তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৩+৪৪

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৩+৪৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আমি একটা ঢোক গিলে উনার দিকে তাকালাম।।চোখে রাগের আগুন জ্বালিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উনি।কি ভয়ানক সে চাহনী।।সামনে রাখা পানির গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবো।ঠিক তখনই পাশ থেকে বলে উঠলো শ্রেয়া-

রোদ তুমি না খুব কিউট একটা মেয়ে।।তুমি ননদ হিসেবে কিন্তু অসাম হবে।।শুভ্র ভাইয়ার বউ কিন্তু খুব লাকি হতে চলেছে,, তোমার মতো ননদ পাবে বলে কথা।(মুচকি হেসে)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শ্রেয়ার কথায় বিষম খেলাম আমি।কাশতে কাশতেই উনার দিকে ফিরে তাকালাম।উনি চোখ মুখ শক্ত করে চুপচাপ বসে আছেন।।উনার চাহনী দেখেই ভেতরটা কেঁপে উঠলো আমার।।আজ যে কি হবে আমার কে জানে??নিজের বউকেই তার বউয়ের ননদ বানিয়ে দিয়েছে রাগ তো হবার কথায়….আমি টেনশনে টেবিলে রাখা চাটনীর বাটিটা নিয়ে ক্রমাগত চাটনী খেতে লাগলাম।কি বলবো কিছুই তো মাথায় আসছে না আমার….হুট করে কি বলে দিবো,, আমি শুভ্রর বউ??মাথায় যখন এতো এতো প্রশ্নের ছড়াছড়ি ঠিক তখনই ভাবনার চাদরকে ছিন্ন করে আবারও বলে উঠলো শ্রেয়া-
রোদ?তুমি কিছু মনে না করলে আমি কি শুভ্র ভাইয়ার সাথে একা কথা বলতে পারি??এক্চুয়েলি খুবই পার্সোনাল কিছু কথা।।প্লিজ!!

শ্রেয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি।আমার বরের সাথে তার কিসের পার্সোনাল কথা??প্রোপোজ টপোজ করবে নাকি??করতেও পারে…..এজন্যই সুন্দর ছেলে বিয়ে করতে চাই নি আমি… কিন্তু ওইযে কপাল….আমার জামাইকে প্রোপোজ করতে আমার কাছেই পারমিশন চাচ্ছে ও…ভাবা যায়??আমার জায়গায় শুভ্র থাকলে নিশ্চয় এতোক্ষনে ধুয়ে দিতো ওকে??আর আমি?জড়বস্তুর মতো বসে আছি….ডাফার!!কথাগুলো ভেবে কড়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন শুভ্র –
না।ও কোথাও যাবে না।তোমার কিছু বলার থাকলে ওর সামনেই বলো শ্রেয়া।আমার লাইফে রোদের চেয়ে পার্সোনাল কিছু নেই। রোদ ব্যতীত অন্যকোন মেয়ের সাথে আমার প্রফেশনাল কথা থাকতে পারে কিন্তু পার্সোনাল কখনোই নয়। তাছাড়া এখন দুটোর বেশি বাজে এখনও কিছু খাই নি ও।।একটু পর আমার ক্লাস সো ওকে এখনই খাওয়াতে হবে….তুমি প্লিজ যা বলার এখানেই বলো…নয়তো বলার দরকার নেই।

আমি ততক্ষণে শুভ্রর চাটনির বাটিটিও সাবার করে চলেছি…চামিচ দিয়ে চাটনীগুলো নাড়তে নাড়তে শ্রেয়ার দিকে আড়চোখে তাকালাম আমি।বেচারী যে অস্বস্তির চূড়ান্তে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার।।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু বলতে গিয়েও আমার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো শ্রেয়া।।কপাল হালকা কুঁচকে অবাক চোখে বলে উঠলো সে-
তুমি ঠিক আছো রোদ?এতো চাটনী খাচ্ছো কেন?ক্যান্টিনের চাটনী যে টক সেটা তুমি এমনি কি করে খাচ্ছো??শরীর খারাপ করবে তো…
শ্রেয়ার কথায় নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। সত্যি তো!! আজ নির্ঘাত পেট ব্যাথা হবে আমার।।চাটনীর বাটিটা আস্তে করে টেবিলে রাখলাম….জোড় করে একটা হাসি দিয়ে উত্তরটা দিবো ঠিক তখনই পাশ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো শুভ্র-

সমস্যা নেই শ্রেয়া। প্রেগনেন্সিতে এসব চলে…
“প্রেগনেন্সি” শব্দটা শুনেই আমি আর শ্রেয়া চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।শ্রেয়া বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো-
প্রেগনেন্সি মানে?রোদ তুমি প্রেগনেন্ট?তোমার বিয়ে হয়েছে?কিন্তু কবে?আমরা তো কেউ জানি না।।
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি। শুভ্র যে এমন একটা কথা কেন বললো কে জানে??আমার অস্বস্তিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই আবারও বলে উঠলো শুভ্র-
এক্চুয়েলি হুট করে বিয়ে হয়েছে তো তাই জানো না৷। ওর হাজবেন্ড একটু বেশিই ডেস্পারেট কিনা।।ওকে জোড় করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে…
জোড় করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো??কি ডেঞ্জারাস!!! (অবাক হয়ে) আপনারা কিছু করলেন না??(আমার দিকে ফিরে)কি করে তোমার হাজবেন্ড?? কোনো গুন্ডা টুন্ডা নয় তো??
ওর হাজবেন্ড এই ভার্সিটিরই টিচার শ্রেয়া।।তবে গুন্ডামোও একটু আধটু করে….তবে আগের তুলনায় কম।।বিয়ে করেছে তো…বাচ্চা বউ সামলাতেই সময় যায়… এসব গুন্ডামো করার সময় কই বলো?(মুচকি হেসে)

কিহ!!(অবাক হয়ে) রোদের বর আমাদের ভার্সিটির টিচার??ভার্সিটির টিচার হয়ে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো??কি অদ্ভুত!!
কি আর করবে বলো??ভালোবাসা মানেই পাগলামো তা কি আর এসব টিচার,, ডাক্তার দেখে কমে যায়??তাছাড়া যখন তুলে নিয়ে গেছে তখন ওর হাজবেন্ড এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলো।।রিসেন্টলি টিচার হয়েছে….এইতো ২০ থেকে ২৫ দিন হবে।।
২০ থেকে ২৫ দিন??এই কয়েকদিনে তো শুধু আপ….(চোখ বড় বড় করে) আপনি??আ আ আপনিই ওর হাজবেন্ড??
শুভ্র হাসলো।একটু নড়ে চড়ে বসে খাবারটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে খেতে ইশারা করেই বলে উঠলেন –
হুম আমিই ওর হাজবেন্ড।। তো শ্রেয়া,কি খাবে বলো?রোদের পক্ষ থেকে তোমায় খাওয়ানোর দায়িত্ব আজ আমার….

শ্রেয়া কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো উনার মুখে।।তারপর চুপচাপ উঠেই ক্যাফিটেরিয়া থেকে বেরিয়ে গেলো সে।।শুভ্র ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইগনোর করে আমার খাওয়া নিয়ে পড়ে গেলো।।আমিও চুপচাপ উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।। একটা মেয়ের মন কি সুন্দর ভেঙে খানখান করে দিলেন উনি।।শ্রেয়ার নজরে দেখলে উনি বড্ড নির্দয়…আর আমার নজরে দেখলে??পুরো আস্ত এক ভালোবাসা….যে ভালোবাসার চাদরে আমাকে মুড়িয়ে দিচ্ছেন ক্রমাগত।।আমার ভাবনার পথেই টেবিলের নিচে দুইপা দিয়ে আমার পা দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলেন উনি-
আমি তোমার ভাই??তো আমাদের বাচ্চাকে কি মামু ডাকা শিখাবে??ডাফার!!(রাগী চোখে)
আ আমি যখন বলেছিলাম তখন তো ভাই ই ছি.. ছিলেন।(ভয়ে ভয়ে)

আমি কখনোই তোমার ভাই ছিলাম না৷।তুমিই এক ডাফার ছিলে যে প্রতি সেন্টেসে দু’বার করে ভাইয়া ডাকতে….ইচ্ছে তো করতো ধরে আছাড় দিই।।আমি কি তোমাকে বলেছি কখনো যে আমায় ভাইয়া ডাকো… মাথামোটা কোথাকার৷। আর কখনো এমন ব্লান্ডার করলে …… আজ ক্যান্টিনে আছো বলে বেঁচে গেলে।।এবার নাও খাও…. আমার খাবারগুলোও তুমি ফিনিশ করবে এটাই তোমার শাস্তি।।নাও স্টার্ট ডার্লিং…
এ এতো গুলো?? (করুণ চোখে)
আমার কথায় উনি মুচকি হাসলেন যার অর্থ “নাও ইউ আর গন বেইবি”

রাত কটা বাজে জানি না৷। পরম শান্তিতে ঘুমের রাজ্যে সাঁতার কাটছিলাম আমি।।কিন্তু সেই শান্তিটাকে ভেঙেচুরে ফোনটা ভেজে উঠলো তীব্র আওয়াজে।বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে নিতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র-
রোদপাখি?
হুম…
ঘুমোচ্ছো?
হুম…
একটু বারান্দায় আসবে, প্লিজ?
কককেন?(ঘুমু ঘুমু কন্ঠে)
তোমায় একটু দেখবো একটু আসো…আমি নিচেই দাঁড়িয়ে আছি…একটু আসবে?
আমি ঘুমের ঘুরেই আধবোজা চোখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।। ঘুমগুলো যেনো দু’চোখ চেপে ধরেছে আমার।।কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই বলে উঠলাম –

এবার যাই?ঘুমাবো!!
বেশি ঘুম পাচ্ছে?আরেকটু থাকবে?তোমাকে দেখে আজ চোখটা যেনো জোড়াচ্ছেই না আমার।।কেনো যেনো মনে হচ্ছে আর হয়তো দেখতে পাবো না তোমায়।।
কি সব বলছেন আপনি??এমন কথা কেন বলছেন??
কিছু না।। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
হুম…
কথাটা বলেই কোনোরকম বিছানায় গিয়ে আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম আমি।।ঘুমের মাঝেই যেন শুনতে পেলাম কানের কাছে কেউ একজন বলে চলেছে- “ভালোবাসি রোদপাখি।অনেক বেশি ভালোবাসি।”সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি চিত্রা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বিছানায়।।আমি মুচকি হেসে ওর দিকে তাকালাম ।। মাথার মধ্যে যেনো ” ভালোবাসি ” কথাটা ঘোরপাক খাচ্ছে।।আচ্ছা?কাল রাতে উনি সত্যি এসেছিলেন নাকি আমার স্বপ্ন ছিলো?কথাটা ভেবেই ফোন চেক করলাম ঝটপট।।নাহ….সত্যিই এসেছিলেন উনি।।ফোনটা পাশে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম আমি-

কি রে?এতো সকাল সকাল আমার বাসায়? কাহিনী কি?
……………………..
কি ব্যাপার?মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেন??হয়েছেটা কি??
………………………
এই তুই এই মুহূর্তে আমার বাসা থেকে বের হ।চুপ করে বসে থাকার হলে রাস্তায় গিয়ে চুপ করে বসে থাক।।আমার সামনে নয়।।তুই কি বলবি নাকি চড় খাবি কোনটা??
রোদ…..(কাঁদো কাঁদো গলায়)
একদম ন্যাকামো করবি না।।কি হয়েছে বল।।
ওই স্যার আবারও…
আবারও কি?(ভ্রু কুঁচকে)
আবারও চুমু দিয়েছে আমায়…..(কান্না কান্না গলায়)

চিত্রার কথায় আমি অবাক হলেও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলাম-“অহ” আমার ওহ কথাটা ওর ঠিক পছন্দ হলো না বলেই মনে হলো।।করুণ চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই মরাকান্না জুড়ে দিলো।।আমি বিছানায় পা ঝুলিয়ে ওর কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি।।শিশির স্যার থাকলে হয়তো এই কান্নামাখা মুখ দেখে সেই ভুলটা আবারও করতো…..করতে হয়তো বাধ্য হতো!!!

পুরো ভার্সিটি চষেও শুভ্রকে খুঁজে পেলাম না আমি।।রাতুল ভাই বা সাকিব ভাইও বলতে পারছেন না কোথায় আছেন উনি।।একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কিভাবে শুনি??বিরক্ত হয়ে আবারও ফোনটা কানে নিলাম আমি।।গলা শুকিয়ে আসছে আমার….হার্টও বিট করছে হাজার গতিতে…
এবারও কি ফোনটা বন্ধ পাবো উনার??কিন্তু নাহ…এবার আর নিরাশ হতে হলো না আমায়।।ফোনটা রিং হলো এবং ওপাশ থেকে শান্ত আর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র-
বিজি আছি রোদপাখি।পরে কথা বলছি।
বিজি মানে? যতো ব্যস্ততায় থাকুক না কেন…আগে এটা বলুন,, আপনি কোথায় আছেন??আমি আপনাকে কতো খুঁজেছি জানেন??

আমি চিটাগং আছি।। প্রজেক্টের কাজে এসেছি।জানি না কবে ফিরবো।।দু থেকে তিনদিন লেগে যেতো পারে।।এবার ফোনটা রাখো মিটিং রুমে আমি….
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।।সাথে সাথেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার।।উনার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে যেন হাজার বছর দেখি না উনাকে।।কতোদিন উনার নেশা ভরা চাহনী দেখি না আমি।।ইশশ…এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে আমার??কথাটা গুলো ভাবতেই গালের উপর দু’ফোটা জলের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম আমি….

জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি।।আকাশে মস্ত এক চাঁদ ওঠেছে… এই বিশাল চাঁদটাকে বারবার ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ।তাদের দেখে মনে হচ্ছে চাঁদের সাথে তারা এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়েছে।যেমন খেলায় মত্ত হয়েছে শুভ্র।।আজ দু’দিন হতে চললো উনি চট্টগ্রামে আছেন।।প্রতিদিন তিনবার ফোন করেন আমায়….সকাল,দুপুর,রাত….এই বিষয়ে একফোঁটা অনিয়ম নেই তার।।প্রতিবার ফোন দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলবেন-” রোদপাখি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।খেয়ে নাও প্লিজ।একদম অনিয়ম করবে না।।সাবধানে থেকো… রাখছি” ব্যস এটুকু বলেই প্রতিবার ফোন কাটেন উনি… আমার কিছু বলার সুযোগই নেই।।আমার যে বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে…উনাকে দেখার জন্য দম বন্ধ হয়ে আসছে তা শোনার সময় আছে নাকি তার?একদমই নেই….কতো ব্যস্ত মানুষ সে…বউয়ের পিছে পড়ে থাকলে কি চলবে তার??কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো মা-

রোদ?এই রোদ? দরজা খোলে খেতে আয়…খাবারে মাছি বসছে তো।কখন থেকে ডাকছি…আর পারি না বাপু।এই ধিংগি মেয়ে হয়েছে তবু পিছে দৌড়ে খাওয়াতে হয়…কি রে এলি না??
মা তুমি যাবে প্লিজ?যাও এখান থেকে…খাবো না আমি…(বিরক্ত হয়ে)
খাবি না?কেন খাবি না কেন? খাওয়ার সাথে কিসের শত্রুতা তোর?চুপচাপ এসে খেয়ে যা বলছি।
প্লিজ মা যাও তো।খবরদার বিরক্ত করবে না আমায়।কি পেয়েছো টা কি তোমরা? যা বলবে তাই মানতে হবে?খেতে বললে খেতে হবে,,উঠতে বললে উঠতে হবে…এমনটা কেন??আমার একটা জীবন আছে মা…আমি কোনো রোবট নয়…প্লিজ যাও মা….(চিৎকার করে)

ওপাশ থেকে মার বকাঝকা শোনা যাচ্ছে।। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যে এই টেপরেকর্ডার চলতেই থাকবে তা বেশ বুঝতে পারছি আমি।তাই সেদিকে কান না দিয়ে ঘোলাটে চোখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি।চোখ দুটো বন্ধ করতেই গালে দু’ফোটা বড় বড় অশ্রুর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম…মনের সাথে সাথে চোখদুটোও জ্বালা করছে খুব…একগুচ্ছ জমানো আবদার নিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছি…ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে একদম বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকি….জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস বয়ে চলেছে,, যার ধাক্কায় পর্দার সাথে সাথে আমার শরীরের লোমগুলোও কেঁপে উঠছে বারংবার…এই বাতাসটাকেও অসহনীয় লাগছে আজ….বাতাসের তালে যখন উড়ছে আমার চুল ঠিক তখনই হাতে থাকা মোবাইলটাও কেঁপে উঠলো মৃদু ভাবে।।আমি একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে আছি…স্ক্রিনে “সাদা বিলাই” নামটা ভাসছে নিঃসংকোচে সাথে ভাসছে নীল পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো তার হাসি মুখ।।কি সুন্দর নিঃশব্দে হাসছেন উনি…সামনের দাঁতগুলো যেনো ঝলমল করছে….ডানপাশে একটা ত্যাড়াবাঁকা দাঁত আর বামগালে পড়া টোল।।ছবিটি দেখেই বুকের বা’পাশটায় চিনচিনে এক ব্যাথা খেলে গেলো।।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ধীর হাতে ফোনটা তুলে নিলাম আমি….ওপাশ থেকে “রো” বলার সাথে সাথেই চাপা চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি-

খাবো না আমি।।শুনেছেন আপনি?খাবো না।আপনার যদি ইচ্ছে হয় তো আপনি খান।।চাইলে খাবারের মাঝে ঢুবে থাকুন বাট আমাকে খেতে বলবেন না।
রোদ তুমি কি রেগে আছো?(শান্ত কন্ঠে)
নাহ একদম না।।রেগে থাকবো কেন?আমি তো খুবই আনন্দিত।আপনি জানেন?আমি রীতিমতো আনন্দে নাচানাচি করছি।এইযে,, আপনি ফোন রাখার পর…লাউড মিউজিকে লুঙ্গি ডান্স দিবো।।হেভ ইউ এনি প্রবলেম?
আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই হালকা কন্ঠে বলে উঠলেন উনি-
আমার রোদপাখিটার কি হয়েছে, সে কি বলবে আমায়?তার কি আমার উপর রাগ হচ্ছে??সে…
কতোদিন পর উনার মুখে এমন কথাশুনে শরীরটা কেঁপে উঠলো আমার।।কান্নারা অবাধ্য হয়ে নেমে গেলো গাল বেয়ে…গলার কথাগুলোও জড়িয়ে আসছে বারবার….যেনো এইতো এখনি শ্বাসবন্ধ হয়ে মরে যাবো আমি।।তবু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলাম আমি-

খখখবরদার আমায় রোদপাখি ডাকবেন না।আমি কারো রোদপাখি নই।।আআআর আমাকে কলও করবেন না।আমাকে খাবার কথাও জিগ্যেস করবেন না।।আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবেনও না…..
তারপর?(মুচকি হেসে)
ত তারপর আমায় একদম জড়িয়ে ধরবেন না।টাচও করবেন না আমায়।হুট করে আমার শাড়ির আঁচলে টানও দিবেন না।।তা..
তোমাকে মন ভরে দেখতে তো পারবো?সেটাই বা কম কিসে??
না কিচ্ছু পারবেন না।কিচ্ছু না…
কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।।এ এক অযাচিত কান্না।।না চাইতেও যে কান্নাটা বুক ফেটে বেরিয়ে আসে এ যে সেই আকস্মিক কান্না।।ওপাশ থেকে চুপচাপ আমার কান্নার শব্দ শুনে চলেছেন উনি….কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠলেন উনি-

আমি আসছি রোদু!!
উনার এই কথা কানে যেতেই কান্নার গতি যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেলো আমার…. উনি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন –
এই দেখো বউকে আমি এতো ভালো খবর একটা দিলাম কই সে খুশিতে নাঁচবে তা না মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে।আমি আসছি বলে কাঁদছো?? তাহলে কি আর আসবো না?এখানেই থেকে যাবো?
থাথাকুন..ওখানেই থাকুন।খবরদার আমার শহরে আসবেন না আপনি…একদম না।

বললেই হলো?তোমার শহরেই তো আমার বসবাস সুন্দরী….ওই শহরটাতেই রেখে এসেছি আমার প্রাণভোমরা.. তাকে ছেড়ে কি আমার চলে বলো?মরে যাবো তো…..
উনার কথায় চুপ হয়ে গেলাম আমি।।কিছুক্ষণ পর পর শুধু হেঁচকির শব্দই ওঠে আসছে কানে…উনি বেশ মনোযোগ দিয়ে শব্দগুলো শুনছেন… .. কয়েক সেকেন্ড পর গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন –

তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল ৬ টার আগে আমি তোমার সামনে থাকবো।ট্রেন রাত ২ টোয় কিন্তু আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি….. নিজেই ড্রাইভ করে চলে আসবো…কতক্ষণ আর লাগবে বলো?ততক্ষণ কি আমার বউটা একটু ঘুমিয়ে নিবে??প্লিজ!!
উনার কথায় হেসে দিলাম আমি।নাক টেনে বললাম-
থাক…ড্রাইভ করে আসতে হবে না।।ট্রেনেই আসুন…চট্টগ্রাম টু ঢাকা কতোখানি পথ…এতোরাতে ড্রাইভ করা খুব রিস্ক…আপনি প্লিজ ট্রেন দিয়েই আসুন।
সরি সুন্দরী।সুন্দরী বউয়ের কান্নামাখা কিউট কন্ঠ শুনে আবরার শুভ্রের পক্ষে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

আপনি এতো বেশি বুঝেন কেন অলওয়েজ?? সারাদিন কাজ করার পর টায়ার্ড শরীরে ড্রাইভ করবেন?পাগল হয়েছেন আপনি?খবরদার এমন কিছু করবেন…নয়তো..
আমার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে.. দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলে উঠলেন উনি-
তুমি এই কথাগুলো আমার সামনে বসে বলবে প্লিজ?তোমার কন্ঠ টা একদম বউ বউ লাগছে গো।।এতোদিনে মনে হচ্ছে আমি বিয়ে করেছি।।এখন তো একসেকেন্ডও দেরি করা যাবে না….আই এম কামিং সুন্দরী…রেডি থাকো।

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।।কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও ডায়াল করতেই ফোন কেটে ম্যাসেজ পাঠালেন উনি-” ড্রায়িব করছি রোদপাখি।কল দিও না…গিয়ে কথা হবে… এখন খেয়ে শুয়ে পড়ো প্লিজ!!” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তামাখা মুখে উঠে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।।এই চিন্তিত মনে গলা দিয়ে খাবার নামাটা ইম্পসিবল!! কে জানে এতো রাতে কিভাবে ফিরবেন উনি??সত্যিই আজকেই প্রথম নিজেকে কারো স্ত্রী বলে মনে হচ্ছে… স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা কাকে বলে তা আমার অস্তিত্বে মিশে যাচ্ছে।।প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের সাথে তারজন্য দোয়া করছে এ মন….”সে ভালো থাকুক,,,সুস্থ থাকুক”

ঘুমের মাঝেই মুখে কিছুর ছোঁয়া লাগায় লাফিয়ে উঠলাম আমি।নিশ্চয় শুভ্র চলে এসেছে? কিন্তু চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না আমি।।জানালার পর্দাটা বারবার আছড়ে পড়ছে গায়ে…বুঝতে পারলাম শুভ্র নয়…জানালার পর্দা ছিলো ওটা।।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯ টা ২০ প্রায়…এতো বেলা হয়ে গেছে??রাতে জানালাটা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি…জানালা গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাইরেটা অন্ধকার…আকাশটা ঘন মেঘে ডাকা…হয়তো ঝড় হবে…ভীষন ঝড়।।হঠাৎ শুভ্রর কথা মনে পড়ায় ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করলাম ফোন বা ম্যাসেজ কিছু আছে কি না?কিন্তু একি সব ফাঁকা।।কিন্তু এতোক্ষণে তো উনার পৌঁছে যাওয়ার কথা৷ তবে কি উনি এসেই ঘুম দিয়েছেন??ফোনটা হাতে নিয়ে কি মনে করে ডায়াল করেই ফেললাম।।দুবার কেটে গিয়ে তিনবারের সময় রিসিভ হলো।।রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই বলতে শুরু করলাম আমি-

হ্যালো?কোথায় আপনি?ঘুমোচ্ছেন?কখন ফিরেছেন?আমায় ফোন দেন নি কেন?আপনি কি আজ ভার্সিটি আসবেন??
আমার প্রশ্নের বহর থামলে আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মোটা স্বরে কথা বলে উঠলেন এক ভাদ্রলোক-
সরি ম্যাম।আমি আবরার শুভ্র নই।আমি ডক্টর রাহিম আলম।
উনার ফোন আপনার কাছে কেনো?(অবাক হয়ে)
এক্চুয়েলি উনি এখন ফোন ধরার পজিশনে নেই তা…
উনার সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই বলে উঠলাম আমি-
কোন হসপিটাল!!

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪১+৪২

কথাটা শুনেই হাত থেকে ফোনটা খসে পড়লো আমার।মাথাটা কেমন ভো ভো করছে আমার…চিন্তা শক্তি যেনো লোপ পাচ্ছে ক্রমাগত…ব্রেনটা যেন ক্রমাগত ঘুম পারিয়ে দিতে চাচ্ছে আমায়…কিন্তু আমায় তো যেতে হবে।।শুভ্রর কাছে যেতে হবে।।যেতেই হবে….কথাটা ভেবেই বালিশের পাশে রাখা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে।।ডায়নিং এ বসে থাকা বাবা-মা,ভাইয়া সবাই যে অবাক চোখে দেখছে বেশ বুঝতে পারছি….কিন্তু আমায় তো থামলে চলবে না…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছুতে হবে আমায়….তাকে যে আমার চাই!!খুব বেশি চাই।

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৫+৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here