তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৭+৪৮

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৭+৪৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

চোখদুটো পিটপিট করে খুলে চারপাশটা দেখার চেষ্টা চালাচ্ছি।মাথাটা বড্ড ভারি ভারি লাগছে আমার। বাম হাতটাতেও কেমন চিনচিনে ব্যাথা।ঘাড় ঘুরিয়ে বামদিকে তাকাতেই দেখি হাতে লাগানো স্যালাইনের নল….ব্যাপারটায় বিস্মিত হলাম আমি।চারপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কোথায় আছি আমি?রুমটা কেমন অপরিচিত লাগছে আমার…কিন্তু একটা পরিচিত গন্ধ চারপাশে…..ডানপাশের দেয়ালে আমার আর শুভ্রর ছবি দেখে বুঝতে পারলাম এটা শুভ্রর রুম।।হসপিটালে দাঁড়িয়ে শুভ্রর বুকে আছড়ে পড়ার পর কি হয়েছিলো….কিচ্ছুটি মনে নেই আমার।বেডে শুয়ে যখন এসব কথা ভাবছিলাম ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো শুভ্র।খালি গা…গলায় ঝুলছে সাদা টাওয়াল…পরনে ছাই রঙের থ্রী কোয়াটার প্যান্ট।কিছু চুল এসে পড়েছে কপালে…ভেজা চুলে বিন্দু বিন্দু জল।বুকের পশমগুলো লেপ্টে আছে পরম আবেশে…চোখগুলো হালকা লাল..ঘাড়ে বুকে ফোঁটা ফোঁটা পানি।।শুভ্র ডানহাতে তাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।আমার পাশ ঘেষে মাথার কাছে এসে বলে উঠলো –

মহারানীর ঘুম ভাঙলো তবে?কি লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলে বলো তো আমায়?স্বামী এক্সিডেন্ট করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বউ সেই দুঃখে ৮ ঘন্টা যাবৎ সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
উনার কথায় অবাক হলাম আমি।৮ ঘন্টা মানে কি?তবে কি আমি ৮ ঘন্টা যাবৎ সেন্সলেস ছিলাম??আমি বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলাম –
৮ ঘন্টা?
জি ম্যাডাম ৮ ঘন্টা।আর আপনার স্বামীকে তার ভাঙাচোরা শরীর নিয়েই আপনাকে কোলে উঠাতে হয়েছে।এটুকুতেই এই অবস্থা…সত্যি মরে গেলে কি করতে শুনি?(ভ্রু নাচিয়ে)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উনার কথায় ভেতরটা কেঁপে উঠলো আমার।সত্যি এমন হলে কি হতো আমি জানি না।আর এই বিষয়টা আমার মনের কোনো একটা কোণায়ও আনতে চাই না কখনো।সকালে উনার এক্সিডেন্টের খবরে যে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম সেটাও ইচ্ছেকৃত ছিলো না।অটোমেটিক রিয়েকশন ছিলো ওটা…. স্বামীর মৃত্যু বা বিপদের কথায় যে রিয়েকশনটা প্রতিটি নারীরই হয়ে থাকে।।আমি একটা ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলাম –

এমন কিছুই হতো না।আমি আল্লাহর কাছে সবসময় একটা জিনিসই চাই আপনার আগে আমার মৃত্যু!! আল্লাহ কারো চাওয়া অপূর্ণ রাখে না তাহলে আমার টা কিভাবে অপূর্ণ রাখে বলুন?
আমার কথায় যেনো কেঁপে উঠলেন শুভ্র।চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠলো মুহূর্তেই।কয়েকসেকেন্ড চোখ বুজে থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা জোড় শ্বাস ফেলে একহাতে জড়িয়ে নিলেন আমায়….আমার মাথা উনার বুকে পড়তেই কেঁপে উঠলাম আমি…উনার ঠান্ডা বুকে আশ্চর্যময় এক প্রশান্তি।।উনার উন্মুক্ত বুকের গন্ধেও অন্যরকম এক মাদকতা।উনি আমার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বলে উঠলেন –

এমন স্বার্থপরের মতো দোয়া করো না রোদপাখি।তার থেকে দোয়া করো যেনো আমরা একসাথেই হারিয়ে যাই এই পৃথিবী ছেড়ে।আমি মৃত্যুর পরও তোমাকে অন্যকারো হিসেবে সহ্য করতে পারবো না রোদু।আর না পারবো তোমায় এভাবে অসহায় করে রেখে যেতে।তুমি আমার!!তোমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার নামের সাথে শুধু আমার নামটায় জড়িয়ে থাকবে….শুধু আমার নাম।মিসেস নৌশিন আবরার রোদেলা।
উনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন।আমি চুপচাপ উনার হৃৎস্পন্দনের মাদকতায় মত্ত হচ্ছি। উনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলে উঠলেন-

তোমার থেকে আমি তোমায় অনেক গুণ বেশি ভালোবাসি রোদ।আমার না থাকার কথা শুনে তোমার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ভাবো তোমার না থাকার কথা ভাবলেই কতোটা পুড়ে আমার।।তুমি নতুন প্রেমের জোয়ারে ভাসছো রোদ…আর আমি তো এই জোয়ারে নিজেকে হারিয়েছি কোটি কোটি বার।ভালোবাসা জিনিসটাই বড্ড অসহায় বুঝলে?তুমি যখনই কাউকে ভালোবাসবে তখন থেকেই নিজেকে অসহায় মনে হবে….যেমন আমার নিজেকে তোমার কাছে বড্ত অসহায় লাগে রোদ।।নীর মেয়েটা যেমন এই পৃথিবীর কাছে অসহায়…ওর সব আছে…সব থেকেও কিচ্ছু নেই।

“নীর” নামটা শুনেই হসপিটালের ওই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেলো আমার।।সাথে সাথে তাকে আমার মতো মনে হওয়ার কারনটাও ধরতে পারলাম।আমাদের দুজনের চাহনীতেই ছিলো অসহায়ত্ব।। ভালোবাসার কাছে আমরা দু’জনেই ছিলাম অসহায়…তাই হয়তো আমাদের দৃষ্টি ছিলো এক… অনুভূতি ছিলো এক।।আমি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বুক থেকে মাথা তুলে বলে উঠলাম –
ওই মেয়েটার কি হলো পরে?
কে? নীর?তুমি সেন্সলেস হওয়ার দু’মিনিট পরই সেন্স হারিয়েছে ও।মেয়েটা দু’মাসের প্রেগনেন্ট… আমি বের হওয়ার আগে ওকে আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়েছে।।অবস্থা তেমন ভালো না।স্বামীকে হয়তো প্রচন্ডরকম ভালোবাসে।যতোটুকু জানলাম আজই বিয়ের একবছর পূরণ হলো তাদের।ফাস্ট ইউনিভার্সারি।আর প্রথম বছরেই সব শেষ….

শুভ্রর কথায় আত্মাটা ধক করে উঠলো আমার।।এই মেয়েটা কি করে সহ্য করবে এই কষ্ট?আর তার অনাগত সন্তান!! জীবনটা এতো কষ্টের কেনো হয়?এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো জীবনটাকে বারবার থমকে দিতে চায় কেন??হার্টবিট দ্রুত ছুটছে আমার…গলাটাও কেমন শুকিয়ে আসছে…প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়টা কি প্রবল।কি যন্ত্রণার!!এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।।শুভ্র “কে” জিগ্যেস করাতেই ভেতর এলো অভ্র ভাইয়া।আমাকে দেখে মুচকি হাসলো।।আমি দ্রুত শুভ্রর বুকের কাছ থেকে সরে বসে মাথা নিচু করলাম।অভ্র ভাইয়া বাঁকা হেসে মজা করে বলে উঠলেন-

তো?আমার একমাত্র ফুপাতো বোন এবং একমাত্র শালিকার ঘুম ভাঙলো ?
আমি মুচকি হাসতেই পাশ থেকে অনুযোগের স্বরে বলে উঠলো শুভ্র –
ভাই? ও যে আমার বউ… সেটা তুই বারবার ভুলে যাস কেন শুনি?সব বললি! এটা তো বললি না যে,, সে তোর একমাত্র ছোট ভাইয়ের একমাত্র বউ।।
শুভ্রর কথায় হুহা করে হেসে উঠলেন অভ্র ভাইয়া।তারপর হাসি থামিয়ে বললেন।
আমার ঘাট হয়েছে ভাই।এনিওয়ে তোর ফোন কই রে শুভ্র?সাহেল নাকি সকাল থেকে ট্রাই করছে পাচ্ছে না।
ওহ্ শিট! ফোনটা হসপিটালে থাকতে যে ব্যাটারি ডাউন হয়েছিলো সেটা আর চার্জ করে অন করা হয় নি।।আমি এখনই কল ব্যাক করছি ভাই।

অভ্র ভাইয়া মাথা ঝাঁকিয়ে “রুহি!” রুহি! বলে চেঁচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।শুভ্র চার্জ থেকে ফোন খুলে অন করতেই ফোনটা বেজে উঠলো । উনি ফোনটা রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়ে “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে গালির বহর শুরু হলো….
শালা!!কয়বার কল করছি?ফোন কি আলমারিতে তোলে রাখার জন্য কিনেছিস??**********টেনশনে মইরা যাইতাছি আর তুই ফোন অফ করে রঙলিলা করিস শালা*****

এতো এতো গালি দেওয়ার পরও শুভ্রর মুখে মুচকি হাসি।।আমার কান রীতিমতো ভো ভো করছে….সাহেল ভাইয়াও স্লেং ইউজ করে জানায় ছিলো না আমার।।শুভ্র খুব ধীরে আমার হাতের সুঁচ খুলে দিতে দিতে বললেন-
আমার দুলাভাই হওয়ার যে খুব শখ তোর সেটা আমি ভালো করেই জানি।।বার বার শালা বলে সেটা প্রমাণ করতে হবে না দোস্ত।

ব্যাটা ফাজলামো কমা।ফোনটা অফ ছিলো কেন সেটা বল?এদিকে ঘাম ছুটে গেছে আমার।।কাল আমার এসাইনমেন্ট আর আজ আমি সাতঘন্টা যাবৎ এয়ারপোর্টে বসে আছি।।তিন ডাবল টাকা দিয়ে টিকেট নিয়েছি….তবু বালের ওয়েদারের জন্য ফ্লাইট অফ।।নয়তো এতোক্ষণে দেশে থাকতাম আমি।
কুল ইয়ার!! ভাষা ঠিক কর।রাগলে তোর ভাষা ঠিক থাকে না।(হাসতে হাসতে)
তোর কুলের ******। সাইশাইন কাঁদে কেন?কি করছিস তুই?বিয়ে কি ওকে কাঁদানোর জন্য করেছিস??ইচ্ছে তো করছে তোকে*****।

আরে বাবা শুনবি তো আমার কথা!! বাজে কথা থামা…ওকে কাঁদাতে হয় না…একা একাই কাঁদে।আমার ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছিলো তাতেই ম্যাডেম কেঁদে কেটে ৮ ঘন্টা যাবৎ সেন্সলেস হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।।
কস কি?এক্সিডেন্ট।শালা এক্সিডেন্ট করছিস সেটা তুই এতোক্ষণে বলছিস আমায়??ঠিক আছিস তুই??নিশ্চয় ব্যাপক ইনজুরি হয়েছে….নয়তো সানশাইন এতো হাইপার হবে না।।

না রে।মাথায় দুটো সেলাই লেগেছে।হাতে একটু ব্যথা পেয়েছি আর পায়ে।।দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমার কথা ছাড়…যা এপার্টমেন্টে গিয়ে রেস্ট নে।।এসাইনমেন্ট কমপ্লিট কর….আমাদের নিয়ে টেনশন করিস না…একদম ঠিক আছি।
বাঁচাইলি দোস্ত। টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।একটু সাবধানে তো থাকতে পারিস নাকি?তোর কিছু হলে সানশাইনের কি হবে ভেবে দেখেছিস?সানশাইনের খেয়াল রাখিস!!

কথা বলবি ওর সাথে সাহেল?
শুভ্রর একথায় চমকে তাকালাম আমি।।ওপাশ থেকে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো নিয়ে বলেন উঠলেন সাহেল ভাইয়া-
আরে না না।।আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।।রাখছি রে….সাবধানে থাকিস আর(একটু থেমে) তোর বউয়ের খেয়াল রাখিস।

শুভ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।।আমি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছি।এরা দুজনেই দুজনের ফিলিংস জানে….তবু কতো স্বাভাবিক ওরা?কিন্তু কিভাবে এতো স্বাভাবিকতা?অস্বস্তি হয় না ওদের? ওরা কি বন্ধুত্বটাকে সবকিছুর উর্ধে এনে দাঁড় করিয়েছে?যেখানে রাগ,,ক্ষোভ,,হতাশা,,অস্বস্তির কোনো ঠাঁই নেই।।একটুকুও না।।শুভ্র আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো-

উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি খাবার আনছি।
না এখন নয়। নামায পড়বো আমি!
নামায?এখন কিসের নামায?এশার আযান দেই নি এখনই…. ৭ঃ৪০ বাজে মাত্র!
নফল নামায পড়বো।
কথাটা বলে বেড থেকে নামতে গেলেই মাথা ধরে উঠলো আমার…উনি দ্রুত আমার কোমর চেপে ধরে “আহ” করে উঠেই বললেন-
সাবধানে…

আমি উনার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম… ব্যান্ডেজ করা হাতেই কোমর চেপে ধরেছেন উনি।।কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই কিছু একটা মনে পড়ে নিজের দিকে তাকিয়েই বিস্ময় নিয়ে মাথা উঠিয়ে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম-
আমার ড্রেস!! আমার ড্রেস কে চেঞ্জ করেছে?
কেনো?(ভ্রু কুঁচকে)
আপনি করেছেন?(ঢোক গিলে)
আমি করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার??আমার অধিকার আছে বুঝলা?যদিও অধিকারটা এপ্লাই করি নি। বউ মনি এসে চেঞ্জ করে দিয়ে গিয়েছেন।
উনার কথায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি।উনা বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম ।নামায পড়ে আল্লাহকে শুকরিয়া তো জানাতে হবে….!!

বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছি।।দৃষ্টি জানালার বাইরে।মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু কোনো শব্দই আসছে না কানে।কি অদ্ভুত!!বৃষ্টি মানেই তো রিমঝিম শব্দ….কিন্তু এখানে কোনো শব্দ নেই।হয়তো এই শহরে,হাজারো দালানের ভীরে বৃষ্টি হারিয়েছে তার নিজস্বতা।।এমন অগোছালো চিন্তা যখন মন ভরে ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো শুভ্র।।বামহাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দরজা বন্ধ করে মিষ্টি হেসে বসে পড়লো আমার পাশে।আমি তাকাতেই প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো –

খাইয়ে দাও!হাত ব্যাথা, খেতে পারবো না।
উনার কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো আমার।সারা দুনিয়ার সকল কাজ করছেন আর ভাত খাওয়ার সময়ই হাতে ব্যাথা?কি অজুহাত!!আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে প্লেটটা হাতে নিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম।উনি চুপচাপ খাচ্ছেন আর লেপটপে কিছু একটা করছেন। আমি একাধারে উনার চোখে মুখে তাকিয়ে আছি।ব্যান্ডেজেও কি সুন্দর মানিয়েছে উনাকে।সাদা ধপধপে মুখ তাতে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি…কপালে পড়ে থাকা সিল্ক চুলগুলো দিয়ে ঢাকা পড়ে আছে অর্ধেকেরও বেশি ব্যান্ডেজ।ডার্করেড ঠোঁটগুলো খাওয়ার তালে তালে নড়ছে তারসাথে নড়ছে থুতঁনির ওই কালো তিল।।উনি লেপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন –

তুমিও খাও রোদপাখি।আজ আমি খাইয়ে দিতে পারবো না ….হাতটা সত্যি ব্যাথা করছে।পেইনকিলার খেয়েও ব্যাথা কমছে না।।কাল ভার্সিটি শেষে ডক্টরের কাছে যেতে হবে।এমনি কতো কাজ জমে আছে এই হাত ব্যাথা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
আপনি কালই ভার্সিটি যাবেন?একদিন না গেলে হয় না?ঠিকমতো হাঁটতেই তো পারছেন না।এতো কাজ কাজ কেনো করেন শুনি?(মুখ ফুলিয়ে)
উনি হাসলেন।লেপটপ অফ করে পাশে রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলেন।ব্যাড সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে প্ল্যাটটা টেনে নিয়ে আমার মুখে খাবার তুলে দিলেন।।আমি অবাক চোখে বললাম –
আপনার না হাত ব্যাথা?ছাড়ুন প্ল্যাট!আমি খেয়ে নিচ্ছি।
সমস্যা নেই ছাড়ো।
সমস্যা নেই মানে?অবশ্যই সমস্যা আছে… ছাড়ুন তো আমি খেয়ে নিচ্ছি বললাম তো।

আরে বাবা!এটুকু পারবো।কাজ না করে অলস বসে থাকলে ব্যাথা আরো বেশি করবে।।তবে একটা জিনিস ভালোই হয়েছে….ওই ইন্সিডেন্টের জন্য তুমি একদম শশুড় বাড়িতে চলে এসেছো।বিয়ের পর এটাই শশুড়বাড়িতে তোমার প্রথম রাত।তারমানে আজ আমাদের বাসর!!ওয়াও আই এম সো এক্সাইটেড… (চোখ টিপে)
কিহ!বাসর রাত কেনো হতে যাবে?

কেন হবে না?শশুড়বাড়িতে বউয়ের প্রথমরাতই হলো বাসর রাত।ওই হিসেবে আজ আমাদেরও বাসর রাত। বাহ বাহ….বাইরে বৃষ্টি,, ভেতরে খাট আর খাটের উপর কম্বল আর কম্বলের নিচে…..(দুষ্টু হেসে)
ছিহ! আপনি তো দেখি ব্যাপক অসভ্য।(রাগী গলায়)
আহা!অসভ্যই তো হতে চাই রোদপাখি। কিন্তু পাখি তো ধরা দেয় না।এই দহন আর মনে মানে না….

আমি উনার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছি আর উনি হুহা করে হেসে চলেছেন।।উনার হাসির শব্দ যেনো দেয়ালে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত করে উঠছে বারবার….সেই শব্দে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমার মন।বৃষ্টির শব্দের চেয়েও কি ভীষন সুন্দর এই শব্দ।।হৃদয়কে নিগড়ে দেওয়া একমুঠো আবেগ এই শব্দ।একগুচ্ছ কম্পন!!

ভার্সিটির বটতলায় বসে আছি আমি আর চিত্রা।আমার মুখে শয়তানী হাসি আর চিত্রার চোখে মুখে সন্দেহ।চিত্রা বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছে আর পানি খাচ্ছে। অবশেষে থাকতে না পেরে বোতলটা পাশে রেখে আমার পাশে আরেকটু ঘেষে বসেই বলে উঠলো –
এই? তুই এভাবে হাসছিস কেন?তোর এই হাসি মানেই ভয়ংকর কিছু।কি করতে চাইছিস বলতো…
আমি চিত্রার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম।এবার যেনো কেঁদেই উঠবে সে।।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আবারও বলে উঠলো চিত্রা-
দেখ রোদু?তুই একদম আমার দিকে এভাবে তাকাবি না।আমার হার্ট দুর্বল যেকোনো টাইম আট্যাক ফ্যাটাক করে ফেলতে পারি।এমন মধুর হাসি তোর জামাইকে দেখা গিয়ে।তোর এই হাসি আমার সহ্য হয় না …..শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।দয়া করে হাসি অফ কর মেরি মা।

ছিহ!তোর বাপের সাথে আমার বাপ -মেয়ের মতো সম্পর্ক। এসব বিশ্রী অপবাদ আমায় দিস না…..তাহলে আমি নিজেই হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবো।রাস্তাঘাটে অনেক মানুষ আছে মা ডাকার জন্য তাদের রেখে আমায় কেন ডাকছিস?
তুই… তুই আসলেই অসহ্য।কিছু বলবোই না আমি।যায় বলি টেনে হিঁচড়ে নেগেটিভ দিকেই নিয়ে যাস…..ভাল্লাগেনা।(মুখ ফুলিয়ে)
ভাল্লাগবে গো বান্ধবী ভাল্লাগবে….ওই দিকে তাকাও ভালো লাগবে।।তোর জামাই সরি তোর হাফ জামাই এদিকেই আসছে।বি রেডি জানু….(দুষ্টু হেসে)
ম ম মানে?কককিসের রেডি?
কেন মনে নাই?সেদিন ছাদে কি কথা হয়েছিলো?শর্তটা কিন্তু এখনও পালন করিস নি।নেভারমাইন্ড আজ করবি।চল উঠ।
ররররোদদ পপ্লিজজ!!
প্লিজ টিজ কাল বলিস এবার উঠ তো…
কথাটা বলেই চিত্রাকে টেনে উঠিয়ে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।মুখে অমায়িক হাসি টেনে নিয়ে বলে উঠলাম –
আসসালামু আলাইকুম স্যার!!

ওয়ালাইকুম আসসালাম।(মুচকি হেসে)কেমন আছো তোমরা?
ফাস্ট ক্লাস আছি স্যার….তাই না চিত্রা??(চোখ টিপে)
কথাটা বলেই কনুইয়ের নিচে চিমটি কেটে দিলাম আমি।।সাথে সাথেই চিত্রা তুমুল গতিতে মাথা নাড়াতে লাগলো।।আমি আবারও চিমটি কেটে চোখের ইশারা দিতেই করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েই কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিলো সে।।পুরো দুই মিনিটের চেষ্টায় বহুত কষ্টে বলে উঠলো –
কককককেমন আআছো শশশশিশির!!
চিত্রার কথায় শিশির স্যার চরম অবাক।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না উনি।কিছুক্ষণ শক লাগা চোখে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন –

সরি?কি বললে?
চিত্রা যেনো এখনই দৌড় লাগাবে এমন ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে পায়ে একটা পাড়া দিতেই আবারও বলে উঠলো সে-
বববলছিলাম কককেমন আছো শশশিশির….
কথাটা বলেই আমাকে নিয়ে উল্টো দিকে দিলো এক দৌড়।আমি পারলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই।শিশির স্যার বিহ্বলিত চোখে তাকিয়ে আছেন।এতোবড় শক হজম করতে পারছেন না বেচারা।স্যারের নজরের আড়ালে এসে থামলো চিত্রা।ঘাসের উপর বসে হাঁপাতে লাগলো।ব্যাগ থেকে বোতল বের করে একদমে পুরোটা পানি খেয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো সে।মুখ চোখ লজ্জা আর ঘামে লাল হয়ে এসেছে।আমিও মুচকি হেসে ওর পাশে বসতেই কোথা থেকে সাকিব ভাই এসে বললো-

গুড মর্নিং চিতল সুন্দরী। কতোদিন দেখি না তোমায়।
চিত্রার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এবার চরম বিরক্ত।পারলে এই বোতল দিয়েই মাথা ফাঁটিয়ে দেয় সাকিব ভাইয়ের।আমি মুচকি হেসে সাকিব ভাইয়ের উদ্দেশ্য বললাম-
সাকিব ভাইয়া?আপনার সুন্দরী তো গভীর জলের মাছ।সে এখন শিশিরে ভিজে টুইটম্বুর…তার এখন অন্যদিকে মন নাই।
মানে?বুঝলাম না ভাবি।
পেছনে তাকান!ওই যে সুদর্শন পুরুষ অর্থাৎ আমাদের শিশির স্যারকে দেখতে পাচ্ছেন… আপনার সুন্দরী তার হাফ বউ।

আমার কথায় সাকিব ভাই যেনো আকাশ থেকে পড়লো।চোখ বন্ধ করে আবারও খোলে ড্যাবড্যাব করে তাকালো চিত্রার দিকে।।তারপর আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো –
আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিশির স্যার?
আমি মাথা নাড়তেই একটা ঢোক গিলে “এবার আমি শেষ” কথাটা বলেই পেছন ফিরে হাঁটা দিলো।আমি আর চিত্রা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই হুহা করে হেসে উঠলাম।।হঠাৎ ই ফোন বেজে উঠায় হাসি থামিয়ে ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে শুভ্রর উত্তেজিত কন্ঠ ভেসে উঠলো-
রোদপাখি…রোদপাখি…জলদি পার্কিং এ আসো ফাস্ট।
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।আমি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ বসে থেকেই চিত্রাকে রেখে দৌড় লাগালাম পার্কিং এ।।পার্কিং গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি পার্কিং একদম ফাঁকা।আরেকটু এগিয়ে যেতেই কেউ একজন হেঁচকা টানে কোলে তুলে নিলো আমায়।আমি ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে আবারও চোখ মেলে তাকালাম।চোখের সামনে শুভ্রর হাসি হাসি মুখ ফুটে উঠলো।।উত্তেজনায় ফর্সা মুখটা যেন লাল হয়ে আছে।আমি উনার গলা জড়িয়ে ধরতেই আমাকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন উনি।আমি চাপাস্বরে বললাম-

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৫+৪৬

নামান!আপনার হাতে ব্যাথা তো…
থাকুক ব্যাথা।।টুডে আই এম সো হ্যাপি রোদপাখি।এই খুশির সামনে তো এই ব্যাথাটা কিছুই না….
আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।কিসের এতো আনন্দ তার?

তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৪৯+৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here