তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২
নীল মণি
মধ্যাহ্নের দুপুরে বিশাল চৌধুরী বাড়ি যেন প্রাণবন্ত এক জীবন্ত সঙ্গীতের মতো গমগম করছে। মানুষের কন্ঠ, হাসির ঝলক, রান্নাঘরের ঠুংঠ্যাং শব্দ, প্রতিটি কোণায় যেন জীবনের স্পন্দন মিশে আছে। বাতাসে ভেসে আসে তাজা রান্নার গন্ধ, আর লোকদের হাসি-ঠাট্টা যেন পুরো বাড়িকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামছিল তিয়াশা রোদ চৌধুরী। তার ছোট ছোট পদক্ষেপের শব্দও যেন শান্তি ভেঙে সবাইকে তার দিকে টেনে আনছিল। হঠাৎ সেই মুহূর্তে জায়নের হাত থেকে জুসের কাঁচের গ্লাসটি পড়ে গেল। ছোট্ট শব্দে, কাঁচের ভাঙার ঝিঁঝিঁ-ঝঞ্ঝনিতে ঘর যেন থমকে গেল, আর এক মুহূর্তের জন্য সবাই চুপচাপ হয়ে দাঁড়াল। তারপরও ভয়ে ছুটে এসে সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল,
__”কি হলো বাবা?”
কিন্তু আবরার জায়ন চৌধুরীর চোখ তখন অন্য কোথাও। তার চোখে যেন এক অচেনা বিস্ময় মিশে আছে, ঠোঁটের কোণে হালকা খোলা অভিব্যক্তি এমন কিছু যা সবাই বুঝতে পারছিল এই প্রতিক্রিয়া কোনো সাধারণ বিস্ময় নয়। তার হৃদয় যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে।
তিয়াশা, তাকে দেখে কাঁপতে লাগল। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি ঢেউ খেলল, রক্ত দ্রুত বেগ পেয়ে চলল। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেও, হৃৎস্পন্দন যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। চোখের কোণে অল্প অশ্রু জমে আসছিল, মুখে লাল ভাব ফুটে উঠল।
সবার দিকে তাকিয়ে, সে কণ্ঠে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
__”এটা আমাদের ছোট্ট তিয়াশা না?”
মেহজাবীন বেগমের চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল। তার হাসি যেন পুরো ঘরকে আলোকিত করে তুলল, মুখের কোণে কোমল ভরা অভিব্যক্তি এবং গলার সুরে মধুর কণ্ঠ মিশে গেল। তিনি মনে মনে সন্তুষ্টি বোধ করছিলেন, এত বছর পর ছোট মেয়েটিকে বড় হয়ে দেখে যে অভিভূত হবেন, সেই অনুভূতি তার চোখে প্রকাশ পাচ্ছিল।
__”হ্যাঁ রে, দেখনা পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে রোজ। আজ দেখনা কেমন ঘরকুনে হয়েছে, হা হা হা।”
রুহেনা বেগমের চোখে খুনসুটি ও আনন্দের মিশ্রণ ফুটে উঠল। তিনি মৃদু হাসলেন, কিন্তু ভিতরে ভয় এবং মমতার মিশ্রণে মনে হচ্ছিল, বড় মেয়েটিকে নতুন করে দেখা যেন তার মনে এক অদ্ভুত তৃপ্তি দিচ্ছে। সে ভয়, আনন্দ, মায়া সব একসাথে মিলেছে তার চোখে।
__”বড় ভাই এসেছে, ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সালাম দিতে পারছিস না? তোর জ্বালায় জলে যাবো আমি!”
মেহজাবীন বেগম তর্কের মধ্যে ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন। তার চোখে হালকা কৌতূহল আর তাচ্ছিল্য ছিল, কিন্তু হৃদয়ে গাঢ় মমতা মিশে আছে,
__”ওই মেজো ছার না, বাচ্চা মেয়ে!”
সুরাইয়া বেগমের চোখে হাসির উজ্জ্বলতা এবং মৃদু তাচ্ছিল্য একসাথে ফুটে উঠল। তার মৃদু নির্দেশে বোঝা যাচ্ছিল, তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, মেয়েটির দিকে গভীর মমতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চান।
__”হ্যাঁ মেজ আপী, কেনো বকছ? ওকে বলো, তিয়াশা ভাইকে সালাম দিয়ে আয়।”
রুহান বেগমের চোখে কোমল হাসি ফুটে উঠল। তার মন আনন্দের ছোঁয়ায় ভরে গেছে। চোখে মায়া, হাসি আর সামান্য খুনসুটি মিলেছে মেয়েটিকে যেন সামান্য ছুঁয়ে দেওয়া যায়, সে আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছিল।
__”ঠিক আছে বাবা, তোমাদের মেয়েকে কিছু বলা যাবে না দেখছি।”
সবাই একসাথে হাসছিল, প্রতিটি হৃদয়ে মিশে আছে আনন্দ, মমতা, উত্তেজনা আর নতুন করে দেখা প্রিয়জনের আকাঙ্ক্ষা। পুরো বাড়ি যেন সেই ছোট্ট মুহূর্তে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, প্রতিটি কোণায় প্রতিটি ব্যক্তি অনুভব করছিল আনন্দ, আশ্চর্য, এবং গভীর প্রেমের মিশ্রণ।
সুরাইয়া বেগম যখন তিয়াশার দিকে চোখ রেখে বললেন,
__”হ্যাঁ মেজ আপী কেনো বকছ? ওকে বলো তো তিয়াশা কে, উদ্দেশ্য করে বলে যা তিয়া ভাই কে সালাম দিয়ে আয়,”
তখন তার কণ্ঠে মৃদু হাসির সঙ্গে মায়ার এক অনাবিষ্কৃত উষ্ণতা ঝলকানি ছড়াচ্ছিল। পুরো ঘর যেন হালকা আনন্দের আলোয় ভরে উঠল।
রুহান বেগম হেসে বললেন,
__”ঠিক আছে বাবা, তোমাদের মেয়ে কে কিছু বলা যাবে না দেখছি।”
তার হাসি শুধু বাক্য নয়, পুরো পরিবেশকে নরম, কোমল আর প্রাণবন্ত করে তুলল। যেভাবে চোখে মায়া আর মুখে কৌতূহলের মিশ্রণ ফুটছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, এই ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তগুলোই পরিবারকে আরও কাছে টেনে আনছে।
আবরার এ সব দেখে এক ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি দিল। সেই হাসি যেন ঘরের মধ্যে এক অব্যক্ত আনন্দের সঞ্চার করল, যা চোখে পড়া আর মনকে উষ্ণ করে।
তিয়াশা তখন একটু লজ্জায় মাথা নিচু করে সামনে এগিয়ে এলো, দুই হাত সামনায় করে একেবারে বিনম্রভাবে আবরারের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল,
__”আসসালামু ওয়ালাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন?”
তার চোখে লজ্জা, হৃদয়ে অল্প অস্থিরতা আর মুখে সামান্য হাসি মিশ্র অনুভূতির এক সূক্ষ্ম ছাপ ছিল।
জায়ন তিয়াশার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে একটু দুষ্টু হাসি হেসে মৃদু স্বরে বলল,
__ “ওয়ালাইকুম সালাম, ভালো আছি, এত ভয় পাচ্ছিস কেন? তোর সামনে কি বাঘ বসা?”
এই কথায় তিয়াশার হৃদস্পন্দন অজান্তেই দ্রুততর হয়ে গেল, গলায় হালকা হাঁচি ধরল আর তার লাজুক চোখগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তিয়াশা জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
__ “আরে না না ভাইয়া, ভয় পাবো কেনো, ওই এমনি একটু শুয়ে ছিলাম।”
মনে মনে ভাবল,
__”উম, বাঘ নাকি, বাঘের থেকে কম কোথায়? হায় আল্লাহ, এরম এক খান পোলা আমার সামনে বসায় রাখছ, এখন কি করব, আমি তো পুরাই ফ্লার্ট।”
জায়ন বুঝে গেল যে তিয়াশা কিছু ভাবছে, তাই আবার হালকা স্বরে বলল,
__” “ভয় পাসনা রোদ, খেয়ে নেব না তোকে, হা হা হা।”
এই শব্দে ঘরের প্রতিটি কোণে হাসির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। মারিয়া, অনন্যা, বৃষ্টি, রায়ান, আকাশ এবং ইউভি একসাথে জোরে জোরে হেসে উঠল। প্রতিটি হাসি যেন পরিবারের আনন্দকে আরও উজ্জ্বল করল, চারপাশে অম্লান উচ্ছ্বাস তৈরি করল।
তিয়াশা পড়নের চুড়িদার টা দুই হাত দিয়ে মুচড়ে ধীর কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল,–
__”শালার বেটা, আমায় নিয়ে মজা করা, ঘাড় মটকে দেব একদম।”
তার রাগ আর লজ্জার মিশ্রণ যেন চতুর্দিকে এক মৃদু উত্তেজনার বাতাবরণ সৃষ্টি করল।
বৃষ্টি তিয়াশার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো,
__”কি বিড়বিড় করছিস? তোর না এক্সাম যা গিয়ে পড়তে বোস।”
ইউভি তিয়াশাকে দেখে একটু গম্ভীর ও আদেশের সুরেই বলল,
__”পড়তে বসলে ডাঙ্গ ডাঙ্গ করে নাচবে কে? যা গিয়ে পড়তে বস। ”
তিয়াশা রাগের ভঙ্গিতে চিৎকার করে চলে যেতে যেতে বলল, ”
__”ধ্যাত, ভাল লাগেনা, গেলাম আমি।”
ঘরের বাকি সবাই অবাক চোখে তাকালো, কেউ হেসে কেউ মৃদু হাসি ধরে রাখল। মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা আর লজ্জার মিশ্রণে পুরো পরিবেশ যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। প্রতিটি চোখে, প্রতিটি হাসিতে, প্রতিটি কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল ছোট্ট খুনসুটি আর ঘরোয়া উচ্ছ্বাসের সুন্দর এক ছোঁয়া, যা পরিবারের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল।
কিছুক্ষণ বাদে আয়েশা খান বলল,
__ “জায়ন বাবা যা ফ্রেশ হয়ে আয়, খেতে হবে তো।”
তার কণ্ঠে কোমল স্নেহ আর পরিবারের প্রতি যত্নের উষ্ণতা মিলিত। আয়েশার চোখে ছোট্ট উচ্ছ্বাস, মুখে হালকা হাসি যা শুনলেই মনে হলো, সে সত্যিই তার ভাতিজার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। ঘরে বসে থাকা সকলের মনেও একটা নরম, শান্ত অনুভূতি ছড়িয়ে গেল।
প্রান্তিক চৌধুরী সাহেব বলে ওঠেন,
__ “তোদের কি আজ রান্না শেষ হবে না, আমরা কি খেতে পারব না?”
তার কণ্ঠে একটি গুরুগম্ভীর, অথচ আরাধ্য সুর। চোখে অদৃশ্য খুশির ঝলক, মুখে স্নিগ্ধ গুরুদায়িত্বের ছাপ। এই এক কথায় ঘরটা যেন মুহূর্তে জাগ্রত হয়ে গেল, সবাই চুপচাপ তাকিয়ে রইল।
ওপাশ রান্নাঘর থেকে মেহজাবীন বেগম বললেন,
__”আরে বাবা, আমার ছেলে টার জন্য রান্না করছি, আপনার সহ্য হচ্ছে না তাই না?”
তার সুরে আনন্দ আর স্নেহের মিশ্রণ, চোখে কোমল উজ্জ্বলতা। সে শুধু কথা বলছিল না, তার পুরো শরীরের ভাষা প্রকাশ করছিল পরিবারের জন্য যত্ন, মনোযোগ, এবং নরম মাতৃভূমি।
প্রান্তিক চৌধুরী হালকা হাসি, চোখের কোণে কৌতুকের ছাপ, কণ্ঠে কোমল রসিকতা ঘরের মেজাজে হালকা আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে দিল। সবাই হেসে উঠল, যেন মুহূর্তেই অম্লান প্রশান্তি ফিরে এল, তারপর বললেন, __”আরে বাবা, আমি সে কথা কোথায় বললাম? ভাই দের উদ্দেশ্য করে বললাম এই তোরা বল, আমি এ কথা বলেছি?”
জায়নের ছোট চাচু তাহসান চৌধুরী বললেন,
__”আরে না না, তুমি কি বলতে পার ভাইয়া?”
তার চোখে হাসি, ভঙ্গিতে খুশি, কণ্ঠে প্রাণময় উচ্ছ্বাস সব মিলিয়ে ঘরে একরকম প্রফুল্লতা। তারপর জায়নকে উদ্দেশ্য করে বলল,
__”যা, যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
জায়নের মনে লেগে গেল একটি প্রশান্তি, দীর্ঘদিন পর যেন শৈশবের সেই নিরাপদ ঘর তাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
জায়ন বলল,
__”হ্যাঁ চাচু, যাচ্ছি।”
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা, চোখে হালকা উচ্ছ্বাস, পা ধীরে ধীরে ধরা দিল পুরনো ঘরের দিকে। ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল সবকিছু আগের মতো, শুধু রঙ ও সিলিং বদলেছে। ডিভানে বসে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনে হলো স্মৃতি আর বাস্তবের মিলনের এক মুহূর্ত।
রুম থেকে লাগেজ বের করে ব্রাউন রঙের টিশার্ট আর বেজি প্যান্ট পরল, চুল মুছতে মুছতে বাইরে বের হল। তখন চোখে পড়ল, বৃষ্টি আর ইউভি বসে আছে।
জায়ন ভ্রু কুচকে বলল,
__ “কি ব্যাপার? আসছিলাম তো নিচে, তোরা দুই ভাই বোন এভাবে বসে আছিস কেন?”
তার চোখে সতর্কতা, কণ্ঠে অল্প উৎকণ্ঠা, মনোভাব পূর্ণ বড় ভাইয়ের উষ্ণ সুর।
বৃষ্টি কিছু বলতে গেলে, ফোন বেজে ওঠে। সে চট করে ফোন দেখে বলল,
__ “আচ্ছা, আমি পড়ে এসে বলব, আমার ফ্রেন্ড তন্নী ফোন করেছে।”
চেহারায় হালকা লজ্জা, চোখে কৌতূহল, দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া সব মিলিয়ে তার উদ্যম ও সতর্কতার সুন্দর মিশ্রণ।
জায়ন কিছু ভাবল, তারপর ইউভিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
__”আমাদের অনু তো বয়সে অনেক ছোট, তোর থেকে। পরবর্তিতে কোনো ঝামেলায় না পড়িস।”
চোখে সতর্ক সতর্কতা, কণ্ঠে বড় ভাইয়ের মৃদু সুর, মনটা যেন পূর্বাভাস দিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য নিখুঁত নির্দেশনা।
ইউভি থতমত খেয়ে বলল,
__”ম-ম মানে ভাইয়া।”
কণ্ঠে কাঁপুনি, চোখে অল্প লজ্জা, ভ্রুতে চিন্তার রেখা মনের ভেতর অস্থিরতা স্পষ্ট।
জায়ন আবার বলল,
__ “তুই যে তোর হৃদয়হরিণীর কথা আমায় বলতি সেটা আমাদের ছোট্ট অনু তো? দেখ, অনু কিন্তু আমার ছোট বোনওর যদি মত থাকে ভবিষ্যতে, তাহলে আমি নিজে তোদের দাঁড়িয়ে বিয়ে দেব। কিন্তু ও যদি ইন ফিউচার তোকে একসেপ্ট না করে, তাহলে আমি কিছু করতে পারব না।”
চোখে দৃঢ়তা, কণ্ঠে কোমল অথচ শক্তিশালী সুর।
ইউভি আফসোসের স্বরে বলল,
__”জানিনা ভাইয়া, আদেও কোন দিন ওকে মুখ ফুটে বলতে পারব কিনা। এত পিচ্চি মেয়ে টা কিন্তু কি করব, বল এই পিচ্চি কেই তো মনে ধরেছে।”
চোখে মৃদু উদ্বেগ, মুখে লজ্জা, হৃদয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও আনন্দের মিশ্রণ।
হঠাৎ জায়ন রোদকে মনে করল। মাথা ঝুকে বলল, __”অনু, তোর থেকে প্রায় ৮ বছরের ছোট, সাবধান ইউভি।”
ইউভি হতাশা ও মৃদু হাসি মিশিয়ে দীর্ঘস্বাস ফেলে বলল
__, “তোমার থেকেও তো বৃষ্টি ৭ বছরের ছোট। তবে পরিবারের মতামত থেকেই ঠিক। আমার ই কপাল পোড়া, কবে আমার পিচ্চি টা বড় হবে, হায় আল্লাহ, তত দিনে তো বুড়ো হয়ে যাবো।”
কণ্ঠে হতাশা, চোখে দুঃখ, মনে অস্থিরতা।
জায়ন হেসে বলল,
__ “চল, নিচে যাই।”
হাসিতে শান্তি, চোখে অল্প উচ্ছ্বাস, ধীরে ধীরে তারা দুজনে নিচে নামল।
ডাইনিং টেবিলে সবাই গোল করে বসে আছে। ছোটরা পাশে বসে খুশি, বড়রা দাড়িয়ে পরিবেশন করছে। মধ্যমণি হেড অফ দি ফ্যামিলি আহমেদ প্রান্তিক চৌধুরী, পাশে তার ভাই, ছোট ভাই ও ফুপা। অন্য পাশে বসে জায়ন, পাশে ইউভি, রায়ান, আকাশ, বৃষ্টি, অনু, মারিয়া।
তিয়া এসে তাদের পাশে বসল। সামনে বসে আছে দ্য গ্রেট আবরার জায়ন চৌধুরী, ব্রাউন টি শার্ট, বেজি প্যান্ট, হালকা ভেজা চুল।
তিয়াশার হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে গেল। মনে মনে বলল, “কি দেখলাম আল্লাহ, এবার শান্তিতে খেতেও পারব না।”
চোখে অচেতন উচ্ছ্বাস, গালে লালিমা, মনটা এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে গেল।
আবরারের মা চাচিরা প্লেটে তুলে দিল সে যা খেতে পছন্দ করে। বললেন, সব শেষ করবি।
আবরার হাসি দিয়ে বলল,
__ “আমাকে কি একদিন এই ভুরী ওয়ালা কাকু বানাবে।”
সবাই হেসে উঠল। হাসি মিলিয়ে ঘরে আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে গেল।
জায়ন এর বাবা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
__”বাবা, তোর এখনই অফিস জয়েন করার দরকার নেই, তিয়া আম্মুর এক্সাম চলছে, ওর এক্সামের পরেই তোর আর বৃষ্টির বিয়ের ডেট রেখেছি। বিয়ের পরেই একবারে জয়েন করিস।”
জায়ন বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল,
__”ঠিক আছে বাবা, তুমি যা বলবে।”
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে কণ্ঠ নরম করে হেসে ফেলল।
তিয়াশার খাওয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সে ভুলেও গিয়েছিল যে যার দিকে তাকিয়েছে, সে তার দুলাভাই হতে চলেছে। খাবার না খেয়ে মা চাচীর উদ্দেশ্যে বলল, __”আমার খাওয়া শেষ, আর কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে।”
এক দৌড়ে বেসিনে হাত ধুয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেল।
সবাই তাকিয়ে রইল। রুহেনা বেগম স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল,
__ “দেখলেন, আপনার মেয়ের অবস্থা। এই আপনার আশকারাতেই এত বিগড়েছে। ইউভি, দেখ তোর বোনের চালচলন।”
ইউভি একটু বিরক্ত হয়েই বলল,
__ “মা, চুপ করো না, এক্সামের চিন্তায় হয়তো খেতে পারছেনা।”
রুহেনা বেগম মুখ ঘুরিয়ে বললেন
__, “হ্যাঁ, তোদের আশকারাতেই বিগড়াবে আরো।”
এই বলে সে চুপ করে সবাইকে খেতে দিতে লাগল।
একজন সব কিছু লক্ষ্য করছিল।
এদিকে তিয়াশা দরজা বন্ধ করে অজানা কারণে চোখে অশ্রু ঝরতে লাগল। বালিশে মুখ ডুবিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
হঠাৎ দরজায় নক্। তিয়াশা দরজা খুলল না। গম্ভীর স্বরে শোনা গেল,
__”রোদ, দরজা খুলে এক্ষুনি যদি নিচে খেতে না জাস, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
তিয়াশা বুঝল কার শুর। হুট করে দাঁড়িয়ে দরজা খুলল।
জায়নের চোখ চমকে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চোঁখ ফোলা, চুল এলোমেলো, মুখ লাল। কিছু না ভেবে তিয়াশার বাহু ধরে জিজ্ঞেস করল,
__”এ কি অবস্থা রোদ, কি হয়েছে তোর?”
তিয়াশা জায়নের হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল। জায়নের হাত ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে বলল,
__ “না, জায়ন ভাইয়া, এক্সামের টেনশান এ মাথা টা ব্যথা করছিল।”
জায়ন তার কথায় বিশ্বাস করে কিছু না বুঝে একটু ম্লান হাসি দিয়ে বলল,
__”ঠিক আছে, যা মা মেজো মারা খাচ্ছে, তারাতারি গিয়ে খেয়ে আয়, আমার যেন আর একবারও বলতে না হয়।”
তিয়াশা ভয়ে খেতে চলে গেল।
এদিকে বৃষ্টি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছে। হঠাৎ খেয়াল করল কেউ পাশে এসেছে। চোখ পড়তেই কেঁপে উঠল। আস্তে বলল,
__ “জায়ন ভাই, আপনি এখানে, কিছু লাগবে?”
জায়ন ব্যালকনির রেলিংয়ে দু হাত রেখে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
__, “কি হয়েছে বৃষ্টি, কি ভাবছিস? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত? দেখ বৃষ্টি, আমি জানি এই বিয়েটা পরিবারের ইচ্ছায় ঠিক হয়েছিল। কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, তবে থেকেই তোকে মেনে নিয়েছি। তুই সুন্দর, নম্র, ভদ্র, মেধাবী। আর কি চাই একজনকে ভালো লাগতে গেলে? সেখানে তোর আমাকে যদি পছন্দ না হয়, আমাকে বলতে পারিস। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
বৃষ্টির চোখে মুখে চিন্তা তবুও সেটা বুঝতে দিলো না , শান্ত শুরে জবাব দিয়ে বলল,
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ১
__”না, জায়ন ভাই, তেমন কিছু না, আপনাকে অপছন্দের কোনো কারণ নেই। শুধু একটু ভার্সিটি নিয়ে চিন্তায় ছিলাম।”
জায়ন হাসি দিয়ে বলল,
__”ওকে, লেটস্ সি হোয়াট উইল হ্যাপেন্ড ফর আস ইন ফিউচার।”