তোমাতেই আসক্ত পর্ব ১
তানিশা সুলতানা
“তুমি মানো বা না মানো মেয়েটির সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। এটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।
হাফিজুর চৌধুরীর কথা শুনে হাতের কাছে থাকা টি-টেবিল খানায় প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে ঘুষি মারে আবরার। মুহুর্তেই টি-টেবিলে ভেঙে গুড়িয়ে যায়। ঝনঝন শব্দে মুখরিত হয় গোটা ড্রয়িং রুম। শক্তপোক্ত হাতের পিঠেও ঢুকে গিয়েছে এক টুকরো কাঁচ। সেখান হতে গল গল করে গড়াচ্ছে লাল রংয়ের তরল পদার্থ। তাতে একটুও বিচলিত দেখালো না হাফিজুরকে। যেনো তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। এই মুহুর্তে নাতী মা রা গেলেও তিনি দমে যাবে না।
আতিয়া বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ওঠে। শশুরের সামনে গিয়ে দুটো বাক্য উচ্চারণ করার সাহস তার নেই। আর না আছে ছেলেকে শান্ত করানোর শক্তি। মাঝেমধ্যে তিনি নিজেকে ব্যর্থ মা বলে ঘোষিত করে। যে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
আবরার নিজের র ক্ত মাখা হাতের পানে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর স্বরে বলে
“আমি তাকে মানি না৷ কবুল বলি নি৷ চালাকি করে কাবিন নামায় সাইন করিয়েছেন আপনি দাদাভাই।
নরেচরে বসে হাফিজুর। যেনো সে এই জবাবেরই অপেক্ষায় ছিলো৷ ধবধবে ফর্সা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলে
” মানতে বাধ্য তুমি। চালাকি করেছি তবে চুরি করি নি।
(পানজাবির পকেট থেকে এক খানা কাগল বের করে সেটা আবরারের সামনে তুলো ধরে)
এটা তোমাদের কাবিনের কাগজ। এখানে স্পষ্ট তুমি
বাকিটা শেষ করতে পারে না হাফিজুর। আবরার কাগজ খানা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। আশ্চর্য বনে যায় হাফিজুর। শক্ত কন্ঠে বলে
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আবরার কি করলে তুমি এটা? তোমাদের বিয়ের একমাত্র প্রমাণ ছিলো এই কাগজ।
আবরার কাগজের টুকরো ফ্লোরে ফেলে দেয়। হাফিজুরের চোখে চোখ রেখে বলে
” এবার আর বলতে পারবে না সে আমার বউ। ঝামেলা চুকে গেলো।
দাঁড়িয়ে পড়ে হাফিজুর। রাগান্বিত স্বরে বলে
“মেয়েটিকে আমি আমার কাছেই রাখবো। তোমার বউ পরিচয়ে। ঝামেলা চুকাতে দিবো না। মানতেই হবে তোমার। বিয়েটা ছেলে খেলা নয়।
আবরারও দাঁড়িয়ে পড়ে। দাদার থেকেও দ্বীগুণ তেঁজি স্বরে বলে
” তাহলে আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি এই বাড়ি থেকে।
“দরজা খোলা আছে।
ব্যাসসস আবরার তাসনিন বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় চৌধুরী বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে। একবার পেছন ফিরে তাকালে হয়ত দেখতে পেতো আতিয়া বেগম এর কন্দরত মুখশ্রী। দাদাভাই এর অসহায় চোখ দুটো।
আবরার চোখের আড়াল হতেই হাফিজুর চৌধুরী ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। এক হাত চোখের ওপর রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কলিজা খানা তার পুরে যাচ্ছে। বুকে ব্যাথা হচ্ছে। মৃত ছেলের একমাত্র স্মৃতি ছিলো কলিজার টুকরো নাতী। ছেলে গত হয়েছেন বারো বছর হবে। তখন আবরারের বয়স ছিলো নয় বছর। এবং অহনা ছিলেন আতিয়ার গর্ভে। সেই থেকে হাফিজুর চৌধুরী দুই হাতে আগলে রেখেছেন আবরার আর তার মা আতিয়া বেগমকে। কখনোই এতটুকু দুঃখ তাদের পেতে দেয় নি। চাওয়ার আগেই হাজির করেছে প্রয়োজনীয় সকল কিছু। শুধুমাত্র ছোট ছেলের বউ বাচ্চার সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা করে ঢাকার শহরে গড়েছেন বিশাল অট্টালিকা। বড় ছেলে এবং মেঝো ছেলের সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করেছেন।
আতিয়া বেগম দৌড়ে আসে শশুরের নিকট। হাঁটু মুরে বসে পড়ে পায়ের কাছে। শশুরের হাত দুটো মুঠো করে ধরে অনুন্নয়ের সুরে বলে
” বাবা আবরারকে ফেরান। আমার ছেলে চলে যাচ্ছে।
হাফিজুর আতিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলের বউকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা তার নেই। শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
“যেদিন তার মনে হবে আমরা তার ক্ষতি করি নি। সেইদিন ঠিক চলে আসবে তোমার ছেলে। অপেক্ষা করো বউমা।
সত্যিই কি তাই?
এক বছর দুই বছর তিন বছর চার বছর পাঁচ বছর ছয় বছর সাত বছর আট বছর চলে গেলো আবরারের মনে হলো না তার দাদা এবং মা তার ক্ষতি করে নি। তেরো বছর বয়সী একটা মেয়ের সাথে তার জীবন জুড়ে দিয়ে ভুল করে নি। তাকে ঠকায় নি।
আট বছরে পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছু। হাফিজুর চৌধুরী আর বেঁচে নেই। আবরারকে হারানোর শোকে বছর দুয়েক পড়েই পরলোক গমন করেছেন।
হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে যখন পাঞ্জা লড়ছিলো তখন তার মেঝো ছেলে, ছোট ছেলে এবং একমাত্র মেয়ে ছুঁটে এসেছিলেন সকল অভিমান ভুলে। ক্ষমা চেয়েছেন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া বাবার পা জড়িয়ে। দম বের হওয়ার আগে হাফিজুর চৌধুরী অক্সিজেন মাক্স খুলে শেষবার দুটো কথাই বলেছিলেন
” শেষ বেলায় আবরারের মুখ খানা দেখতে পারলাম না৷
আর
তুলতুলকে তোমরা দেখে রেখো। আবরারের আমানত তোমাদের ভরসায় রেখে গেলাম।
ঘুমের ঘোরে অনুভব করে ঠান্ডা একটা জিব্বা চেটে দিচ্ছে তুলতুলের গোটা মুখ। যেনো জিব্বার মালিক জাগাতে চাইছে তাকে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। হাঁড় কাঁপানো শীতে পড়েছে। এমন সময় সাধের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে নিশ্চয় ভালো লাগবে না৷ তুলতুলেরও ভালো লাগলো না। মুখ খানা কম্বলের তলায় নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। তবে জিব্বার মালিকের জন্য পারে না। সে যেনো পণ করেছে বিরক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবে তুলতুলকে।
পিটপিট করে চোখ খুলে তুলতুল। কপাল কুঁচকে বলে
“এ্যানি ডোন্ট ডিস্টার্ব ।
বিড়ালটি মালিকের ঘুমঘুম কন্ঠস্বর শুনে থামলো। যেনো সে বুঝতে পারলো তার উপস্থিত টের পেয়েছে মালিক। আর জ্বালাতন করা ঠিক হবে না। তাই ভদ্র বাচ্চার মতো মালিক এর গা ঘেসে শুয়ে পড়ে। হাত পা নেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। মিউ মিউ আওয়াজ তুলে কিছু একটা বোঝালো যেনো৷ তুলতুল পাশ ফিরে এ্যানির ওপর একটা হাত রাখে। শান্ত হয় এবং মুহুর্তের মধ্যেই সেও ঘুমিয়ে পড়ে।
কিছু সময়ের ব্যবধানে দুজনই চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। কেনোনা দুজনের মুখেই কেউ ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। এ্যানি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে যে। তুলতুলেরও ভয়ে বুক কাঁপছে। গভীর ঘুমে ছিলো হঠাৎ পানির ঝাপ্টা সামলে উঠতে সময় লাগে। যখনই বুঝতে পারে সে এবং তার ছোট্ট এ্যনি ভিজে জবুথবু হয়ে গিয়েছে তখনই বড়বড় নয়নে সামনে তাকায়। তিথি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। তুলতুল চোখ নামিয়ে শুকনো ঢোক গিলে। মুখ সহ জামার কিছু অংশ ভিজে গিয়েছে। কম্বলখানা চুপচুপে ভেজা। এ্যানি ছোটাছুটি থামিয়েছে। ঠান্ডা লাগছে বোধহয় তাই তুলতুলের কোলে এসে গুটিশুটি মেরে বসে পড়ে। তুলতুল নিজের কামিজের অংশ দিয়ে মুছিয়ে দিতে থাকে এ্যানির শরীর। এমনিতেই ঠান্ডা সহ্য হয় না তার। না জানি আবার অসুখ বাঁধিয়ে ফেলে।
এহেম আদিক্ষেতা সহ্য না তিথির তাই মুখ বাঁকিয়ে বলে
” মেলোড্রামা শেষ হলে এবার উঠুন মহারানী। অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজ গুলো শেষ করে উদ্ধার করুন আমায়৷
তুলতুল এ্যানির শরীরে নজর রেখেই বলে
“ডাকলেই পারতে। এভাবে ভিজিয়ে কেনো দিলে? এবার শুকবে এই ভেজা কম্বল তোষক?
তিথি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। এলোমেলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে জবাব দেয়
” আম্মু বললো না উঠলে পানি মারতে।
তুই তো জানিস আমি আম্মুর কথা ফেলতে পারি না।
তুলতুল পাল্টা কোনো কথা বলে না। এর সাথে কথা বললে কথা বাড়বে। এক পর্যায়ে ঝগড়া লেগে যাবে। তখন বকা গুলো তারই খেতে হবে। তাই এ্যানিকে কোলে নিয়েই বিছানা ছাড়ে। রুম থেকে বের হতে উদ্যত হলেই তিথি বলে ওঠে
“তোর বিলাইকে লুকিয়ে রেখে যা। ভাইয়া আসছে বাড়িতে। তার সামনে পড়লে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসবে৷ আর তুইও লুকিয়ে থাকবি।
তিথির কথা কানে তুলে না তুলতুল। তুহিন খুব ভালো। সে তুলতুলের এ্যানিকে ভীষণ ভালোবাসে। কিছুতেই ফেলবে এটা নিশ্চিত সে।
