তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩
ভূমিকা তালুকদার
সকাল সকাল খান বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন আলো আর ব্যস্ততায় জেগে উঠেছে। ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত ডুপ্লেক্স “খান বাড়ি “নামই বলে দেয়, এখানে রুচি, ঐতিহ্য আর ক্ষমতার ছাপ মিশে আছে প্রতিটি ইট-পাথরে। বাইরে থেকে দেখতে সাদা আর মাটির রঙের এক মিশ্র রঙের ধাঁচে বানানো, যেখানে কার্ভড ব্যালকনি আর ভিতরে ঢুকলেই বিশাল ড্রইংরুমের মেঝেতে ইতালিয়ান মার্বেল, আর সিলিং থেকে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতি। দেয়ালে চোখে পড়ে জয়নালের আঁকা পুরনো পেইন্টিং, আর লম্বা সিঁড়ি ঘুরে ওপরে উঠলে দেখা মেলে পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত রুম।
এই সকালটা একটু বেশিই প্রাণবন্ত।
“টিং টিং টিং টিং টিং!”
গোলাপি কভার দেওয়া গোল ঘড়িটা একটানা চিৎকার করে চলেছে।
আরে গাধা ঘড়ি, একটু চুপ করবি?ঘড়িটাকে তো একদিন গুলি করে মারবো! সকাল সকাল কানের বারোটা বাজিয়ে দেয়।মন চায় লাথি মেরে উড়িয়ে দিতে।লিয়ানার কণ্ঠে ভরপুর বিরক্তি।যেনো ঘড়ির তীব্র অ্যালার্মে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।চোখ খুলেই রাগে মুখটা ফুলিয়ে ফেলে সে।মেজাজ খারাপ করে ঘুম ভাঙে লিয়ানার।গলা ভেঙে যায়, মুখে চুল এলোমেলো, চোখ আধবোজা।ঘড়ির উপর রাগ ঝারতে ঝারতে পাজামার গোঁড়া টেনে হেঁচড়ে বিছানা ছাড়ে।
হায় খোদা! আজ তো আমার টেস্ট এক্সাম!! আম্মু! আব্বুর বউ টাকে কাজের সময় পাই না।
বাথরুম এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মুখ ধুয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে, জামা খুঁজে—সব কিছুতেই হুলস্থুল। তারপর,রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখে সবাই ব্যস্ত। টেবিলে ব্রেকফাস্ট চলছে—পরোটা, ডিম, ফলমূল, আর সবার হাতে সোনালি মোড়কের চকোলেটের বাক্স।আরিশা, মাইশা আর রিহান—তিনজনেই বসার ঘরে বসে জায়ান ভাইয়া বিদেশ থেকে আনা গিফট নিয়ে খুশিতে আত্মহারা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিশা একটা সোনালি রঙের গিফটবক্স খুলে খুশিতে বলে উঠল,
মাই গড! ভাইয়া আমার জন্য “ডিউর লিপ বাম” এনেছে”
রিহান হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নতুন PSP টা দেখে বলল, ভাবতেই পারছি না জায়ান ভাই আমার জন্যো PS আনছে! এইবার আমার ফ্রেন্ডরা তো জেলাস হবেই হবে!
মাইশা আবার চকলেটের বক্স নিয়ে লাফাচ্ছে,আর বলছে, Belgium er truffle! খাইলে দেখিস, স্বর্গে চলে যাবি!সেই স্বাদ মধু মধু।
এমন আনন্দের মাঝেই নিচে এলো লিয়ানা। হাতে ফোন। সবার চোখ তখন তার দিকে।
আরিশা চোখ কুঁচকে বলল,
লিয়ু আপু, তোর জন্য কি আনছে ভাই, দেখি তো?
লিয়ানা ভুরু কুঁচকে ভেংচি কেটে বলল,
“হ্যাঁ, আমার জন্যও একটা দারুণ জিনিস এনেছে, থাপ্পড়।আয় এদিকে তোকে একটা মেরে দেখিয়ে দিচ্ছি কেমন।
তার কথা শেষ হতেই হাসিতে ফেটে পড়ল সকলে। এমন রসিকতা করতেই ওস্তাদ লিয়ানা। সে যতই ভয় পাক জায়ানের নাম শুনে, মুখের উপর কথা বলায় সে কখনও পিছু হটে না।খানিক পরেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন জায়ান খান। ধীর পায়ে, চোখে ঘুমঘুম ভাব। তার পায়ের নিচে মোটা কার্পেট, হাঁটার কোনো শব্দ নেই। নীল-ধূসর পোলো শার্ট, কালো ট্রাউজার, টেবিলে বসে সে এক দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে নিলো। সকলে নিজের আনন্দে মেতে থাকলেও সে যেনো কারো কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না। সকালের রুটিন মাফিক খাবার—অমলেট, বাটার-টোস্ট, ফ্রেশ জ্যুস—তার সামনে রাখা হল।
অন্যদিকে লিয়ানা হাতে রুটি মেখে ফোনে চোখ রাখল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, উফ! আজকে একটা পার্সেল আসার কথা আমার! কোথায় গেলো ওটা!
আরিশা জানতে চাইল, কি পার্সেল, আপু?
লিয়ানা বলল,” ফেইরি লাইট” অর্ডার করেছিলাম রুমে লাগাবো বলে। অনলাইন পেইজ টা খুব সুন্দর ছিল, আজকেই আসার কথা”
তখন হঠাৎ লিয়ানার ফোনে একটি নোটিফিকেশন এলো। চোখে তাকিয়েই কপাল চাপড়াল লিয়ানা।”মাই গড! ওই পেজটা নাকি “Unavailable” হয়ে গেছে? মানে আমি তো টাকা আগেই দিয়েছিলাম!হায় রেএএ কপাল পোড়া।
সে একটানা চেষ্টা করতে লাগলো কল করতে। কিন্তু সব নম্বরে শুধুই, number you have dialed is currently switched off।
এই চিটারগুলো বদমাশ এর দল আমার টাকা মেরে দিল! এক ঝাঁজে বলে লিয়ানা কেঁদে ফেললো।
লিয়ানার মা রুকসানা খান রাগে ফুঁসে উঠলেন, তোকে না বলি এসব পেইজে অর্ডার দিবিনা।ভালো হয়েছে একদম।
কিন্তু এই সবার মাঝেই জায়ান খান ছিল নিঃশব্দ, নিরুত্তর। যেন এই ছোট খাটো ঝগড়াঝাঁটি, হাসি-কান্না কিছুই তাকে স্পর্শ করছিলো না। সে নিজের কফির কাপটা তুলে এক ঢোঁক খেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে হাতে নিতে না নিতেই পেছন থেকে তার মা নাফিসা খান ডাক দিলেন—
জায়ান বাবা, একটুখানি দাঁড়া তো! লিয়ানাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আয় বাবা,এমনিতেই লেইট করে ফেললো মেয়েটা।
জায়ান মৃদু দাঁড়াল, একবার পেছন ফিরল। চোখেমুখে নির্লিপ্ততা।
বাড়িতে আরও অনেক গাড়ি আছে,,ওকে বলো, যেমনটা এতদিন যেত, আজও সেভাবেই যেতে ।
একটু দূরে থাকা লিয়ানা সেটা স্পষ্ট শুনে ফেলে। তার বুকের ভেতরটা যেন মুহূর্তেই কেঁপে উঠে। অভিমান গিলে ফেলে সে মাটির দিকে তাকিয়ে একটানা বলে উঠল-
বড়ো আম্মু, আপনার ছেলেকে লাগবে না আমাকে কলেজে পৌঁছাতে। আমি নিজেই চলে যেতে পারবো। ফরিদ চাচাকে বলব, উনি ড্রপ করে দেবেন। তাতে কারও দয়া লাগবে না।যত্ত সব আজাইরা ডং।
তার চোখে তখন একরাশ অভিমান, কণ্ঠটা ভেতর থেকে হালকা কেঁপে উঠছিল, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখল।জায়ান পেছন থেকে শুনে ফেলে সবটা। তার পা থমকে যায় এক মুহূর্তের জন্য। দাঁড়িয়ে থাকে একদম স্থির হয়ে।তার চোখ দুটো রাগে টকটকে লাল হয়ে ওঠে, যেন আগুন ছড়ায়। তবে সে কোনো কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে পড়ে।দরজার শব্দটা একটু বেশি জোরেই বন্ধ হয়, যেন অভিমানটা সেও ঠিক গোপন রাখতে পারছে না। গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জনে খানিকটা ধাক্কা খায় সকালের নিস্তব্ধতা।লিয়ানা দাঁড়িয়ে থাকে, ঠোঁট কামড়ে ধরে। তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।নাফিসা খান চুপ করে থাকে, কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। মুহূর্তটা ভারি হয়ে ওঠে।,,ফরিদ চাচা এক এক করে গাড়িগুলো বের করে আনছেন।
রিহান হাফ হাতা শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আসছে, হাতে ব্যাগ, পেছন পেছন বেরিয়ে এলো মাইশা, একহাতে চুল বেঁধে, অন্য হাতে ব্যাগ।আরিশা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল— স্কুল ইউনিফর্মে, চোখে রিমলেস চশমা।আর সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়। কেউই জানে না, লিয়ানার ভেতরে আজ কী ঝড় বইছে। জায়ানের সামনে নিজেকে ছোট মনে হওয়ার তীব্র যন্ত্রণাটা যেন প্রতিটা নিঃশ্বাসে পোড়াচ্ছে তাকে।
ফরিদ চাচা এসে গাড়ির দরজা খুলে দেন।
“চলেন,” মুচকি হেসে বলেন তিনি।
লিয়ানা একটাও কথা না বলে উঠে বসে। গাড়ি ছাড়ে।তারপর কলেজে যেতেই দেখলো প্রবেশদ্বারে ভীড়। লিয়ানা গাড়ি থেকে নেমে নিজের ব্যাগটা সামলে নেয়। সূর্যের আলো পড়ে তার চুলে একটা সোনালি ছায়া ফেলেছে। বাদামী চোখ,আর মুখে কোনো সাজ নেই— তবু তাকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় ভীড়ের ভেতরেও।তারপর লিয়ানা হলরুম বের করেই চলে গেলো এক্সাম দিতে।
তিন ঘন্টা পর এক্সাম হল থেকে বের হতেই হঠাৎ পেছন থেকে দু’জনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো— রিমা আর মেরিন।
হায়রে তোরে খুঁজতেছি,কই ছিলি,এত লেইট,বাসা থেকে বের হতে মন চায় না তাই না সোনা, নিজের কাজিনের প্রেমে পরে গেছিস নাকি?— মেরিন টিজ করে বললো।
লিয়ানা চোখ গোল করে বলল, কি বলিস এসব?ঐ আর্কিওপটেরিক্স এর প্রেমে কোনো সুস্থ মানুষ পরবে নাকি।
কি আর্কিওপটেরিক্স আবার কি?
গুগল করে দেখে নিস,, তাইলে বুঝবি,একদম খাপে খাপ ময়নার বাপ!
বলেই লিয়ানা মুখ বাকালো।
রিমা চোখ টিপে বললো- তোর ওই জ্বালাময়ী ভাইয়া দেশে ফিরছে… আমার সন্দেহ বাড়তাছে।
লিয়ানা একটুও রাগ না করে ঠোঁট বাকিয়ে বলল, আরে ধুর! তুই চিনিস না তো ওরে, অমন একখান রোবট টাইপ মানুষ! আমি কোনো ছেলের সাথে একটু কথা বললে ওনার বাড়ির মানসম্মান চলে যাবে — এই জন্যই এমন করছেন।আর কিছুই না।
মেরিন হেসে বলল, তাই নাকি? ভাইয়ার আত্মসম্মানের ওপর আঘাত! মানে এখন থেকে তোর আশেপাশে কোনো ছেলে থাকলে তুই বিপদে, কলেজ তো পুরাই নিষিদ্ধ হইয়া যাবে।
তোরা চুপ কর তো! অনেক হইছে ভালো লাগছে না বাড়ি যেতে হবে,
বলেই গাড়িতে উঠে পরে লিয়ানা।
বাড়ির গেট খুলে ঢুকল ও। গেটম্যান সালাম দিলো, লিয়ানা মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল।বাড়িতে ঢুকেই সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতেই হঠাৎ খেয়াল করল—ঘরটা আজ একটু অদ্ভুত লাগছে।নিঃশব্দ। যেন সবাই কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে।পায়ের শব্দটাই শুধু কানে আসছে।ঘরের সামনেএসে দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে ভিতরে ঢুকল লিয়ানা।ঘরে ঢুকতেই আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেল।সকাল তখনও বাইরে, রোদের আলো ছড়িয়ে আছে বারান্দা জুড়ে—কিন্তু ঘরের ভিতরটা?পূরোপুরি অন্ধকার।সব জানালা ভারী পর্দায় ঢাকা। এমনকি বাতিগুলোও নিভানো।এমন একটা স্যাঁতসেঁতে নীরবতা যেন বুকের মধ্যে নামিয়ে আনে কেমন অজানা এক কাঁপুনি।
লিয়ানা ধীরে ধীরে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে সুইচ চাপল।
“টিক!”
সুইচ অন হতেই—
ফুটে উঠল অসংখ্য ছোট ছোট আলো!
এক ঝলকে জ্বলে উঠল শত শত ফেয়ারি লাইট!একেকটা বাতির আলো যেন জাদুর মত ঘরটাকে এক নতুন রূপে রাঙিয়ে দিল।বিছানার চারপাশে, আয়নার ফ্রেমে, জানালার কিনারায়, বইয়ের তাকের গায়ে—মৃদু আলোয় সেজে উঠেছে লিয়ানা’র ঘর।লিয়ানা থমকে দাঁড়িয়ে গেল।চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে।এই যে দুপুর বেলা, এই যে রোদ পোহানো মুহূর্ত—তার মাঝেও এমন রূপকথার মত সাজানো একটা রুম!সে একটু ধীরে হাঁটল ঘরের মধ্যে, যেন স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছে।তার চোখে জল এসে গেল,চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। ওর নিঃশব্দ ঠোঁটে ফুটে উঠল এক অনিচ্ছাকৃত হাসি।
এগুলো,,কে করল?
বিছানার ওপর একটা ছোট বক্স রাখা, তার ওপরে একটা কার্ড—Just because your smile deserves it।
আর নিচে ছোট করে নাম লেখা—
—Z
লিয়ানা থমকে গেল। বুকের ভিতর ধক করে কেঁপে উঠল কিছু একটা।
“জ়েড মানে??”
হাতের মধ্যে কার্ডটা ধরে ও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝেও না বোঝার ভান করল সে।ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে রাখল—হয়তো হৃদয়ের ভেতর কোনো আলো নীরবে জ্বলে উঠেছে।তারপর ধীরে ধীরে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। চুল থেকে জল পড়তে পড়তে ঘরে ঢুকেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানায় এলিয়ে পড়তেই শরীরটা যেন নিঃশেষ হয়ে এলো। ঘুম চোখে হানা দিতেই ভাবল— কে এত যত্ন করে সাজিয়ে গেল ঘরটা? কেনই বা এত কিছু করল কেউ?কিন্তু ক্লান্তি শরীরের সমস্ত প্রশ্নকে ঢেকে দিল। ক্ষুধার কথা মনেও থাকল না। দুপুরের খাবার না খেয়েই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল লিয়ানা…লিয়ানা অজান্তেই ঘুমের জালে হারিয়ে গিয়েছিল। কতটা সময় কেটে গেছে, কিছুই বুঝতে পারেনি সে।
সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠেই নিচে গিয়ে চাও মিন খেয়ে উঠে পড়ল সিঁড়ি ধরে উপরে, আর নিজের রুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলে জানালার পাশে চলে এল। বাইরে তাকিয়ে রইল, যেন কোথাও জায়ানের কোন ছায়া খুঁজছে।লিয়ানা বুকের মাঝে অজানা এক টান অনুভব করে পড়ার জন্য বসল। সামনের দিনটা তার বড় একটা পরীক্ষা, তাই মন যেন চায় ভালো করে প্রস্তুত হওয়া। কিন্তু যতই বইয়ের পাতা ফেলে, মন ততই হারিয়ে যায় জায়ান ভাইয়ের কথা ভেবে। চোখের সামনে বারবার ওর কঠোর মুখ ভেসে ওঠে, সেসব কথা, সে অস্পষ্ট মনে হয় আজও যেন কানে কানে ফিসফিস করছে।ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকে, কিন্তু লিয়ানার মন পড়ার পেছনে আর নেই। মনটা ওর অনেক দূরে, যেখানে জায়ানের রুম—সেই নিরিবিলি, একাকী ঘরটি অবিকল একটা মায়াময় বৃত্তের মতো ঘিরে রেখেছে ওকে। রাত যখন গভীরতম, তখনও ঘুম তাকে ছুঁতে চায় না। চোখ খুলেই সে ভাবতে থাকে, “এত রাতে যাওয়া ঠিক হবে না কি যাবো” অবশেষে অস্থির হৃদয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ঘুমের অবহেলায় সে উঠে পড়ে।
লিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে জায়ান ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে। হাত বাড়িয়ে প্রায় স্পর্শ করবে দরজার , কিন্তু ফিরে আসে। মাথার ভেতরে প্রশ্নগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে—”যদি সে বিরক্ত হয়? যদি দরজা না খুলে? যদি…?”কিন্তু কোনও ভাবনা ওর হৃৎপিণ্ড থামাতে পারে না। সে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল, এবং এক মুহূর্তের জন্য।লিয়ানা অস্থির হাতে জায়ানের রুমের দরজায় ধীরে ধীরে হাত রাখল। একটু সাহস জোগাতে দরজায় কয়েকবার নড়াচড়া করল—দরজা খুলে গেল! সে হঠাৎ একটু থেমে গেল। দরজাটা খানিকটা খুলে গিয়েছিল, ভিতর থেকে হালকা আলো এসে পড়ছে।একপ্রকার গুঁটি গুঁটি পায়ে ভিতরে ঢুকলো লিয়ানা। ঠিক তখনই চোখ পড়ল জায়ানের উপর। ওর শরীর ভেজা, স্নানের পরের অবস্থা,শুধু একটা টাউজার পড়া, আর কিছু পরা নেই। চুলগুলো ভেজা ভেজা, কপালের উপর পড়ে আছে যা থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। আর টাওয়াল হাতে ধরে সেগুলো মুছছিল।
লিয়ানা হিম হয়ে গেল, হঠাৎ ওর ঠোঁট অল্পটা ফাঁকা, জায়ানের ঝরঝরে, সিক্সপ্যাক উঁকি দিচ্ছে টাওয়েলের আড়ালে। লিয়ানা হঠাৎ তার মেদহীন, কাটা ছাড়ানো শরীর দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। হাত তুলে মুখ ঢেকে নিল, যেন কিছু না দেখতে পায়। কিন্তু তার মধ্যে একটা দুষ্টু জিগিরও কাজ করছিল আঙুল এর ফাঁকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে থাকলো।
দেখার ইচ্ছে হলে এমনি দেখতে পারিস, নাটক করার দরকার নেই, জায়ান ভিজা চুল মুছতে মুছতে বলল।
লজ্জায় লিয়ানা পেছনে হয়ে ফিসফিস করে, আরে, আপনি একটু দ্রুত কিছু পরেন প্লিজ। এত রাতে কেউ গোসল করে নাকি!
জায়ান মুখ বাকিয়ে বলে,
কেনো এতো রাতে গোসল করা পাপ নাকি?
যদি একটা বউ থাকতো, তাহলে তো সকালেই গোসল করতাম।
একটু থেমে
একটা কাজ কর,আজ রাতটা আমার রুমেই থেকে যা, কাল সকালে একসাথে ফরজ গোসল করবো । কী বলিস?
জায়ানের কথা শুনে লিয়ানার গাল লাল হয়ে গেল, কান দুটো যেন আগুনে পুড়ে উঠল। ফিসফিস করে বলল,
ছি! অসভ্য লোক! নিজের বোনকে কী কথা বলছেন?
জায়ান গম্ভিরভাবে উত্তর দিল,
এই বেয়াদব মেয়ে তোর মা আর আমার মা কি এক?যেহেতু এক না তুই আমার বোনও না।আর আমি অসভ্য হলে ? তুই এত রাতে কী করিস একটা পুরুষের রুমে? তাও আবার নক না করেই ঢুকে পড়েছিস।তার বেলা কিছু না, খালি আমি বললেই দোষ, বাহ,!কী সুন্দর তোর লিলা খেলা!
জায়ান এর কথা শুনে,লিয়ানা বলে উঠল,
ধুর! এখানে আসাই ভুল হলো, আমি চলে যাই।
জায়ান পিছন থেকে দ্রুত এসে ওর হাত শক্ত করে ধরে বলল,
কিসের জন্য এলি? নাটক করিস না! মুখ খুল।
তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
এতো রাতে একটা অবিবাহিত পুরুষ এর রুমে আসতে বুক কাপলো না?? এখন যদি আমি কিছু করে ফেলি এর দায় কে নিবে??বল!,,,,,
জায়ান এর কথাগুলো যেনো লিয়ানার পুরো শরীর বরফের মতো জমিয়ে দিলো,মুখ দিয়ে কিছু বেরও হচ্ছে না বেচারির,গলা শুকিয়ে এলো।
“দে…দেখুন,,, ভাইয়া প্লিজ ছেরে দিন,হাতে লাগছে আমার।ব্যাথ্যা পাচ্ছিতো”
হাত ছেরেই জায়ান ধীরে ধীরে পেছনের ড্রয়ার থেকে ছোট্ট একটা বক্স বের করলো। কালো মখমলে মোড়ানো বাক্সটা খুলতেই লিয়ানার চোখ পড়লো দুটা পেন্ডেন্ট যার এক পাশে ছোট্ট রুবি বা লাল পাথরের হৃদয়, আরেক পাশে একটি ক্ষুদ্র তলোয়ার। ফ্রান্স থেকে বানিয়ে আনা… নাম Poiray Ma Premiere Heart pendant ” বা” heart & Sword।
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ২
জায়ান হাত বাড়িয়ে নিজেই লিয়ানার গলায় রেড হার্ট এর টা পরিয়ে দিয়ে নিজে তলোয়ার এর টা পড়ে নেয়।
হার্টের পিছনে খোদাই করে লিখা:
“Mon cœur mon arme”
(আমার হৃদয়, আমার অস্ত্র।)
