তোকে ছুয়েছি আঁধারে গল্পের লিংক || ভূমিকা তালুকদার

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১
ভূমিকা তালুকদার

ভালোবাসা এমন এক অদ্ভুত আগুন।যা ছুঁয়ে দিলে পোড়ায়, না ছুঁয়েও শান্তি দেয় না।তবে ভালোবাসা মানে দু’জন মানুষ নয়,একটি আত্মা, দুটি শরীরে বিভক্ত।”তোকে ছুঁয়েছি আঁধারে “উচ্চারণেই লুকিয়ে আছে এক অনন্ত গোপন প্রেমের গন্ধ, এক শপথ যার জন্ম আলোতে নয়, অন্ধকারের নিস্তব্ধতায়।এই তিনটে শব্দ যেনো সমগ্র অস্তিত্বের স্বীকারোক্তি। এক অন্ধ আকুলতার প্রতিধ্বনি, যা কখনো প্রার্থনা, কখনো অভিশাপ হয়ে বুকের ভেতর দগ্ধ হয়।

অর্ধ খোলা টকটকে লাল রঙা জামদানি শাড়ি পরিহিতা উনবিংশতী কন্যা লিয়ানার নিজের চোখ বেয়ে নামা অশ্রু জল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো,তবে চোখের জল মুছে গেলেও মনের জ্বালা মিটাতে পারলো না। নিঃশ্বাসটা তার গলায় আটকে আসছে,মনে হচ্ছে, এ যেনো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সে।নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে, এত জঘন্য, এত ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস তার আর নেই। লিয়ানা ঘৃণায় নাক ছিটকালো।এমন অমানবিক পশুর সঙ্গে, এমন মুখোশপরা শয়তানের সঙ্গে এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব নয়,এমন ভাবনাই যেন তার বুকের ভেতর আগুন জ্বেলে দিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বারবার মনকে বুঝালো যা হচ্ছে যা দেখছে তা সব এই ভ্রম, কিছুক্ষণ মাথাটা চেপে ধরে রাখলো।বাস্তবে ফিরতে চাইলো।তবে সে ব্যর্থ আজ,চোখের সামনের এমন,বিভীষিকাময় দৃশ্যেখান সবই সত্যে,কাঁচের মতো সচ্ছ।সব কিছু আজ পরিষ্কার, কোনো প্রশ্ন, কোনো সন্দেহর আর বাকি নেই।ভয়ে ও ঘৃণায় চোখে জল জমে আছে, কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। বুকের ভিতরটা জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাত কাঁপছে,মনে হলো এখনি বুক ফেটে হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসবে ।এক হাত বুকের পাশে রেখে, শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে, শব্দহীন আশ্রু মেঝেতে টপটপ করে পরছে। ঠাণ্ডা পাথরের মতো মুখে ভেঙে পড়া সাহসটুকু নিয়ে, ধীরে ধীরে পিছিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

ঠিক তখনই তার পিঠের সঙ্গে কারোর বুক ঠেকলো।বরফে ঢাকা নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই স্পর্শটা যেনো বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো তার শরীরে। মুহূর্তেই বুঝে গেলো,এটা অন্য কেউ নয় তার স্বামীই।লিয়ানার বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। তার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠলো, ঠোঁট ফুলে উঠে কাঁপতে থাকে, এখন সে জেনে গিয়েছে, সে যা জানে, সেটাও তিনি জেনে গিয়েছেন।তারমানে এতক্ষণ তিনি তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এখন কী হবে?
লিয়ানা ঘুরে দাঁড়ালো,
দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো শাড়ির আঁচল, বুকের পাশে শক্ত করে টেনে নিলো।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মানুষ, যাকে সে মনপ্রান উজার করে ভালোবেসেছিলো। আর আজ যার মুখে কেবল এক অমানবিক পিশাচের ছায়া।লিয়ানার চোখের দৃষ্টি যেনো ছুরির ধার।রাগ, ঘৃণা, ভয়সব একসঙ্গে জমে গেছে তাতে। শরীর কেঁপে উঠছে, কিন্তু সে তাকিয়ে রইলো এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরালো না।

তারপর হঠাৎ—
এক তীব্র ধাক্কা!
লিয়ানা দু’হাতে নিজর স্বামীর বুকে তীব্র ধাক্কা দিয়ে নিজের চোখে অশ্রু আর নিঃশ্বাসে আগুন নিয়ে, দৌড়ে পালাতে লাগলো সামনে শুধুই কুয়াশা, অন্ধকার, আর অজানা গহ্বর চাঁদের আলো কুয়াশার আস্তরে ঢেকে আছে, চারদিক যেন দমবন্ধ নীরবতায় আচ্ছন্ন। বরফের ঢালে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে, অদ্ভুত এক হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। যেন পৃথিবীর বুকের সব আলো নিভে গেছে শুধু ভয় আর একাকীত্বের ঘন কুয়াশা ভেসে আছে চারপাশে। দূরে হালকা বাতাসে গাছের পাতায় সোঁ সোঁ শব্দ, যেন কেউ অন্ধকারের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে,অপেক্ষা করছে কারোর পতনের।
এই নিঃস্তব্ধতার মধ্যে চাঁদের আলো কুয়াশার আস্তরে ঢেকে আছে, চারদিক যেন দমবন্ধ নীরবতায় আচ্ছন্ন।
এই নিঃস্তব্ধতার মধ্যে
তবুও আজ সে থামবে না।
যে ভালোবাসা মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর, তার কাছ থেকে পালানোর এই একটাই রাত।

*******[ফ্লাশ ব্যাক]******
মায়ের কণ্ঠটা যেনো কোনো স্বপ্নের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। কিন্তু লিয়ানা চোখ না খুলেই বিছানার চাদরটা আরও বেশি টেনে মুখটা ঢেকে ফেললো।ঘুম আর জেদের মিশ্র সুর মিশিয়ে বলে উঠে।
“আরেকটু ঘুমাই আম্মু.,একদম ৫ মিনিট”
মেয়ের কথায় রোকসানা খান রেগেমেগে কোমড়ে হাত দিয়ে বিছানার চাদর টানতে লাগলেন।
“৫ মিনিট শুনতে শুনতে তো সকাল ১০টা বেজে যাবে। ক্লাস নাই তোর??এখুনি উঠবি তা না হলে মুখে ঠান্ডা পানি মারবো।
মায়ের একটানা ডাকে বিরক্ত হয়ে লিয়ানা চিৎকার করে বললো,
“আছে তো! আরেকটু গুমাই না চিৎকার করছো কেনো।রোজ রোজ এক কাহিনী করো,,বলো দশটা বাজে, আর আমি উঠে দেখি সাতটা,আটটা।উফ!”
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ঘুমা, আমি তোর বাবাকে বলে দেই আজকে তোর নামে কলেজ ছুটি।যেতে হবেনা আর কলেজে।”
মায়ের এই কথা শুনেই লিয়ানা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বসলো, হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে বলে,
“ও মাই গড! বাবাকে বলতে হবেনা,,না না! যাও যাচ্ছি,একদম ঠিক সময়ে কলেজে পৌছাবো।”
“হুম,,,,জানি তো তোর মত ঘুমপাগলা রাজকুমারীকে কীভাবে সায়েস্তা করতে হয়।বাপের ভয় না দেখালে তো তোর পেটের ভাত হজম হয়না”

ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা। বাড়ির প্রতিটি রুমে একটু একটু করে আলো পড়েছে। “খান বাড়ি” যেন প্রতিদিনের মতো একটা অদ্ভুত অথচ চেনা উষ্ণতায় ডুবে আছে।”খান বাড়ির “বড় কর্তা সুলেমান খান ও নাফিসা খান এর একমাত্র ছেলে জায়ান খান,প্রায় এক যুগের কম হলো বিদেশ পাড়ি দিয়েছে তবে দেশে আসার আর নাম নিলো না,যার আসার অপেক্ষায় দিন পার করে চলেছে খান বাড়ির সকলে।বাড়ির মেজো কর্তা ফাহিম খান আর রুকসানা খান এর দুই মেয়ে লিয়ানা,মাইশা।আর খান বাড়ির ছোটো কর্তা রেজাউল খান আর শারমিন খান এর এক ছেলে এক মেয়ে আরিশা ও রিহান। তবে বাড়ির তিন কর্তাই বাড়ি নেই বিজনেসের কাজে ঢাকার বাহিরে গিয়েছেন।
কিছুক্ষণ পর লিয়ানা নেমে আসে নিচে, চোখে-মুখে তাড়াহুড়া, মুখ ধুয়ে খোলা চুল এলোমেলো, গায়ে হালকা নেভী ব্লু কামিজ।ডাইনিং টেবিলে সকালের ব্যস্ততা চলছে।দাদি চা খাচ্ছেন, মাঝে মাঝে টিভির খবরের দিকে চোখ।রিহান নিজের মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে বসে আছে।মাইশা আর আরিশা দুজনেই টোস্ট নিয়ে ঝগড়া করছে কে আগে নেবে।আর লিয়ানা লাফিয়ে বসে নিজের প্লেট টেনে নেয়।একটা নাটুকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“এমনিতেই এতো লেইট হয়ে গেলো তার উপর নিজেই নিয়ে খেতে হচ্ছে! কেউ আমাকে ভালোবাসে না এই বাড়িতে”
পাশেই বসা মাইশা,পাউরুটিতে জ্যাম মিশাতে মিশাতে,মুখ বাকিয়ে বলে,
“তোর জন্য তোকে ভালোবাসার লোক দেশে আসবে,,তারপর নিজের হাতে খাইয়ে দিবে।”
লিয়ানা চোখ বড় বড় করে তাকায়,
“কি বললি?! কে আসবে?”
“বলবো না,যা ভাগ তবে আমার বানানো কেক খেলে বলবো!”
“ওহ প্লিজ,,,তুই যেই ফালতু মার্কা কেক বানাস তা আমার জানা আছে।চিনির বদলে এক গাদা লবণ দিয়ে বসে থাকিস। এখন না নাটক কম কর! অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমার সময় নাই!”- বলে লিয়ানা মুখ গুঁজে খেতে থাকে।
এইসময় রান্নাঘর থেকে নাফিসা খান তড়িঘড়ি করে,শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছত আসেন ফোন হাতে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু সিরিয়াস গলায় বলে উঠেন,

“তোরা একটু চুপ কর তো,একটা ফোন এসেছে বিদেশি নাম্বার থেকে।”
নাফিসা খানের এহন কথায় টেবিলে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নামে। শুধু টিভির শব্দটা নিচু ভলিউমে বাজে।সকলে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে নাফিসা খানের দিকে।তিনি হ্যাঁ-হুঁ করে কিছু কথা বলেন, তারপর হঠাৎ যেন চমকে ওঠেন
“সত্যি? তুমি কি জায়ান এর বন্ধু বলছো?”
তারপর একটু পরে নাফিসা খান এর কণ্ঠে এমন উচ্ছ্বাস ভেসে আসে যা সচরাচর শোনা যায় না।
“আল্লাহর শুকরিয়া! অবশেষে আমার ছেলেটা ফিরছে! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সবাইকে বলি,আমরা অপেক্ষা করছি!”
কল শেষ করে নাফিসা খান ঘুরে দাঁড়ান। মুখে অদ্ভুত এক আলো। চোখদুটো চিকচিক করছে।
“জায়ান আসছে! ইমারজেন্সি ফ্লাইটে কাল রাতেই দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।আজকেই চলে আসবে আমাদের মাঝে!’

খান বাড়ির মধ্যে যেনো মুহূর্তেই ঝড় বয়ে গেলো।
দাদির যেনো এক মুহূর্তে ১০ বছর বয়স কমে এসেছে তিনি এতদিন তার বড় নাতির জন্যে দোয়া করে এসেছেন যেনো মৃত্যুের আগে একবার হলেও নাতির মুখখানা দেখে মরতে পারে
“আমার জায়ান! ফিরছে? আল্লাহ্! আমার মোনাজাত কবুল হয়েছে..”ঐইরে কেউ মোল্লা বাড়ির মসজিদে মিষ্টি পাঠানোর ব্যবস্তা কর।
মাইশা আর আরিশা ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠে
“কিহ!জায়ান ভাইয়া আসছে অবশেষে!”
তবে লিয়ানা?সে তো ততক্ষণে টেবিলের ও-পাশে খাওয়া শেষ করে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে কলেজের উদ্দেশ্যে।
“আমি দেরি করে ফেলেছি! সবাইকে বাই!”
মেয়েটা জানতেই পারলো না,আজ যে ফোনটা এলো খান বাড়িতে, তা তার জীবনের গতিপথ বদলে দিবে।

বাড়ির প্রত্যেকটা ঘর ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে।দাদির মুখে হাসি থামছে না।নাফিসা খান কিচেনে জায়ানের পছন্দের খাবার বানাচ্ছেন,
খিচুড়ি, রোস্ট, চিংড়ির মালাইকারি।আর জায়ানের রুম?একটা রুম দশ বছর ধরে ঠিক তেমনই আছে।নাফিসা খান নিজের ছেলের রুমের কিছু পরিবর্তন করাননি,।সেই রুমটাও যেন অপেক্ষা করছে।তবে সবার অপেক্ষার পালা শেষ।ঝকঝকে কালো রঙা বি এম ডাব্লিউ গাড়ি এসে থামে খান বাড়ির বিশাল গেটের সামনে।গাড়ি থেকে নামা পায়ের শব্দ শোনা যায়।জায়ান খান দীর্ঘ দশ বছর পর ফ্রান্স থেকে দেশে এসেছে,চলে গিয়েছিলো রাগ করে সারাজীবন এর জন্যে তবে হঠাৎ করে দেশে আসতেই হলো।উচ্চতা আগের চেয়ে আরও বাড়তি, ফর্সা শার্প চেহারার মধ্যে গভীরতা। চোখজোড়া অন্ধকারে দীপ্তি ছড়ায়।দেখতে আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর সুদর্শন হয়েছে।বাড়িতে ঢুকতেই সবার চোখ যেন স্থির হয়ে গেলো । ভারী পায়ে, ধীর কিন্তু অনমনীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো জায়ান খান। এতবছর পর আজ সে বাড়ি ফিরেছে, খান বাড়ির চৌকাটে পা ফেলেছে,কিন্তু তবু যেনো তার চোখে কোনো শিথিলতা নেই। যেন এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল তাকে চিনে, জানে,কিন্তু সেও তাদের প্রতি নির্লিপ্ত, নিরাবেগ।সবার কণ্ঠে অভ্যর্থনা, আবেগ তবে তার চোখ কাউকে খোঁজে।

লিয়ানা।
সে নেই।
তার ঠোঁট শক্ত হয়, চোয়াল টাইট।কিছুক্ষণ সকলের দিকে তাকিয়ে থাকে।নাফিসা খান জায়ানের কাছে আসতে চাইলেন, তবে জায়ান দু পা পিছিয়ে যায়।একটা মুহূর্ত চুপচাপ কাটিয়ে, সে হঠাৎই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
“বাড়ির বড় মেয়েটা কোথায়?”
তার গলা এতটাই ধারালো আর ভারী ছিলো যে মুহূর্তে ঘরে নেমে এলো একটা ঠান্ডা ছায়া। কেউ সাহস করছিলো না প্রথমে উত্তর দিতে।শেষমেশ লিয়ানার ছোট বোন মাইশা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ও মানে..আপু কলেজ শেষে ওর বান্ধবীর জন্মদিনে গিয়েছে ভাইয়া। একটু আগেই গিয়েছে, এখনই চলে আসবে।”
এই কথাটা শুনেই জায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তার চোখে একরকম অগ্নিদৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে টান, কণ্ঠে রুদ্ধ হাওয়া।সে দাঁড়িয়ে থেকে, চারপাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,

“আমি নাই বলে সবার সাহস অনেক বেড়ে গিয়েছে দেখেছি।”
তার মা নাফিসা খান কিছু বলতে যাবে, কিন্তু জায়ান তখনই উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
“আর একটাও কথা না! বাড়ির বড় মেয়ে কোথায় আমি জিজ্ঞেস করেছি, অজুহাত না!”
তার কণ্ঠে কোনো চিৎকার না থাকলেও এমন এক শীতল রাগ ছড়িয়ে পড়লো যে কারো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। তারপর মাথা নিচু করে জায়ান মৃদু গলায় বললো,
“এই বাড়িতে আমি যখন ছিলাম, কেউ এতটা সাহস দেখাতে পারতো না।”

মাইশা চুপ করে যায়, সবাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জায়ান আর কিছু না বলে সোজা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।গেট পেরিয়ে এসেই সে যা খুঁজছিলো, তা না পেয়ে আজ যেনো তার অস্থিরতা, হতাশা আর ক্রোধ একসাথে ছুঁড়ে দিল চারপাশে।তার চোখে ভয়ঙ্কর এক অন্ধকার খেলা করে।রাত নেমে এসেছে। ছাদের কিনারাগুলো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, আর চারপাশটা যেন নিস্তব্ধ এক ভয়। রাগ, অস্থিরতা আর এক ধরনের অজানা তীব্র আকর্ষণ,সব একসাথে তার রক্তে ফুটতে শুরু করেছে।একবার মোবাইল চেক করে,কোনো ফোন, কোনো বার্তা নেই। কপালের শিরাগুলো টনটন করছে। তারপর সে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়ায়।

“Enough!”
নিজের নামের মতোই,ধ্বংসের মতো প্রবল সিদ্ধান্ত নেয় জায়ান।নিজের রুমে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে না করে,গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে পড়ে ।তার চোখ যেনো রাস্তার আলো গিলে নিচ্ছে।গাড়ি ছুটছে, শেষমেশ লিয়ানা কোথায় গেছে, তার খোঁজ বের করেই ছাড়ে ।প্রায় ত্রিশ মিনিট পর, এক ছিমছাম, উজ্জ্বল আলোয় মোড়া বাড়ির সামনে থামে তার গাড়ি।ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের শব্দ, হাসাহাসি আর কেক কাটার আওয়াজ।জায়ান গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে, মুখে কোনো ভাবনা নেই,শুধু চোখ দুটো রক্তিম লাল । চোখ ঘুরে দাঁড়ায় এক জায়গায়।
লিয়ানা লাল গ্রাউন, খোলা চুলে, কানে ঝুমকা, দাঁড়িয়ে হাসছে।আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলে,হয়তো তার বান্ধবীর ভাই,হাতের গ্লাসে সফট ড্রিঙ্কস, খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে ।কিন্তু জায়ানের চোখে আর কিছুই পড়ে না।সে শুধু দেখে, লিয়ানা, অন্য একজনের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে,এই মেয়ের এত সাহস দেখে মাথার চুল খামছে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে।পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিজলি চমকের মতো ধেয়ে যায় জায়ান।পার্টিতে উপস্থিত সকলে তাকায় জায়ানের দিকে,কেউ কেউ কানাঘেষা শুরু করে দেয়।কিন্তু জায়ানকে কেউ কিছু বলার সাহস করে উঠে না।জায়ান এগিয়ে যায় লিয়ানার দিকে।

এক পা, দুই পা
লিয়ানা ঘুরে তাকায় গলা উঁচিয়ে জায়ানের চোখে চোখ মিলায়।আর ঠিক সেই মুহূর্তে,একটা তীব্র চড় তার গালে এসে পড়ে।
আশেপাশে সব নিস্তব্ধ।সবাই হতবাক।
লিয়ানা গালে হাত রেখে চিৎকার করে ওঠে,
“জায়ান ভাইয়া!”
লিয়ানা হতভম্ব। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটার দিকে,যার রাগে চোখ এখন অগ্নিময়, আর গলায় বরফশীতল হুকুম।
“আমাকে ওয়েলকাম করতে তো তোকে পেলাম না।তাই এইটা তোর ওয়েলকাম থাপ্পর গিফট হিসেবে নে।”
সবার সামনে, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জায়ান লিয়ানার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায়।
“ভাইয়া প্লিজ ছাড়ুন! সবাই দেখছে!”

“চুপ!” আশপাশে না দেখে বাসায় চল কি কি দেখতে পারিস তা আমিও দেখবো।”
জায়ানের গলা এতটাই কাঁপা, যেন এই মুহূর্তে সে কাউকে ছিন্ন করে ফেলবে।সবাই সোজা দাঁড়িয়ে, চোখ বড় করে দেখছে, কেউ কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না।তারপর জায়ান জোর করে লিয়ানাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।গাড়ির দরজা ধুপ করে বন্ধ হয়ে যায়।লিয়ানা চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে আছে জানালার বাহিরে, বোঝে উঠতে পারছে না কেন জায়ান ভাইয়া দেশে এসেই তার সাথে এমন করলো, ইনি কখনি বা এলেন।কি করেছে সে। আর জায়ানের চোখ তার দিকে নয়,সে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকার রাস্তায়, ঠোঁট কামড়ে।
“এইসব নাটক কেন করিস আমার সাথে??”
তার কণ্ঠ নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে।

“তুই জানতি না, আমি ফিরছি, বল জানতি না?নাকি চাসনি আমি ফিরি?”
লিয়ানা জায়ানের দিকে না তাকিয়েই কাঁপা গলায় বলে,
“আমি জানতাম না, সত্যি জানতাম না ভাইয়া,বিশ্বাস করুন।”
“আমি তোর ভাই না!”
গাড়ির ভেতর বজ্র নেমে পড়ে যেন।এ কেমন কথা।
দাত কিরমির করে শক্ত গলায় জায়ান বলে উঠে
“আর একবার ভাই বললে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো”

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here