তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৩১+৩২

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৩১+৩২
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

সারারাত গল্প মত্ত থেকে এখন সবার চোখই ঘুমে ঢুলুঢুলু। আমি ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন রহিমা খালা।অজানা কিছু কারণে রহিমা খালা আমায় খুব পছন্দ করেন।এ বাড়িতে এলো আমার আশেপাশে রহিমা খালার থাকা চাই-ই চাই এমনকি আমি ওয়াশরুমে গেলেও উনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।অনেক ধমকেও উনাকে আমার পিছু ছাঁড়াতে পারি নি।। খেতে বসলে সবচেয়ে বড় মাছটা আমার প্লেটে এলো কি না তা নিয়ে তার ব্যাপক চিন্তা।এমন কিছু আনএক্সপেক্টেড ভালোবাসা বিরক্তিকর হলেও তৃপ্তিকর!!নিচে সাহেল ভাইয়া বিভিন্ন ফুলের ঢালি,, গ্রামের বাচ্চা মেয়ে এসবের ছবি তুলছেন।কি এতো মজা পাচ্ছেন কে জানে??

শুভ্র ভাইয়াকেও এক কোণে বসে থাকতে দেখা গেলো… কাগজ হাতে বাজারের হিসাব দেখছেন হয়তো…মেরুন পাঞ্জাবিতে অসাধারণ লাগছে তাকে। আশেপাশে বেশকিছু মেয়ে আর বাচ্চারা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে উনার দিকে।ব্যাপারটায় যেনো উনি চরম বিরক্ত….চোখ মুখ লাল করে সাকিব ভাইয়াকে কিছু একটা বললেন উনি। কথাটা শুনেই সাকিব ভাইয়া মেয়েদের দিকে এগিয়ে এলো…কিছু একটা বললো কিন্তু কাজ হলো না মোটে।শুভ্র ভাইয়ার এই বিষয়টায় ব্যাপক হাসি পায় আমার…কোনো মেয়ে উনার দিকে তাকালেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় উনার…যেনো সাত রাজার ধন নিয়ে যাচ্ছে তার!!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হঠাৎই পেন্সিলটা ঠোঁটে চেপে ধরে পাশে দাঁড়ানো রাতুল ভাইয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলেন উনি। রাতুল ভাইয়ার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে।।এক দুইবার গালে হাত ঘষে সাহেল ভাইয়া দিকে তাকিয়ে ৩২ দাঁত বের করে ছবির মডেল হয়ে গেলেন তিনি…নীলি আপু,রাহি আপু আর চিত্রা আলপনা আকঁছে… চিত্রার পিঠ থেকে শাড়ি সরে গেছে সেদিকে খেয়ালই নেই তার।মেয়েটা এতো বেখেয়ালি কেনো?? নীলি আপুর ছোট চুলগুলো আটকে দেওয়ার দায়িত্ব রোহন ভাইয়ার…বেচারা পাশে চুলের কাটা হাতে বসে আছে… কিভাবে লাগাবে বুঝতে পারছে না নয়তো বা লজ্জা পাচ্ছে খুব।।আমিও খুশি মনে নিচের দিকে হাঁটা দিলাম…..আল্পনা আঁকতে ইচ্ছে করছে খুব!!সিড়ি শেষ করে আঙ্গিনায় পা রাখতেই সাহেল ভাইয়াকে চোখে পড়লো…উনার দিকে এগোতে নিতেই দেখি চিত্রা উনার পেছন ছুঁটছে আর তুমুল গতিতে ঢেকে চলেছে। সাহেল ভাইয়া তুমুল বিরক্তি নিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন-

কি সমস্যা তোমার?? অলওয়েজ চেঁচাও কেন??
চেঁচালাম কই?? আমি তো আপনাকে ডাকলাম।(মুখ গোমড়া করে)
ডেকে উদ্ধার করেছেন আমায়!! এখন দয়া করে বলবেন?এই অনুগ্রহ করার কারণ?(হাত জোড় করে)
ভাইয়া দেখুন না সাকিব ভাইয়া আমাকে কাল থেকে ডিস্টার্ব করছে।।
চিত্রার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাহেল ভাইয়া তারপর বিরক্ত মুখে সাকিব ভাইয়াকে ডেকে উঠলেন।।সাকিব ভাইয়া পাশে এসে দাঁড়াতেই মুখ বাঁকালো চিত্রা।সাকিব ভাইয়া সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন-
জি ভাই?কোনো দরকার?
তুই নাকি চিত্রাকে কাল থেকে ডিস্টার্ব করছিস?কেনো রে?প্রেমে টেমে পড়েছিস?(ভ্রু কুচঁকে)
না মানে আসলে ভাই…(মাথা চুলকে)

এতো তুতলানোর কিছু নেই। চিত্রা?(চিত্রার দিকে তাকিয়ে) ও তো তোমাকে পছন্দ করে…তোমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে এটাকে ডিস্টার্ব বলতে পারো না।।বেচারা এতো ট্রাই করছে ইম্প্রেস হয়ে গেলেই তো পারো বোন…এই সাকিব?ওকে প্রোপোজ কর…মানা করে দিলে আর ট্রাই মারিস না…বুঝিসই তো সানশাইনের বান্ধবী…আর যদি রাজি হয়ে যা তো একটা ঠান্ডা কোক খাওয়াস তো আমায়….বড্ড গরম পড়েছে রে…

কথাটা বলেই ক্যামেরা চেইক করতে করতে উল্টো পথে হাঁটা দিলেন উনি।সাকিব ভাই মুচকি হাসছেন আর চিত্রা হতবাক।তাকে দেখে মনে হচ্ছে হৃদয়ভঙ্গ হয়েছে তার…এমটা আশা করে নি সে।।আমি একটু এগিয়ে গিয়ে গলা খাকারি দিয়ে ডেকে উঠলাম-
এই যে মিষ্টার..
সাহেল ভাইয়া পাশে তাকালেন। আমায় দেখে মুচকি হেসে পাশে দাঁড়িয়েই বলে উঠলেন-
হ্যালো সানশাইন।তোমার প্রকোপে আমি ঘেমে হয়রান….আজ এতো রোদ কেন গো??
উনার কথায় হালকা হাসলাম আমি।।উনি পাঞ্জাবির কলার ঝেড়ে আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন-

মাথা ব্যাথা নাকি তোমার সানশাইন??মুখটা শুকনো লাগছে!!
হ্যা হালকা!!
শুভ্রকে ডাকবো নাকি??সারিয়ে দিবে একদম(দুষ্টু হাসি দিয়ে)
উনার হাসিতে লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। কোনোরকমে বলে উঠলাম-
আমার মাথা ব্যাথায় উনার কি কাজ??
উনি হাসলেন।আমি আবারও বলে উঠলাম..
কাল থেকে দেখছি ছবি তুলছেন।এতো কিসের ছবি তুলছেন শুনি??
সবকিছুর ছবিই তো তুলছি।তোমার ছবিও তুলবো.?(কিছু একটা ভেবে) নাহ্ থাক।
কেনো??
উনি আমার কথার জবাব না দিয়েই বলে উঠলেন-

কয়েকবছরের জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি তাই দেশটাকে আর কাছের মানুষগুলোকে ক্যামেরা বন্ধী করে নিয়ে চলেছি।।তাছাড়া আমি এমনিতেও ছবি তুলতে পছন্দ করি।ভার্সিটিতেও তো আমার হাতে,কাঁধে, ব্যাগে সবসময়ই ক্যামেরা থাকে…তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।।শুভ্রকে রেখে আর আশেপাশের দিকে তাকানোর সময় আছে তোমার?(মুচকি হেসে)
ছি ভাইয়া!!আমি উনাকে দেখতে যাবো কেন??আর আপনি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন মানে??
স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করেছিলাম হয়ে গেছে।তাই যাচ্ছি ঘুরে আসি।।তোমার জন্য একটা গিফ্ট আছে সানশাইন যাওয়ার দিন দিয়ে যাবো।নিবে তো??
জ..জি অবশ্যই।কিন্তু আমার জন্য কেনো?(অস্বস্তি নিয়ে)
উনি হাসলেন।প্রসঙ্গটা পাল্টে দিয়ে বলে উঠলেন-
পুকুরের পাশের ছবিগুলো অস্থির হয়েছে বুঝলে সানশাইন??সকালের প্রথম রোদের প্রতিফলন…ওদিকটায় ছবি তোলা হয় নি।।আমি যাচ্ছি তুমি থাকো!!

চারদিকে রমরমা পরিবেশ।আজ আপুর বিয়ে ভাবতেই ফুরফুরে লাগছে।লাল রঙের শাড়ি পড়েছি আজ…হাতে লাল চুড়ি। ঢালা ভর্তি ফুল নিয়ে আঙ্গিনায় বের হতেই থমকে গেলাম আমি।আমার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো রহিমা খালাও।কৌতূহল নিয়ে বলে উঠলেন-
কি হইছে ছুডু আম্মা?খাড়ায় পড়লেন ক্যান?
সামনে দেখো ওই রাজপুত্র ছেলেটি…বুকটা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে আমার।
রহিমাখালার হাতে ফুলের টুকরিটা দিয়েই বুকে হাত দিয়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলাম আমি।শুভ্র ও লাল শেরওয়ানি আর ঘিয়া ধুতি পড়েছেন আজ।সিল্কি স্ট্রেট চুলগুলো পড়ে আছে কপালে…হাতে ব্র্যান্ডেড ঘড়ি।।এই অল্পতেই কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে আমার।বুকে চিনচিন ব্যাথা করছে যেনো।।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।।রহিমা খালা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলেন-

কি হয়ছে আম্মা? ঠিক আছেন গো?
নাহ..রহিমা খালা। একদম ঠিক নেই আমি।এই লাল পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটি(বুকে হাত দিয়ে) আমার এখানটায় খুব ব্যাথা দিয়েছে গো।।
আমার কথায় আটকে উঠলেন রহিমা খালা…ফিসফিস করে বলে উঠলেন –
কন কি আম্মা?কাউরে কইছুন?

আমি উত্তর না দিয়ো বললাম। আমায় রুমে দিয়ে আসো তো রহিমা খালা।একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলবো।রহিমা খালা আমায় রুমে দিয়ে আসতেই দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম আমি।।মাথাটা ভনভন করছে আমার…. সবকিছু কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে আমার।আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারি নি।যখন ঘুম ভাঙলো তখন চারদিকে নিস্তব্ধতা…. বিয়ে বাড়িও কি এতো নিস্তাব্ধ হতে পারে??বিয়ে পর্ব কি তাহলে শেষ?সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?কতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি?ইশশ…একটা ঘড়ি দেখতে পেলে বেশ হতো।।এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বাইরে বের হতেই আমি হতবাক।।বাড়ির আঙিনায় সবাই বসে আছে চুপচাপ।সবার চোখ-মুখে গম্ভীরতার ছাপ।শুভ্র ভাইয়ার মুখটায় শুধু রাগের চিন্হ আর এলাকাবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা।।আমাকে দেখতে পেয়েই সবাই গুঞ্জন শুরু করলো।।মা এসে টেনে মামুর পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন।মামু গম্ভীর শান্ত মুখে বলে উঠলেন-

রোদ মা?শুভ্র কি সত্যি তোমার সাথে অসভ্যতামো করেছে?রহিমা আর মজিদ আমাদেরকে ব্যাপারটা বলেছে তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।
মামুর কথায় আমি হতবাক।শুভ্র ভাই অসভ্যতামো করেছে আর আমার সাথে?? কখন?? আমি কনফিউসড হয়ে বলে উঠলাম-

মামু?শুভ্র ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতামো করে….
এটুকু বলতেই রহিমা খালা হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন-
কি কন সাহেব?মাইয়া মানুষ কি এসব মুখে কইবো?তাও এত্তোগুলান মানুষের সামনে?আমি আর মজিদ ভাই নিজে দেখছে এই পোলা রে ছুডু আম্মার বুকে হাত দিতে…ছুডু আম্মায় তো দুক্কুও পাইছে এইজন্যই তো এত্তোক্ষন দরজা বন্ধ কইরা বইসা আছিলো।শুধু আমরা ক্যান?এই কমলার মা তুমিও দেখছো না??(চোখ রাঙিয়ে)
হ আমিও দেখছি…
এরপরও আমাগো কথা বিশ্বাস হইতেছে না?? মাইয়ারে সবার সামনে এসব জিগানো কি ঠিক?
সাথে সাথে গ্রামের লোকদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা দেখা দিলো।কেউ কেউ বলেও ফেললেন-“না ঠিক না।এইসব অইতো না।।সরকার বাড়ির মাইয়ার লগে পুন্টামী করবো আর ছাইড়া দিমু তা হয়তো না”

এদের কথায় আমি স্তব্ধ।কোথা থেকে কোথায় চলে গেছে এরা?আমার বুকে ব্যাথার কথাটাকে এতোটা বিশ্রীভাবে সবার সামনে আনা হবে জানলে…. আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকালাম উনার চোখে পানি টলমল করছে…রাগে চোখমুখ লাল….আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন উনি-
রোদ?তুমি কিছু বলবে না?
উনার এই একটা কথায় চোখ ফেটে কান্না পেয়ে গেলো আমার।।কতোটা চাপা অপমান,,কষ্ট আর রাগ নিয়ে কথাটা বলেছেন উনি!! আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো…”উনাকে ঘিরে এসব কথা বলো না প্লিজ!! উনি ওমন নন” কিন্তু গলা দিয়ে স্বরই বের হচ্ছে না আমার।এই সাডেন শকটা শরীরে ঝিম ধরিয়ে দিয়েছে আমার।।চোখ দিয়ে পড়ে চলেছে কিন্তু গলা স্তব্ধ…. বড্ড তেষ্টা পেয়েছে আমার।ঠিক তখনই পাশ থেকে বলে উঠলেন রহিমা খালা-

সাহেব?ছুডু আম্মায় কানতাছে এইডা দেইখাও বিশ্বাস হইতাছে না আপনার??
আমি এবার সাহস নিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই আম্মু আমার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এলো।।ঘরে এনে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো আমায়…আমি উঠে বসতেই গালে জোড়ে সোড়ে চড় বসিয়ে দিলো।আমি গালে হাত দিয়ে মার দিকে তাকাতেই প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলে উঠলেন উনি-
শুভ্র এমন ছেলে নয় রোদ এটা আমি জানি।ও এমন কিছু করতেই পারে না…তবুও যদি কিছু করে থাকে তাতে তোর দোষই আছে নিশ্চয়।সুযোগ না দিলে সে এমনটা করবে কিভাবে শুনি??নির্লজ্জ মেয়ে…

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো মা।এবারও কিছু বলার সুযোগ পেলাম না আমি।।মা কি বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো??প্রায় একঘন্টা পর বাবার সাথে একজন বৃদ্ধ করে লোক এলেন…গায়ে সাদা পাঞ্জাবী… মাথায় টুপি।।তার কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম লোকটি কাজি।।কি অদ্ভুত ভাবে কিছু বুঝে উঠার আগেই বিয়ে হয়ো গেলো আমার!! সামন্য ভুল বোঝাবুঝিতেই জীবনটা কোথায় গিয়ে আটকে গেলো আমার।।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ক্রমাগত।।একবার আপু আর চিত্রা রুমে ঢুকার চেষ্টা করেছিলো…তাদের ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে মা।।নিজেকে কোন নাটকীয় উপন্যাসের পটভূমি মনে হচ্ছে আমার!!এভাবেও বিয়ে হয়??এটা কি বাস্তব নাকি স্বপ্ন??

জানালা দিয়ে রহিমা খালাকে ডেকে দরজা খুলতে বললাম।।রুম থেকে বেরিয়েই সোজা হাঁটা দিলাম আঙিনায়।আপুর বিয়েটা এখনও শেষ হয় নি।সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।চুপ থেকে যে অন্যায়টা আমি করেছি তার মাশুল দেবো এবার।নিজের প্রতি ঘৃণা জাগছে আমার….নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্য প্রতিবাদই যখন করতে পারলাম না কেমন মানুষ আমি??নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।।আমার জন্য শুভ্র ভাইয়ার চোখে জল…!! ছি রোদ ছি।আঙিনায় রাখা চেয়ারে মুরুব্বীরা বসে আছে।আমি সোজা মামুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম….. কাঁপা গলায় বলে উঠলাম-

মামু?
মামু আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।মামুর দৃষ্টিতেই কান্না পেয়ে গেলো আমার।নিজেকে সংযত করে বলে উঠলাম –
মামু?গ্রামের সবাইকে জড়ো করো প্লিজ। একঘন্টা আগে যেমনটা ছিলো ঠিক তেমন… প্লিজ মামু…প্লিজজ(করুণ গলায়)
মামু কিছু বললেন না।কেউ একজনকে কিছু একটা ইশারা করলেন।।দশ পনের মিনিটের মধ্যেই বিয়ে বাড়ির সব লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেলো।আমি মামুর দিকে তাকিয়ে কান্না মিশ্র গলায় বলে উঠলাম-
সরি মামু?আই এক্সট্রিমলি সরি।শুভ্র ভাইয়া আমার সাথে কিচ্ছু করে নি।উনি তো কখনো আমার দিকে খারাপ নজরে তাকায়ও নি….আর অসভ্যতামো?? ছি! মামু?আমার জন্য তোমাদের এতো অপমানিত হতে হলো প্লিজ মাফ করে দাও…প্লিজজ।
কথাগুলো বলতে বলতেই শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো আমার হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়েই হাত জোড় করে বলে উঠলাম –

আ..আমি সাডেন শক গুলো নিতে পারি না।এই সমস্যাটা আমার ছোট থেকেই…সাডেন কোনো পরিস্থিতিতে ডিসিশন নিতে গেলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই… আমার নার্ভাসনেসটা এতো বেশি হয়ে যায় যে কথায় বলতে পারি না…মনে হয় গলায়,কেউ জোরে চেপে ধরে আছে।। ঘুম থেকে উঠা মাত্রই এমন একটা সিচুয়েশন ফেইস করতে হয়েছে যে আমার সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো….সবকিছু।যার কারণে তখন কিছু বলতেই পারি নি আর শুধু আমার ফলিসনেসের জন্য শুভ্র ভাইয়ার এতো অপমান!!! আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে মামু!এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।।মরে ফেলো তো আমায়…খুবই খারাপ মেয়ে আমি মামু…খুইব।

কি মনে করে সটান উঠে দাঁড়ালাম।চোখের পানি মুছে রহিমা খালাকে ডেকে উঠলাম।উনি পাশে এসে দাঁড়াতেই উনার হাতটা আমার হাতে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলাম –
আমাকে ছুঁয়ে বলো তো রহিমাখালা শুভ্র ভাইয়াকে এমন কিছু করতে দেখেছো কখনো??
রহিমা খালা মাথা নিচু করে মাথা নেড়ে বলে উঠলেন-
না ছুডু আম্মা দেহি নাই।
উনাকে কখনো আমার দিকে বাজে নজরে তাকাতে দেখেছো?তুমি না সবসময় আমার সাথে সাথেই থাকো!!বলো দেখেছো?
জি না আম্মা দেহি নাই।।উনি তো কোনো মাইয়ার দিকেই তাহায় না।।সবসময় কামের মধ্যেই থাহে..
তাহলে এমনটা বললে কেনো রহিমা খালা?কেনো?(কঠিন গলায়)

আ..আপনে বুকে দুক্কুর কতা কইলেন এইজন্য আমি ভাবচি যে….মাফ কইরা দেন আম্মা!!ভুল হইয়া গেছে..
মাফটা যাকে দোষারোপ করেছো তার কাছেই না হয় চাইবে।।আর এই যে মজিদ চাচা?(মজিদ চাচাকে ইশারা করে) আপনি না রহিমা খালাকে ভালোবাসেন….তো উনার দোহায় দিয়েই বলুন তো.. আপনি কি কখনোই এমন কিছু দেখেছিলেন?? কখনো??
মজিদ চাচা মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে বলে উঠলেন-
জে না আম্মা! দেহি নাই
তাহলে বললেন কেনো??এতো নিঃসংকোচ মিথ্যা কেন??(রাগী গলায়)
আসলে রহিমা আমারে আর কমলার মারে এমনডায় কইতে কইছিলো এর লাইগ্যা।মাফ করবেন আম্মা।।আমি শুভ বাজানের কাছে মাফ চামু আম্মা…মাফ কইরা দেন…এমন কাজ আর করতাম না।জিন্দিগিতেও না…এই কানে ধরলাম!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকালাম আমি।।কি বলবো বুঝতেই পারছি না।এতোকিছুর পরও কি কিছু বলার বাকি আছে?সামনে দাঁড়ানো লোকদের মাঝে চাপা গুঞ্জন।আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলাম-

এবার তো ঘটনার সত্যটা জানলেন আপনারা।আফসোস হচ্ছে না আপনাদের?? একটি নির্দোষ মানুষকে এভাবে হেনস্তা করার দায়ে সামন্য অনুশোচনা তো থাকা উচিত।।শুভ্র ভাইয়ার মতো একটা মানুষ যিনি মেয়েদের সাথে হাসি ছাড়া কথায় বলে না….তাকে নিয়ে এতো জঘন্য কুৎসা??লজ্জায় আমারই মাথা কাটা যাচ্ছে।।নিজের এই অপরাধবোধটা মেরে ফেলছে আমায়।আপনারা কি প্লিজ শুভ্র ভাইয়ার সামনে একবার বলবেন যে উনি নির্দোষ…ভুল ছিলো আপনাদের উনার নয়… প্লিজজ!! আমি হাতজোড় করছি আপনাদের কাছে…একটু বলবেন?
আবারও চাপা গুঞ্জন করে উঠলো সবাই।তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে উঠলেন-
অবশ্যই কইবো। কইবো না কেন?একটা নির্দোষ মানুসরে এতো কতা হুনাইলাম।মাফ চাইমু না?সক্কলে মাফ চাইবো….

আমি মামুর দিকে করুণ চোখে তাকালাম মামু জলভরা চোখে মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন-
থেংকিউ মা! থেংকিউ সো মাচ!!
আমি অনেক কষ্টে একটু হেসে নিয়েই সাকিব ভাইয়াকে জিগ্যেস করলাম “শুভ্র ভাই কোথায়?” উনি বললেন “ছাদে!” সাথেসাথেই দৌড় লাগালাম ছাঁদের দিকে।

ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন শুভ্র ভাই।উনার সামনে যাওয়ার সাহসটাও হচ্ছে না আজ।কোনোরকম কাঁপা পায়ে উনার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিভাবে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম না।ইতস্ততভাবে এদিকসেদিক তাকাচ্ছিলাম…চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে…ঠিক তখনই এদিকে না ফিরেই বলে উঠলেন শুভ্র ভাই-
কেন করলে এমন রোদ? কেনো??
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না…কাঁপা স্বরে বলে উঠলাম- “সরি” সাথে সাথে পেছন ফিরে খুব শক্ত করে চেপে ধরলেন আমার হাত….রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন-

শুধু সরি??আমার সব শেষ করে দিয়ে শুধু সরি রোদেলা??একটাবার ভাবলে না ফুপ্পি,ফুপা,গ্রামের লোক সবার সামনে আমি কতটা নিচে নেমে যাবো…কতোটা!!বাবার মাথাটাও তো হেট হয়ে গেলো শুধু আমার জন্য।এই অপমান কি সহ্য করা যায়??
স স সরি!!আ আমি আসলে..
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ছাদের রেলিং এ একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললেন আমায়।সাথে সাথেই আবার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন-
আই সয়ার রোদেলা।তোমার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে হলে জাস্ট খুন করে ফেলতাম তাকে…জাস্ট খুন করে ফেলতাম।কিন্তু ভাগ্য দেখো আমার..তোমার গায়ে হাত তুলতেও বুক কাঁপে আমার।।বউ বলে কথা!(তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)

কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের চুল টেনে ধরে ফুলের টপে লাফি মারলেন উনি…ফিরে এসে আবারও চেপে ধরে চলে উঠলেন-
মিসেস আবরার শুভ্র?? আই জাস্ট হেইট ইউ।।জাস্ট হেইট ইউ….
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে জড়িয়ে দড়লেন আমায়!!ফিসফিস করে বলে উঠলেন- “কাঁদছো কেন? তোমার এই কান্নায় রাগ কমবে না আমার।স্টপ ক্রায়িং..জাস্ট স্টপ!!” আমার কান্নার বাঁধ যেনো ভেঙে গেলো এবার।নিজেকে কোনোভাবে আটকাতেই পারছিলাম না।ঠিক তখনই ছাঁদের দরজা থেকে কেউ একজন বলে উঠলো-
ভাই?আঙ্কেল নিচে ডাকছে….আর্জেন্ট!!

শুভ্র ভাইয়া আমায় ছেড়ে একরকম ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েই সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।আমার মাথা গিয়ে লাগলো ছাদের রেলিং এর কোণে।সাথে সাথেই ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা…তবুও কোনোরকমে ছাদের ডানপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম…. এখান থেকে আঙিনাটা দেখা যায় স্পষ্ট।শুভ্র ভাইয়া নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই রহিমা খালা দৌড়ে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরলেন…উনার দেখাদেখি মজিদ চাচাও অন্যহাতটা চেপে ধরলেন।সবাই কিছু একটা বলছিলো উনাকে আর উনি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।।মামু গভীর আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।মাকেও দেখলাম উনার মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসলেন।আমি আর দাঁড়ালাম না,,, ছাঁদের ওই কোনটাতেই গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাম।মাথাটা ব্যাথা করছে খুব….হয়তো ফুলে গেছে।।যাক ফুলে… যা হওয়ার হোক।শুভ্র ভাইয়ার পাওয়া ব্যাথার তুলনায় এই ব্যাথা কি খুবই তুচ্ছ নয়??

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ২৯+৩০

হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসেছিলাম ছাদের এককোণে।হঠাৎই মনে হলো কেউ একজন এসে বসেছে আমার পাশে।মাথাটা তুলে মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না মোটে।মাথাটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো।তিন চার ঘন্টা যাবৎ একভাবেই বসে থাকায় পা,ঘাড় দুইই ব্যাথা করছে খুব…শরীর নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।তবুও মাথাটা কাত করে আড়চোখে তাকালাম।শুভ্র ভাইয়া!! রেলিং এ মাথা ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।।উনাকে দেখেই মাথা সোজা করে বসলাম…চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়ালই করি নি আমি।পা দুটো সোজা করে রেলিং এ ঠেস দিয়ে বসে উনার দিকে তাকালাম।এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটায় হয়তো আমার পাশে বসে আছে আনমনে।সন্ধ্যার হালকা আলোয় স্বর্গীয় দূতের মতো লাগছে তাকে।মাথাটা আরেকটু হেলিয়া ডান কানটা ধরে দুর্বল গলায় বলে উঠলাম আমি-“সরি!!ক্ষমা করবেন না আমায়?লাস্টবারের মতো প্লিজ।” উনি এবার আমার দিকে তাকালেন…উনার শীতল চাহনীতে সারা শরীরটাই ঠান্ডা হয়ে আসছিলো আমার।উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই একহাতে কোমর জড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন আমায়।ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন- “বেশি ব্যাথা লেগেছে মাথায়?একদম ফুলে গেছে তো।।সরি!! আর হবে না।” আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি…উনি আমায় সরি বলছেন?এতোকিছুর পরও??এতোটা ভালো হতে কে বলেছে উনাকে??ঋণের পাল্লা যে ভারি হয়ে চলেছে ক্রমাগত!!

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৩৩+৩৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here