তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৭
ভূমিকা তালুকদার
বাক্যে শেষ করার আগেই অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জায়ান।নাক বেয়ে দু ফোটা র*ক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়তেই চারদিক থেকে ছুটে এলো মানুষজন। মার্কো ততক্ষনাৎ হাঁটু গেড়ে বসে জায়ানকে নিজের বুকে তুলে ধরলো, জায়ানের নাক বেয়ে অনবরত শীতল র*ক্ত বেরোচ্ছে, মূহুর্তেই যেনো হাত পা ঠান্ডা হয়ে জমে গিয়েছে।জায়ানের হাতের তালু ঘষতে ঘষতে মার্কো চিত্কার করে উঠল,
“কল দ্যা অ্যাম্বুলেন্স রাইট নাও!”
মার্কো শুকনো ঢুক গিলে নেয়।মার্কোর পুরো শরীর ঘেমে উঠেছে, লম্বা লম্বা ঘাড় ছুই চুল বেয়ে ঘাম ঝড়ে পড়ছে।এক নাগারে জায়ানকে ডেকে চলেছে।কাঁপা কাঁপা হাতে জায়ানের গাল স্পর্শ করে,
“জায়ান প্লিজ ওপেন ইউ আই’স।ওপেন ইউর আই’স ড্যাময়েইট”
স্টেজের ওপর থেকে রেহমান পাষা ছুটে এলেন। ফোন বের করে হাতে নম্বর ডায়াল করছেন,
“দ্রুত এসো, ফাস্ট!ইমিডিয়েটলি। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম এসে পৌঁছায়। পরিস্থিতি এখন গাড়ি ব্লাস্ট থেকে সরে জায়ানের দিকে, অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস টিম এসে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।পুরো গাড়ি পুরে চুপসে গিয়েছে, গাড়ির ভিতরে কেউ থাকলেও বা তার অস্তিত্ব পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না।মাং*স গলে শুধু পোড়া হাড়গুলো হয়ত বা অবশিষ্ট থাকবে। অন্যদিকে পাখির ঝাঁকের মতো মেডিকেল টিম এসে হাজির, স্ট্রেচারে জায়ানকে তোলা হচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে জায়ানের হাত শক্ত করে ধরে এম্বুলেন্স এর দিকে ছুটছে মার্কো, চোখের।
ঠিক তখনই পিছন দিক থেকে ভেসে এলো এক নারীকণ্ঠ ছিন্ন, কাঁপা, বুক ফাটানো একটা চিৎকার,প্রায় দৌড়ে এ’দিকেই ছুটে আসছে।আর কেউ না লিয়ানাই। দূর থেকে শুধু দেখতে পাচ্ছে স্ট্রেচারে করে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।এতো লোকজনপর ভিড়ে ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না।তবে স্ট্রেচার থেকে ঝুলে থাকা হাতটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই বুঝতে আর বাকি থাকলো না এটা তার জায়ানই।হাতে চকচক করা সিলভার কালারের ব্রেসলেট।লিয়ানা কি করেই বা না চিনবে।মার্কো আর রেহমান পাষা সকলে মিলে জায়ানকে এম্বুলেন্সে উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে হসপিটালের দিকে রওনা হয়।পিছন থেকে খরগোশের ন্যায় লাফিয়েও এসেও যেনো আর একটিবারের জন্যেও জায়ানের দেখা মিলল না লিয়ানার
পেছনে নাদিয়া। দুজনের মুখে আতঙ্কের ছায়া, লিয়ানার নিঃশ্বাস যেনো থেমে থেমে আসছে,সিল্কি চুল উড়ছে হাওয়ায়।
[অর্ধ ঘণ্টা আগের সময়]
লিয়ানা তখন গাড়ির ভেতর বসে আছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি। ইঞ্জিনের শব্দ, বাতাসে পেট্রোল আর ধোঁয়ার গন্ধ।একবার ভাবলো বের হবে, আবার ভয়ও হলো।শুধু শুধু লোকটাকে রাগিয়ে লাভ নেই।রেগে মেগে আবার না ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো সিং দিয়ে তাকে গুতো না মেরে দেয়।লিয়ানা ভেংচি কেটে ফিসফিস করে উঠে,
“শয়তান বজ্জাত লোক শরীরে শুধু তেজে ভরা।উফফ!”
লিয়ানা না জায়ানকে দিনের বেলা কন্ট্রোল করতে পারে আর না রাতের বেলা।মানে সবি জায়ান এর হাতে।শরীরে শুধু হাই বোল্টেজের কারেন্ট অন হয়ে থাকে সর্বদা।লিয়ানা ঠোঁট গুল করে নাক কুঁচকিয়ে হাসলো।
“নো প্রব্লেম মিস্টার জাওরা খান।একবার শুধু রাতে আপনাকে কন্ট্রোল করার উপায় টা রিসার্চ করি দ্যান এমন মজা দেখাবো। পাঁ ধরে বসে থাকতে বাধ্য হবেন।”-বলেই লিয়ানা হাত দিয়ে নিজের চুল উড়িয়ে দেয়।
ঠিক তখনি নাদিয়া এসে জানালায় টোকা দিলো।
“কাম ইউথ মি প্রিটি”
নাদিয়াকে দেখে লিয়ানা মৃদু হাসলো।
” আহ!নূরি আপু।কোথায় যাবে? তোমার গুনোধর বন্ধু আমাকে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন।এক পাও যেনো এখান থেকে না নড়াই।নাহলে আস্ত গিলে খাবে”
লিয়ানার মুখশ্রী এমন করুণ দেখে নাদিতা ফিক করে হেসে দিলো।কি ভয়টাই না পায় মেয়েটা জায়ানকে।নাদিয়া লিয়ানার কপালে দু আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বলে,
“আরে এসো।আমি ম্যানেজ’ড করে নিবো।এভাবে বসে থাকলে বোর হয়ে যাবে।জায়ানদের লে’ইট হবে আসতে।”
লিয়ানা গাড়ি থেকে নেমেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
“কোথায় যাবো? ”
নাদিয়া লিয়ানার কাঁধে হাত জড়িয়ে হাটা দিলো।”
“পাশে একটা আইসক্রিম ক্যাফে আছে ওখানে!”
লিয়ানা হেসে মাথা নাড়ল, ওকে,আমি কিন্তুু আমেরিকানু আর মিন্ট আইসক্রিম খাবো।এখানে কি ক্যালোফোর্নিয়ার আমেরিকানু পাওয়া যাবে?
“অবশ্যই হুয়াই নট।”
দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে ক্যাফের কাছে চলে আসে। Ice Cream Café
রাস্তাটার কোণে ছোট্ট কিন্তু দারুণ সাজানো সেই ক্যাফেটার কাচের দরজায় লেখা “Pinkflash scoops of happiness।লিয়ানা ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো নরম গোলাপি আর সাদা রঙের দেয়াল, তাতে টাঙানো ছোট ছোট ফ্রেমে লেখা মিষ্টি উক্তি “Happiness is melting in your mouth” “Life is better with sprinkles”।
কাউন্টারের পেছনে চকচকে স্টিলের আইসক্রিম মেশিন, পাশে রঙবেরঙের টপিংস — চকো চিপস, ক্যান্ডি, বাদাম, আর গোলাপি হালকা ভ্যানিলা আর ক্যারামেলের ঘ্রাণে পুরো দোকানটা ভরে ছিল। ক্যাফেটা একজন বৃদ্ধা চালায়।এ দোকানটার বয়স প্রায় পঁচিশ বছর।প্রতিবছর নতুন করে ডেকোরেশন করান তিনি।লিয়ানা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ক্যাফেটা দেখতে লাগলো।
এক কোণে রাখা ছিলো দুটো নরম কুশন দেওয়া সিট, সেখানেই লিয়ানা আর নাদিয়া বসলো।বৃদ্ধা মহিলাটি টেবিলে এনে রাখলো দুটো কাপ, একটাতে mint ice cream, আরেকটাতে Americano।লিয়ানা আমেরিকানু খেতে খেতে নাদিয়াকে কিছুটা ধিদায় পড়ে জিজ্ঞেস করলো।
“আচ্ছা আপু।তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?তুমিতো আমাদের দেশী”
“জানি না কেউ নেই।আমি বড়ই হয়েছি ফ্রান্সের অনাথ আশ্রমে।কখনো কেউ কোনোদিন দেখা করতে আসেইনি,তাহলে কিভাবে জানবো কে আছে নাকি না!”
লিয়ানা বাক্’ রুদ্ধ হয়ে পড়লো।এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করা মোটেও উচিত হয়নি।এতো বোকা কেন সে।শুধু শুধু নূরি আপুর মন খারাপ করালো।নাদিয়া হাসলো।লিয়ানা যেনো রিগ্রেট ফিল না করে,লিয়ানার চুলে হাত বুলালো।জোরপূর্বক হেসে জবাব দিলো।
” পৃথিবীতে কতশত রঙবেরঙের মানুষ আছে।আমরা কেবল মানুষের বাহ্যিক রঙটাই দেখতে পাই।ভিতরের লুকায়িত রঙটা কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছেই দৃশ্যমান।তবে হাস্যজ্জল মানবের মনেই যে লুকায়িত থাকে আকাশসম যন্ত্রণা।”
নাদিয়া বৃদ্ধা মহিলাটির দিকে ইশারা করে দেখালো।
“ঐ যে দেখছো ওনি।না কানে শুনতে পায় আর না কথা বলতে পারে।তাও সুখি।কারণ মিথ্য দুনিয়ার শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছায়ই না।”
“হুম ঠিক বলেছো আপু।”
লিয়ানা কেঁদে ফেললো।অল্পতে কেঁদে ফেলা একটা বদঅভ্যাস তার।কেনো যে একটুতেই এতো ইমোশনাল হয়ে যায় নিজেও বুঝতে পারে না।কষ্ট ঠিকমতো অনুভব করার আগেই চোখে অশ্রু টলমল করতে থাকে।এতো দূর্বল হৃদয় নিয়ে মহামুশকিলে ফেঁসে আছে।ঐ পুলিশ বেটা তো ভুল কিছু বলেনি ঠিকি তো জায়ান আর সে মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ। নাদিয়া কপালে হাত রেখে চিন্তায় পড়ে গেলো।
“আহা।এই মেয়েকে কিছু বলাও দেখছি ভুল।”
লিয়ানা ঠোঁট উল্টোলো ঠিক তখনই, দূর থেকে একটা তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ।বুম!
মুহূর্তে পুরো শহরটা যেনো কেঁপে উঠলো।, বাতাসে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেলো। ক্যাফের ভেতর ধোঁয়া ঢুকে পড়ছে, সবাই ছুঁটছে চিৎকার করে।লিয়ানা আর নাদিয়া তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে দেখলো।দূরে জায়ানের লাল রেসিং গাড়িটা আগুনে জ্বলছে! ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেছে পুরো গ্রাউন্ড ।লিয়ানার মুখ থেকে একটাও শব্দ বেরোল না,গলা যেনো কথা আটকে আসছে। তার চোখ শুধু স্থির হয়ে আছে সেই আগুনের দিকে।
লিয়ানার ঠোঁট কাঁপছে, চোখে জল আরও তিব্র বেগে পরতে শুরু করে।নাদিয়া লিয়ানার হাত শক্ত করে ধরে তারপর দু’জনেই ছুটে চললো গ্রাউন্ডের দিকে।
“ও…ওনি ঠিক আছে তো?আপু! আমার ওনি।”
“জায়ান তো গাড়িতে নেই লিয়ানা।গাড়িতে তুমি ছিলে।Thank god!বেঁচে গিয়েছো”
চারপাশে তখন ধোঁয়া আর চিৎকারে ভরে গেছে। মানুষের ভিড়, গরম বাতাসে পুড়ে যাওয়া রবারের গন্ধ, আর দূরে বিস্ফোরিত গাড়িটার কালো ধোঁয়া আকাশে উঠে গেছে।।
লিয়ানা ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়ে দুই হাঁটু ভাঁজ করে, বুকের কাছে হাত রেখে কাঁদতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।তার কান্নাটা যেন নিস্তব্ধতাকেও কাঁপিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে বের হয় টুকরো টুকরো শব্দ।
“হে আল্লাহ! মাবুদ। কেন তু..মি.. আমায় এতো পরীক্ষার মধ্যে ফেলছো।কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি।ওনার যেনো কিছু না হয়।ওনার রুহ এর বদলে তুমি আমার… আমার রুহটা নিয়ে নাও।মৃত্যুটা যেনো আমারি আগে হয়।”
নাদিয়া পেছন থেকে ছুটে এসে লিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে, চোখে ভয়।কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।কি হলো জায়ানের।আপাতত মন শক্ত করে লিয়ানাকে শান্ত করতে হবে।
“লিয়ানা, উঠো দাঁড়াও… ওঠো… কিছু হয়নি জায়ানের।কিছু হবেও না।”
লিয়ানা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
“কিছু না হলে এম্বুলেন্সে করে কোথায় নিয়ে গেলো ওনাকে”
“চলো আমার সাথে Be strong!”
লিয়ানা তবুও মাথা নাড়ে না। নাদিয়া লিয়ানাকে ধরে নিজের বাইকে উঠিয়ে দেয়।ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই
বাইকের হেডলাইটের আলো ছিঁড়ে ফেলে ধোঁয়ার ঘন পর্দা।আর লিয়ানা, কাঁপা হাতে জোরে ধরে থাকে নাদিয়ার কাঁধ।বাইকটা গর্জে উঠে ছুটে যায় হাসপাতালের দিকে।
প্যারিস সেন্ট লুই হাসপাতাল,
চারপাশে সাইরেনের আলো লাল-নীল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গেটের সামনে এখনো সাংবাদিকদের ভিড়।নাদিয়া বাইক থামায় হঠাৎ। লিয়ানা পেছন থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে আসে।চুল এলোমেলো, চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।পোশাক ধুলোয় মলিন। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ঠিকঠাক ভাবে। তবুও সোজা দৌড়ে ঢুকে যায় জরুরি বিভাগের ভেতর।
জয়ান! জয়ান! কোথায়! কেউ আমাকে বলুন ওকে কোথায় রেখেছে! চিৎকারে ভরে যায় করিডোর।নার্সরা কেউ তাকায়, কেউ চমকে ওঠে। একটা সাদা পোশাক পরা একজন ইন্ডিয়ান ডাক্তার এগিয়ে আসে, শান্ত গলায় বলে,
মিস, দয়া করে শান্ত হোন। আপনি কি মিস্টার জায়ান খানের ওয়াইফ?
লিয়ানা কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আমি…আমি ওনার স্ত্রীও কোথায়? প্লিজ, কিছু বলুন…ওনি ঠিক আছে তো?
ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকে, তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে বলে,
মিস্টার খান এখন critical অবস্থায় আছেন। আমরা ওনাকে ICU তে নিয়েছি। সম্ভবত প্রচণ্ড চাপের কারণে ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ওনার হৃদযন্ত্র কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, আমরা CPR দিয়ে ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু এখনো বিপদ পুরোপুরি কেটে যায়নি।
লিয়ানার গলা শুকিয়ে যায়।মাথা ঘুরে হসপিটালপর ফ্লোরে পড়ার আগেই পেছন থেকে নাদিয়া ধরে নেয়।
“হার্ট…হার্ট অ্যাটাক? ”
ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন,
“Yes,he took too much mental pressure. Overstress, exhaustion, long exposure to adrenaline
এই জিনিসগুলো শরীরের উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। ওনার শরীরের ভিতর সেই চাপ জমে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমরা এখন ওনার শরীর স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পরের ২৪ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।just pray for him”
লিয়ানা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন থেমে যায়। আশেপাশের শব্দগুলো— সাইরেন, পায়ের আওয়াজ, মনিটরের ‘বিপ বিপ’।সব এক হয়ে যায় এক অনন্ত প্রতিধ্বনিতে। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় ICU র কাঁচের দেয়ালের দিকে। ভিতরে দেখা যায় জায়ান,মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইনের টিউব, বুকের ওপর সেন্সর লেগে আছে। মনিটরের নরম সবুজ আলোয় তার মুখটা ফ্যাকাশে, নিস্তব্ধ।বুকের ভেতরটা মনে হচ্ছে এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।কাঁচের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বুকের উপর হাত ঠেকিয়ে অঝরে কেঁদে উঠে।বুকের পাশের শার্টটা শক্ত করে চেপে ধরার ফলে,হাতের গিট সাদা হ’য়ে উঠে।নাদিয়া এসে লিয়ানাকে জড়িয়ে ধরতেই।লিয়ানা নাদিয়াকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁফাতে থাকে।
এ প্রথম নিঃশ্বাসটা নিতে এতোটা কষ্ট হচ্ছে তার।চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। অচেতন হওয়ার আগ মূহূর্তে একটা অস্পষ্ট বাক্যে বের হলো ঠোঁট দিয়ে,
“আমার সমস্ত আয়ু আপনার হউক”
পিয়ে’মন্তে,ইতালি [ফ্রান্সের শেষসীমানার পর অবস্থিত]
রাতের পিয়ে’মন্তে দূরের পাহাড়ের আলোর ঝলক স্পর্শ করছে শহরের রাস্তায়। চারপাশে তিমির অন্ধকার। রাস্তার পাশে ঘুমন্ত গাছগুলো হালকা হাওয়ায় দুলছে, আর তুষারগুলো কখনও কখনও এলেক্সের ড্যানিম জ্যাকেটের কাঁধে পড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে নির্ঘুমে তার চোখের নিচে কালো ছায়া ফেলেছে, দেহ ক্লান্ত, মনে অদ্ভুত বিষণ্ণতা,ইনভেস্টিগেটর মাল্টা যেহেতু ইতালিয়ান তাই তার পারিবারিক খোঁজ নিতে ইতালি এসেছিলো।কিন্তুু এক সপ্তাহ খোজেও মাল্টার কোনো খুজ পাওয়া যায়নি। ঠোঁটে অর্ধ খাওয়া সিগারেট, বিদঘুটে অন্ধকার রাস্তার মাঝে এসে তার পেটে তিব্র ক্ষুদা লেগে গিয়েছে। দুপুরে শুধু চাউমিন খেয়ে ছিলো বেশ্, আর কিছুনা,সিগারেট কেলে কি আর পেট ভরে বাকি।ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। বাসায় গিয়ে বড়সর একটা ঘুমের দিবে এই আশায়। খুব মিশ করেছে রেসিং,ভেবেছিলো রেসিং এর আগেই ফ্রান্স চলে যেতে পারবে তা আর হয়ে উঠে নি।।যদিও সে প্রফেশনাল রেসার ছিলো এক সময়,একটা দূর্ঘটনার পর রেসিং ছেড়ে দিতে হ’য়েছে।
হঠাৎ, অন্ধকারের কোণে কিছু ছিটমহল আলো থেকে দৌড়ে আসছে একটা ছায়াঁ। এলেক্স তার জিপের ব্রেকে পা রেখে স্পিড কমাতে থাকে।ছায়া?একটা মেয়ে এই গভীর পাহাড়ের রাস্তায় কি করছে।তার দৃষ্টির সঙ্গে মেয়েটার চোখ মিললো মাত্র, আর তখনই,মেয়েটা তার গাড়ির পাশে এসে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়।দেখে মনে হলো কারোর কাছ থেকে প্রাণপনে বেঁচে পালাতে চাইছে।
মেয়েটি রাস্তায় পড়ে যেতেই, হাঁপিয়ে উঠে। এলেক্স গাড়ি থামািয়ে।জিপ্ থেকে লাফিয়ে নেমে সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে। এলেক্স যখন মেয়েটার দিকে এগোতে থাকে মেয়েটা রাস্তায় হামাগুড়ির মতো বড় বড় ঢুক গিলে পিছাতে থাকে।এলেক্স কিছুটা অবাক হলো।মেয়েটার সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে নাকি।পড়নের জামার হাতার কাছের অংশটা কেমন ছেড়া।এলেক্স হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেয়েটার সামনে।
“হ্যালো মিস্।এখানে কি করছেন।কি হয়েছে আপনার? ”
মেয়েটা কোনো জবাবই দিলো না।অতিরিক্ত ভয় পেয়ে আছে।মেয়েটার লম্বা চুলো মুখের সামনে এসে থাকার কারণে চেহারা তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না।এলেক্স ভ্রু কুচকিয়ে মেয়েটার চুল মুখ থেকে আলতো করে সরাতেই দুজনের দৃষ্টি একএিত হয়।শ্যামবর্ণের মুখশ্রি দিকে তাকাতেই এলেক্সের মায়া হলো মেয়েটার জন্যে। সাথে সাথে এলেক্স নিজের আইডিকার্ড টা বের করে মেয়েটার মুখের সামনে ধরে।বলে,
“নাও টেল মি হু আর ইউ? ”
এলেক্স আইনের লোক দেখে মেয়েটা যেনো প্রাণ ফিরে পায়।হামাগুড়ি দিয়ে এলেক্সের কাছে এসেই তার জ্যাকেট জড়িয়ে ধরে ফেলে।মেয়েটা এমন আচরণের এলেক্স কেশে উঠে,চোখ মুখ খিচে সরিয়ে দেয়।ঠোঁট গোল করে বাতাস বের করে বলে,
“What the……এই মেয়ে শুনতে পাওনি, কে তুমি,জিন ভূত হলে আগে বলে দাও জীবন বাঁচিয়ে কেটে পড়ি।”
মেয়েটা নিরুত্তর দেখে এলেক্স রেগে মেগে উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দিতে গেলে।মেয়েটা আচমকা এসে তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে,
প্লিজ, হেল্প মি।প্লিজ!ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
একটু থেমে, চোখের জল মুছে।
“ওরা খুবই বাজে লোক।আপনি কি জানেন এটা কোন জায়গা।?”
“ইতালি”
ইতালি নামটা শুনতেই মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।এলেক্সের জ্যাকেটের কোণা শক্ত করে ধরে বলে,
“আজকের রাতটা আমায় একটু সাহায্য করুন।প্লিজ।”
এলেক্স পিছনে ফিরে মেয়েটার দিকে এক পা এক পা করে এগুতে থাকে।মেয়েটা পিছাতে থাকে। ডাগর ডাগর নয়নে তাকায়। এলেক্স একটা বাঁকা হাসি টানে,
“আর ইউ সিরিয়াস? ”
“হুয়াট?”
এলেক্স এবার হাত উঁচিয়ে আঙুল দিয়ে জিপ্ এর দিকে ইশারা করে বলে,
“ইউ আর নট মাই টাইপ,ভয় পেয়ো না।উঠে বসে পড়ো।”
মেয়েটা একটু সাহস জুগিয়ে।গুটু গুটু পায়ে জিপ্ এর দিকে এগিয়ে উঠে বসে পড়ে।হাতে আর কোনো উপায় নেই।তার সাথে না গেলে এমনিতেও গু্নডাগুলোর হাতে মরতে হবে।ইজ্জত যাবে।অনেক কষ্টে পালিয়ে বেঁচেছে।জিপ্ এ উঠে বসতেই।এলেক্স চুল গুলো পিছনে বেক ব্রাশ করতে করতে জিপে এসে বসে পড়ে।গাড়ি স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলে উঠে,
“নাম কি? ”
মেয়েটা তুতলিয়ে উঠে,
“কা…কার নাম?”
এলেক্স মেয়েটার কাছে এগিয়ে ঝুকে পড়তেই।মেয়েটা পিছনের দিকে হেলে যায়।এলেক্স ঠোঁট কামড়িয়ে হাসে,সিট বেল্টটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“ইউ ফা*কিং গার্ল।ওভার এক্টিং করার কোনো দরকার নেই।ইউ আর নট মাই টাইপ।আন্ডারস্ট্যান্ড?”
মেয়েটা শুকনো ঢুক গিলে বলে উঠে,
“মেরিন ফুল”
এলেক্স গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘাড়টা এপাশ ওপাশ করে,গম্ভির কন্ঠে বলে,
“বোকাফুল”
জিপ্ এর হেডলাইটের আলো কুয়াশা ভেদ করে সরু রাস্তাটা আলোকিত করলো, যেন অন্ধকারকে ছিন্ন করে পথ খুলে দিয়েছে।সে গিয়ার বদলে জিপটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিল ঢালু পথে।
জায়ান হসপিটালের আজ প্রায় পনেরো দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।আইসিইউ এর বেডে শুয়ে আছে জায়ান মাথার পাশে সারি সারি তার, নাকের কাছে অক্সিজেন টিউব, আর সেই যন্ত্রের শব্দ।তবে লিয়ানা এই পনেরো দিনে এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছাড়েনি। না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালচে দাগ, শরীর শুকিয়ে গেছে, মুখে একরাশ নিস্তেজতা। নাদিয়ার সাথে সাথে নার্সরা বারবার বলেছে ম্যাম, একটু বিশ্রাম নিন, একটু কিছু খান। কিন্তু লিয়ানা শুধু একটিই কথা বলেছে এসেছে, “ওনি আগে জেগে উঠুক”
আজও ভোরের আলো ঢুকেছে জানালা দিয়ে। লিয়ানা জানালার পাশে বসে আছে নিঃশব্দে। হাতে জায়ানের সিলভার ব্রেসলেটটা ধরে রেখেছে
ঠিক তখনই হালকা পদশব্দে হসপিটালে প্রবেশ করে এলেনা।তার চোখে সানগ্লাস, মুখে হালকা ক্লান্তি, হাতে একটা বড় ব্যাগ। দূর আমেরিকা থেকে জায়ানের অসুস্থতার খবর শুনে চলে এসেছে।এলেনা এগিয়ে এসে একটু থেমে তাচ্ছিল্য সুরে বললো,
“হেই ইউ।কি করেছো জায়ানের সাথে।একজনকে আর কতো ভাবে শেষ করবে?টু মা’চ ”
লিয়ানা আবাক হয়ে গেলো।আশ্চর্য সে কি করেছে মানে।এলেনা এমন রা’ফট বিহেভিয়ার এর মানে বুঝে উঠতে পারলো না লিয়ানা।কোনো মেয়েকে কি তার হাসবেন্ডের ক্ষতি চাইতে পারে।এলেনা লিয়ানার হাতের মাঝবরাবর শক্ত করে চেপে ধরলো।
“বেঁচে আছো কেন।তোমার মরে যাওয়া উচিৎ ছিলো।তোমার না আছে কোনো যোগ্যতা জায়ানের পাশে থাকার।তুমি একটা আপদ জায়ানের লাইফের।দূর্ভাগ্যে দ্যাট্’স ইট।”
শেষের কথাটুকু যেন লিয়ানার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল।চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।আসলেই কি সে জায়ানের জীবনের একটা আপদ।
এতো বিষমাখানো কথা সহ্য হলো না তার। এমনিতেই মন ভালো নেই তার উপরে এসব কথা।লিয়ানা মাথাটা চেপে ধরে বললো।
“চুপ করুন।আপনি দয়া করে এখান থেকে যান।প্লিজ।”
ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। সেই সময়ই আইসিইউ এর কেবিনের দরজা ঠেলে এক নার্স এগিয়ে এসে বললেন।
“ম্যাম, মিস্টার জায়ানের চেতনা ফিরছে! ”
লিয়ানার মুখে দীর্ঘদিন পর হাসির রেখা দেখা গেলো।লিয়ানা কাঁপা কাঁপা হাতে চোখের জল মুছে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার আগেই এলেনা ব্যাগ নামিয়ে দৌড় দেয় রুমে।এলেনা গিয়েই জায়ানের বেডের পাশে বসে পড়ে।স্যালাইন লাগানো হাতটা ধরে ফুঁপিয়ে উঠে। জায়ানের আঙুলের ফাকের ভাজে মুখ গুজে দেয়।
“তোর কষ্ট আমার সহ্য হয়না তুই তো জানিস।মুখবুজে আর কতোদিন সহ্য করবো।অনেক করে চাই তোকে ছাড়া বাঁচতে। পারছিনা।চোখ খুল তোর সব কষ্ট আমার হউক।ইউর পে’ইন মিন মাই পে’ইন।”
লিয়ানা আইসিইউর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলো বুঝলো।এলেনার প্রত্যেকটা কথা ব্যাখা স্পষ্ট হলো।তাকে পছন্দ না করার তাহলে এটাই কারণ ছিলো।এই মুহূর্তটা লিয়ানার জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণার মূহুর্ত হয়ে দাঁড়ালো।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো ভিতরে প্রবেশ করলো না। কিছু না বলে পেছন ফিরলো। চোখের কোণে জল, মুখে নিঃশব্দ
ঠিক জায়ানের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো।
অচেতন অবস্থার মধ্যেও ঠোঁট নড়লো হালকা করে,
“লিন!মাই White rose”
জায়ানের মুখে লিয়ানার নাম শুনতেই এলেনা জায়ান হাত ছেড়ে দেয়।মৃদু হেসে উঠে।এসব তো আর নতুন কিছু না।আগেও শুনেছে এখনোও শুনছে।জায়ানের জন্যে আনা সাদা গোলাপের তোড়াটা হাত দিয়ে পিষে মেঝেতে ফেলে দেয়।উঠে চলে যেতে নিলে।পিছন থেকে লিয়ানা এলেনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ফেলে।হিংস্র বাঘিনীর মতো বড় বড় চোখ করে এলেনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৩৬
“আগামী ২৪ঘন্টার মধ্যে এই রুমের আশেপাশেও যেনো না দেখি আপনাকে।রি’মাইন্ড দ্যা’ট”
এলেনার হাতটা ছেড়ে দিয়েই লিয়ানা জায়ানের কাছে গিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরে ফেলে।হাত দিয়ে জায়ানের কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কপালে চুমু খায়,তারপর হাতে গালে চুমুতে ভিজিয়ে দিতে থাকে……
