তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩২

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩২
ভূমিকা তালুকদার

দেখতে দেখতে ফ্রান্সে শীত চলে এসেছে।পাথরের রাস্তায় শিশির বরফে পাতলা চাদর জমেছে,ল্যাম্পপোস্টের হালকা হলুদ আলোয় ঝিকমিক করছে চারপাশ। শহরের রাস্তায় কেবল কফি শপের উষ্ণ ঘ্রাণ ভেসে বেরাচ্ছে, গরম কফির কাপ হাতে মানুষরা ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে ।সাধারণত ফ্রান্সে বিভিন্ন শহরগুলোতে ডিসেম্বর এর পর থেকে snowfall শুরু হয়,তবে আল্পস যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল তাই এখানে অন্যন্যে শহরগুলোর তুলনায় তাপমাত্রা প্রায় -১০ ডিগ্রি থেকে -০ তে নেমে যায়।তুষারপাতও তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।

গোধূলির বেলায় আল্পস এর চারপাশ যখন কোয়াশাচ্ছন্ন, লিয়ানা তখন প্যালেস অফ লিয়ার্জ এর গার্ডেনের এ থাকা সবুজ পাতার পাইন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে, পড়নে সাদা কালারের উলে বোনা সুতো দিয়ে তৈরি চেরি ফ্যাশনেবল ক্রপ সুয়েটার,গলায় একটা লাল রঙা মাফলার পেঁচানো।জায়ান বলেছে আজকে বছরের প্রথম তুষারপাত হওয়ার কথা,লিয়ানা কখনই তুষারপাত দেখেনি,কারণ বাংলাদেশ তো বরফ পরে না ইহকালেও দেখবে কেমন করে। লিয়ানা আজকে অনেক খুশি,ফোনে স্নুফল দেখত আর ভাবতো যদি সেও বিদেশ থাকতো তারও হয়তো দেখার সৌভাগ্য হতো।যাক শেষমেশ সপ্ন বাস্তবে রুপ নিবে।পাহাড়ের গাঁ বেয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস লিয়ানার শরীর বেয়ে স্পর্শ করার ফলে অনেক শীতও লাগছে তাও খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবে তার দৃষ্টি গার্ডেনের অপর প্রান্তে থাকা জায়ানের দিকে,সাদা শার্ট গায়ে জড়িয়ে লিও জিও কে খাবার খাওয়াচ্ছে।এত পাতলা শার্ট ফুলো ফুলো পেশি গুলো তো বুঝা যাচ্ছেই সাথে আর্ধখোলা।লিয়ানা ভেবে উঠতে পারে না এই লোকের চামড়া ঠিক কতটা মোটা হলে এই শীতের মধ্যেও ভারি কিছু না পরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।অবশ্য জায়ানের বডির টেম্পারেচার এমনিতেই হাই হয়ে থাকে,লিয়ানাকে স্পর্শ করে তার শরীরও গরম করে দেয়।উফ!লিয়ানা এবার জায়ানের কাছে যেতে থাকে,মাঝে মাঝে হিংসা হয় তার লিও জিও কে যখন জায়ান আদর করে।খইয়ে দেয়।তবে দুটো ঘোরাই লিয়ানারও বেশ পছন্দের। দেখতে খুবই সুন্দর,একটা কালো,আরেকটা সাদা রঙা।
লিয়ানা জায়ানের কাছে গিয়েই হাত বাড়িয়ে জায়ানের শার্টের বোতামগুলো লাগিয়ে দিতে নেয়।জায়ান লিয়ানার হাত ধরে কোমড় চেপে ধরে বলে,

“কি স্লিপং বিউটি?? ”
“শার্টের বোতোমগুলো লাগাতে দিন!”
“হুয়াই সুইটহার্ট??তুই কি কোনোভাবে সিডিউস হয়ে যাচ্ছিস নাকি”
“ইশশশ! মোটেও না।আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তাই।”
জায়ান লিয়ানার নাকে নাক ঘষতে ঘষতে বলে,
“ওহহহ নো,ইউ আর রাইট।এখন আমাকে তোর সোয়েটারের ভিতর ডুকতে দে,বডির টেম্পারেচার হাই হয়ে যাবে।তারপর আর ঠান্ডা লাগবে না।ক্যান আই??… ”
লিয়ানা লজ্জায় জায়ানের মুখ চেপে ধরে ফেলে।
“চুপ করুন তো।আপনি না আস্ত একটা কন্ট্রোলেস পারস’ন।”
“হুহ!কেন তুই ফিল করতে পারিস না আমাকে??”
“অসভ্য লোক। ফিলিং’স নিয়ে কি আপনার মতো সারাক্ষণ বলে বেরাবো নাকি।উফ!নিজেকে একটু কন্ট্রোল করা শিখুন। ”

জায়ান লিয়ানার ঘারে চুমু খেয়ে বলে,
“উহু!যেদিন আমার ডায়মন্ড কন্ট্রোল হওয়া শিখে যাবে, সেদিন আমিও হয়ে যাবো।”
লিয়ানা কথার জোরে জায়ানের সাথে পেরে উঠে না কোনোদিনও।তাও আবার লাগামহীন কথাবার্তা তাকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেয়।লইয়ারদের সাথে এমনিতেই চাপার জোর জিতা আর কাটা চামচ দিয়ে পানি খাওয়া একি কথা।রান্নাবান্না সব জায়ান নিজ হাতে করে, লিয়ানাতো রান্নার র ও পারেনা।জায়ান গার্ডেনে সোফায় বসে ল্যাপটপে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং করছে এই ফাকে লিয়ানা কিচেনে চলে আসে।জায়ানকে গরম গরম কফি বানিয়ে খাওয়াতে মন চাইলো তাই।কফি পাউডার দুধ মিক্স করে কফি একদম রেডি করে ফেলে তবে সুগার জায়ান পছন্দ করে না।এমনিতেও জায়ান ব্লেক কফি খায়।লিয়ানার তিতা তিতা লাগে তাই খেতে পারে না।দু কাপ কফি রেডি করে খুশি মনে জায়ানের কাছে নিয়ে যেতে থাকে।

প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো।লিয়ানা কফি নিয়ে জায়ানের সামনে যেতেই দেখে জায়ান ওয়াইনের বোতল ঢেলে ওয়াইন খাচ্ছে।মানে লিয়ানা এত কষ্ট করে জায়ানের জন্যে কফি মেইক করে আনলো আর জায়ান বসে বসে ম’দ গিলছে।রাগ করে মুখ ভেংচি মারলো লিয়ানা।জায়ান ল্যাপটপের ক্রিনের দিকে তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দেয় লিয়ানার কাছে।কিছুটা রেগে বলে,
“কিচেনে গিয়েছিস কেন?যদি হাত পুড়ে যেতো!ভালোবেসে বানিয়েছিস দে,তবে আর পাকনামো করবি না।আমাকে বলবি আমি করে দিবো ”
“আজব তো আমি আপনার জন্যেই বানিয়েছি।আমার জন্যে না।”
জায়ান লিয়ানার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে লিয়ানাকে টেনে নিজের ঊরুর উপর বসিয়ে দেয়।
“অ,,অ কি করছেন!”

“এখানে বসে থাক,তোকে দেখবো আর তোর বানানো ইয়া’মি কফি খাবো।”
“আগে খেয়ে তারপর রিভিউ দিন!”
“ওকে সুইটহার্ট। ” বলেই জায়ান কফির কাপে চুমুক দেয়।জায়ান কফি খাচ্ছে আর লিয়ানা এক দৃষ্টিতে জায়ানের গলার উঠা নামা করা এড্যাম’স এপ্যাল এর দিকে তাকিয়ে থাকে,কিছু একটা ভেবে লিয়ানা জায়ানের ল্যাপটপের পাশে রাখা ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে এক ঢুকে পুরোটা গিলে নেয়।লিয়ানার এহন কান্ডে জায়ান বেশ রেগে গেলো। চোখ এর মণি জোড়া লাল বর্ণ ধারণ করে, রাগে গজগজ করতে করতে লিয়ানার গলা চেপে ধরে।
“তোর কতো বড় সাহস।এই মা’তারি তুই আমার থেকে অনুমতি নিয়েছিস??এই মূহুর্তে যেভাবে খেয়েছিস সেভাবেই বের করবি তোর পেট থেকে ”

জায়ান যে এভাবে রেগে যাবে তা বুঝতে পারেনি লিয়ানা।ভেবেছে জায়ান যখন কফির রিভিউ তাকে দিবে সেও এই ছাইপাশ এর জঘন্য রিভিউ শুনাবে।কিন্তুু লিয়ানার এখন কেমন নেশা নেশা ফিল হওয়া শুরু হয়ে যাচ্ছে।লিয়ানা জায়ানের গলা আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“রাগ করবেন না একদমি। আমি কিন্তুু আপনার একমাত্র ভি লাভ’ড ওয়াইফি।”
“তুই আমার বা’ল,বউ হলে কথা শুনিস না কেন?? ”
“ছেহ! কি জঘন্য জিনিস। মুখটা তেতো হয়ে গেলো”

“ঢুলছিস কেন এক পে’গ খেলে কারোর নেশা হয় নাকি।ব’মি করে বের করাবো এখন বেশি বাড়াবাড়ি করলে।”
লিয়ানা জায়ানের কথা পাত্তা না দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে দেখলো বছরের প্রথম তুষারপাত শুরু হচ্ছে।একটু একটু করে তুষার পরছে।লিয়ানার জায়ান দুজনের চুলের উপর সাদা সাদা স্নু এসে জমছে।লিয়ানা হেসে উঠে, হাত পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে স্নু ধরতে থাকে।আজ সে আনেক হ্যাপি জায়ানের সাথে একসাথে বসে তুষারপাত দেখছে।দাঁত কেলিয়ে দু হাত দিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে জায়ানের চুল থেকে স্নু গুলো সরাতে থাকে।লিয়ানাকে এভাবে হাসতে দেখে জায়ানের রাগ কিছুটা কমে আসে।লিয়ানার ললাটে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে কানে গুজে দেয়।ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয় লিয়ানার কানে।
জায়ান সোফায় মাথা হেলান দিয়ে বসে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।মাথাটা চিন চিন করছে।বুকে ব্যথা অনুভব হতে থাকে।লিয়ানা জায়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।এত বছর যেই ভয়ংকর সত্যে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে, এই তুষারপাত জায়ানকে আবার মনে করিয়ে দিলো।চোখ বেয়ে না চাইতেও দু ফোটা অশ্রু ঝরে পরে।একটা পাথর হয়ে যাওয়া পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ এর চোখে অশ্রু বরই বেমানান।ঠোঁট জোড়া হালকা কেঁপে উঠে জায়ানের।লিয়ানাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো।লিয়ানা সরলো না উল্টো মায়া ভরা দৃষ্টিতে জায়ানের দিয়ে তাকায়।জায়ানকে এভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিয়ানা ঢলঢল চোখে জিজ্ঞেস করে,

“ওমা,অমন করে কি দেখছেন?”
“তোর কি সত্যিই কিছু মনে নেই লিন,??”
লিয়ানাও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“কি মনে থাকবে??”
“মনে না থাকারি কথা। ”

রাত হতেই তুষারপাত বাড়তে থাকে,সাথে তিব্র হাওয়া।এভাবে খোলা আকাশের নিচে থাকাটা তাদের জন্যে মুটেও ভালো হবে না।কেননা এতক্ষণে ঠান্ডা বাতাসের সাথে তুষার বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। জায়ান সোজা হয়ে বসে লিয়ানাকে নিজের কোলে তুলে নেয়।লিয়ানা সেই কখন থেকে জায়ানকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে জায়ান কোনো প্রতিউত্তুর না দিয়েই হনহনিয়ে প্যালেসের ভিতর প্রবেশ করে। তবে লিয়ানা কিছুটা নেশার ঘোরে চলে গিয়েছে,জায়ান লিয়ানার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট বাঁকায়,একটা টাওয়াল এনে লিয়ানার তুষারে ভিজা চুল গুলো মুছে দিতে লাগলো।জায়ান লিয়ানার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে টমেটোর মতো গোল গাল দুটো চেপে ধরে বলে উঠে,

“তুই এতো সুন্দর কেন বল তো?”
“আপনার দেখার চোখ সুন্দর তাই সুন্দর মনে হয়। কিন্তুু আপনি কেন সুন্দর? পুরুষ মানুষের এতো সুন্দর সুদর্শন হতে নেই,”
জায়ান লিয়ানাকে কোলে থেকে নামিয়ে ডাইনিং স্পেসের সোফার উপর বসে পড়ে নিজের ঊরুর উপর বসিয়ে দেয়।আজকের রাতটা মোটেও অন্যে দিনের মতো ছিলো না জায়ানের কাছে। এতগুলো বছর একা একা নির্ঘুৃমে কাটিয়ে দিতো আর আজ লিয়ানা তার পাশে।জায়ানকে অন্যমনস্ক দেখে লিয়ানা বলে,

“কিছু বলছেন না কেনো??”
জায়ান লিয়ানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলে, জায়ানের শ্বাস প্রশ্বাস এত দ্রুত গতিতে উঠানামা করতে দেখে লিয়ানা জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরে, জায়ান আকড়ে ধরে লিয়ানাকে যেনো বুকে ভিতর ডুকিয়ে ফেলবে।আত্তার সাথে মিশিয়ে ফেলতে চাইছে।জায়ান নিজের বউকে জড়িয়ে ধরে সোফায় ঘাড় হেলিয়ে শুয়ে বলে উঠে,
“একটু জড়িয়ে ধরে থাকবি আমায়?”
“হুহ!”

অত:পর জায়ান লিয়ানার মাথায় চুমু খেয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলে,
“হ্যাপি ম্যারেজ এনিভার্সারি বউ”
কথাটা বলতে গিয়েও কেমন আটকিয়ে আটকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠে জায়ানের সর্বাঙ্গ।বিদুৎ এর ন্যায় জায়ানের শিরা উপশিরা কেঁপে উঠে। তবে লিয়ানা হাসলো, জায়ানের বুকে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
“হ্যাপি টু মান’থ ম্যারেজ এনিভার্সারি হাবি।”
উঁহু! নট অনলি টু মা’নথ,…….
একটু থেমে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো জায়ান।তারপর,
“হ্যাপি ট্যান ইয়ার ম্যারেজ এনিভার্সারি পরি।”

কথাটা লিয়ানার কানে যেতেই আঁতকে উঠলো লিয়ানা, এক গ্লাস ওয়াইনেই লিয়ানার মাথা যতটা না চক্কর দিতে থাকে এতক্ষণ, তার থেকে বেশি এখন এই ট্যান শব্দটার শুনে মাথা ৩৬০°অ্যাঙ্গেল ঘুরছে তার।মনে হচ্ছে বেশি নেশায় ধরে গিয়েছে তাই হয়তো আবল তাবল শুনেছে,ঢলঢল চোখে আবার বলে উঠে,
“ক কি বললেন??…. ”
“যা শুনেছিস তাই, আর রিপিট করতে পারবো না।”

জায়ান জানে লিয়ানাকে এখন কিছু বলেও লাভ হবে না সকাল হতেই অর্ধেক কথাও মনে থাকবে না তার, রাতের গভীরতার সাথে বুকের ব্যথাটাও বেড়ে চলেছে,জায়ান প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে ঠোঁটে পুরে নেয়, সিগারেট ধোঁয়ার সাথে মনের কোণে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো উড়িয়ে দিতে চাইছে,কিছু তিক্ত সত্যে পুরনো ক্ষত মনে পড়ে যায়,দু’ফোটা নোনা জল জায়ানের গলা বেয়ে লিয়ানার চুলে স্পর্শ করে।জায়ান একটাু বাঁকা হাসি টানে,

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩১

“জানিস আমাদের যে আরও একবারও বিয়ে হয়েছিল! ”
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে সালটা দু’হাজার পনেরো,পহেলা নভেম্বর।চট্টগ্রামে,
তালুকদার বাড়িতে সেদিন জাঁকজমক বিয়ের অনুষ্ঠান,,, মামা ফাহাদ তালুকদার এর ……

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here