তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৯

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৯
ভূমিকা তালুকদার

প্রায় দুই দিন কেটে গেছে, কিন্তু সেই রাতের পর থেকে খান বাড়ির বাতাসই যেন বদলে গিয়েছে।যেন প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি করিডোর সেই ঘটনার চাপা ছায়া ধরে রেখেছে।লিয়ানা তার ঘর থেকে বের হয়নি— আর জায়ানও আসেনি তার কাছে।পুরো বাড়িতে সবার আচরণ পাল্টে গেছে। কেউ কারও সাথে চোখে চোখ মেলাতে সাহস পায় না।খাবারের টেবিলে সবাই নিঃশব্দে বসে, তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নিজ নিজ ঘরে চলে যায়।যেন কেউ ভয় পাচ্ছে— আবার না কোনো অঘটন ঘটে যায়।আজ বিকেলের পর থেকেই বাইরের আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে।আকাশে কালচে মেঘ জমে আছে, গাছে গাছে হাওয়া জোরে দুলছে।

লিয়ানা বারান্দার এক কোণে বসে, হাওয়ার ঠান্ডা ছোঁয়া গায়ে মেখে, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে অন্ধকার হয়ে আসা
আকাশের দিকে।হঠাৎ তার মনে পড়ে, ছাদে তার কিছু ফুলের গাছ আছে,যদি আজ রাতে ঝড় হয়, গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাবে! মনে মনে ভাবতে থাকে দ্বিধা না করে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ছাদের সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে লিয়ানা।উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে, ঠিক পাশেই জায়ানের রুম পিছনে ফিরে এক ঝলক তাকায় সেদিকে।দরজা সামান্য ফাঁকা,ভেতরটা অন্ধকার, আলো জ্বলছে না।লিয়ানা থমকে দাঁড়ায়।
তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক— “একবার গিয়ে দেখি? না,,থাক,,অযথা ঝামেলা বাড়াতে চাই না।এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে— ফুলের গাছগুলোর দিকে।লিয়ানা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে, হাতে ছাদের দরজার খুলে ভেতরে ঢোকে।ঠান্ডা বাতাস তার চুল উড়িয়ে দেয়, আর আকাশে ঝুলে থাকা কালচে মেঘ বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে ওঠে।
হঠাৎ—
লিয়ানার চোখ পড়ে ছাদের এক কোণে, রেলিংয়ের পাশে।কেউ দাঁড়িয়ে
আছে।ছয় ফিটের লম্বা,শরীর।অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না, শুধু লম্বা
অবয়বটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।লিয়ানার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।গলা দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইলেও… শব্দ আটকে যায়।তারপর মনে হয়, বুকের ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি মেরেছে,এ আবার কে?!
বিদ্যুতের হালকা ঝলকানিতে মুখটা স্পষ্ট হয়—

এ তো জায়ান!
ঠান্ডা বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখ যেন দূরের অন্ধকারের ভেতরে কিছু খুঁজছে।লিয়ানা ধাক্কা খাওয়ার মতো পিছু হটে,
আরেে এতো জায়ান ভাইয়া! ওনি এখানে? কি করছেন।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় আগের ঘটনাগুলো ঝলসে ওঠে।সে ঠোঁট কামড়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়—যা-ই করুক, আমার কী! আমি গাছগুলো সরিয়ে নেই, না হলে আবার এই লোকটার চোখে পড়লে তার হাতে মার খাবো,,,
লিয়ানা গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে।তার স্লিপারের হালকা শব্দ ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে যায়।আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, বিদ্যুতের আলো দূরে কোথাও এক সেকেন্ডের জন্য চমকায়।
হঠাৎ—

জায়ান পেছন থেকে, নিচু গলায় বলে,
এভাবে চোরের মতো হাঁটছিস কেন,, লিন?
লিয়ানার বুক ধক করে ওঠে।সে ঘুরে তাকায়,,জায়ান ঠিক যেমন ছিল,
রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে, সেভাবেই আছে।কোনো নড়াচড়া নেই।
কিন্তু লিয়ানা থমকে যায়।
আপনি?,,না দেখে কিভাবে বললেন আমি?
জায়ান ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়।তার চোখে অদ্ভুত এক শান্ত তীক্ষ্ণতা।
“এখানে আয়।”
হাত দিয়ে ইশারা করলো।
রাতে ছাদে উঠেছিস কেনো? তাও আবার চুল ছেড়ে,, এত সাহস তোর?
লিয়ানা একটু এগিয়ে আসে।ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি,
জায়ানের মুখ পুরো আলোকিত হয়।তার ঠোঁটের নিচে ফ্যাকাশে একটি দাগ,
লিয়ানার চোখ বড় হয়ে যায়এটা তো বড় আব্বু সেদিন থাপ্পড় মেরে দিয়েছিলো যে সেটার আঘাতের চিহ্ন,, সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল এইটা।

লিয়ানা এক মুহূর্ত থেমে যায়, তারপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই এগিয়ে গিয়ে বলে
আপনি, এতে ওষুধ লাগাননি? এত careless কেন?
জায়ান ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি টেনে বলে
“হ্যাঁ.. তোর জন্যই রেখে দিয়েছিলাম।”
ঠান্ডা বাতাসে লিয়ানার চুল উড়ছে, বিদ্যুতের ঝলকানি আকাশে মাঝে মাঝে আলো ফেলছে।সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জায়ানের ঠোঁটের নিচের ক্ষতটার দিকে তাকায়।কোনো অনুমতি না নিয়েই একটু উঁকি দিয়ে,,তার আঙুল ক্ষতটার ওপর আলতো করে ছুঁয়ে দেয়।
“ইশ,,এখানেও এখনো রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
বেশি ব্যাথা পেয়েছিলেন, তাই না? সব আমার জন্য।”
জায়ানের চোখের দৃষ্টি এক সেকেন্ডে বদলে যায়।সে হঠাৎ লিয়ানার হাত ধরে ফেলে টেনে নিয়ে আরেক হাতে লিয়ানার কোমর জড়িয়ে ধরে ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে ছাদের রেলিংয়ে বসিয়ে দেয়।পেছনে ঝলমলে শহরের লাইট, সামনে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

জায়ান কিছুটা লিয়ানার দিকে ঝুঁকে বলে,,,
এতো কাছে আসিস না..আমি তোকে বরবাদ করে দেবো।
জায়ানকে এতো কাছে আসতে দেখে লিয়ানার বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,চোখে ভয় আর অদ্ভুত এক আকর্ষণ,যেন হৃদস্পন্দন থেমে গেছে।
জায়ান লিয়ানার একদম কাছে,,,চাঁদের আলো আর বিদ্যুতের ঝলক
মিলেমিশে জায়ানের চোখে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রঙ ফুটিয়ে তোলেছে।তবে লিয়ানার চোখ পরে জায়ানের ঠোঁটের নিচের বাদামি তিলটার দিকে। একটা পুরুষ মানুষের ঠোঁটের নিচে তিলক ভারি অদ্ভুত সুন্দর আর আকর্ষণীয়। লিয়ানা অজান্তেই চোখ নামিয়ে ফেলে দেখে জায়ানের শার্টের সব বোতাম খোলা,শার্ট বাতাসে দুলছে আর তার বুকের রেখা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

লজ্জায় লিয়ানা চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলে।
আ…আপনি কি! আমাকে ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলতে চান নাকি?
নামিয়ে দিন, প্লিজ।পড়ে যাবো তো!
জায়ান কোনো উত্তর দেয় নাশুধু গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে,বাতাস, নিস্তব্ধতা আর দূরে বজ্রের গর্জন,মুহূর্তটাকে আরও ভারী করে তোলেছে।বিদ্যুতের আলোয় মুহূর্তে জায়ানের চোখে হিংস্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফুটে ওঠে।
সে হঠাৎ লিয়ানার কোমরে আরও শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরে,যেন এক ইঞ্চি ফাঁকও রাখতে চায় না।
আমি থাকতে তোকে পড়তে দেবো?
লিয়ানা আতঙ্কে ফিসফিস করে বললো-
না..মানে,এতটা কাছে আসবেন না,, আমার,,আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে,,,।
Owhh shit!আমি এসেছি নাকি তুই এলি?”
লিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-
আচ্ছা.. একটা কথা,,একটা প্রশ্ন করবো? সত্যি উত্তর দেবেন তো?
কি?

আপনি কি আবার চলে যাবেন ফ্রান্সে,, আমাদের সবাইকে ছেড়ে?
জায়ান ধীরে ধীরে এক কদম আরও কাছে আসে, কণ্ঠে শীতল ব্যঙ্গ—
সবাইকে? নাকি এটা বোঝাতে চাইছিস,,তোকে ছেড়ে যেন না যাই?
মোটেই তেমন কিছু না।
তাইই?জায়ান হঠাৎ লিয়ানার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে আসে।তাকে এভাবে কাছে আসতে দেখে লিয়ানা দু’হাত দিয়ে জায়ানের শার্ট শক্ত করে চেপে ধরে
আঙুলগুলো যেন কাপড় ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।
সরে যান,, ভুলে যাবেন না,,we are cousin.

Just cousin?
“Yes.”
“Really?”But now,I am going to destroy you.
জায়ান এক হাতে লিয়ানার মুখের সামনে এসে থাকা চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়,বিদ্যুতের ঝলকানি আবার আকাশ ছিঁড়ে পড়ে,
পেছনে হাওয়া তীব্র হয়, আর লিয়ানার গলা শুকিয়ে যায়,,মুহূর্তটা অদ্ভুত ভয় আর উত্তেজনায় ভারী হয়ে ওঠে,শ্বাস কাঁপছে, চোখে অবিশ্বাসের ছাপ।তারপর নিঃশ্বাসের দূরত্বে ঝুঁকে জায়ান লিয়ানার গালে এক গভীর চুমু, দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে লিয়ানার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল –
আমায় থামিয়ে দিচ্ছিস না কেনো??…এত শখ তোর !এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যা ভালো হতে টাকা লাগে না।
বলেই জায়ান এক গালে হেসে দিলো,,,লিয়ানার কাছ থেকে সড়ে যাবে ঠিক সেই সময়ই,, লিয়ানা চট করে জায়ান এর শার্টের কলার ধরে কোনো কিছু না ভেবেই বলে দেয়,,,
আপনি…আপনি কি….আমায় ভালোবাসেন, জায়ান ভাই?”

না!
ওহহহহ।
লিয়ানার চোখে রাগ, অপমান আর হতাশা,সে ঝটকা দিয়ে জায়ানের
থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়,দাঁত চেপে, ঠোঁট কামড়ে গটগট করে হাঁটতে শুরু করে সিঁড়ির দিকে।প্রতিটি পদক্ষেপে হাওয়ায় তার রাগের তাপ যেন ছড়িয়ে পড়ছে।ছাদের অর্ধেক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, এক গালে বাঁকা হাসি নিয়ে
লিয়ানার সরে যাওয়া দেখতে থাকে,,বজ্রের ঝলক তার মুখে পড়তেই সেই হাসিটা আরও গভীর হয়,,যেন সে জানে, লিয়ানা যতই রেগে যাক,,গল্প এখানেই শেষ নয়,,,তারপর জায়ান ও নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলে।

রাত প্রায় দুটো,
রুমের ভেতর হালকা লাইট, জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে। জায়ান সোফায় বসে আছে। হাতে আধা খাওয়া হুইস্কি গ্লাস।গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।
হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে নাম ভেসে ওঠে, -মার্কো।জায়ান ফোন তোলে রিসিভ করে।
মার্কো ফোনের ওপাশ থেকে ভয়মাখা তাড়াহুড়োয় কন্ঠে বলে উঠে,
Zayan! listen to me very carefully The court just moved the final hearing forward Its happening tomorrow morning.(জায়ান খুব সাবধানে আমার কথা শুন। আদালতে সবেমাত্র চূড়ান্ত শুনানিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এটি ঘটছে আগামীকাল সকালে।)

___[⛔বোঝার সুবিধার্থে:বাংলাদেশ আর ফ্রান্সের সময়ের পার্থক্য ৪ ঘন্টা। সে হিসেবে বাংলাদেশে যেহেতু এখন রাত ২টা বাজে তাহলে ফ্রান্সে তখন রাত ১০টা।]
মার্কোর এহন কথায় জায়ান বেশ্ চিন্তিত হয়ে পড়ে,কপালে আঙুল ঠেকিয়ে ভুরু কুঁচকে, হালকা ঠোঁট চেপে,বলে,
Impossible We had three more weeks.(অসম্ভব! আমাদের হাতে এখনো তিন সপ্তাহ সময় আছে।)
মার্কো-
No!জায়ান নো!
জানালার বাইরে বজ্রপাত, এক মুহূর্তের জন্য ঘরের ভেতর আলো ঝলসে ওঠে। জায়ান টেবিলে রাখা সেই USB এর বক্স টার দিকে তাকায় যেটা সে সেদিন চিটাগং থেকে নিয়ে এসেছিলো যেটার জন্য তাকে হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসতে হলো।
জায়ান হালকা দম নিয়ে, ধীরে বলে,

Book me the earliest flight. I’ll be in Paris before the sun sets there.(আজকের প্রথম দিকের ফ্লাইট টা বুক কর,,,সূর্য উঠার আগে আমি প্যারিসে উপস্থিত থাকবো।)
লাইন কেটে যায়। ঘরে বৃষ্টির শব্দ আর জায়ানের শ্বাস ফেলার শব্দ মিশে যায়।সে USB হাতে তুলে নেয়, এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে এক শীতল হাসি।অন্ধকার রাত, কাঁচের দরজায় আলো।জায়ান কালো কোট পরে নেয়, ট্রলির উপরে শুধু একটি ছোট ব্যাগ। তার চোখে হিমশীতল দৃঢ়তা
আজ রাতেই “সে বাংলাদেশ ছাড়ছে”।সিঁড়িঘরে হালকা আলো, চারদিকে গাঢ় নীরবতা। জায়ান ধীরে ধীরে লিয়ানার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ম্লান আলো দেখা যায়, ভেতরে হয়তো লিয়ানা ঘুমোচ্ছে।জায়ান দরজার হ্যান্ডেলের দিকে হাত বাড়িয়ে থামে।এক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। চোখে এক অদ্ভুত মিশ্রণ—স্নেহ, অপরাধবোধ, আর তীব্র তাড়াহুড়ো।

বলে যেতে পারলাম না, কিন্তু কাজ শেষ করেই ফিরব,very soon”
এক সেকেন্ড থেমে,
গুড, বাই!
জায়ান ধীরে পা টেনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে।সোফার পাশ দিয়ে, বড় ঝাড়বাতির নিচ দিয়ে হাঁটে,, সামনের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।
দরজার কাছে এসে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। গাড়িতে ওঠার আগ মুহূর্তে সে একবার ঘুরে নিজের বাড়ির দিকে তাকায় সেই প্রাসাদের মতো খাম্বা, জানালার পিছনের ম্লান আলো, আর স্মৃতির ভার।মৃদু নিশ্বাস নিয়ে দরজা খোলে, ভেতরে ঢোকে,,গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট—নিম্ন গর্জন রাতের নীরবতা ভেঙে দেয়।গাড়ি বাড়ি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে… আর বাড়ি অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

প্যারিস, ফ্রান্স | চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্ট |
প্যারিসের সকালের আলো, আইফেল টাওয়ারের সিলুয়েট। এয়ারপোর্টের বাইরে চকচকে কালো Lamborghini দাঁড়িয়ে, ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন।
ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দেয়।জায়ান গাড়িতে ওঠে, বুক পকেটে থাকা সানগ্লাসটা পরে এক শব্দে বলে-
হাইকোর্ট,, ফুল স্পিড
গাড়ি বজ্রগতিতে ছুটে যায়, রাস্তার দুই পাশে প্যারিসের বিল্ডিং, সাইনবোর্ড, আর গাড়ির ভিড় স্লো-মোশনে পিছিয়ে পড়ছে।

[Palais de Justice de Paris (ফ্রান্সের হাই কোর্ট)]
কোর্ট বিল্ডিংয়ের ভেতর,উত্তেজনার তুঙ্গে পরিবেশ। বিশাল হলরুমে বিচারক আসনে বসে, দুই পাশে আইনজীবী, সামনে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা টিম।
বিচারক গম্ভীর স্বরে -Final evidence?
প্রসিকিউশনের টিম দ্বিধায়—
Your Honour!our lead counsel Mr. Zayan এখনও পৌঁছায়নি।
প্রতিরক্ষা টেবিলে বসা মাফিয়া নেতা, দামি স্যুটে, হালকা কুটিল হাসি দিয়ে বলে,
দেখলেন তো? No evidence. no case.-তার হাসি আদালতের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।
জায়ানের টিমের সদস্যরা (মার্কো, এলেনা, নাদিয়া, এলেক্স) ঘড়ি দেখছে—চোখে আতঙ্ক, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।বিচারক হাতুড়ি তুলতেই
হলরুমের বিশাল দরজা ধাক্কা মেরে খুলে যায় সবাই তাকিয়ে দেখে, দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে জায়ান। কালো স্যুটে, হাতে সেই USB। ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোয়, পুরো হলরুম নিস্তব্ধ।সে সরাসরি বিচারকের ডেস্কের সামনে গিয়ে ল্যাপটপে USB লাগায় স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মাফিয়া লিডারের চোরাচালান, হত্যা, আর অর্থপাচারের ভিডিও ফুটেজ।হলরুমে শোরগোল মাফিয়ার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়।বিচারক গম্ভীর কণ্ঠে বলে-
এই আদালতের রায় অনুযায়ী অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।”আদালতে করতালির ধ্বনি, সংবাদমাধ্যমের ফ্ল্যাশের ঝলকানি।

পুলিশ মাফিয়াকে নিয়ে যাচ্ছে যাওয়ার আগে সে জয়ানের দিকে তাকিয়ে ধীরে, কুটিলভাবে হাত নাড়ে—
This isn’t over-তার চোখে স্পষ্ট হুমকি,তোকে শেষ করে দিবো।
জায়ানের চোখে শীতল স্থির হয়ে আছে। নির্ভীক,কিন্তু ভেতরে বোঝা যায়,, যুদ্ধটা মাত্র শুরু হয়েছে।কোর্টের রায় ঘোষণার পর, জায়ানের টিম মার্কো, এলেনা, নাদিয়া, এলেক্স সবাই হাসিখুশি। কেউ হাই-ফাইভ দিচ্ছে, কেউ একে অপরকে আলিঙ্গন করছে। কোর্টের গেটের বাইরে সাংবাদিকদের ভিড়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি থামছেই না।
জায়ান হালকা হাসি দিয়ে সিগারেট ধরায়, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে —
এই ফা*কিং কেস এর জন্যে আমার সুইটহার্টকে দেশে রেখে আসতে হয়েছে। কাল সকালেই আমি আমার প্রাইভেট জেট-এ ওকে উড়িয়ে নিয়ে আসবো।সবাই দেখবে শুনবে জায়ান খান আসলে কে!
এ কথা শুনে মার্কো, নাদিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে টিজ করতে শুরু করে —

Ooooh!Mr. Romantic!
Bring her to Paris। we wanna meet her too!
তবে তাদের এসব এলেনার একদমই পছন্দ হলোনা যেনো সে চায়না লিয়ানা ফ্রান্সে আসুক।আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, রাস্তার ল্যাম্পগুলো জ্বলছে।
জায়ান কালো “Lamborghini Aventador”নিজে ড্রাইভ করছে গাড়ির ইঞ্জিনের গভীর গর্জন। সামনে রাস্তা ফাঁকা, পিছনে মার্কোদের Range Roverতারা হাসতে হাসতে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত নাড়ছে।জায়ানের সানগ্লাসে রোদের শেষ সোনালী আলো পড়ছে, কানে হালকা মিউজিক বাজাচ্ছে। গন্তব্য প্যারিসের বাইরে তার ব্যক্তিগত “প্যালেস লিয়ার্জ “টাতে।
গাড়ি যখন প্যারিস আউটার রিং রোড এ আসে রাস্তার মোড়ে বাঁক নিতে গিয়েই সামনে হঠাৎ এক বিশাল কন্টেইনার ট্রাক ডান দিক থেকে,

অস্বাভাবিক গতিতে এসে দাঁড়িয়ে যায়।ব্রেক চাপার শব্দ চাকার চিৎকার
ল্যাম্বরগিনির সামনের অংশ ট্রাকের ধারে আঘাত করে উল্টে যায়,কয়েকবার গড়িয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়।এক মুহূর্ত পরেই আগুন।ইঞ্জিন থেকে আগুন ছিটকে উঠে পুরো গাড়ি ঘিরে ফেলে।এই দৃশ্য মার্কোদের চোখের সামনে—তাদের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করে থেমে যায়, সব নীরব… শুধু আগুনের দাউ দাউ শব্দ।মার্কো, এলেনা, নাদিয়া দৌড়ে আসে রাস্তার বাতিগুলো জ্বলছে, কিন্তু চারপাশ অস্বাভাবিকভাবে ফাঁকা,যেন কেউ ইচ্ছা করে রাস্তা খালি করে রেখেছে।মার্কো চিৎকার করে – Zayan!!!

তারা গাড়ির দরজা ভেঙে, ধোঁয়া আর আগুনের ভেতর থেকে জায়ানকে টেনে বের করে আনে।জায়ানের মাথা থেকে রক্ত, পোশাক ছিঁড়ে গেছে, নিস্তেজ শরীর, চোখ আধা খোলা, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
স্ক্রিনে টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ ব্যানার-
“Breaking from Paris- Famous criminal lawyer Jayan khan critically injured in a road accident tonight ।

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ৮

পাশাপাশি নিউজ অ্যাঙ্করের কণ্ঠ, প্যারিসের বিভিন্ন রাস্তা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ, জ্বলন্ত ল্যাম্বরগিনির ছবি, দূরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।শহরের কফি শপ থেকে শুরু করে, পুলিশ স্টেশন, নিউজরুম—সবাই আলোচনা করছে, The great criminal lawyer Zayan khan কি বাঁচবে?…

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here