তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৬

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৬
ভূমিকা তালুকদার

ভোরের নীল ছায়া, এক অজানা বিদায়ের সকাল।সকালের আলো তখনও ঠিকমতো ফুঁটে ওঠেনি। ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি হাওয়া ঢুকে আসছিল ধীরে ধীরে—কখনও যেন পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল কারও গালে, আবার কখনও নিঃশব্দে বলে দিচ্ছিল, আজকের দিনটা অন্যরকম।
আর ঠিক তখনই—
“ট্রিং ট্রিং ট্রিং!”
বিছানার পাশে রাখা ফোনটা কাঁপতে কাঁপতে একটানা বেজে উঠল। চাদরের নিচে ঘুমে মগ্ন, এলোমেলো চুলে গুটিশুটি মেরে ঘুমানো লিয়ানা বিরক্ত মুখে এক হাত বার করল। চোখ আধা বন্ধ,,,,উফ! এত সকালে কে আবার কল করলো…?

স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মুখটা আরও বেঁকিয়ে গেল।”আবার মেরিন! এতো সকালে কল দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করার একটাই মানে ও কিছু না কিছু বিম্রি খাওয়াবে।বজ্জাত মেয়ে।
কল রিসিভ করেই,,
-কি মেরিন? গুমাচ্ছিলাম, কানে সুর তুলছিস কেনো,,গলা খানিকটা ভারী, তবুও অভ্যস্ত বন্ধুর প্রতি কাঁপা ভালোবাসার অভিব্যক্তি লুকায়নি।
তুই এখনও ঘুমোস?? গাধা মেয়ে! কলেজের ফেয়ারওয়েলের কথা ভুলে গেছিস নাকি?
ফেয়ারওয়েল? লিয়ানা চোখ বড় বড় করে বসে পড়ল, যেন শব্দটা হঠাৎ কোনো ঘুমন্ত রাজকুমারীর কানে ঢুকে গেছে।ফোনটা হাতে নিয়েই তারিখ দেখল—৩০ জুন।তার মুখে একেবারে চমক..ওঠা অভিব্যক্তি-
উফফ্ মা গো! আজকেই তো ৩০ তারিখ! একদম ভুলেই গেছি,,আচ্ছা তুই না ফোন দিলে আমি তো পুরো প্রোগ্রামটাই মিস করতাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভাগ্যিস আমি আছি! শোন, সব মেয়েরা শাড়ি পরে আসবে, আর ছেলেরা পাঞ্জাবি… তুই কিন্তু নিজে বলেছিলি তুইও পরবি। আজকে না পরলে আমি কসম করে বলছি, তোকে মে*রে বালি চাপা দিয়ে দিবো।
লিয়ানা চোখ বড় বড় করে আয়নার দিকে তাকাল।শাড়ি? দেখি তো… আরে বাপরে, এতক্ষণ তো ঘুমই শেষ হচ্ছিলো না! একেবারে লেট হয়ে গেলাম।
ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৭:৫০।চট করে উঠে ফ্রেশ হয়ে, চুলটা ক্লিপে আটকিয়ে, পায়জামা-টি শার্টেই ছুটে গেল তার ছুটো আম্মু শারমিন খানের রুমে। এই ছন্নছাড়া মেয়েতো শাড়ি কিভাবে পরতে হয় জানেই না।পরবেই বা কিভাবে তাই নিজের চাচির রুমের দিকে দৌড় লাগালো।ছোট আম্মু, শুনুন তো… আজকে কলেজে ফেয়ারওয়েল… সবাই শাড়ি পরবে… মেরিনরা বলছে আমাকেও পরতে হবে। কিন্তু আমি তো পারি না পরতে,তুমি না পরিয়ে দিলে আমি পরতেই পারবো না। প্লিজ্‌,প্লিজ্‌ একটু হেল্প করো না?”

শারমিন চোখ এক ঝলক চমকে উঠল।
ওররে আমার লিয়ানা রে! তুই শাড়ি পরবি? আমার সোনামণি বড় হইছে রে! আয় আয়, আমার ওয়ারড্রব খুলি, দেখি কি তোকে মানায়!
সোনালি আলমারি খুলে একটার পর একটা রঙিন শাড়ি বের করতে
লাগলেন তিনি। তার চোখ যেন আনন্দে ঝিলমিল করছিল।
এই যে দেখ, এইটা নীল পাটভাঁজের সিল্ক, নীলরঙা শাড়ির মাঝে পাতলা রূপোলী পাড়। এটা তোকে একটা পরীর মতো মানাবে।লিয়ানা শাড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো আয়নার সামনে। চোখে একটা বিস্ময়ের ঝিলিক।
আসলে… খুব সুন্দর তো…

আর কথা না, আয় বস্‌। আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
শারমিন খান একদম যত্ন করে, ধৈর্যের সঙ্গে শাড়িটা পরিয়ে দিলেন। কোমরে একটু কষে পিন, আঁচলে নরম ভাঁজ, আর হাতখানা ঘুরিয়ে এনে একটা টিকিয়ে দেয়া স্টাইল। তারপরে সামনের চুলগুলো এলিয়ে এনে, পিছনের দিকটা খোঁপা করে পিন দিলেন। লিয়ানা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
তার ত্বক আজ একেবারে জ্যোৎস্নায় ভেজা—উজ্জ্বল, নিস্পাপ। গালটা একটু গোল, চোখে মায়াবী আভা। ঠোঁট দুটো আলতো গোলাপি, একটুও সাজ না থাকলেও যেন ইতিমধ্যেই সজীব। কানের পাশে চুলটা আলতোভাবে ঘামে ভিজে পড়েছে, যা তাকে আরও কোমল করে তুলছে।একটা কালো ছোট্ট টিপ, পাতলা কাজ করা কাঁচের চুড়ি,—এই ছোট ছোট সাজে লিয়ানা যেন একেবারে স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে যেন নিজেকেই চিনতে পারছে না।

আমি এটা? আমি কি সত্যিই এতটা সুন্দর হতে পারি?ধুর নিজেকে নিজে কেউ সুন্দর বলে নাকি!
তারপর ধীরে ধীরে সে ফিরলো নিজের রুমে—আর জানালার ওপাশে রোদ এসে পড়েছে বিছানার লাল চাদরে। তার প্রতিফলনে যেন সে নিজেই নিজের ছায়ার ভেতর খুঁজে নিচ্ছে কে সে আসলে… আর আজকের দিনটা কতটা নতুন হতে যাচ্ছে!লিয়ানার হাতে তখনও তোয়ালে, চোখে অস্থিরতা। নিজে থেকে কিছু বলতে পারছে না, শুধু এক অদ্ভুত কৌতূহল আর শঙ্কা ওকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে গেল জায়ানের রুমের দিকে।গতরাতে রাগী লোকটা কড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছিলেন রাতের বেপারের কথা কারো সামনে যেন মুখে না আসে, লিয়ানার।নিজের বড় আম্মু শুনলে অস্থির হয়ে পড়বেন,তাই ভেবে লিয়ানাও কাউকে কিছু বললো না।তবু বুকের গভীরে জমে থাকা উদ্বেগের পাহাড়ে চড়ে লিয়ানা পৌঁছে গেল সেই দরজার সামনে।দেখি তো এনাকোন্ডাটা কি করছে।হাতটা বাড়িয়ে ধাক্কা দিলো হালকা করে—
ক্লিক।

ডোর লক করা।
হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল।
ভেতরে নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন,ব্যাথার ওষুধ তো নিয়েছিলেন রাতে, সাথে
ঘুমেরও।
“উনি যদি ঘুম থেকে না উঠেন? যদি কিছু হয়ে যায়? যদি…
ধুর, বাজে চিন্তা করিস না লিয়ানা,”নিজেকেই ধমকালো সে।
তবুও মনে একটা চাপা কষ্ট থেকে গেলো।কিন্তুু বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারলো না ভিতরে থাকা লোকটা যদি ঘুম থেকে উঠে তাকে না দেখে কি যে কাহিনী ঘটিয়ে বসবে কে জানে!দরজায় কানের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একবার শোনার চেষ্টা করলো ভেতরে কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা।না, সব যেন নীরবতায় গিলে গেছে।তবু আর কিছু না ভেবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো—যেন কিছুই হয়নি।ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ঠিক তখনই মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেল—

“ফেয়ারওয়েলে যাচ্ছিস, না? ঠিক আছে, কিন্তু খেয়ে যা আগে মা। খালি পেটে গেলে মাথা ধরবে আবার।”
লিয়ানা ব্যস্ত গলায় বলে উঠল,
না আম্মু, অনেক লেট হয়ে গেছে। কলেজে খেয়ে নিবো, বেরোচ্ছি আমি!
মাথায় একরাশ ঝড়, কিন্তু মুখে হাসি রাখার চেষ্টা।
বাইরের গাড়ির শব্দ পেয়ে যেনো সেই সমস্ত চিন্তা মুহূর্তেই চাপা পড়ে গেলো দরজা খুলে বসতেই শহরের ভোরের আলোতে ওর চোখে এসে পড়ল এক ঝলক সূর্যরশ্মি।কিন্তু লিয়ানার মন তখনো আটকে আছে সেই বন্ধ দরজার ওপারে, যেখানে এক নিঃশব্দ অস্থিরতা অপেক্ষা করছে জেগে ওঠার।সকালটা আজ যেন একটু বেশিই রোদেলা। কলেজের সামনের খোলা চত্বরটা সাজানো হয়েছে ছোট ছোট রঙিন পতাকা, ব্যানার, আর বেলুনে। একটা বড় স্টেজ বানানো হয়েছে, যেটার পাশে দড়িতে ঝুলছে “Farewell to 12th Grade Students” লেখা প্ল্যাকার্ড। সাউন্ড বক্সে বাজছে হালকা মিষ্টি গানের সুর। সব মিলিয়ে চারদিকেই এক উৎসবমুখর পরিবেশ।একেক করে শিক্ষার্থীরা ভিড় করছে। ছেলেরা কেউ কোট-প্যান্টে, কেউ
শার্ট-প্যান্টে,পাঞ্জাবি আর মেয়েরা একেকটা যেন সাজানো পরীর মত সেজে এসেছে। বৃষ্টির মতো ফুল ঝরছে কারও মাথায়, কেউ হাসছে, কেউ ছবি তুলছে—সবমিলিয়ে চারদিকই মেতে উঠেছে।
ঠিক সেই সময়—

একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল কলেজ গেটের কাছে। জানালা নামতেই দেখা গেল, লিয়ানা মাথা নিচু করে চুল ঠিক করছে, নীল রঙের সিল্কের শাড়িটা একটু পেছন থেকে ঠিক করে নিচ্ছে। এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে ফোন ধরে ব্যস্তভাবে কিছু টাইপ করছিল। তারপর হঠাৎ—
গাড়ি থেকে নামতেই পায়ের হিলটা একটু বেঁকে গেল, আর তার উপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ আচমকা পিছিয়ে আসায়—
“ঢ্যাঁৎ!”

এক চমকে লিয়ানা তার ভারসাম্য হারিয়ে ধপাস করে ধাক্কা খেয়ে বসলো,,এক সুদর্শন অপরিচিত পুরুষের সাথে! হঠাৎ পুরো গেট এলাকার চেহারা পালটে গেল।
লিয়ানা চট করে কাপড় ঠিক করতে করতে বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল—
এই যে মিস্টার ! দেখে চলতে পারেন না?! সুন্দরী মেয়ে দেখলে গায়ের সাথে ধাক্কা খেতে মন চায় নাকি! আহা চোখে আবার কালো চশমা ! অন্ধ নাকি??
একটানা কথা গুলো বলে গলা রাগে কাঁপছিল, কিন্তু তার মুখটা ছিল লাল হয়ে ওঠা রাগ আর লজ্জার এক অদ্ভুত মিশ্রণে।এদিকে যার উপর পড়ে গিয়েছিল লিয়ানা, সে ধীরে তাকালো তার দিকে। সে কিছু বলার আগেই,
আররেএএ!চুপ করুন,, কোনো বাহানা বানাতে হবে না!ফালতু বেটা মানুষ। মুডটাই শেষ করে দিলো।
এইসব চেঁচামেচিতে এক মুহূর্তেই গোটা কলেজের গেট জমে গেল। শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। কেউ ভিডিও করছে, কেউ ফিসফিস করছে,
কিন্তু সেই লোক?

সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, হাতের সানগ্লাসটা খুলে লিয়ানার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।তার চোখে কোনও রাগ নেই। বরং—মুগ্ধতা। সে যেন আর কিছু দেখছে না, শুধু সেই মেয়েটির কাঁপা কাঁপা চোখ, তার কপালের মাঝখানে কালো টিপ, তার নীল শাড়ির পাড়ের সঙ্গে দুলতে থাকা সোনালী কাজের আভা।তার মনে হচ্ছিল, যেন এক কবি চোখের সামনে জীবন্ত কবিতা খুঁজে পেয়েছে।তার ঠোঁটের কোণে একটুকরো মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ধীর গলায় সে মনে মনে শুধু বলল,
“এই মেয়ে কি জানে,, সে দেখতে কেমন? ঠিক যেন নীল রঙা বৃষ্টির মাঝে ফুটে ওঠা প্রথম শিউলি ফুলের মতো… রাগটাও কি অপূর্ব।”
লিয়ানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। সে জানে না এই লোক কে, কোথা থেকে এল, মেরিন লিয়ানার হাত টান দিয়ে একরকম জোর করেই ওকে নিজের পাশে নিয়ে এলো, মুখটা ওর খুব কাছাকাছি এনে চাপা গলায় ফোঁস করে বলল,

পাগল মেয়ে! কী করছিলি তুই? কাকে কী বলছিস জানিস? একবারও বুঝলি না—
জানার ইচ্ছা, আগ্রহ, কিছুই নেই!কী গায়ে-পড়া লোক রে বাবা!”
চুপ থাক, শালী!মেরিন চোখ গোল করে কটমট করে তাকাল, ওনি এই কলেজের এক্স-স্টুডেন্ট। ওনার থেকেও বড় কথা, আজকের স্পেশাল সারপ্রাইজ গেস্ট!
লিয়ানা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, কে?
-বাংলাদেশের নবপ্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় রকস্টার
মঞ্চের লাইট সেই লোকের দিকে। আর সেই মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত গলায় ঘোষণা করা হলো,,,
আজকের কলেজে বিশেষ অতিথী হিসবেে উপস্থিত হয়েছেন—বাংলাদেশ রকস্টার,,
ইশান শেখ
চারদিক থেকে হঠাৎ করেই একরাশ করতালি, চিৎকার আর হর্ষধ্বনি ভেসে এল। মঞ্চের আলোতেও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ—লম্বা চুল, ব্ল্যাক জ্যাকেট, হাতে মাইক, আর সেই নিজস্ব স্টারলাইট চাহনি।
লিয়ানা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চারপাশের উচ্ছ্বাসের মাঝেও তার কানে যেন হিমশীতল একটা নিস্তব্ধতা বাজল। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল,

কি বলিস! এত বড় রকস্টার? আমি তো চিনলামই না! কখনও দেখিনি তো… অবশ্য আমি তো ব্যান্ড মিউজিক শুনি না, তাও আবার বাংলাদেশের তো একদমই না!
মেরিন ওকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, তোর মুখে তালা দে এখন। আর কিছু বলিস না, প্লিজ।উপস্থাপক গলা ঝেড়ে মাইক্রোফোনে বলল—
এবার আমাদের আজকের বিশেষ চমক, যাঁর জন্য আপনারা এই আসরে অপেক্ষা করছিলেন,,, এক মুহূর্তের জন্য পুরো অডিটোরিয়ামে আলো নিভে গেল।
তারপর—

ব্লু-হোয়াইট হেডলাইট ফেটে পড়ল মঞ্চের ওপর। সেই আলো সরাসরি গিয়ে পড়ল একটিমাত্র জায়গায়—এক পুরুষ মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে, হালকা ঝুঁকে, চোয়ালে স্থির আত্মবিশ্বাস, চোখে সেই চিরচেনা অদ্ভুত জ্যোতি
আলোর ফাঁকে ফাঁকে, লোকটার চোখ সারি সারি মানুষের মাঝখান থেকে হঠাৎ থেমে গেল একটি রঙে।
নীল রঙা শাড়ি।
প্রায় চারশো ছাএ ছাএীর ভিড়ে, আলো-আঁধারির মধ্যেও সে স্পষ্ট দেখতে পেল সেই মেয়েটিকে—যার চোখ তখন নামানো, ঠোঁটে চেপে রাখা অস্বস্তি, আর গালে যেন সামান্য লালচে আভা।
লিয়ানা।

সে নিজেই অবাক।
‘কি করলাম আমি? এতটা নোংরা কান্ড করে ফেললাম একটা অনুষ্ঠানে?
মেরিন পাশে ফিসফিসিয়ে বলল, তুই জানিস না আসলেই? ওনি যে একজন গায়ক,,। ওনার গান তুই শুনিস না বুঝি?”
লিয়ানা ম্লান গলায় বলল, “বললাম তো আমার ব্যান্ড মিউজিক একদম ভালো লাগে না, বাংলাদেশি তো দূরের কথা,,আমি চিনিই না!
মেরিন ফোঁস করে উঠল, “তুই পাগল? চুপ কর, সব লোক এখন তোকে দেখছে। চুপচাপ বসে থাক—আর মুখ দেখাস না!”

মঞ্চে তখন গিটার তুলে নিচ্ছে ইশান।
ধীরে ধীরে চারপাশে আলো জ্বলে উঠছে। বেজে উঠছে soft bass আর electric riff।
গিটারটায় আঙুল ছোঁয়াতেই বাজল প্রথম ঝংকার।তালির ঝড় উঠল অডিটোরিয়ামে।লিয়ানা মুখ নামিয়ে ফেললো।সেই মুহূর্তে ইশান শেখ চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করল—
🎵
“যখন খোলা চুলে,,
হয়তো মনের ভুলে,, তাকাতো সে অবহেলে দুচোখ মেলে…”
🎵
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে নরম গিটার বাজতে শুরু করে। লাইভ মিউজিক শুরু হয়েছে।
🎵
“হাজার কবিতা, বেকার সব ইতা,,
তার কথা কেউ বলে না,,,
সে প্রথম প্রেম আমার—নীলাঞ্জনা…”
🎵
ইশানের গান শেষ হতেই গোটা অডিটোরিয়াম যেন থমকে যায় কিছুক্ষণ। দর্শকদের করতালির মধ্যে একরাশ আবেগ, বিস্ময় আর প্রশংসা মিশে ছিল। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ওঠে, কেউ হাততালির সাথে চিৎকার করে ওঠে—

“ওয়াঞ্চ মোর,,,
“ইশান ভাই,,, সেই,,,
কিন্তু ইশান তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে থেকেও অন্য কিছুতে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছিল না। তার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই নীলশাড়ি পরা মেয়েটির খোঁজে, যার চোখে এক অপার্থিব লজ্জা আর বিস্ময়ের ছায়া ছিল।
এই সময়েই ঘোষণা হলো,
এবার আমরা দেখতে চলেছি আমাদের কলেজের অন্যান্য প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের একে একে কিছু অসাধারণ পারফরম্যান্স।”তারপর শুরু হলো ক্লাসিকাল নাচ, রবীন্দ্রসংগীত, নাট্যাংশ, মডেলিং… একের পর এক রঙিন দৃশ্য বুনে গেল সকালের শরীরজুড়ে।শেষ পারফরম্যান্সের পর, স্টেজে আসেন প্রিন্সিপাল।তিনি সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন প্রথমে। এরপর তাঁর কণ্ঠে একটু কর্কশতা এলো, আবেগের স্পর্শ।—”তোমরা আজ যারা বিদায় নিচ্ছো, তারা শুধু এই কলেজের ছাত্র নয়, আমাদের পরিবারের অংশ।

এই অডিটোরিয়ামে তোমাদের হেসে ওঠা, রাগ করা, ভালোবাসা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সবকিছু যেন আজও বাতাসে গুমরে কাঁদে।কেউ কেউ হয়তো
আগামীকালই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে, কেউ কেউ হয়তো আর দেখা দেবে না কোনোদিন।কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাদের প্রতিটি পদচিহ্ন এই কলেজের দেয়ালে দেয়ালে থেকে যাবে।”
এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। তারপর আবার করতালি।
অনুষ্ঠান শেষ।

মানুষজন আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ছবি তোলা, কান্না, হাসাহাসি—সব মিলিয়ে যেন এক অনুভবের কোলাজ।ইশান নিচে নেমে আসে। তার চোখ খোঁজে সেই মুখ।
ভাই, এভাবে তাকিয়ে কি দেখিস?পাশে এক বন্ধু কৌতুক করে বলে।
ইশান একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকায়, তুই চুপ কর।
তারপর একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে পরিচিতদের যারাই তার কাছে অটোগ্রাফ নিতে আসে—
এই, ওই নীল শাড়ি পরা মেয়েটার নাম জানো?
ও তো… হুম… ক্লাস টুয়েলভের।
নামটা?

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৫

মনে নাই ভাই। ও তো অনুষ্ঠান শেষ হতেই চলে গেল।
ইশানের বুকটা ধ্বসে পড়ে যেন।সে ছুটে যায় দরজার দিকে। গেটের সামনে। কিন্তু ততক্ষণে একটি কালো প্রাইভেট কার ধুলোমাখা আলো ছড়িয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেছে কলেজের গেট দিয়ে। সামনের সিটে, চুল খোলা এক মেয়ে জানালার পাশে বসে আছে।ইশান দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। গেটের দিকে তাকিয়ে।
হয়তো মনে মনে বলে—
তোমার নামটা জানতে হবে আমায়… কে তুমি???

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here