তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ২০
ভূমিকা তালুকদার
জায়ান গাড়ি থেকে নেমেই একদম সোজা ভেতরের দিকে হাঁটা শুরু করল। কারও দিকে তাকালো না।জায়ানকে দেখে ভিতরে থাকা গেস্টটা অভিনন্দন জানালো, কেকেউ কেউ মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো, তবে কেউ তার সাথে কোশল বিনিময় করলো না,আর না করলো হেন্ডশেক,কেননা,জায়ান এর এইসব পছন্দ না। বরাবরের মতোই নির্বিকার, কারও দিকে তাকালো না, কোনো সৌজন্য বিনিময় করল না। সবাই জানে, তার কাছ থেকে এসবের আশা করাই বৃথা।
লিয়ানা এদিকে ভারী গাউন সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলো। গাড়ি থেকে নামার পর যখন দেখলো জায়ান তাকে ফেলে রেখেই ভেতরে ঢুকে গেছে, মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল তার। ঠিক তখনই পিছনের গাড়ি থেকে নেমে এল নাদিয়া। দ্রুত পা বাড়িয়ে লিয়ানার কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে নিল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চলো
লিয়ানা জায়ানের উপর রাগ করে জোর করে হলেও এক চিলতে হাসি দিলো। নাদিয়ার হাত ধরে, গাউন সামলে, সে ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলো। পেছনে বাজতে থাকা মিউজিক আর চারপাশের আলোয় তাদের দু’জনকে একসাথে ঢুকতে দেখে অতিথিদের চোখ অনায়াসেই সেদিকে গিয়ে থামলো।পার্টির হলঘরটা আলো ঝলমল, চারদিকে শুধু নামী-দামী মানুষ। দেশের, বিদেশের বড় বড় ব্যক্তিত্ব সবাই আমন্ত্রিত। সবাই সবার চেনা, পরিচিত মুখ। অথচ, তাদের দৃষ্টি একসাথে গিয়ে আটকাল এক জায়গায়।
লিয়ানা।
গাঢ় কালো গাউন পরা, বয়সে খুবই অল্প। এত বড় আয়োজনে এমন কচি মুখ দেখে সবার ভেতরে কৌতূহল জাগলো। বিদেশে তো আঠারো-উনিশ বছরের ছেলেমেয়েকে এখনো টিনএজ ধরা হয়। সেই হিসেবেই লিয়ানাকেও সবাই সেভাবেই দেখছিলো। একে অপরের সাথে ফিসফিস করে বলাবলি শুরু হলো—
—কে এই মেয়ে?
—দেখতে তো বাঙালির মতোই লাগছে।
—হয়তো কোন স্পেশাল কেউ।
চোখের মনি বাদামি রঙ, ত্বক ধবধবে ফর্সা,যেভাবে লিয়ানা সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তার ভেতরের লাজুকতা লুকালেও, বাইরের আভায় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো।
একজন ফিসফিস করে বলল—
যেহেতু জায়ান খানের পার্টি, আর মেয়েটিও স্পষ্টই বাঙালি, তবে নিশ্চয়ই জয়ান খানের নিজের কেউ হবে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন ঠোঁটে চাপা হাসি টেনে বলল—
জায়ান খানের পরিবার আছে,এমন কথা তো আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি। তিনি নিজেও কখনো প্রকাশ করেননি। আদৌ কিছু আছে নাকি নেই,কে জানে!
এই রহস্যময় কৌতূহলের ভেতরেই লিয়ানার দিকে সবার চোখ নিবদ্ধ হয়ে রইলো। যেনো অচেনা অথচ অবধারিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র হঠাৎ করে প্রবেশ করেছে তাদের জগতে।সবার দৃষ্টি যখন তার দিকে স্থির হয়ে রইলো, লিয়ানার বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি দানা বাঁধল। যেন চারপাশের আলো, মানুষজন, সবার কৌতূহলী চোখ তাকে হঠাৎ আরও ছোট্ট করে ফেলল। অথচ তার স্বামী?
জায়ান খান!
পার্টিতে এসে একবারও যেনো তাকে খেয়াল করার ফুরসত নেই। মুখ গম্ভীর করে বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে চলেছে, যেন এটাই তার আসল পৃথিবী। লিয়ানা মনের ভেতর গজগজ করল—
থাক, আমি নিজে থেকেও ওনার কাছে যাবো না। না হলে উল্টো ওনার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে আমাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে পার্টি থেকে। পুরো পার্টি মুড নষ্ট হবে।
এমনটা ভেবেই লিয়ানা ধীরে ধীরে একা একা চারপাশে তাকাতে শুরু করলো। কিন্তু তখনই খেয়াল করলো, নাদিয়াও তাকে ছেড়ে সরে গেছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে এক ফরাসি মেয়ের সঙ্গে আড্ডায় ব্যস্ত।
এদিকে চারদিকে সবার হাতে দামি হুইস্কি, ওয়াইন কিংবা বিদেশি বিয়ার। হাসাহাসি, গল্প, ঠাট্টা চলছেই। অথচ লিয়ানার হাত শূন্য। কোণের এক পাশে এসে চুপচাপ বসে রইলো সে।
কার সঙ্গে বা কথা বলবে? ইংরেজিই তো বলতে পারে না, ফরাসি তো আরও দূরের কথা। তাই মুখ বন্ধ করে বসে থাকাই এখন নিরাপদ ভাবছে।
কিন্তু এই নীরবতা! এই চুপচাপ বসে থাকা,এটা একেবারেই তার স্বভাব নয়। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগতে শুরু করলো। কতক্ষণ আর এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যায়!সে তো বাচাল, মুখ না খুলে কি থাকা যায়?মুখে যদিও কোনো কথা নেই, চোখেমুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো, ভেতরে ভেতরে লিয়ানা টগবগ করে ফুটছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ এলেনা মাইকে ঘোষণা দিল—
এবার শুরু হবে Ballroom Dance!
বলার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল হলঘরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মুহূর্তেই মাথার ওপর থেকে নামতে লাগল রঙিন আলো, মিউজিক বদলে গিয়ে বাজতে লাগল ধীর, রোমান্টিক সুর।
সবাই যেন এই মুহূর্তটার অপেক্ষায়ই ছিল। যে যার মতো সঙ্গী বেছে নিয়ে ফ্লোরে নামলো। মার্কো হাত বাড়িয়ে নাদিয়াকে টেনে নিল কাছে, আর নাদিয়া হেসে তার বাহুতে জায়গা নিলো। এদিকে এ্লেক্স আর এলেনা একসাথে জুটি বাধলো,চোখাচোখি, হালকা ঘূর্ণন, পুরোপুরি সিনেমার দৃশ্যের মতো। একে একে প্রায় সবাই নাচে মেতে উঠলো।
কিন্তু দু’জন বাদে
এক কোণে বসে থাকা জায়ান আর অন্য কোণে দাঁড়িয়ে থাকা লিয়ানা
জায়ানের হাতে হুইস্কির গ্লাস। ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে চলেছে, ঠোঁটে একফোঁটা হাসি নেই। আর লিয়ানা? তার চোখ জুড়ে শুধু একটাই প্রশ্ন,এ কেমন স্বামী?চারপাশে এত রোমান্টিক পরিবেশ, সবাই জুটিতে মগ্ন, অথচ সে একা দাঁড়িয়ে আছে।মনে ভীষণ কষ্ট জমে উঠল তার। চোখে জল আসার উপক্রম। তবুও একবার সাহস করে তাকালো জায়ানের দিকে,হয়তো সে আসবে, হয়তো একটিবার হাত বাড়াবে।কিন্তু ঠিক তখনই জায়ান মুখ ফিরিয়ে নিলো। যেনো ইচ্ছে করেই। হুইস্কির গ্লাস ঠোঁটে তুলল আর পুরো শরীর ঘুরিয়ে নিলো অন্য দিকে।
লিয়ানা বুঝে গেল,জয়ান সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ইগনোর করছে। চোখের দৃষ্টি, ঠোঁটের বাঁক,সবকিছু দিয়ে যেন জায়ান জেনে শুনেই তাকে ভেঙে দিতে চাইছে।সেই মুহূর্তে, রঙিন আলো আর স্লো মিউজিকের ভেতরেও লিয়ানার বুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো।এলেনা কিছুক্ষণ চুপচাপ জায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলো লিয়ানার দিকে।জায়ান কেন লিয়ানার কাছে আসছে না,তা এলেনা খুব ভালো করেই জানে।ওরা সবাই জানে।
এলেনা ঠোঁটে এক চিলতে বাঁকা হাসি আনলো।জায়ানকে সে আগেও পছন্দ করত, এখনো করে।কখনো মুখে স্বীকার করেনি, কিন্তু তার আচার,আচরণ, দৃষ্টি,সবই অন্যরা বুঝে যেতো।তবে লিয়ানার অস্তিত্ব এলেনার অজানা ছিলো না। তবু কেনো,যেনো জায়ানের ব্যক্তিত্বের প্রতি তার আকর্ষণ কোনোদিন কমেনি।অনেকবার চেষ্টা করেছে জায়ানের কাছে যেতে, কাছে টানতে।
কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।জায়ান কখনো পাত্তা দেয়নিভালোবাসা তো দূরের কথা, কোনোদিন নরম কোনো অনুভূতিও দেখায়নি।তবু কাজের স্বার্থে, সম্পর্কের কারণে মুখে কিছু বলতো না,আর না এলপনা সাহস পেতো।
কিন্তু,ভালোবাসাকে কি এত সহজে অন্য কারোর সাথে সহ্য করা যায়?
যাকে আপনি চান, তাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে,সেটা মেনে নেওয়া কি সম্ভব?ঠিক এই কারণেই লিয়ানা ছিলো এলেনার চোখের কাঁটা।
এবার এলেনা ধীরে ধীরে ডান্স ফ্লোর থেকে সরে এলো।
তার হাতে হুইস্কির গ্লাস।
একটা হাতে নিয়ে সোজা লিয়ানার দিকে এগিয়ে গেলো।
এই নাও, তোমার জন্য,
হাসি মুখে গ্লাসটা এগিয়ে দিল এলেনা।
লিয়ানা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকালো।
এত মিষ্টি করে হঠাৎ কথা বলছে কেন ওনি?
মনে মনে প্রশ্ন করল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
শুধু হেসে বলল,
না আপু, আমি খাবো না। এসব আমি খাই না,কোনোদিন খাইনি। তোমিই খাও।
আরে এটা তো মদ নয়।
তাহলে কী?
সাধারণ ড্রিঙ্কস। আমি কি তোমাকে মদ খাওয়াবো নাকি? পরে জায়ান জানলে আমাকেই তো বকাঝকা করবে।
লিয়ানা একটু থমকালো।সে সরল মন, সহজ বিশ্বাসী।ভাবল,যেহেতু এলেনা আপু বলছে, তাহলে নিশ্চয়ই মদ নয়।মনে মনে দ্বিধা থাকলেও হাসিমুখে গ্লাসটা হাতে নিল লিয়ানা।তারপর এক ঢোঁকে পুরোটা খেয়ে নিল। খেতেই মাথাটা কেমন যেনো ঝিম ধরে উঠলো, দুনিয়াটা একটু দুলে উঠল তার চোখের সামনে। এলেনা সুযোগটা হাতছাড়া করল না,ঝটপট আরেকটা গ্লাস এগিয়ে দিল।কেমন যেন অচেতন ভঙ্গিতে লিয়ানা সেটা নিয়েও খেলো। তারপর আরেকটা, আবার আরেকটা। চার গ্লাস নামিয়ে দেওয়ার পরেই এলেনা দুষ্টু হাসি দিলো, চোখে যেনো শয়তানি ঝিলিক। নিজের কাজ শেষ করে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ভিড়ের মধ্যে হেটে চলে গেলো সে।অন্যদিকে লিয়ানার শরীর তখন সম্পূর্ণ ভেসে গেছে মদের ঝড়ে। মাথাটা দুলছে, চোখ আধো ঝাপসা, পা টলমল করছে। কোনো রকমে ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল সুইমিং পুলের ধারে।
চারপাশে তাকিয়ে একবার, দু’বার,খুঁজতে লাগলো জায়ানকে। কোথাও নেই।দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না আর। মনে হচ্ছিল, এখনই বুঝি পড়ে যাবে পানির ভেতরে। ঠিক তখনই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল এক ফরাসি পুরুষ,অচেনা, অপরিচিত, আর লিয়ানার ঝাপসা চোখে আরও রহস্যময়।লোকটার দৃষ্টি ভয়ানক খারাপ। বাজে নজরে লিয়ানার দিকে তাকিয়ে আছে। লিয়ানার চোখ তখন আধো ঝাপসা,মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবুও সে ভয়ে এক ধাপ পিছিয়ে গেলো। লোকটা বুঝতে পারল লিয়ানা বিদেশি, এই দেশের না। তাই ইংরেজিতে তার নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলো, সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো।লিয়ানা পিছোতে লাগলো,একের পর এক।
ঠিক তখনই মাথা ঘুরে ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো। মুহূর্তের মধ্যে সামনে এসে দাঁড়ালো জায়ান। এক হাতে লিয়ানাকে শক্ত করে ধরে দাঁড় করালো, আরেক হাতে ঝটকা দিয়ে লোকটার কব্জি চেপে ধরলো।জায়ান দূর থেকে লিয়ানাকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছেছিলো। কিন্তু এমন দৃশ্য চোখে পড়তেই তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছে।
এক নিমিষে সজোরে ঘুষি মারলো লোকটার নাক বরাবর। তীব্র আঘাতে লোকটার নাক ফেটে রক্ত ছিটকে পড়লো। সে সামলে উঠবার আগেই জায়ান কলার চেপে ধরে প্রচণ্ড গর্জে উঠলো,
Son of a bi*tch! How dare you? She is my wife!
জায়ান খানের বউ সে।
সাহস হলো কীভাবে ওকে স্পর্শ করতে চাওয়া।
চোখ লাল, মুখ রক্তিম, জায়ান যেন মুহূর্তেই আগুন হয়ে উঠলো।
কু*ত্তার বাচ্চা! তোকে এখানেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলব!
চারদিকের অতিথিরা হইচই ফেলে, নিজেদের পার্টি থামিয়ে এখন ভিড় করে জড়ো হয়েছে সুইমিং পুলের পাশে। সকলের দৃষ্টি এখন জায়ান আর সেই ফরাসি ছেলেটার দিকে।জায়ান যেনো বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠলো। এতদিন যে মানুষটা নিজের বিয়ের খবর আড়ালে রেখেছে, যে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেও কাউকে পরিচয় করায়নি,সে-ই হঠাৎ করে সবার সামনে সিংহের মতো দাঁড়িয়ে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে উঠলো। তার গলা যেন বাজছে, সে আমার বউ! জায়ান খানের বউ!
যেনো রাজ্য রক্ষায় সিংহ গর্জে উঠছে। মুহূর্তেই হলঘর কেঁপে উঠলো জায়ানের চিৎকারে।
চারদিক থেকে অতিথিদের ফিসফিসানি ভেসে আসতে লাগলো। সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে, বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে।
ওই ছোট্ট মেয়েটা নাকি জায়ান খানের বউ?
অসম্ভব! এতো বাচ্চা বয়স।
সুন্দর তো বটেই, কিন্তু ওনার মতো ফেমাস বড় মাপের মানুষ এমন কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলো?
তাদের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত, এমনকি কিছুটা হাস্যকরও লাগলো। কারণ এই দেশে তো এত অল্প বয়সে বিয়ে হয় না, ওদের সংস্কৃতিতে এটা একেবারেই অচিন্তনীয়।তার ওপর লিয়ানা তখন টলমল করছে, চোখ আধো বুজে, মাতালের মতো দাঁড়িয়ে। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে, আর ফিসফিসিয়ে গসিপ ছড়াতে লাগলো মুহূর্তের মধ্যে।তবে জায়ানের এমন রেগে যাওয়া নতুন কিছু না । এর আগেও কতবার রাগের মাথায় কতজনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে সে,এই খবর সবার কাছেই শোনা। তাই আজকের এই বিস্ফোরণ যেনো,তাদের কাছে বিয়ের ব্যাপারটাই অকল্পনীয়।জায়ানের চোখে তখন শুধু আগুন। অনবরত ঘুষি বর্ষণ করছে লোকটার মুখে। চারপাশে কেউ তাকে থামানোর সাহস করছে না। লোকটা হাত জোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে, কিন্তু জায়ান থামছে না। এক পর্যায়ে সে লোকটাকে মাটিতে ফেলে তার গলার ওপরে পা চাপিয়ে দেয়,,নিজের পা দিয়ে গলা পিষে ধরে । যার ফলে গলা আর নাক বেয়ে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।এই দৃশ্য দেখে লিয়ানা ভয়ে মুখ চেপে ধরলো। মাথায় ঠিকঠাক কিছু কাজ করছিল না, শুধু ডুলতে ডুলতে জায়ানের কাছে এসে কাঁপা হাতে তার শার্টের কোনা ধরলো। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললো,
ছাড়ুন,মরে যাবে তো।
জায়ান লোকটাকে এক লাথি মেরে সোজা সুইমিং পুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। চারপাশের জল ছিটকে উঠে। তারপর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে লিয়ানার দিকে তাকায়। মুহূর্তেই তার হাত বাড়িয়ে লিয়ানার গাল শক্ত করে চেপে ধরে গর্জে উঠে
তোর সাহস হলো কীভাবে এসব খাওয়ার? আমার কাছ থেকে একবারও অনুমতি নিয়েছিস? তোর এই সাহস দেখে মনে হয় নিজের গালেই নিজে থাপ্পড় মারি।
লিয়ানা তখনো আধো মত্ত, আধো হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
আরে কিছুই তো খাইনি,একটু জুস খেয়েছি, একদম রাগবেন না।
কথাটা শেষ করার আগেই তার মাথা ঘুরে গেলো। ধীরে ধীরে মাথাটা হেলে পড়লো জায়ানের বুকের ওপর। জায়ান একটুও দেরি না করে তাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। চারপাশের মানুষদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে সোজা বড় বড় পদক্ষেপে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলে ভিতরে বসে গেল লিয়ানাকে আঁকড়ে ধরে।গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
ঠিক তখনই দূরের অন্ধকার কোণের ধূসর আভায় বসে আছে এক অচেনা লোক। এক হাতে ওয়াইনের গ্লাস, অন্য হাতটা চেয়ারের হাতলে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, স্থির।পাশে থাকা কারও সাথে নয়, নিজের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে, প্রায় ফিসফিসের মতো গলায় সে বলে ওঠে,
“জয়ান খানের ওয়াইফ,ভেরি interesting।
রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়ির ভেতরটা যেন আলাদা এক পৃথিবী হয়ে গেছে। বাইরের আলো-আঁধারির ছায়া জানালার কাঁচ বেয়ে ভেতরে ঢুকছে, আর গাড়ির হালকা স্পিডে সবকিছু ছুটে যাচ্ছে পেছনে।জায়ানের কোলের উপর আধশোয়া লিয়ানা মাথা রেখেছে তার কাঁধে। চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে শার্টের উপর, তার হালকা নিঃশ্বাস যেনো বুকের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে। চোখদুটো অর্ধেক বুজে, সে যেন এক মায়াবী তার দুনিয়ার ভেতরে ডুবে আছে।কখনো সে চাপা হেসে উঠে জয়ানের বুকের কাছে ঠেসে ধরে বলে,
আপনি জানেন, ছোটবেলায় আমি ভাবতাম ঐ যে চাঁদ, ওখানে একটা চাঁদের বুড়ি থাকে।হি হি চাঁদে বুড়ি।
জায়ান নিঃশব্দে স্টিয়ারিংয়ে এক হাত রেখে গাড়ি চালাচ্ছে, অন্য হাতটা লিয়ানার হাত ধরে রেখেছে। মুখে কোনো কথা নেই, শুধু চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। লিয়ানার এলোমেলো কথাগুলো তার কানে যেন সঙ্গীতের মতো বাজছে।গাড়ির ভেতর শুধু ইঞ্জিনের হালকা শব্দ আর লিয়ানার ফিসফিস করে বলা আবোল-তাবোল কথা। আর জায়ান, যেন রাতের এই দীর্ঘ পথ আর লিয়ানার এই নির্ভেজাল সরলতা দুটোই বুক ভরে শুনছে।গাড়ি এসে থামল শ্যাডো এম্পায়ারের ভেতরে। রাতের ভারি নীরবতায় কেবল গাড়ির দরজা খোলার শব্দটা বাজল। জায়ান কোনো কথা না বলে লিয়ানাকে আবার কোলে তুলে নিলো। এক হাতে বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো।
লিয়ানা আধমাতাল হাসিতে ফেটে পড়ে খিলখিল করতে করতে বলে উঠে,
Ohh noo! আপনি কি জিম করেন? এত হট বডি কেমন করে হলো? এসব আমায় টানে
সে আবারও হেসে জায়ানের ঠোঁটে হাত রেখে ফিসফিস করে—
হি হি,pink lipss, pink lipsss।
বারো বছর ধরে যে সিগারেটে ঠোঁট জ্বলে গেছে, সেই ঠোঁট পিংক হলো কেমন করে? মদের ঘোরে যা মুখে আসছে, সব বলে যাচ্ছিস নাইস।
আমায় উল্টোপাল্টা কিছু করতে বাধ্য করিস না। নাহলে কাল সকালে হ্যাংওভার কেটে গেলে আমাকেই গালি দিবি,কাঁদবি।
না না, কী করবেন, আমিও দেখবো।
তাই নাকি?
হুম্মমমমমমম
জায়ান হঠাৎ লিয়ানার নাকে নাক ঘষে ফিসফিস করে,
আমি তো রোমান্সের কথা বলছিলাম।
রোমান্স আবার কী? খায় নাকি মাথায় দেয়?
কি সেটা শিখাইতে তো বিয়ে করলাম।
খাওয়া গেলে বলুন,খিদে পেয়েছে। ফুচকা খাবো!
এটা কি বাংলাদেশ নাকি? ফুচকা কোথায় পাবো এখানে?
লিয়ানা হেসে আবার বলল,
আপনি যদি ফুচকাওয়ালা হতেন, কত ভালো হতো, আমার বান্ধবী মেরিন কে ঝালমুড়িওয়ালার সাথে বিয়ে দিতাম তারপর দুজনে ফ্রি ফুচকা আর ঝালমুড়ি খেতে পারতাম।
Rubbish! কান ধরে গালে একটা কষিয়ে চড় দিলেই নেশার ঘোর কেটে যাবে। তোর এইসব শুধু সহ্য করছি, কারণ তুই আমার বউ। না হলে মুখে স্টেপলার মেরে চুপ করিয়ে দিতাম। চিনিস আমি কে?
হ্যাঁ, চিনি তো,আপনি আমার জায়ান,without য়া
জান বলছিস??জানের অধিকার চাই আমি।
লিয়ানা কিছু বলার আগেই জায়ান ধীরে ধীরে লিয়ানাকে বেডের উপর বসালো।তারপর বেড থেকে সরে যেতে নিলে,লিয়ানা জায়ানের হাত ধরে নেয়।
যাবেন না, আমার ভয় করে, অন্ধকারে।
জায়ান একটু এগিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
তোর জীবনের বড় অন্ধকারটাই তো আমি। যতদিন নি:শ্বাস থাকবে তোর
এ অন্ধকার নিয়েই থাকতে হবে তোকে।
মূহুর্তের মধ্যেই জায়ান বিছানায় বসে লিয়ানাকে টেনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়।
কি চাস তুই??
সকাল হলেই তো সবকিছু ভুলে যাবি।
আমায় পেইন দিস না আর সুইটহার্ট।
লিয়ানার গাল শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট নিঃশব্দে লিয়ানার শরীর এর থেকে ভেসে আসা গ্রাণ অনুভব করলো।আর ভাবছে একটু ওয়াইন খেয়ে ছে এই মেয়ে আর মাতাল করছে তাকে।
তবে লিয়ানা এইবার তার মাথার হেয়ার ক্লিপ খুলে ফেললো। হালকা দারালো সেই ক্লিপ অন্ধকার রুমে চিকচিক করতে থাকে।পরের মুহূর্তে লিয়ানা জায়ানের ব্লেজার খুলে,শার্টের বোতামগুলো খুলে দিলো। জায়ান তার হাত দিয়ে লিয়ানার হাত ধরলো, কিন্তুু সে আঙ্গুল রাখলো জায়ানের ঠোঁটে,তারপর টোপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো। জায়ানের উ*ন্মুক্ত বুকে লিয়ানা হেয়ারপিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের নাম লিখলো। হালকা লাল দাগ জায়ানের ফর্সা বুকের উপর ভেসে উঠলো,কোনায় র*ক্ত জমে উঠেছে।
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৯
জায়ান কিছুই বলল না,না বাধাঁ দিলো। শুধু লিয়ানার প্রতিটি স্পর্শে অনূভব করলো।
যে হৃদয়ের ভিতর নাম খোদাই করা আছে, তা হৃদয়ের বাইরে লিখা মূল্যহীন।
❝তুই চাইলে ব্লেড/ছুরি/চাকু ইউস করতে পারিস।❞

21 episode