তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২২

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২২
নীল মণি

“কি রে জায়ন, বৃষ্টির রুমে কী করছিস তুই? আর মাত্র দুই দিন অপেক্ষা কর, তারপরই তো একেবারে তোর রুমে চলে আসবে ও।”
সুরাইয়া বেগমের হঠাৎ কণ্ঠে যেন ঘরে হিমেল এক স্তব্ধতা নেমে এলো।
বৃষ্টি আর জায়ন দুজনেই চমকে উঠল।
“না চাচী, আসলে… বৃষ্টির সঙ্গে কিছু কথা ছিল। তাই ”
“কথা তো পড়েও বলা যায়, জায়ন। এই দুই দিন আর দেখা করা চলবে না। কিছু পারিবারিক নিয়ম আছে, যেগুলো মানতেই হয়। বুঝলি তো? এখন যা, নিচে যা।”

সুরাইয়া বেগমের কণ্ঠে ছিল না রাগ, ছিল এক দৃঢ়তা, এক নিঃসংশয় নিয়মের ঘোর।
বৃষ্টির ভেতরটায় হঠাৎ একটা আশ্বাসের আলো জ্বলে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল আজ, এইবার, সে নিজের কথাগুলো বলেই দেবে জায়ন ভাইকে। কিন্তু হঠাৎ করেই সব আলো নিভে গেল,চোখের সামনে যেন কালো পর্দা টানা হলো।
সে চুপ করে গেল।
আর জায়ন?
সে আর কিছু বলল না। তার মনে যে ভার চাপা ছিল, সেই বোঝাটুকু অন্তত নামিয়ে দিতে পেরেছে, বৃষ্টিকে বলে এসেছে, তাই ফিরে গেল নিঃশব্দে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোর শরীর খারাপ, তাই আমি উপরে খাবারটা নিয়ে আসলাম। কেমন লাগছে এখন, আম্মু?”
সুরাইয়া বেগম কোমল সুরে জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ চাচী, এখন একটু ভালো লাগছে।”
বৃষ্টি একটুখানি হাসতে চাইল, কিন্তু ঠোঁট কাঁপল শুধু হৃদয়ের ভেতরে অজস্র না বলা কথা জমে রইল।

কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্যটা কোনো ছবি দিয়ে বোঝানো যায় না ওটা অনুভব করতে হয়, জলের ওপর সূর্যের আলো যেভাবে খেলে যায়, সেভাবেই মনে হয় যেন জীবনের প্রতিটি কষ্ট, প্রতিটি অনুচ্চারিত অভিমান ধুয়ে-মুছে এই জলে হারিয়ে যাবে, আর তার জায়গায় জন্ম নেবে এক নিঃশব্দ শান্তি, যা আর কোনো শহরের কোলাহলে পাওয়া যায় না, কেবল এই পাহাড় আর জলের মেলবন্ধনে।
” এই আমার এই ফোন টায় কেউ ছবি তুলে দিবে ?”
আরোহীর কথায় আকাশ নয়ন দুজনে ফিরে তাকালো।
আকাশ মনে মনে ভাবছে –

” এই পিচ্চি আবার ফোন ব্যবহার করে ?”
” এই যে রঙ্গা মূলো কি ভাবেন?”
নয়ন মনে মনে ভাবল, কথাটা বুঝি আরোহী তাকে বলেছে।
এই বুঝি একটা সুযোগ এল সে কথা বাড়াবে—
“এই যে মিস, আমি কেন রাঙ্গা মূলো হবো?” — হালকা কণ্ঠে, কিন্তু একটু রাগ রাগ ভাব এনেই বলল নয়ন।
আরোহী কিছু বলার আগেই আকাশ হেসে বলে উঠল,
“সরি ছোট ভাই, ও তোমাকে বলেনি বুঝি?”
নয়নের ভ্রু কুঁচকে গেল।

“মানে?”
আকাশ এবার আর একটু এগিয়ে এসে, হালকা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“মানে ওই ‘রাঙ্গা মূলো’ নামটা আমার জন্য নির্দিষ্ট। তোমার জন্য না রে ভাই।”
এক মুহূর্ত চুপ।
আরোহী ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়ে ভাবল,
“এরা কেউ আমার ফটো তোলার দিকে নজর না দিয়ে ,সবাই ‘রাঙ্গা মূলো’ নিয়েই পড়ে আছে। যত্তসব আজাইরা কারবার।”
আর তখনই আরোহী একটু বিরক্ত হয়ে গলা তুলে বলল
“এই যে! আমার ফটোটা কি তুলে দেবেন কেউ?”
আকাশ আর নয়ন তখনও কে কার ‘রাঙ্গা মূলো’ তা নিয়ে ভাবছে, ঠিক তখনই রায়ান গিয়ে ঝটপট বলে উঠল,
“আরে রুহী আপু! তোমার এই ভাই থাকতে চিন্তা কিসের? আসো, এইদিকে, ফটো তুলে দিই এখনই!”
রায়ানের কথা শুনে আরোহীর মুখে অল্প হাসির রেখা ফুটে উঠল।
সে আর এক মুহূর্তও অপচয় না করে দু’জনের দিকে মুখ বাঁকিয়ে সটকে পড়ল রায়ানের দিকে, যেন মনের ভেতর ভাবছে,
“এই একমাত্র ভাইটাকেই ঠিক কাজের মনে হচ্ছে!”

রায়ান এগিয়ে গিয়ে যখন আরোহীর ফটো তুলতে উদ্যত, তখনই আকাশ হঠাৎ তার হাত থেকে ফোনটি আলতো করে নিয়ে বলল,
“যা তুই, আমি-ই তুলে দিচ্ছি।”
আরোহী মনে মনে একটু বিরক্তই হলো ,
“এতক্ষণ বললাম, তখনদর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন এমন ঢং কেন? যাক, আমার তো কেবল ছবিটাই চাই। কে তুললো তাতে কিছু আসে যায় না।”
আকাশ এর কাছে থাকা ফোন ক্যামেরার লেন্সের পেছনে দাঁড়িয়ে পরপর কিছু ছবি তুলতে লাগল।
লেকের নীল জলরাশির পটভূমিতে, গোলাপি লম্বা গাউনের ঢেউ খেলানো ছায়ায়, কোমর ছুঁয়ে ঝরে পড়া কেশরাশি আর কাজল আঁকা চোখে সেই কিশোরী যেন কোনো জলপরী হয়ে উঠেছে নিরব, অনিন্দ্যসুন্দর, অবিকল এক নিখুঁত মুহূর্তে ধরা দেওয়া সৌন্দর্যের অবয়ব।
আকাশের মনে কোথা থেকে যেন এক চাপা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হতে থাকে

“আহ্, কী সুন্দর! এ তো নিছক কিশোরী নয়, এ যে আমার জলপরী আমার আপন, একান্ত, অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে। আকাশ, হারিয়ে যেতে দিও না ওকে…”
হঠাৎ
“এই যে রাঙা মূলো, ফটো তুলছেন না শুধু দাড়িয়ে আছেন?”
আরোহীর কথায় আকাশের টনক নড়ল।
আকাশ এক ঝটকায় ফিরে এলো সেই মায়াবী জগৎ থেকেযেখানে সুধুই ছিল তার জলপরী, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ঠোঁটে চিরচেনা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল
“জী জলপরী, অনেকগুলো ফটো তুলে ফেলেছি। ভালো লাগলে ‘থ্যাংকস’ বলার দরকার নেই, তবে কোনোদিন যদি কিছু চাওয়া পড়ে… না করে দিয়ো না।”
এই বলে ফোনটি আরোহীর হাতে দিয়ে এক ঝটকায় সরে গেল ইউভির দিক।
আরোহী একটু চমকে হেসে ওঠে
“এই ছেলে শুধু রাঙা মূলোই না, পাগল ও বটে।”
সে ফোন হাতে নিয়ে ফটোগুলো দেখতে লাগল। আর প্রথম ছবিতেই থমকে গেল তার দৃষ্টি
“উফ্… রাঙা মূলো তো একেবারে ছবির কারিগর! অসাধারণ তুলেছে…”

সবাই মিলে লেকের ধারে দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়ার স্পর্শে, অকারণ হাসি, গল্প আর কিশোরসুলভ ঠাট্টায় এক মনোরম বিকেল কাটাচ্ছিল,
অনু, মারিয়া, নেহা, আকাশ, রায়ান, ইউভি, রিক, অয়ন আর নয়ন ।এদের মাঝে মারিয়া ছিল বয়সে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু চঞ্চলতায় কারও কম নয়।
হঠাৎ রায়ান অনুর চুল ধরে টান দিয়ে বসে।
রায়ানের অকারণে বলা কোনও উক্তিতে অনু রেগে গিয়ে তার কান টেনে ধরে।
খুনসুটির সেই নিরীহ ছায়ায়, হেসে হেসে একে অপরকে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে কখন যে তারা লেকের পাড়ের একান্ত দূরপ্রান্তে চলে এসেছে, কেউ টেরও পায়নি।
ঠিক তখনই, অনুর পা পিছলে যায় কাদামাটিতে, আর মুহূর্তের ব্যবধানে সে ভারসাম্য হারিয়ে গভীর জলে পড়ে যেতে উদ্যত,

চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে ইউভি যেন হঠাৎ বাস্তব ভুলে আতঙ্কের গভীরে ডুবে যায়।
“অনু!” তার কণ্ঠস্বর যেন আকাশ বিদীর্ণ করে ছুটে আসে।
দৌঁড়ে এসে ইউভি শক্ত করে অনুর হাত ধরে টেনে নিজের দিকে টেনে আনে,
সেই দৃশ্য দেখে সবাই থমকে যায়, যেন সময় স্থবির হয়ে পড়েছে।
ইউভির হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এসেছে। মনে মনে তার বুকের ভেতরে এক দমবন্ধ ঘূর্ণিপাক চলতে থাকে,
আরেকটু হলেই তার হৃদয়ের একান্ত পাখি, সেই অনু, এই অজস্র জলতলে হারিয়ে যেত চিরতরে।
অনু নিজেও ভীত, কিন্তু ইউভির চোখের আতঙ্ক, তার তুলনায় যেন বহুগুণ তীব্র।
সে কাঁপা কণ্ঠে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল

“ঠিক আছিস তো অনু? আমি আছি… তোকে কিছু হতে দেব না… কিছুই না।”
এই বলে নিজের কাছে টেনে নিল
সেই মুহূর্তে ইউভি ঘুরে দাঁড়াল, তার দৃষ্টিতে ছিল আগুনের হলকা।
সে রায়ানের দিকে তীক্ষ্ণ, রক্তগোলার মতো চোখে তাকিয়ে বলল–
“নেক্সট টাইম যদি ওর গায়ে একটা আঙুলও ওঠাস, রায়ান, আমি তোর হাত ভেঙে দেব।”
রায়ান স্তব্ধ, ভয়ে নিঃশব্দ।
সবাই তাকিয়ে আছে ইউভির দিকে তাকে তারা এভাবে আগে কখনও দেখেনি।
রাগ, ভালোবাসা, আতঙ্ক, অধিকার সব মিশে এক অপ্রতিরোধ্য উত্তাল আবেগ তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনু ইতস্তত গলায় বলে উঠল,
“ইউভি ভাইয়া… আমি ঠিক আছি।”
রায়ানও তৎক্ষণাৎ বলে–

“ভাইয়া, আমি সত্যি বুঝিনি…”
কিন্তু ইউভির কণ্ঠ বজ্রের মতো প্রতিধ্বনিত হলো,
“আজ যদি ও ওই গভির জলে পড়ে যেত, তখনও কি তুই বলতি ‘আমি বুঝিনি’?”
তার সেই রাগত কণ্ঠ যেন বাতাস কাঁপিয়ে তোলে, সবার মুখের ওপর নেমে আসে ভারী স্তব্ধতা।
আর এই মুহূর্তে, ইউভির অনুর প্রতি অজস্র যত্ন, অধিকারমিশ্র ভালোবাসা দেখে
নেহার চোখে যেন হঠাৎ একটা কাঁটা বিঁধে গেল।
তার অন্তরে কোনো অচেনা বিষাদের ছায়া নেমে এল
এই অনুভূতির নাম সে জানে না, কিন্তু তা যে একধরনের তীব্র অস্বস্তি, তা আর অস্বীকার করা যায় না।
আর দেরি না করে এবার সবাই বাসার উদ্দেশে রওনা দিল,
গাড়ি তে ওঠার আগে আকাশ ইউভির হাত টেনে বলল

” ইউভি ভাইয়া এটা কি ছিল?”
” কোন টা কি ছিল ?”
” তুমিও জানো কোনটার কথা বলছি, যেটা ছিল নরমাল ছিল না ।”
ইউভি একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমরে হাত দিয়ে বলল –
” তোর যেমন গভির জলের জলপরী আছে , তার থেকেও বেশি আমার আমার হৃদয়ের হৃদয় পাখী আছে ,
আর অনু হলো আমার সেই হৃদয়পাখী ।”
আকাশ চমকে উঠে বলল —
” কি আমাদের অনু ? কিন্তু ভাই ও তো তোমার থেকে অনেক ছোট ।”
ইউভি একটু হেসে বলল —

” ৭ বছর ৪ মাস ১৮ দিন এর ছোট। অন্তত ১২ বছরের ছোট মেয়ের প্রেমে তো আর হাবুডুবু খাচ্ছি না।”
আকাশ আবার ও চমকে উঠে ভ্রূ কুচকে বলল —
” ১২ বছর মানে কে আবার ১২ বছরের ছোট মেয়ের প্রেমে পড়ল ?”
” তোর কি মনে হয় আকাশ , তিয়াশার হঠাৎ করে ১৫, ২০ মিনিটের মধ্যে শরীর খারাপ কি করে হলো?”
” মানে? এখানে তিয়াশা কোথা থেকে আসলো?”
” বনুর কোন শরীর খারাপ হয়নি , জায়ন ভাই আসতে দেই নি ওকে । আর আমাদের তিয়শা জায়ন ভাইয়ের আনহেলদি অবসেশন। আর তার ওই আনহেলদি অবসেশন এর কাছে আমার আর তোর হৃদয়ের বাতি
সামান্য হারিকেনের আলো বরাবর।”

আকাশের চোখ বিস্ময়ে প্রলম্বিত হয়ে উঠল, চেহারার প্রতিটি রেখায় ছড়িয়ে পড়ল বিস্ময় ও হতবাক ভাব—একপলকের জন্য যেন নিঃশ্বাসটুকু থেমে গেল তার মনে মনে ভাবছে যে বড় ভাইয়ার কাল হলুদ সেই বড় বড় ভাইয়া আমাদের বনু তিয়াশার ……..
তারপর
শুধু মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো —
” কি ই ই ই ই…..”

এদিকে তিয়াশা বসেছিল তার খালামণি, আম্মু, মামিমা ও চাচিদের সান্নিধ্যে। নারীকণ্ঠে হাস্যরস, গল্প, আর রান্নার ঘ্রাণে ভরপুর ছিল বৈঠকখানা।
হঠাৎ করিডোরের ওপরে থেকে এক পুরুষকণ্ঠ ভেসে এলো, যেন অকারণেই বাতাসে আগুন ধরিয়ে দিল,
“রোদ!”
তিয়াশার চোখ রসগোল্লার মতো বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
“আবার কী করলাম আমি? ডাকে কেন এই লোক? এই ডাক উপেক্ষা করলেই তো কিছু না কিছু কাণ্ড ঘটায়।”
অগত্যা, সে দম নিয়ে জবাব দিল,
“জী জায়ন ভাই ?”

উত্তর এলো উপরের দিক থেকে, গম্ভীর ও নির্দেশনামূলক কণ্ঠে,
“একটু উপরে আয় তো, একটা কাজ আছে তোকে দিয়ে।”
মেহজাবীন বেগম সস্নেহে বললেন,
“তাড়াতাড়ি যা আম্মু, দেখ তো কী কাজ।”
“জী বড় আম্মু।”
এই বলে সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল।
জায়নের কক্ষের সামনে এসে সে দেখল, রুম নিঃস্তব্ধ কেউ নেই।
একটু ভিতরে উঁকি ঝুঁকি করতে গিয়ে হঠাৎ দরজা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল।
তিয়াশা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই কেউ পেছন থেকে একখানা লাল রঙের শাড়ি মাথায় জড়িয়ে, কাপড়টি তার গায়ে পেঁচিয়ে দিল।

তারপর সেই হাত পেছন দিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে, কাচের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।
আয়নায় প্রতিবিম্বে প্রতিফলিত হলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য
গায়ে লাল শাড়ি, চোখে বিস্ময়, চুল এলোমেলো আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে জায়নের চোখে সেই অদ্ভুত দীপ্তি, যেন সেই মুহূর্তে সে সময় হারিয়ে এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছে।
জায়ন মনে মনে বলে উঠল,
“হে আল্লাহ, এই পিচ্চি কি রূপে ধরা দিল? এইটুকু মেয়ে এতটা অপার্থিব সুন্দর কী করে হয়? আমার এই পশুবৃত্তির ভালোবাসার তীব্রতায় আমি যেন নিজেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি… হে খোদা, যদি কখনও হালাল করি একে, তখন আমায় তুমি রক্ষা করো!”
জায়নের এতটা ঘনিষ্ঠতায় তিয়াশা শিউরে উঠল, যেন সে অজান্তেই এক মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
কাঁপা কণ্ঠে সে বলে উঠল,

“আপনি সবসময় এভাবে জড়িয়ে ধরেন কেন? জানেন আমার… কত কিছু হয়?”
জায়ন হাস্কি কণ্ঠে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বল,
“কি হয় রোদ? বল তো…”
“কি যেন হয়… ঠিক বলতে পারি না।”
” যা হয় হোক, শুধু বাধা দিস না আমায়।’
তিয়াশা সরে যেতে চাইল, ফিসফিসিয়ে বলল
“আমি পরপুরুষের স্পর্শ নেব না।,”
জায়ন দৃঢ়স্বরে বলল,
” আমি তো কোনও পরপুরুষ নই।”

“ছাড়ুন… আমাকে ধরবেন না, কাল পরশুই তো আপনার বিয়ে।”
এইবার জায়ন তিয়াশাকে ঘুরিয়ে তার চিবুকে আলতো ছোঁয়া দিয়ে, তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তাই বলে আমি ছুঁবো না? তোকে না ছুঁয়ে থাকব কেমন করে বল!”
তিয়াশা ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিল, বলল,
” জাই হোক, আপনি আমায় ছুঁবেন না।”
জায়নের ধৈর্যের সীমা এবার ফেটে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে তিয়াশার কব্জি ধরে নিজের বুকের সঙ্গে জোরে চেপে ধরল,
“খবরদার, যদি আবার এমন কিছু বলিস… যেই আসুক না কেন, যদি তোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে আমি তার কবর তৈরি করে ফেলবো।”
তিয়াশা এবার আর কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ভয়ে। ধীরস্বরে বলল,

“এই… এই শাড়িটা কা…কার?”
জায়ন চোখ সরিয়ে বলে উঠল,,
“এখন কার গায়ে আছে?”
“আমার।”
“তাহলে তোর।”
জায়ন।একটু আলগা করে দিল তিয়াশার ছোট্ট নরম তুল তুলে শরীরটা । তৎক্ষনাৎ দেরি না করে তিয়াশা দরজা খুলে সজোরে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
জায়ন চুল ব্যাক ব্রাশ করে কোমরে এক হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, তার চোখের সামনে তিয়াশার দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ঠাট্টামিশ্রিত হাসি টেনে বলল,
“পালা যত পালানোর, যেদিন তোকে একবার পেয়ে যাব, সেদিন বুঝবি তুই কাছে আসলে আমার কী কী হয়। আর সেই ‘কি কি’ দেখাতে গিয়ে কয়টা বেড আমি ভাঙবো আমি নিজেই জানিনা আমার লিটিল কিটি ক্যাট।”

চৌধুরী বাড়ির সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ আজ এসে উপস্থিত জায়ন ও বৃষ্টির গায়ে হলুদের আয়োজনে যেন ঘূর্ণি তুলেছে এক নিভৃত অস্বস্তির ঝড়। যাদের জন্য এত আয়োজন, সেই দু’টি মুখেই স্পষ্ট বিরক্তির ছায়া। অথচ বাড়ির কর্ত্রীগণ ও কর্তা ব্যক্তিবর্গ যেন আনন্দে বিভোর, যেন আজ জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত তাদের দু’চোখে।
বাগানবাড়ির সম্মুখভাগে বিশাল এক প্যান্ডেল নির্মিত হয়েছে, যা প্রাকৃতিক শোভাকে আড়াল করে তুলেছে কৃত্রিম আলোকচ্ছটায়। মূল ফটকে সুদৃশ্য ফুলের গেট, ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে শুভ্র চুনির লাইটে সজ্জিত সৌন্দর্য। মেহেন্দি ও গায়ে হলুদের স্টেজ হয়েছে সেই প্যান্ডেলের মাঝেই চোখ ধাঁধানো সেই আয়োজন যেন সবাইকে মুগ্ধ করলেও, তিয়াশার অন্তরে বাঁধিয়ে দিয়েছে এক অজানা অস্বস্তির কাঁটা।
আকাশটাও যেন আজ মনের মতো রং মেলাতে ব্যর্থ ,ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ যেন পূর্বাভাস দিচ্ছে এক অপ্রত্যাশিত বর্ষার। গৃহিণী ও চাচীরা আকাশের এই রূপে খানিক হতাশ, এমন এক উজ্জ্বল দিনে প্রকৃতি কেন এতো বিমর্ষ?

আজকের দিনে আরও অনেক অতিথি এসে পৌঁছাবে। তার মধ্যে রয়েছে জায়নের অন্তরের বন্ধুরা যাঁদের আগমন এ বিয়ের অনুষ্ঠানে এক ভিন্ন রঙের আবেশ আনবে। তবে নাজিম আগেই জানিয়েছে, সে এই শুভক্ষণে উপস্থিত হতে পারবে না। সকালে ফোনে জায়নের সঙ্গে কথা বলে সে দুঃখপ্রকাশও করেছে।
সাগর, আহান ও পলাশ আসছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অবধি ফ্লাইট এআসছে সেখান থেকে চৌধুরী পরিবারের গাড়ি তাদের নিয়ে আসবে বাগানবাড়িতে।
দুপুরে অনুষ্ঠিত হবে মেহেন্দির অনুষ্ঠান, যার জন্য নির্ধারিত হয়েছে সবুজ রঙের ড্রেস, আর সন্ধ্যার গায়ে হলুদের থিমে থাকবে লেমন-হলুদ রঙ।

বাড়িজুড়ে এখন এক অপার কোলাহল শিশুদের হাসি-কান্না, ছোটাছুটি যেন প্রাণ জুগিয়ে তুলছে চারপাশ। আর সেই কোলাহলের মধ্যেই আয়েশা বেগম ছোট্ট মারিয়াকে ধমক দিচ্ছেন, যেন অতিরিক্ত ছোটাছুটিতে সে কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায়। বড় ভাতিজা-ভাতিজির এই শুভ লগ্নে কোনো বিপর্যয় তিনি দেখতে চান না।
দুপুরের আলো ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হচ্ছে, সোনালি রোদের কোমল পরশে চারপাশ জ্বলে উঠেছে এক রকমের স্বর্গীয় আভায়। ঠিক এমন সময়ে পৌঁছেছে জায়নের বন্ধুরা–সাগর ও তার স্ত্রী ইভা, আহান ও তার স্ত্রী মিথিলা, পলাশ ও তার স্ত্রী নূর। আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই সাগর শুরু করেছে তার স্বভাবসুলভ ঠাট্টা-রসিকতা। অতিথিদের জন্য করা হয়েছে হালকা নাস্তা ও নানান রকমের কোল্ডড্রিংকস এর আয়োজন করেছে।
বন্ধুদের স্ত্রীরা মেহজাবীন বেগমের সাথে রুমে রেস্টার জন্য গমন করেছে। এদিকে বাইরের বসার অংশে, ছায়াঘেরা এক কোণে বসে আছে জায়ন ও তার তিন বন্ধু।

“কি রে মামা, তোর তো সেই লাক।”
সাগরের এই কথায় জায়নের চোখ রাঙিয়ে ওঠে।
পলাশ মুখ গম্ভীর করে বলে ওঠে
“এই তোরা সবসময় কিসের এত সিক্রেট রাখিস রে? কানে কানে ফিসফাস করিস, যেন পৃথিবীর সব সিক্রেট তোদের কাছেই জমা।”
সাগর তৎক্ষণাৎ গলা চড়িয়ে বলে–
“আরে আরে না না! কিছু না ভাই, এমনি…”

পলাশ থামিয়ে দেয়– “চুপ কর সাগর! তুই মিথ্যে বললেই বুঝতে পারি। এবার বল, কেসটা কী?”
সাগর কেবল বারবার জায়নের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আর জায়নের মনে যেন ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে একধরনের রাগ, বিরক্তি—এই সাগর নামের পাত্রটাকে যেন এক থাপ্পড়ে চুপ করিয়ে দেয় সে।
অবশেষে জায়ন উঠে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে টেনে আনে এক রহস্যময় বাঁকা হাসি–“হয়তো দুই-তিন বছর পর আবারও একটা বিয়ে করবো।”
এই বলে সে ধীরপায়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, পেছনে রেখে যায় বন্ধুদের মুখে বিস্ময়ের ঢেউ আর পলাশের মনে হাজার প্রশ্নের স্রোত।

বাইরে চলছে মেহেন্দির অনুষ্ঠান উপস্তিত মেহমান দের সঙ্গে আয়োজিত হচ্ছে সেই অনুষ্ঠান , বৃষ্টি কে ভীষন সুন্দর লাগছে সবুজ রঙের লেহেঙ্গা তে কিন্তু কোথায় যেন এক অস্বস্তির ছায়া ।তার মা চাচীরাও পড়েছে সবুজ রঙের শাড়ি সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী।
এদিকে মেয়ে দের ঘরে সাজার ঝড় উঠেছে তিয়াশার সাজার একটুও ইচ্ছে নেই কিন্তু আরোহী জোর করে সাজাচ্ছে। নেহা তো এমন সাজ দিয়েছে যেন আজ তার মেহেন্দি।
আজ সবাই সবুজ রঙের সিল্ক এর শাড়ি পরেছে অনন্যা পর্জন্ত আজ শাড়ি পড়েছে ।
জায়ন , ইউভি, আকাশ ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে এক প্যাচরা পারছে । আকাশ জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে তার মনের হাজারো প্রশ্ন ।
জায়ন বুঝতে পারছে এই ইউভি আকাশ কে সব বলেছে , এদিকে জায়ন এর বিরক্ত দেখে ইউভি মুচকি মুচকি হাসছে ।

” ভাইয়া বলোনা”
আকাশ জায়ন এর পেছনে পেছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে ।
” আরে কি বলবো?”
” তোমার তো কাল বিয়ে তাহলে তিয়াশা? ”
” উহম তিয়াশা না আপু বলবি ।”
” আপু কেন বলবো? ও আমার ৪ বছরের ছোট ।”
” আমি কোন রিস্ক নিতে চাই না ভাই আমার হবু বউ টা এতো সুন্দর যতই তোর জলপরী থাক , আপু বলবি যদি আপু ভালো না লাগে ভাবি বলতে পারিস।”
জায়ন এর এই কথায় যেন আকাশ তার কিছু উত্তর পেয়েই গেল । শকড এর পর শকড খেয়ে যাচ্ছে ছেলেটা ,
এই শকড এর পর আরেক শকড খেয়ে বসলো ৩ জনেই যখন দেখলো ৪ রমনী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে,
কিন্তু যে যার রমনী কে দেখে শকড খেয়ে গেলো। মুখ হা হয়ে গেল —
আকাশ হা করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো —

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২১

” ওরে আমার জলপরী এ তোর কেমন রূপের খেলা জে আমার চোখ ঝলছে দিলি।”
ইউভির যেন চোঁখের সামনে সব বেসামাল লাগছে , সঙ্গে নিজেকেও বেসামাল করে নিচ্ছে।
” হৃদায়পাখী আমার হৃদয় নিয়ে খেলা করে না সোনা।”
জায়ন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে একটাই কথা বলল-
“ইউভি রে আমায় ধর আমার অসুস্থ লাগছে ,
তোরা চোঁখ বন্ধ কর, তোদের নজর ও যেন আমার গ্রীন এঞ্জেল এর দিকে না যায় ,
ওরে ইউভি এ তোর বনুর
কেমন রূপ , হায় আমি তো লুইটা গেলাম”
এই বলে নিচে পরে যাওয়ার আওয়াজ আসলো
ধাসস স স স স…….

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here