তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২১

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২১
নীল মণি

রাঙামাটির পাহাড়ে নেমে আসা বিকেলটা যেন এক নিঃশব্দ কবিতা, চৌধুরী বাগানবাড়ির লালচে ইটের উঠোন জুড়ে ছায়া-রোদ্দুরের খেলা, পুরনো আমগাছের নিচে পাতারা নরম হাওয়ায় ফিসফিস করে; দূরে কাপ্তাই লেকের জলে সূর্যের সোনালি আলো টলমল করে ঝিকিমিকি করে ওঠে, আর চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন এক অলিখিত স্মৃতিচিত্র যেখানে প্রতিটা হাওয়ার দোলা, প্রতিটা পাখির ডাক বলে দেয়, এই বিকেলটা শুধু সময় না, এ এক আবেগের আঁকাবাঁকা নদী।
এই পরিবেশে সবাই আনন্দে ফূর্তিতে মেতে উঠেছে,সবার মাঝে এত ক্লান্তি সত্বেও কেউ আরাম এর জন্য বসে নেই ।

বাগানবাড়িতে পৌঁছানোর কিছু মুহূর্ত পরেই সবাই কে খেতে দেওয়া হয়। প্রায় ৬,৭ টা টেবিল ও ৪০টা চেয়ারের পর্যন্ত আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়ির উঠনেই ।
আগেই আলাদা করে রাঁধুনি, কাজের মানুষ রাখা ছিল, আর কেয়ারটেকার তো ছিলই। ফলে এই কয়েকদিনের জন্য গৃহিণীদের গা থেকে গৃহস্থালির দায়ভার সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু বিয়ের রঙে রঙিন হয়ে থাকার সময় আয়োজন, উচ্ছ্বাস আর আবেগের বাঁধভাঙা স্রোত।
খাবারের টেবিল ঘিরে আত্মীয়-স্বজনের সরগরম উপস্থিতি, আর ঠিক তখনই
প্রান্তিক সাহেব রসিক কণ্ঠে বলে উঠলেন
“হ্যাঁ রে মেজো, আর দু’দিন পরেই তো তুই আমার ‘বিয়াই’ হবি! প্রস্তুত থাকিস, তোর ‘হার’ আমি আগেই জ্বালাতে শুরু করব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার এই বক্তব্যে টেবিলজুড়ে অট্টহাসির স্রোত বয়ে গেল।
মেজো চাচু তৎক্ষণাৎ হাত তুলে বললেন
“সব জ্বালাতন মাথা পেতে নেব বড় ভাই, তবে বিয়ের আগেই তুমি আমার দাদা আমার উপর দয়া করো। তবে আমার চিন্তা হচ্ছে তিয়াশা আম্মু নিয়ে কে যে এ মেয়েকে বিয়ে করবে, কে স্বশুর হইবে কতটা জ্বালাবে কে জানে!”
তাদের ঠিক পাশে বসে ছিলেন জায়ান। চুপচাপ খেতে খেতে এক পলক চোখ মেলে তাকাল তিয়াশার দিকে। তারপরে মুখে স্থির ভঙ্গিতে বলল
“মেজো চাচু, আপনি চিন্তা করবেন না। যদি আমার বাবা আপনাকে না জ্বালায়, তবে রোদের শ্বশুরমশাই-ও আপনাকে জ্বালাবে না সো ডোন্ট ওয়ারি চাচু।”
এই কথা শুনে ইউভির তো খাবারই নাকে-মুখে উঠে গেল। আর তিয়াশা যেন একদম স্তব্ধ মনে মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে–

“এই লোকটি আসলে কী বলল? তার কথার মানে আমার মাথাতেই ঢুকছে না।”
সংগে সংগে মেহজাবীন বেগম জল নিয়ে এগিয়ে আসে ইউভির কাছে। এদিকে রুহেনা বেগম ইউভি কে বকাঝকা করছে যে খাওয়ার সময় তার মন কোথায় থাকে।
ইউভির পাসে তাহসান সাহেব বসে ছিলেন, ইউভির কানের পাশে এসে বললেন —
” তুই আজকাল খাওয়ার সময় একটু বেশিই কাশাকাশি করছিস না, তোর মন থাকে কোথায় ।”
ইউভি হালকা দৃষ্টি তার চাচুর দিকে ফিরিয়ে মনে মনে আওড়ালো — “মন তো থাকে চাচু তোমার মেয়ের মাঝে, কিন্তু আপাতত আপনার বড় ভাতিজা আমার বড় ভাইয়া বহুৎ ডিস্টার্ব দিচ্ছে।”
কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস তার এখনো হয়ে ওঠেনি –

” না চাচু কিছু না।”
এর মাঝেই প্রণয় সাহেব হালকা হাসিতে বললেন ,
“কি যে হবে এখন বলা বড়ই দুষ্কর বুঝলি জায়ন । তবে একটা কথা ঠিক—যদি তোর মতো আরেকটা জামাই পেয়ে যাই, তবে আমি সত্যি ভাগ্যবান হব।”
জায়ান তৎক্ষণাৎ একটু মুচকি উত্তর দিল
“চাচু তাহলে আর চিন্তা নেই। আমার মতোই জামাই আপনি পাবেন, নিশ্চিত থাকুন।”
প্রণয় সাহেব হেসে বললেন ,
“তাহলে তো আমি বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান শ্বশুর হতে চলেছি।”
এইসব হাসির মুহূর্তের মাঝেই, আরোহী তিয়াশার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ,
“বুঝলি বেবি আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ভাইয়া নিজের কথাই বলছে।”
তিয়াশা চোখ কুঁচকে চাপা গলায় বলল ,

“তোর অনেক কিছুই মনে হয়, তুই এখন খা নইলে মাথার ভেতর আরও আজগুবি কথা আসবে।”
প্রণয় সাহেব এবার আরোহীর দিকে ফিরে বললেন ,
“আরোহী আম্মু, কিছু লাগবে নাকি? তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না।”
আরোহী হালকা হেসে বলল
“না না আংকেল, আমি খাচ্ছি এই তো।”
“ঠিকঠাক করে খেয়ো মা, নইলে তোমার আব্বাজান বলবেন আমি তোমার যত্ন নিচ্ছি না।”
আরোহী সম্মান-ভরা গলায় মাথা নুইয়ে বলল
“জি আংকেল।”

এই সময়ে রহমত সাহেব আকস্মিকভাবেই বলে উঠলেন,
“আমিও অয়নের বিয়ে আরও দু-তিন বছরের মধ্যেই সেরে ফেলবো বুঝলেন দুলাভাই।”
প্রান্তিক সাহেব সপ্রসন্ন হাসি হেসে সায় দিলেন,
“আরে হ্যাঁ, এবার তো একের পর এক বিয়ের ঘনঘটা লাগবেই। আমাদের ইউভি, অয়ন, নয়ন, রিক কত যে নিমন্ত্রণপত্র বিলানো যাবে, হিসাব রাখা কঠিন!”
এমন সময় মাসরুফ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“বড় ভাই, বুঝলেন আমি তো রিকের বিয়েটা, পারলে আজই দিয়ে ফেলি। কিন্তু মনের মতো উপযুক্ত মেয়ে কিছুতেই মিলছে না!”

এইসব কথাবার্তার মাঝেই পাশ থেকে বৃষ্টির খালামনি তার ছোট মেয়েটির পেছনে পেছনে ছুটে ছুটে খাবার মুখে দিচ্ছেন। সেই দৃশ্য অবলোকন করে মেহজাবীন বেগম, রুহেনা বেগম ও সুরাইয়া বেগম কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন; হয়তো তাঁদের নিজেদের সন্তানের শৈশবস্মৃতি ধরা দিয়েছিল চোখের সামনে।
ঠিক তখনই রিক অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
“বাবা, দয়া করে! আমি তো মাত্র ২০ বছর পেরিয়েছি! এখনো অনেক পড়াশোনা বাকি, আপনি এসব বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করবে না প্লীজ!”

মসরুফ সাহেব সাথে সাথেই হেসে বলে উঠল,
“দেখেন, দেখেন! বড় ভাই, এই একটা কথায় তো ওরে খাড়া কইরা ফেলা যায়!”
প্রান্তিক সাহেব মৃদু হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন,
“আরে মসরুফও তো ঠিকই বলছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করাটা অপ্রয়োজনীয়!”
আরেকজন গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, বড় ভাই! এখন তো আপনিও দেখছি ওর সুরে তাল মিলিয়ে চলেছেন।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই রুহেনা বেগম বিরক্তিভরে বলে উঠলেন,
“মাসরুফ ভাই, আমার ছেলেটার মাথায় তুমি বিয়ের কথা ঢোকাতে যাস না। ওকে অন্তত শান্তিতে পড়তে দাও! কেবলমাত্র আবোলতাবোল নিয়ে বসে থাকিস!”
বড় আপার স্পষ্ট কথা শুনে মাসরুফ আর কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না; নীরবে গালভরা চা চুমুক দিতে লাগলেন।
ওদিকে, খাবার টেবিল জুড়ে দৃষ্টির এক সূক্ষ্ম যুদ্ধ চলমান।
অয়নের দৃষ্টি নিবদ্ধ তিয়াশার উপর। সে যেন সবার উপস্থিতি ভুলে কেবল তাকিয়ে আছে অপলক। যা জায়নের চোখে ধরা পড়ে নিঃশব্দে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার চামচ নিয়ে জোড়ে জোড়ে টুং টং আওয়াজ করেই যাচ্ছে ।
অন্যদিকে নেহার চোখ বারবার স্থির হচ্ছে ইউভির দিকে। ইউভি বুঝেও তা উপেক্ষা করতে পারছে না— বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার মুখে।

নয়ন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আরোহীর খাবারের দিকে, যেন সেখানে লুকিয়ে আছে কোনো অতল গোপনীয়তা। পাশেই বসে থাকা আকাশ এই অকারণ মনোযোগে হালকা অস্বস্তিতে পড়ে।
হঠাৎ, পরিবেশের ভারসাম্য ভেঙে দিয়ে জায়ন গম্ভীর কণ্ঠে তিয়াশার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“খাবার নিয়ে যদি এমন নাড়াচাড়া চলতেই থাকে, তাহলে উঠে পড়।”
তারপর মুখ ঘুরিয়ে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, তুমিও উঠে যাও।”
তিয়াশা কিছুটা হতচকিত সে বুঝে উঠতে পারে না, জায়নের এই আচমকা কঠোরতা কিসের ইঙ্গিত। মনের ভিতরে অভিমান জমাট বাঁধে

“এই লোকটার মাথায় দিন দিন প্যারা হয়েই যাচ্ছে, বাঘের বাচ্চা আমার এই টুকু ছোট্ট মন তার পুরো ১২ টা বাজিয়ে ছাড়ছে”
ঠিক তখনই আবার ভেসে আসে জায়নের কঠিন কণ্ঠ,
“শোনা যাচ্ছে না নাকি, যা বলছি?”
তার গলার ভারে দু’জনেই চুপচাপ উঠে যায়।
এই দৃশ্য দেখে মেহজাবীন বেগম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে উঠলেন,
“মেয়েটাকে একটুখানি শান্তিতে খেতেও দিবি না?”
জায়ন নির্বিকারভাবে জবাব দিল,
“খাচ্ছিল কোথায়? শুধু নাড়াচাড়া করেই যাচ্ছিল। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো ”
কেউ আর কিছু বললেন না কারন তারাও জানে এখন কথা বললে কথা বাড়বে কারণ জায়ন কখনো ছেড়ে কথা বলে না।
ওদিকে, শারীরিক অসুস্থতায় ক্লান্ত বৃষ্টি, উপরের তলার বারান্দায় একা বসে ছিল। কারও সঙ্গে কথা বলছে না, শুধু একরাশ চিন্তায় নিমগ্ন ঠিক কী ভাবছে, কেউ জানে না।
এভাবেই কাটল চৌধুরী বাগানবাড়িতে প্রথম দিনের সূর্যাস্ত। আবেগ, অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা আর এক চিলতে অভিমান ছুঁয়ে গেল সেই রাতের প্রতিটি কোণ।

রাঙামাটির সকালগুলো খুব নির্লজ্জভাবে সুন্দর যেন পাহাড়, লেক, আকাশ আর কুয়াশার এক নিঃশব্দ আঁকাবাঁকা প্রেম। চৌধুরী বাগানবাড়ির চারপাশে তখনও শিশির জমে আছে ঘাসে, আমগাছের পাতায়, ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড়ের কিনারায়। বাড়ির পুরনো কাঠের দরজাটা খোলা, সামনে উঠোনে পড়ে আছে রাতের ফেলে যাওয়া চুপচাপ হাওয়া।

দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে নামা সূর্যের আলো যেন আস্তে আস্তে বাড়িটার গায়ে পড়ছে প্রথমে জানালার পাল্লায়, তারপর লাল ইটের দেয়ালে, তারপর বারান্দার পুরনো দোলনায়। কারো হাতে ধরা ঝিনুকের মত ছোট এক কাপ চা, পাশেই রাখা হাঁড়ি থেকে উঠছে ভাতের ধোঁয়া। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ঘি-জিরে ভাজার হালকা গন্ধ।
পাখিরা গাছের মাথায় বসে গান গাইছে, আর বাড়ির পিছনের পুকুরপাড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ হয়তো কারো দিন শুরুর আগে নিজেকে একটু খুঁজে নেওয়া। কারো ঘরের জানালা তখনও বন্ধ, কেউ আবার ছাদের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে কাপ্তাই লেকের দিকে যেখানে ভোরের আলো আর নীলজল একসাথে মিশে আছে, যেন কোনও প্রাচীন চিঠির শেষ লাইনে লেখা অশ্রুজল।
এই বাড়িতে সকাল শুধু সময় নয়, এটা একটা অনুভূতি কুয়াশা মোড়ানো, রোদের মতো নরম, আর স্মৃতির মতো গভীর।

চৌধুরী পরিবারের বাগান বাড়ির সামনের বারান্দা সংলগ্ন খোলা বসার স্থানে ছেলেমেয়েরাসবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কারো হাতে চা, কেউ মোবাইল নিয়ে টিপাটিপি করছে, কেউ শুধু ঘুরে ঘুরে কথা বলছে।
এই আড্ডার মাঝেই রায়ান হঠাৎ বলে উঠল,
“আচ্ছা, বিকেলবেলায় যদি সকলে মিলে কাপ্তাই লেকে যাই, কেমন হয়?”
মারিয়া চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল,
“আমি যাব! আমিও যাব!”
রায়ান ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল “ সরি বাচ্চারা নট অ্যালওয়েড “

“রায়ান ভাই আমায় না নিয়ে গেলে কিন্তু যাওয়া ভঙ্গ করে দেব।”
মারিয়ার এই কান্না কান্না সুরে বলে যাওয়া কথার পরেই অনু বলে উঠল,
” মারিয়া ও নট অ্যালওয়েড হয়ে যাবে তাও তুই যাবি বইন এখন শান্ত হো”
এই কথায় যেন আবারও মারিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও রায়ান রেগে গেল অনুর কথায় ।
ওর কথা শেষ হতে না হতেই বসার জায়গাটা হেসে উঠল কে কাকে কতটা খোঁচা দিতে পারে, সেই লড়াই যেন শুরু হয়ে গেল আবার।

নয়ন রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুইও অ্যালাউ না, তুইও তো ছোট!”
রায়ান গম্ভীর ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “প্ল্যানটা আমি দিয়েছি তো, আমি তো যাবই!”
নেহা পাশে বসেই জিজ্ঞেস করল, “কখন যাবে তাহলে?”
তিয়াশা চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে নিচু গলায় বলল, “কাল তো আপুদের হলুদ… (বলতে যেন গলা ভারী হয়ে উঠছিল)… তাহলে আজই চলো।”
আকাশ বলল, “তাহলে সবাই রেডি হই চলো এই সকালেই যাওয়া যাক চলো ”
ঠিক তখনই দিগন্তরেখা ছুঁয়ে, মিষ্টি রোদ্দুরে ভেজা রাস্তায় জগিং করে বাড়ি ফিরছিল দুজনে জায়ান আর ইউভি ঘামে ভেজা টি-শার্ট, কপালে জল গড়িয়ে পড়ছে। উফ এই ভেজা চেহারা দেখে তিয়াশার নজর যেন অন্য কোথাও সরতেই চাচ্ছিল না এদিকে নেহাও ধীর কণ্ঠে বলে উঠল

।”আ হা কি হ্যান্ডসাম আমার ইউভি ভাই ”
এর মধ্যেই নয়ন ওদের দেখে ডাক দিল,
“জায়ান ভাই! সবাই মিলে কাপ্তাই লেকে যাচ্ছি ঘুরতে, তোমরাও চলো।”
জায়ান একটু থেমে এক সোজা, স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, “না।”
তার গলায় এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, যে আর কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। চারপাশটা হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
তিয়াশা তখন চুপচাপ বসে, মনেই বলল —

“ইস, একটু গেলে কী হতো? কাল বাদে পরশুই তো বিয়ে হয়ে যাবে…”
জায়ান গটগট করে ভেতরে চলে গেল।
সবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল — কে কার রুমে গেল, কী কাপড় পরবে, কোন ব্যাগে জিনিস নেবে, সব নিয়েই ব্যস্ততা। সদর দরজা পার করে তিয়াশা আর আরোহী নিজেদের রুমের দিকে যাচ্ছিল।
ঠিক তখন পেছন থেকে এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল —
“যেখানে যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে, সেই প্ল্যান থেকে যেন ১০০০ মাইল দূরে থাকা হয়।”
তিয়াশা আর আরোহী বুঝে গেল এই কণ্ঠস্বর কার।

তিয়াশা থেমে পেছন ফিরে বলল, “কেন? সবাই যাচ্ছে, আমিও যাবো।”
“যাক সবাই, তুই যাবি না। আর একটাও কথা শুনতে চাই না।”
এই বলে তিনি সোজা ড্রইংরুমের দিকে চলে গেলেন।
তিয়াশা দাঁড়িয়ে থেকে চাপা রাগে ফুসে উঠল —
“ভালো লাগে না আর, ধুর।মনের মানুষ এত জালাবে জানলে, মনেই ধরতাম না।”
তিয়াশার কথায় আরোহী হেসে বলে উঠল,
“দোস্ত! ভাইয়া তো তোর উপর রীতিমতো হক চালাচ্ছে?”
তিয়াশা গরম হয়ে বলল,
“নিজের হক নিজের কাছেই রাখুক। একদিন বাদে ড্যাং ড্যাং করে আপু রে বিয়ে করবে, আবার হক চালায়।”
মনখারাপের ভার নিয়ে দু’জনে ধীরে ধীরে ওপরে চলে গেল। বৃষ্টি শরীর খারাপ নিয়ে রুমে শুয়ে আছে–
নিঃশব্দ, নিঃসাড়, যেন নিজের মধ্যেই গুটিয়ে থাকা একটা নরম বিকেল।
রুমে ঢুকে তিয়াশা থমকে দাঁড়াল। বৃষ্টিকে এমন শুয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর হঠাৎ করে একটা খারাপ লাগা জন্ম নিল।
নরম গলায় প্রশ্ন করল,

“আপু, কী হয়েছে তোর? সব সময় এত মনমরা হয়ে থাকিস কেন?”
বৃষ্টি চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
“কিছু না।”
আরোহী ততক্ষণে পাশে এসে বসে পড়েছে, বলে উঠল,
“তুই যদি না যাস, আমিও যাব না।”
বৃষ্টি চোখ মেলে তাকিয়ে হালকা হাসল,
“না রে বেবি, তুই যা। প্লিজ।”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানাল,
“কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
তিয়াশা বলল,
“কাপ্তাই লেকে যাব ভাবছি… যাবি আপু?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ল,
“না, তোরা যা। আমি পরে যাব।”
তিয়াশা নিচু গলায় বলল,
“আমিও যাব না। শরীর ভালো লাগছে না।”
আরোহী তখন চুপচাপ বুঝে গেল– তিয়াশা যা বলছে, তা সত্যি নয়। শরীরের নয়, ওর মনটাই বেশি অসুস্থ।

নিচে নেমে আরোহী সবার উদ্দেশে জানাল,
“তিয়াশার শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে। তাই সে যাবে না।”
অয়ন মুখ কুঁচকে বলল,
“এই তো একটু আগেই ঠিক ছিল। এখন আবার কী হলো?”
আরোহী কেবল বলল,
“এখন আর ঠিক নেই, তাই যাচ্ছে না।”
আর অতিরিক্ত কোনো প্রশ্ন না করে, বাকিরা কাপ্তাই লেকের উদ্দেশে রওনা হল।
এদিকে তিয়াশার মনটা তার শরীরের চেয়েও ভারী হয়ে আছে। মন নিয়ে যেতে না পারায় সে ধীর পায়ে চলে গেল আম্মু চাচী দের কাছে একাকিত্ব কাটানোর জন্য।
রুমে তখন নিঃসঙ্গ বৃষ্টি, চোখে যেন কোনো কথা নেই, শুধু অভিমান জমে আছে পাতার নিচে পড়ে থাকা জলবিন্দুর মতো।
ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এল–

“বৃষ্টি, আসবো?”
বৃষ্টি ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বলল,
“হ্যাঁ জায়ান ভাই, আসেন না।”
জায়ান দু’হাত পেছনে গুঁজে রুমে ঢুকল। ঢোকার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হল –তার “পিচ্চি”টি কোথাও আশপাশে নেই। ও থাকলে আবার উল্টোপাল্টা ভাববে।
জায়ান একটু থেমে বলল—
“বৃষ্টি, শরীর খুব খারাপ?”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, এখন একটু ভালো আছি।”
জায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানাল,
“আসলে কাল সকালে তোকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম, কিন্তু বলা হয়নি। আজ মনে হচ্ছে আর চুপ থাকা ঠিক নয়।”

বৃষ্টি শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“বলুন, কোনো সমস্যা নেই।”
জায়ান মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল..
“বৃষ্টি, তোর আর আমার বিয়েটা ছোটবেলাতেই পরিবার থেকে স্থির হয়ে গিয়েছিল। সেসময় আমাদের কারও কোনো মতামতের মূল্য ছিল না, এমনকি বুঝবার বয়সও ছিল না। আমি মেনেও নিয়েছিলাম সব কিছু। তুই দেখতে সুন্দর, ভীষণ শান্ত, ভদ্র , ভেবেছিলাম তোকে ছাড়া ভালো জীবনসঙ্গী হয়তো খুঁজলেও পেতাম না। কিন্তু জানিস, জীবন এমনই… হঠাৎ করে কেউ এসে একরকম তোলপাড় করে দেয় হৃদয়কে। আর সেই তোলপাড় আমি চাইলেও থামাতে পারছি না।”

“দেশে ফেরার পর থেকে মনে হচ্ছে, আমার হৃদয় নামক ঘরটা কেউ এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে বৃষ্টি। আমি নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি না ,আমার মন, আমার দৃষ্টি, আমার অনুভব সব কিছুর মালিক যেন এখন অন্য কেউ।”
তারপর ধীরে ধীরে সে বৃষ্টির দিকে ঘুরে তাকাল।
“বৃষ্টি, যদি তোর সঙ্গে বিয়েটা হয়েও যায়, আমি হয়তো খুশি হতে পারব না। শুধু মেজো মায়ের শরীর খারাপ এর কথা ভেবে, আমি চুপ করে রয়েছি। তুই যে যে ফ্যাসিলিটি চাস আমি দিতে পারব। কিন্তু ভালোবাসা?”
সেটা আর পারবো না বৃষ্টি , আমায় ক্ষমা করিস।
“ভালোবাসার মালিক আমি আর নেই, আমার হৃদয় এখন অন্য কারও অধীনে। আর সেই বন্ধন দিনকে দিন আরও শক্ত হচ্ছে।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২০

জায়ানের কথা শেষ হতেই যেন বৃষ্টির ভেতরে বহুদিন ধরে জমে থাকা এক ধোঁয়াটে দ্বিধার কুয়াশা ধীরে ধীরে সরতে শুরু করল। হৃদয়ের অন্তর্গত কোনো ভারী চাপ যেন একটু একটু করে আলগা হয়ে এল ।সে বুঝে উঠতে পারল না কেন, কিন্তু তার ভিতরটা হালকা লাগছে, নিঃশ্বাসগুলো কিছুটা স্বস্তির মতো।
ধীরে ধীরে এক কদম এগিয়ে এসে, নিচু স্বরে বলল ,
“আসলে ভাইয়া, আমারও কিছু কথা ছিল আপনাকে বলার… আমি..……”
কথা শেষ হওয়ার আগেই, দরজার পাশ থেকে হঠাৎ কারো আওয়াজ আসলো……..

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here