তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩১

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩১
তানিশা সুলতানা

“যে বাড়িতে মহিলা নেই সেই বাড়িতে কোনো প্রাণই নেই।
সুস্বাদু খাবার জোটে না। রুম গোছানো থাকে না। বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপলে কেউ দরজা খোলে না।
কি একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতি।
মা বলছিলাম কি
আপনি সারাজীবন এখানেই থেকে যান। নাহলে আদুকে রেখে যান।
আতিয়া বেগম হাসে। রুই মাছের পেটির পিচ তুলে দেয় সিয়াম এর পাতে। হরেক রকমের রান্নাবান্না করেছে সে। টেবিল খানাও সাজিয়েছে ভাড়ি সুন্দর করে। আর এতোসব বাজার করে এনেছে সিয়াম। সুইজারল্যান্ড এ সাধারণত তরতাজা মাছ পাওয়া দুষ্কর। মাছ বাজারে ফ্রোজেন সব ধরনের মাছই পাওয়া যায়। ফ্রোজেন মাছ আবরারের পছন্দ নয়। তাই কখনোই মাছ খাওয়া হয় না। সারা বছরই ওই ম্যাশ পটেটো মাংস, রুটি পিজ্জা এসব খেয়েই জীবন চলে। তবে আতিয়া বেগম সুইজারল্যান্ড এ এসেছে পর থেকেই হরেক রকমের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে। উনি প্রতিদিন নতুন নতুন আইটেম রান্না করে। এসব রান্না আবরার ছুঁয়েও দেখে না তবে সিয়াম পেট পুরে খায়।
এই তো সকালে ভাপা পিটা বানিয়েছিলো। খেজুরের গুঁড়ে তৈরি মিটা আহহহা যেনো অমৃত। সিয়াম গাপুসগুপুস পাঁচ খানা পিঠা সাবাড় করেছিলো। এবং কিছু নিয়ে গিয়েছিলো আমান আহাদ আর ইভানের জন্য।

” তা তো হয় না বাবা।
ফিরতেই হবে আমায়।
আর আদ্রিতা থাকবে কার ভরসায়? হাত দেখেছো বাচ্চাটার?
এখানে আর রাখবো না ওকে।
কন্ঠস্বরের হতাশার রেশ বেশ টের পাচ্ছে সিয়া।
সবেই মাছের পিচে কামড় বসাচ্ছিলো। আতিয়া বেগম এর কথা শুনে থেমে যায়। এবং প্লেটের এক কোণায় অযত্নে ফেলে রাখে। যেনো খাওয়ার রুচিটাই হারিয়ে গিয়েছে। কপালে তিনটে ভাজ ফেলে তাকায় আতিয়া বেগম এর মুখ পানে। করুণ স্বরে শুধায়
“আবরারের সঙ্গে বিয়ে
সিয়ামের কথা শেষ হওয়ার আগে আতিয়া বেগম বলে ওঠে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আমি বেঁচে থাকতে ওদের বিয়ে মানবো না। এতোদিন আবরার মানে নি এবার আমি মানছি না। মরে গেলেও আদ্রিকে দিবো না আবরারের কাছে। নিকুচি করেছে বিয়ের।।
শুকনো ঢোক গিলে সিয়াম। গালে হাত দিয়ে বসে। পরপরই হাসি পায়। ঠোঁট প্রসারিত করে একটুখানি হেসে নেয়। বিরবির করে বলে
বাহহহ এবার জমবে মজা। দেখা যাক বেপরোয়া আবরার কি করে? কিভাবে মানায় নিজের মাকে।
“আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। বাংলাদেশ ফিরে ওনার মেয়েকে ওনার হাতে তুলে দিয়ে আমি শান্তিতে দুদন্ড বসবো। আর কাউকে নিয়ে চিন্তা করবো না।
আতিয়া বেগম চলে যায়৷ যাওয়ার আগে অবশ্যই সিয়ামকে বলে “আস্তে আস্তে খাও”

আবরার যখন বাড়ি ফেরে তখন ঘড়ির কাটা তিনটার কোটরে আঁটকে পড়েছে। গোটা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘনো কুয়াশায় জুরিখ শহর ঢেকে আছে। আবরারের ছোট্ট বাড়ি খানাও কুয়াশার আবরণ সাদা রং ধারণ করেছে। কালো রংয়ের গাড়ি খানার বেহাল দশা। চাকা খুলে গিয়েছে, কাঁচ ভাঙা ড্রাইভিং সিটে র*ক্ত লেগে আছে, স্টারিং বেঁকে গিয়েছে। আবরার গাড়ি খানা গ্যারেজে নেওয়ার চেষ্টা করে না। মাঝ রাস্তার গাড়ি রেখে র*ক্ত মাখা হাত দ্বারা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। ডান পায়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। জুতো ভেদ করে ঢুকে পড়েছে কাঁচের টুকরো। ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। কপালেও বেশ আঘাত পেয়েছে।
আধভাঙা গাড়ির পানে এক পলক তাকায় আবরার। পরপরই বিরবির করে আওড়াও
“ফা******
অতঃপর পা টেনে টেনে বাড়ির মূল ফটকে চলে আসে।

পাসওয়ার্ড টিপে দরজা খুলে বাড়িতে প্রবেশ করে। ড্রয়িং রুমের আলো জ্বলছে। যেটা বিরক্তির লাগে আবরারের নিকট। সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সিয়াম। তার পিঠের ওপরে এ্যানি। আবরার ভ্রু কুঁচকায়। জুতো খুলে ছুঁড়ে মারে বা পাশে অবস্থিত র্্যাকের উদ্দেশ্যে। পায়ে বেশ চোট পড়ে। খানিকটা ব্যাথাও পেলো বোধহয় ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে ওঠে। ট্রাই টেনে ঢিলে করে তারপর পা বাড়ায় কিচেনের উদ্দেশ্যে। এই মুহুর্তে ব্ল্যাক কফি না হলে চলবেই না। মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে।
টুংটাং আওয়াজে এর ঘুম ভেঙে যায় সিয়াম এর। পিটপিট করে চোখ খুলে কিচেনে তাকায়। আবরার তাসনিন এর র*ক্তা*ক্ত মুখশ্রী দেখে দৌড়ে এগিয়ে যায়। বেচারা এ্যানি ঠাসস করে ফ্লোরে পড়ে। বেশ ব্যাথাও পায় বোধহয়। মিউ মিউ আওয়াজ তুলে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে।
সেদিকে খেয়াল নেই সিয়ামের। সে আবরারের পাশে দাঁড়িয়ে শুধায়

“কি হয়েছে? আঘাত পেলি কি করে?
আবরার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। গভীর মনোযোগে পাতিলে পানি ঢালতে থাকে।
সিয়াম বিরক্ত হয়। ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। টিটমেন্ট করা প্রয়োজন। নির্লজ্জ সিয়াম উত্তেজিত হয়। আবরারের ক্ষত স্থান হতে রক্ত মুছে দেয় নিজ হাতে।
আবরার বিরক্ত স্বরে বলে
” এ’ম ফাইন।
প্লিজ লিভ মি এলোন।

সিয়াম সত্যিই এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় কিচেন থেকে। নিজ কক্ষের পানে ছুটতে থাকে। পথিমধ্যে উষ্টা খেয়ে পড়েও যায় একবার। ব্যাথা পায় বুকে। তবুও থামে না। তখুনি উঠে আবারও ছুটে।
কাবাড খুলে ফাস্ট এইচ বক্স নিয়ে দুদন্ড দাঁড়ায়। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার পায়তারা আঁটে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
আবরারের ততক্ষণে পানি গরম হয়ে গিয়েছে। মগে পর্যাপ্ত পরিমানে পানি ঢেলে দুই চা চামচ কফি পাউডার মিশিয়ে তা চামচ দিয়ে নারতে নারতে ড্রয়িং রুমে চলে আসে। সিঙ্গেল সোফায় আরাম করে বসে গরম মগে চুমুক দেয়। ততক্ষণে সিয়াম চলে এসেছে। হাত পা কাঁপছে তার। বুকের ভেরতটা উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করছে। আবরারের সামান্য আঘাতে সিয়ামের কলিজা পুরে যায় যে।
তুলোর মধ্যে একটু স্যাভলন নিয়ে আবরারের ক্ষত স্থানে লাগাতে যায় সিয়াম।
আবরার কড়া নয়নে তাকায়।

“এ’ম ফাইন
ফাকিং সিমপ্যাথি দেখাবি না ওয়ার্নিং দিলাম।
বড়ই গম্ভীর শোনালো আবরারের কন্ঠস্বর। সিয়াম অসহায় নয়নে তাকিয়ে থাকে। এখানে কপাল হতে রক্ত গড়াচ্ছে আর এই ছেলে।
না জানি শরীরে কতো ক্ষত রয়েছে।
” ভালোবাসি তো তাই এসব ধুর ছাঁই করিস তাই না?
বেদনাদায়ক স্বর সিয়ামের। আঁখি পল্লবে অশ্রু জমেছে বেশ জানে আবরার। তবে তাকায় না। বরং আঁখি পল্লব বন্ধ করে বলে

“ওই মেয়েটাকে যদি আমি প্রেগন্যান্ট করে দেই। তাহলে প্রবলেম সলভ হবে?
সিয়াম ঠিক বুঝতে পারে না আবরার কি বলছে। তবে এটা বুঝতে পারে কাউকে প্রেগন্যান্ট করে দিবে। ঘরে বউ রেখে বাইরে পরকীয়া? জনদরদী সিয়াম তা মেনে নিবে না।
” ভাই আদু তোর বউ। তাকে রেখে
“ওকেই প্রেগন্যান্ট করবো।
” বলিস কি?
“ডিস্টার্ব না করে যা এখান থেকে।
মুখ বাঁকায় সিয়াম। এহহ এমন ভাবে ধমক খানা দিলো যেনো সিয়ামই যেচে জানতে চেয়েছে কাকে প্রেগন্যান্ট করবে? ঢং
তখুনি সিয়ামের মাথায় এক খানা বুদ্ধি আসে। ফাস্ট এইচ বক্স রেখে পূণরায় দৌড় লাগায় আদ্রিতার কক্ষের পানে।
আদ্রিতার আজকে ঘুম আসছে না। সেই কখন থেকে শুয়ে আছে, এপাশ ওপাশ করছে তবুও ঘুম ধরা দিচ্ছে না দুচোখের পাতায়। অগত্য বসে পড়ে। মায়ের থেকে ফোন এনেছে। কতোবার কল করলো আসিফ আদনানের নাম্বারে। বার-বার নটরিসেবল বলছে। বিরক্ত আদ্রিতা সবেই বিছানা থেকে নামছে তখনই সেখান উপস্থিত হয় সিয়াম।

” আদু আবরার অসুস্থ। হাত পা কেটে গিয়েছে। কিন্তু ঔষধ লাগাতে চাচ্ছে না। তুমি একটু বলবে প্লিজ?
“আ..আমি কি করে ভাইয়া? আমার কথা শুনবে না।
” আদু প্রচুর র*ক্ত পড়ছে। অনেকখানি কেটে গিয়েছে। ঔষধ না লাগালে ইনফেকশন হয়ে যাবে। হাঁটতে পারবে না।
আদ্রিতা ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা চিন্তা করে। তারপর বলে
“কিন্তু আমার কথা শুনবে না তো।
” শুনবে শুনবে। নিজ হাতে ঔষধ লাগিয়ে দেবে তাই কিছু বলবে না।
আদ্রিতা আমতাআমতা করতে থাকে। সিয়াম আরও অনেক কিছু বোঝায় অতঃপর রাজি হয়। সিয়াম এই টুকু বুঝে যায় আদ্রিতার মনে আবরারের জন্য ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। এই নিরিহ মেয়েটা আবরার তাসনিন এর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
ফাস্ট এইচ বক্স নিয়ে আবরারের কক্ষের পানে এগোয় আদ্রিতা। বুক কাঁপছে তার। এক মন বলছে “আদ্রিতা যাসস না”

আরেক মন বলছে “আদ্রিতা যা। তাড়াতাড়ি যা।”
কোন মনের কথা শুনবে দ্বিধাবোধে ভুগছে সে। আবরারের কক্ষের দরজা বন্ধ। আদ্রিতা কাঁপা-কাঁপি হাতে টোকা দেয়। ভেতর থেকে ভেসে আসে আবরার এর গম্ভীর কন্ঠস্বর
“সিয়াম ডোন্ট ডিস্টার্ব।
আদ্রিতা জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলে
” আ…মি।

ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। অতঃপর দরজা খুলে যায়। আবরারের মুখ পানে তাকানোর আগেই শক্ত হাতের অস্তিত্ব টের পায় নিজের হাতের ভাজে। এবং নিজেকে কক্ষে আবিষ্কার করে। মূলত আবরার এক টানে রুমের ভেতরে নিয়ে এসেছে আদ্রিতাকে। পরপরই দরজা বন্ধ করে।
আবরার পূণরায় গিয়ে খাটে বসে। শার্ট খুলে ফেলেছে বিধায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ক্ষত গুলো। বেশ কয়েক জায়গায় চোট পেয়েছে। আদ্রিতা জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে দু পা এগিয়ে যায়। হাতের ফাস্ট এইচ বক্স দেখিয়ে বলে

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩০

“আ…
ঔষধ লাগানো প্রয়োজন আপনার।
” ভালোই তো ছিলাম আমি।
কেনো আসলে তুমি?

তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৩২