তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৪

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৪
ভূমিকা তালুকদার

সকালের আলোটা জানালার পর্দা গলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। লিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে চুপচাপ, অথচ চোখে-মুখে একরকম ভাঙাচোরা ছায়া। সাদা কামিজের ওপর খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কোমর পর্যন্ত,ঠিক যেমন এলোমেলো আজ তার ভেতরের কথাগুলো।তার ডান হাতের তালুর উপর রাখা ছোট্ট সেই পেনডেন্টটা ঘুম ভাঙার পর থেকেই যেটা গলায় ঝুলে আছে। সে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওটার দিকে। মুহূর্তে যেন সব থেমে যায়।

হঠাৎ… মনে পড়ে যায় আগের রাতের সেই মুহূর্তটা।
সে যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল জায়ানের দিকে।আর জায়ান, ঠান্ডা অথচ দৃঢ় হাতে পেনডেন্টটা তুলে এনে তার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল।সেই চোখের চাহনি, সেই হাতের স্পর্শ, সেই অনুজ্ঞাহীন স্পর্ধা সব মিলিয়ে যেনো এক অদ্ভুত অনুভব ছুঁয়ে গিয়েছিলো তাকে। অথচ সে কিছুই বলতে পারেনি, বাধা দিতে পারেনি, এমনকি চোখ পর্যন্ত ফিরিয়ে নিতে পারেনি।
আর তারপর?
তারপর,
চোখে জল এসে যায় লিয়ানার।
পেনডেন্ট পরিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই,ওনি মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাউ গেট আউট!যা, এবার আমার রুম থেকে বের হ”এভাবে যখন তখন আমার রুমে ডুকলে,পা কেটে রেখে দিবো।
এক মুহূর্তে লিয়ানার মুখ শুকিয়ে যায়।সে কি বেশি পাপ করে ফেলেছিলো নাকি,একটু সুন্দর করে বিহেভ করলে কি এমন ক্ষতি হয় এই লোকের।এসব ভেবে ভেবে লিয়ানার মুখ চুপসে যায়। যেনো কোথাও কিছু একটা খুব বাজে কিছু ভেবে ফেলেছিলো, বা খুব বেশি চেয়ে বসেছিলো।সে আবারও আয়নার দিকে তাকায়।চোখের কোণে কষ্ট লুকিয়ে থাকা লজ্জার ছায়া,সাথে ঠোঁট কাঁপছে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে আস্তে করে বলে।একটু বেশিই ভেবে ফেলেছি তাই তো?”
পেনডেন্টটা গলা থেকে খোলার সাহস তার নেই।
কিন্তু পেছনেও ফিরতে পারছে না।

তারপর রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই লিয়ানার চোখ আটকে গেলো ড্রয়িংরুমে থাকা সোফায় এক কোণে পা গুটিয়ে বসে আছে রিহান। হাতে মোবাইল, গলায় হেডফোন,তবে কান পুরো ঢেকে না, এক দিকটা খোলা। আর মুখে অদ্ভুত এক হাসি। কেমন সন্দেহজনক হাসি, আর ফোনে মুখ গুঁজে কী যেনো গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বলছেকৌতূহল সামলাতে না পেরে লিয়ানা ধীরে ধীরে পেছন থেকে গিয়ে কান পাতলো।লিয়ানা চোখ কুঁচকে তাকাল।
“কিরে রিহান, কার সাথে এত লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলিস?
সত্যি বল! কে রে বেটা?! — লিয়ানা এবার খ্যাপা কণ্ঠে বললো।
আরে আরে লিয়ু আপু কি করছো, আস্তে চুপ!
বল!

রিহান একটু হাসি গোপন করে বলল,
আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে।
কি!এই বয়সে প্রেমও করিস! বাহ্!নামটা কী শুনি?
রিহান ফোন কল কেটে দিলো।না হলে আবার শোনে ফেলবে তাই।
কোনটার নাম বলবো?
লিয়ানা দম বন্ধ করে তাকায়,
মানে? কীসের কোনটা? তুই কয়টা প্রেম করিস?
বেশি না,,আপাতত চারটা
লিয়ানা প্রায় হেঁচকি খেয়ে বলে উঠলো,
চারটা? তুই তো দেখি পুরো হাটের খরিদ্দার!বাড়ির বড়জন,বিয়ে না করে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে অবশ্য ঐ রাগী আর্কিওপটেরিক্সকে কেই বা বিয়ে করবে,,তবে এই দিকে আমি এখনো একটা প্রেম করতে পারলাম না…আর তুই প্রেম করছিস তো তাও আবার একটা না দুটোও না চার চারটে:)।কচু গাছে ফাঁ*সি দিয়ে মরিনা কেনো আমি, হায় আল্লাহ!

তা গুনধর ভাই আমার মন দিয়েছিস কাকে??
রিহান নিঃসারে বলে,
“মন??। সানডে দিলাম শিলাকে,
মানডে দিলাম মোনাকে,
টুইসডে ডেটিং টিনাকে
ওয়েডনেস ডে, ঐন্দ্রিলা কে।
লিয়ানা থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ কপালে!
ভাই এইটা কি তোর মন! নাকি বিশাল সমুদ্র!
রিহান এবার চোখ টিপে বলল,
আরে দুইটা আমার কলেজের, আর দুইটা অনলাইনের।
লিয়ানা আর পারলো না পিঠ বাঁকিয়ে হেসে গড়াগড়ি,,এইটা কি তার ভাই নাকি পাক্কা প্লেয়বয় রোমিও।ঠিক তখনই রিহানের মা শারমিন খান উদয় হয়ে এলেন, হাতে একটা চা-কাপ আর ভুরু কুঁচকে উঠলো।কিছুটা বিরক্ত মুখে বলে উঠেন

তোরা দুইটা বাদর সকাল সকাল এখানে কি করছিস বল তো?”
ছোট আম্মু, তুমি না ডিভোর্স লইয়ার? তোমার কি শুধু বিয়ে ভাঙার লাইসেন্স আছে, না কি প্রেম ভাঙারও?
শারমিন খান থমকে দাঁড়িয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, রিহান লিয়ানার মুখ চেপে ধরে বলে, আল্লাহ্, চলো চলো, খালি বারোটা বাজানোর ধান্দা !
তাকে টেনে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই
মাইশা আর আরিশা হানি জ্যাম আর ব্রেড নিয়ে ভেজা হাতে ঝগড়ায় ব্যস্ত।
মাইশা গলা তুলে: বললাম না আগে আমি নিব! তুই সবসময় আমারটা নিয়ে নিস!

এই দৃশ্যের মাঝখানে হঠাৎ করেই মূল আকর্ষণ ঢোকে—জায়ান খান। রোদে ঝলমল করা সকালেও তার উপস্থিতি যেন ঘরটা একটু ঠান্ডা করে দেয়।কালো শার্ট,চোখে চশমা,চুলগুলো কপাল ছুয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাওয়া জন্যে রেডি হয়ে এসেছে।পকেটে হাত রেখে জায়ান চুপচাপ এসে টেবিলের এক পাশে বসে।তার কফির মগটা কেউ বাড়িয়ে দেয়নি, আবার চেয়েওনি সে যেন নিজে নিজেই একা হয়ে বসার অভ্যস্ত। লিয়ানা তার দিকে এক ঝলক চেয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। অথচ ঠিক তখনই, তার দাদি, রওশন আরা খানের কণ্ঠ ফেটে পড়ে,

আমার বড় ভাইটা তো অনেক বড় হয়ে গেছে রে! বিয়ের বয়স পার করে ফেলেছিস জায়ান। এখন একটা ভালো মেয়ে দেখে মানে আমায় একটা নাতি বউ এনে দে তো!
শারমিন খান, আর রুকসানা খান, সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলান,,
ঠিক বলছেন, আম্মা। এখন তো সময়। একটা ভালো মেয়ে দেখা শুরু করবো নাকি??
দাদি হাসতে হাসতে বলে ওঠেন—
আরে দাদুভাই, ফ্রান্সে কোনও নাগরী পটিয়েছিস নাকি? থাকলে বল, বিয়েটা এখানেই করিয়ে দিই!
রিহান তখন মুখ চাপা দিয়ে হেসে বলে,

জায়ান ভাইয়া ফরাসি মেয়ে পছন্দ করে না, ওর ভেতরে ঢাকার ঘরোয়া রোমান্স লুকানো।
জায়ান সেই হাসাহাসিতে একটুও গা ভাসালো না। সে ঠাণ্ডা গলায়, নিচু চোখে কফিটা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল,
এত কষ্ট করে মেয়ে খোঁজার দরকার নেই। আমার সময় হলে আমি নিজেই ঠিক করে নেব।
তার কণ্ঠে কোনও উচ্চারণগত রাগ নেই, কিন্তু গলার সেই স্তরটা এতটাই ভারী, এতটাই অনুপ্রবেশহীন, যেন ছুরি চালানো শব্দ।পুরো টেবিলটা স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন হাওয়া থেমে যায় কিছুক্ষণ।
জায়ান ঠান্ডা স্বরে, কিন্তু চোখে একরকম হুঁশিয়ারির ঝিলিক নিয়ে বলবে,
যখন করতে চাইবো, তখন যেন কারো মুখ থেকে একটা ‘না’ শব্দটা বের না হয়।

ওর গলাটা ছিলো না উচ্চস্বরে, কিন্তু কথার ভার,কোনো বিস্ফোরণের চেয়েও বেশি জোরালো।বাতাস পর্যন্ত থেমে গেছে মনে হয়।তারপর ধীরে ধীরে, জায়ান নিজের কফির কাপটা তুলে এক চুমুক দেয়।আর সবাই যেন সেই কাপের নিচে পিষে গেল,ভেতরে ভেতরে।তারপর কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলোজায়ান যখন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল, বাড়ির পরিবেশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কারো মুখে তখন কোনো কথা নেই। লিয়ানা চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে রইল—দৃষ্টির প্রান্তে ভেসে চলল জায়ানের গাড়ি, যতক্ষণ না সে চোখের আড়াল হল।
হঠাৎ করেই গেটের বাইরের ডেলিভারিম্যানের ডাক,,

ম্যাডাম,পার্সেল।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে এক ডেলিভারি পার্সেল এসে হাজির। বড় কোনো কোম্পানির নাম নেই। সাদা একটা প্যাকেট, হাতের লেখা একেবারে অপরিচিত, এবং তাতে লেখা শুধু,
“Liyana Khan”
লিয়ানা অবাক হয়ে বলল, আমি তো কিছুই অর্ডার করিনি।
তার মা সঙ্গে সঙ্গে গজগজ করে উঠলেন, তুই আবার কোথা থেকে কি ফালতু জিনিস আনালি! এইভাবে না জানিয়ে প্যাকেট আনাস কেন?
আমি সত্যি কিছু আনাইনি!, লিয়ানা বলল। কিন্তু তার মনের ভিতরেও কেমন একটা শীতল শঙ্কা বয়ে গেল।
প্যাকেটের গায়ে কোনো ঠিকানা নেই, না কোনো মোবাইল নম্বর, না কোনো রশিদ। শুধুমাত্র ভিতরে ছোট একটা কালো বাক্স। এবং সেই বাক্স খুলতেই—

একটা সোনালি কাজ করা চুড়ি দেখতে খুব দামী, কিন্তু ভেতরে খোদাই করা-
“পোড়ার আগে আগুন দেখে নিয়ো।”
তারপর একটি চিঠি,
অদ্ভুত কালিতে লেখা, কিছুটা অস্পষ্ট অক্ষরে:
তোমরা যা পেয়েছো, তা কেবল সময়ের ঋণ। সময় ফিরে আসছে। হিসেব চাইতে।
“আর হিসাবটা তোমার থেকেই নিবো নিস্পাপ লিয়ানা খান”

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩

লিয়ানার কণ্ঠ শুকিয়ে এল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন গলার স্বর হারিয়ে গেছে।অদ্ভুত কে এমন পার্সেল তাকে পাঠালো।আর এসব কি লিখা।কিছু বোঝে উঠার আগে,
তার বড়ো আম্মু নাফিসা খান বললেন, “কি আছে ভিতরে? দেখাচ্ছিস না কেনো?”
লিয়ানা আস্তে করে বললো, কই তেমন কিছু নাতো!

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here