
আমার সাথে কথা বলবি না তুই,আমার ওপর এত রাগ তোর।আমি খুব খারাপ ভাই তাই না, আমি তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারিনি।আজ আমি যদি তোকে মেলায় একা যাওয়ার অনুমতি না দিতাম তাহলে হয়তো তোর সাথে এরকম কিছুই হতো না। আমার সাথে কথা বল না বোন। আমাকে ভাই বলে ডাক।
রাজ কথাগুলো আয়নার উদ্দেশ্যে বলছে ও রাজের চোখে পানি চিকচিক করছে। কিন্তু ভাইয়ের ব্যাধিত কন্ঠ শুনেও ওর ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।রাজ ওর বোনের কাছে যখন আকুল আবেদন করছে তখনি রাজের কাঁধে কেউ আলতো করে হাত রাখলো।রাজ পিছন ফিরতেই সাইরা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
সাইরা রাজের কাছে বসে পরে এবং রাজের হাতে হাত রেখে রাজের উদ্দেশ্যে বলল।
তুমি চিন্তা করো না, আল্লাহ চাইলে আয়না খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের আয়নাকে এখন সাহস জোগাতে হবে যেনো আয়না ওর অসুস্থতার সাথে লড়াই করে সুস্থ হতে পারে।
আয়নার কথা শুনে রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আয়নার কথার প্রতি উত্তরে কিছু বলে না চুপচাপ বসে থাকে। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ আসায় সাইরা রাজের হাত ছেড়ে দেয় ও দরজার দিকে তাকিয়ে আয়না ও সাইরার মাকে একসাথে ভিতরে ঢুকতে দেখে।
আয়নার মা সাইরার মায়ের কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে। আয়নার অবস্থায় যে ওর মা কতটা আঘাত পেয়েছে তা ওনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
কেটে গিয়েছে একটি সপ্তাহ, আব্রাহামের সকল বন্ধুরা এখন আব্রাহামের কেবিনে মধ্যে আছে। ওদের উদ্দেশ্যে হলো আব্রাহাম কে আয়নার অবস্থার সম্পর্কে অবগত করা।ওরা জানে না আব্রাহাম কি করবে আয়নার অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর। তবুও তো আব্রাহাম কে জানানো প্রয়োজন। কেননা আব্রাহামের শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। আব্রাহাম কে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে ওর পায়ের ট্রিটমেন্ট করানোর জন্য।রাজ ও ওর বন্ধুরা এটি খুব ভালোভাবেই জানে আব্রাহাম যেই পর্যন্ত আয়নাকে সুস্থ না দেখবে সেই পর্যন্ত ও কোথাও ট্রিটমেন্ট করতে যাবে না।তাই ওরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই আব্রাহাম কে আয়নার কথা জানাতে এসেছে।
রাজ এসে আব্রাহামের কাছে বসে পরে এবং রাজ আব্রাহামের উদ্দেশ্যে বলল।
তুই কি সত্যি আয়নাকে ভালোবাসিস?
রাজের কথায় আব্রাহাম মাথা নিচু করে হ্যাঁ তে মাথা নাড়ে।
আব্রাহামের সম্মতি পেয়ে রাজ আব্রাহাম কে আবার বলল।
আমি সবই জানি আয়না কেনো তোর থেকে দূরে থাকতো। তুই কিভাবে আমার বোনের মন ভেঙ্গে ছিলি।তোর জন্য আমার বোন কত কষ্ট পেয়েছে।
রাজের কথা শুনে আব্রাহাম নিজের চোখ নিচু করে বলল।
ওকে দেওয়া আঘাতের জন্য,আমি আজ পর্যন্ত জ্বলছি।ওর কাছে অনেকবার মাফ চাওয়ার পরেও আমি মাফ পাইনি।ও আমার কথায় এত আঘাত পেয়েছে যে ও আমার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায়না এখন।আমি কি করবো কি করলে ও আমাকে মাফ করবে আমি কিছু জানিনা না।আমি শুধু এতটুকুই জানি যত দিন যাচ্ছে ওকে না পেয়ে আমার শ্বাস নেওয়া ও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।আমি সত্যি নিজের করা ভুলের জন্য অনেক অনুতপ্ত।আমি চাই আয়না শুধু আমাকে একটি সুযোগ দিয়ে দেখুক। একবার আমাকে মাফ করুক।আমি সত্যি আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করব ওকে ভালো রাখার। ওকে আর ভুল না বুঝার।ওর খেয়াল রাখার।ব্যস শুধু একবার।
আব্রাহামের কথা শুনে রাজ কাঁপা কন্ঠে বলল।
তুমি শুধু গল্প না আমার ভালোবাসা পর্ব ৫১
আয়না চাইলেও এখন তোকে আর সুযোগ দিতে পারবে।
রাজের কথা শুনে আব্রাহামের হৃদয় ধক করে উঠলো। এবং আব্রাহাম অবাক কন্ঠে বলল।
কি বলছিস তুই,ও চাইলেও আমাকে সুযোগ দিতে পারবে না কেনো?
কারণ..