তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৭

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৭
নীল মণি

আম্মু মু মু……”
চিৎকারটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে দোতলার উপর পর্যন্ত পৌঁছে গেল, আরোহী আর তিয়াশার কানে যেন বাজ পড়ল।
“এটা ভাইয়ার গলা না ?নিচ থেকে এত আওয়াজ কেন আসতেছে রুহী?”
তিয়াশার প্রস্নতে আরোহী বলে উঠলো —
” দোস্ত বৃষ্টি কি আপু কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,সবাই খুব কান্না কাটি করতেসে।”
তিয়াশা যেন এক ঘোরের থেকে বেরিয়ে আসলো। সে জায়ন এর কথা ভাবতে ভাবতে তার বাস্তবে কি কি পরিস্থিতি র সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে সেই সত্যি টা প্রায় ভুলেই গেছিল–
তিয়াশা যেন হঠাৎ বাস্তবতায় ফিরল, জায়ন এর কথা ভাবতে ভাবতে আসল পরিস্থিতি ভুলেই গেছিল সে।
“কি ই ই — বৃষ্টি আপু পালিয়ে গেছে সবাই জেনে গেছে ?”
তিয়াশার কথা শুনে এবার আরোহীও থমকে গেল—
“বৃষ্টি আপু পালিয়েছে মানে? তুই কি জানিস কিছু?”
তিয়াশা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আরোহীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল

“সব পরে বলব, সবটা হয়তো বলতে পারব না, কিন্তু তোকে তো বলবই,এখন চল, নিচে…এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না।”
নিচে নামতেই তার চোখে পড়ল—রুহেনা বেগম অবচেতন অবস্থায় বড় আম্মুর কোলে নিথর হয়ে আছেন।
এই দৃশ্য দেখেই তিয়াশার বুকের গভীরে তীব্র আর্তনাদ গর্জে উঠল—
“আম্মু!”
চিৎকার করে ছুটে গেল সে মায়ের দিকে।
রুহেনা বেগমের হাত দুটো ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল—
“কি হয়েছে তোমার, আম্মু? বলো প্লিজ! কি হয়েছে?”
মা কোনো উত্তর না দিলে সে বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল—
“বড় আম্মু, আম্মুর কী হয়েছে?”
মেহজাবিন বেগম চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে কেঁদে বললেন—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জানি না মা… হঠাৎ কান্না করতে করতে এরকম আমার কোলে পড়ে গেল। এখন তোর ফুপা বলতেছে, মেজ আম্মুকে নাকি হাসপাতালে নিতে হবে।”
‘হসপিটাল’ শব্দটা শুনেই যেন পাথরের মতো জমে গেল তিয়াশার শরীর।
তার মনে হলো, পৃথিবীটা যেন চোখের সামনেই ঘুরে উঠল—কি শুনছে সে?
এই সব ভাবনার ভেতরেই হঠাৎ দেখা গেল—আহান আর সাগর মিলে জায়নকে ধরে নিচে নামাচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে পুরো বাসায় যেন হিমশীতল এক আতঙ্ক নেমে এলো।
তড়িৎ গতিতে পলাশ,তাহসান সাহেব আর প্রান্তিক সাহেব ছুটে গেলেন, চোখে মুখে নতুন আরেক ভয় আর উৎকণ্ঠার ছাপ,

“কি হয়েছে জায়নের? কি হয়েছে রে?
পুরো বাসা যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ। সবাই থমকে গেল।
তিয়াশা আর মেহজাবিন বেগম তখনও রুহেনা বেগমের দিকে মনোযোগী ছিলেন।
তাহসান সাহেবের কথা শুনে তাকিয়ে তারা দেখে—
জায়নের পায়ের নিচ থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরছে, তার চেহারায় কোনো সাড়া নেই, চোখ বন্ধ, অস্বাভাবিক অবস্তায় …
তৎক্ষণাৎ আহান আর সাগর জায়নকে নামিয়ে রাখলো সোফায়।
সাগর গাড়ি আনতে দৌড়ে গেল।
মেহজাবিন বেগম যেন ছেলের এমন অবস্থা দেখে শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললেন।
রুহেনা বেগমকে রেখে নিজের বুক চেপে ধরেই চিৎকার করে উঠলেন—
“বাব,আমার জায়ন বাবা… ছোট তাড়াতাড়ি মেজোকে ধর।”
কিন্তু এদিকে তিয়াশা যে তার জায়ন ভাইয়ের কাছে চলে গেছে , তার পৃথিবী টা যে ঘুরছে কি দেখছে সে এইসব।কি দেখছে ?
দৌড়ে গিয়ে জায়নের টিশার্টটা ধরে হাউমাউ করে উঠলো—

“জায়ন ভাই, জায়ন ভাই কি হয়েছে আপনার? চোখ খুলেন, প্লিজ।
জায়ন ভাই চোঁখ খোলেন
আপনি কথা বলেছেন না কেন? আহান ভাইয়া, দেখেন না… জায়ন ভাই চোখ খুলছে না।”
আহান শান্ত গলায় বলল—
“বোন, প্লিজ শান্ত হও। কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। এই তো হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি।”
তিয়াশা আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলো।
তার কান্নায় ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘর।
আরোহী আর অনন্যা ছুটে এল তিয়াশার পাশে।
তৎক্ষনাৎ সুরাইয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে রুহেনা বেগমকে নিজের কোলে শুইয়ে নিতেই ছুটে এলেন
মেহজাবিন বেগমও এসে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন—
“বাবা… ও বাবা, কি হলো তোর? আহান, আমার কলিজার টুকরাটারে কি হইলো রে?”
আহান বলল—

“জানি না আন্টি… রুমে গিয়ে দেখি, এমন অবস্থায় পড়ে আছে।”
আহান সত্যি টা বলতে চায় না পড়িবার কে । তাই যেটা তার ঠিক মনে হলো আপাতত এই পরিস্থিতিতে সেটাই বলেছে ।
“বড় আম্মু দেখেন না জায়ন ভাই চোখ খুলছে না!”
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জায়নকে ধরে নাড়িয়ে দিচ্ছে তিয়াশা।
সবার চোখে জল, কিন্তু কেউ বুঝছে না—এই কিশোরীর কান্নার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার অগ্নি।
কিন্তু আরোহী ভালো ভাবে বুঝতে পারছে তার বান্ধবীর এই পাগলামির কারন। সন্দেহ হলো আহান ও পলাশের ও শুধু তার বন্ধু এই মেয়ের জন্য পাগল না , এই বাচ্চা মেয়ে ও আমার বন্ধুর জন্য পাগল ।
নইলে পাশে তার নিজের আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে সেই ছেড়ে জায়ন এর জন্য কেন পাগলামি করছে।
মেহজাবিন বেগম কানা করতে করতে সর গা বুলিয়ে বলছেন—

“এই যে বাবা, তোর মা… চোখ খোল, বাবা, প্লিজ চোখ খোল”
অনন্যা কান্না করতে করতে এসে তিয়াশার কাঁধে হাত রেখে বলল—
“আপু, প্লিজ শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না ভাইয়ার ইনশাআল্লাহ।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা?
তিয়াশা যেন নিজের ভেতরের সব দায়, সব অপরাধবোধ কাঁদতে কাঁদতে ছুঁড়ে ফেলছে—
“কেন বললাম না… ওই বৃষ্টির রাতে বললেই তো পারতাম… আমিও তো আপনাকে ভালোবাসি, জায়ন ভাই!”
“হে আল্লাহ… আর কত কষ্ট দিবেন আমায়?”
প্রান্তিক সাহেব এক কোণে দাঁড়িয়ে। চোখে জল, মুখে কোনো শব্দ নেই।
তার সেই দৃঢ়চেতা, সাহসী ছেলেকে আজ এই অবস্থায় দেখে যেন তার নিজের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে কাঁপা গলায় বলে উঠলেন—

“তোরা কেউ তাড়াতাড়ি আমার ছেলেটারে হাসপাতালে নিয়ে যা, মেজো বউমাকেও।”
ঠিক সেই মুহূর্তে ইউভি বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকল,
আর ঢুকেই দেখে—তার বড় ভাই জায়ন সোফায় নিথর হয়ে শুয়ে আছে।
দৌড়ে গিয়ে এক বুক ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল—
“কি হয়েছে আহান ভাই? ভাইয়ার এই অবস্থা কেন?”
আহান ইশারায় জানিয়ে দিল—এখন প্রশ্ন নয়, কাজ করো।
ইউভি একবার ছোট বোনের মুখের দিকে তাকাল।
এর মধ্যেই আশরাফ সাহেব বলে উঠলেন—

“ইউভি, তাড়াতাড়ি কর,ভাবিকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।”
“আহান ভাইয়া, প্লিজ আমার বড় ভাইয়ার খেয়াল রাখো। আমি আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছি।”
এই কথা বলেই ইউভি পা বাড়াতেই তিয়াশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল—
“ভাইয়া, আমিও যাবো। আমায় নিয়ে চলো তোমাদের সঙ্গে।”
“না তুই ভাইয়ার সঙ্গে থাক। আমরা আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছি।”
এই বলে ইউভি রুহেনা বেগমকে কোলে তুলে নিল এবং গাড়ির দিকে ছুটে গেল।
সাথে গেলেন আশরাফ সাহেব ও রিক আর রায়ান ।
“তাহসান, তুইও যা। আর মেজ ভাইকে কেউ কল দিয়েছিস?”
প্রান্তিক সাহেবের প্রশ্নে তাহসান বলল—

“হ্যাঁ ভাইয়া আমি ও যাচ্ছি , কিন্তু জায়ন ? আর আমি মেজ ভাই কে কল দিয়ে দিয়েছি তারা আসছে।”
তাহসান সাহেব তার বড় ভাইয়াকে এই কথা বলতেই , প্রান্তিক সাহেব বললেন —
” তুই জায়ন এর কথা চিন্তা করিস না তারাতারি তুই যা।”
সাগর দ্রুত ছুটে এলো জায়নকে নেওয়ার করার জন্য।
আহান আর সাগর তুলে নিল জায়ন কে ।
তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন মেহজাবীন বেগম এবং প্রান্তিক সাহেবও।
পিছন পিছন কান্নাভেজা মুখে দৌঁড়ে এলো তিয়াশা।
প্রান্তিক সাহেব বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন —
“মেজো আম্মু, কোথায় যাচ্ছিস?”
তিয়াশা সজল নয়নে বলল —

“আমি জায়ন ভাইয়ের সঙ্গে যাব, বড় আব্বু।”
“তোর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আম্মু।”
“বড় আব্বু, অনুগ্রহ করে যেতে দিন।”
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রান্তিক সাহেব সম্মতি দিলেন —
“ঠিক আছে, চলো আম্মু।”
এদিকে পলাশ তিয়াশা কে ধীম স্বরে বলে উঠলো —
” বোন তুমি না গেলেও পরতে ।”
” প্লিজ ভাইয়া আমাকে জেতেই হবে ওনার সঙ্গে।”
আর কিছু বললো না পলাশ।

রাঙামাটির স্থানীয় চিকিৎসা-ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো না হওয়ায়, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় — জায়নকে ও চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করতে হবে। কারন রূহেনা বেগম কে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
রাত গভীর হলেও পথ ছিল নিরবিচার, যানবাহনের গতি ছিল দ্রুতগামী —
যেখানে রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে,
তারা পৌঁছে যায় মাত্র এক ঘণ্টা দশ মিনিটেই।
আশরাফ খান সাথে ছিলেন বলে এবং চৌধুরী পরিবারের ঐশ্বর্য ও খ্যাতির কারণে
কোনও প্রকার প্রশাসনিক জটিলতা না করেই,
ইমারজেন্সি ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

দ্রুততার সঙ্গে শুরু হয় দুজনেরই ট্রিটমেন্ট, এরমধ্যে পৌঁছে যায় তাহসান সাহেব ও আকাশ।
বাসায় ছিলেন সুরাইয়া বেগম, অনন্যা ,আয়েসা বেগম, বৃষ্টির মামা মামী ,নেহা, মরিয়া ,আরোহী তার আম্মু আব্বু , ইভা ,মিথিলা, নূর আরো বাকি কিছু মেহমান রা। এর মধ্যে কেউ খেয়াল করেনি যে রহমত সাহেব এর ফ্যমিলি অনুপস্থিত।
এদিকে কান্নায় গলা শুকিয়ে এসেছে তিয়াশার।
হাউমাউ করে কাদছে মেহজাবীন বেগম, তিয়াশা বারবার পায়চারি করছে আইসিইউ কেবিন এর সামনে একবার ও ইমারজেন্সি কেবিন এর সামনে একবার।
তার অস্থির দৃষ্টি বারবার খুঁজছে মায়ের মুখ, কিংবা একটিবার জায়ন ভাইয়ের চোখ— যদি সামান্য দেখাও মেলে…

“আহান ভাই… আমার ভাইয়ের কী হয়েছে?”
হাসপাতালের করিডোরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা আহান, সাগর ও পলাশ— হঠাৎই সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ইউভি।
তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আকাশও।
আহান বাকরুদ্ধ, কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
সেই মুহূর্তে সাগর একপ্রকার চাপা কণ্ঠে বলে উঠল–

“আসলে ছোট ভাই, জায়ন ঘুমের ওষুধ খেয়েছে।”
“কি——ই——ই? কী বলছো ততোমরা?”
তৎক্ষণাৎ আকাশ ও ইউভি দুজনেই চিৎকার করে উঠল।
তাদের চোখেমুখে যেন বজ্রপাত হলো মুহূর্তেই।
ইউভি মাথায় হাত রেখে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে বলল–
“না,না… তোমরা নিশ্চয়ই ভুল করছো! আমার ভাই এ কাজ করতে পারে না… বড় ভাই এমন কিছু করতে পারে না।”

কথা বলতে বলতে চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু।
পলাশ ঝুঁকে ইউভির কাঁধে হাত রাখল, তাকে উঠে দাঁড় করাল–
“ভাই… নিজেকে সামলাও। আন্টির শরীর ভালো নেই, তার ওপর জায়ন এর এই অবস্থা…”
তারই মাঝে আকাশ বলে উঠল–
“কিন্তু কেন করল ভাইয়া এমন কিছু? তোমরা নিশ্চয়ই কিছু জানো!”
পলাশ কিছু বলছে না। যদিও সে ঘটনাস্থলে ছিল না, তবে সাগর ইতিমধ্যেই সব বলেছে তাকে।
কেউ যখন কিছু না বলছে, ইউভি চারদিক ঘুরে একটা হিংস্র চোখে গর্জে উঠল–
“যদি কিছু জানো এখুনি বলো,আমি সব জানতে চাই, এক্ষুণি ”
তখন ধীরে ধীরে আহান মাথা নিচু করে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে ইউভিকে তারা যা শুনেছে , যা দেখেছে —
সব শুনে ইউভির চেহারা মুহূর্তেই বদলে যায়–

চোখে জমে ওঠে রক্তলাল ক্রোধ।
সে শব্দহীন পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে— যেন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে, যেন কাউকে ছিঁড়ে খেতে বেরিয়েছে।
“ইউভি,কই যাচ্ছিস ছোট ভাই?”
“ইউভি ভাইয়া! কোথায় যাচ্ছ?”
কোনও জবাব নেই।
তবে তার গন্তব্য বুঝে নিতে কারও বাকি রইল না, কারণ সে চলে গেল তিয়াশার দিকে।
তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল অন্য কোথাও।
অপ্রস্তুত তিয়াশা চমকে উঠল ইউভির এমন আচরণে।
পিছন থেকে মেহজাবীন বেগম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন—

“ইউভি, এইভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে?”
“একটা জরুরি কাজ আছে, বড় আম্মু। একটু পরেই ফিরে আসছি।”
সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক সাহেব কড়া গলায় বলে উঠলেন—
“এত কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে, মেজো আম্মুর হাত টা টানছিস এভাবে?”
“বড় আব্বু, একটু দরকার ছিল।এক্ষুনি ফিরে আসছি।”
উত্তর দিয়ে আর কিছু না বলেই সামনে এগিয়ে যায় ইউভি।
তিয়াশা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
সে শুধু অনুভব করছে— ভাইয়ার চোখের ভাষা আজ যেন অপরিচিত, আগুনে ঝলসানো।
এই ভাই তো এমন করে কখনও তাকায়নি তার দিকে।
হঠাৎ একটা ফাঁকা করিডোরে এসে ইউভি একপ্রকার বিস্ফোরিত কণ্ঠে চিৎকার করল–

“কী বলেছিস তুই ভাইয়াকে? বল কী বলেছিস?”
তিয়াশা হতচকিত।
তার মাথা কাজ করছে না।
” এদিকে সাগর ভাই বলল বৃষ্টি পালিয়েছে , পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করে রাতে কারো হাত ধরে পালিয়েছে আম্মুর কথাও ভাবলো না । আর এদিকে তুই আমার বড় ভাই কে মারার পাঁয়তারা করেছিস ।
তোদের দুটোকে তো আমি ……

দাঁতে দাঁত চিপে বলে উঠল ইউভি।
তিয়াশা কি বলবে বুঝে পারছে না এদিকে আম্মু জায়ন ভাইয়ের চিন্তা এদিকে ইউভির এরকম চোঁখে রাগ দেখে ভয়ে কাঁপছে , সে তার ভাইয়াকে তার জন্য কখনো এরকম রাগতে দেখিনি।
“কি হল বল বলছিস না কেন।”
আবারো ইউভির চিৎকার কানে এসে লাগলো–
তিয়াশা কি করে সত্যি কথা বলবে তার ভাইয়া কে? সে তো আর জানে না যে ইউভি সবই জানে , তাই বলল —
“আসলে ভাইয়া আমি অয়ন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাই জায়ন ভাই খুব রেগে গেছিল আমি কিছু করিনি ভাইয়া । ”

ইউভির চোখে অবিশ্বাসের ছায়া—
“তুই কী সত্যি বলছিস?”
মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় তিয়াশা জবাব দিল—
“জি ভাইয়া।”
ঠিক তখনই আকাশ ছুটে এসে বলল—
“ডাক্তার বাইরে এসেছেন!”
শোনামাত্র ইউভি ছুটে গেল।
তিয়াশার পা যেন এক জায়গায় আটকে গেল, মাটি থেকে উঠতেই চাইল না।
সে ধপ করে বসে পড়ল আর নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
এদিকে ডাক্তার এসে বললেন—

“ভয়ের কিছু নেই। পায়ে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল বলে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে জন্যই শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর… স্লিপিং—”
ডাক্তার কিছু বলতে যাবে, তখনই আহান এগিয়ে এসে বলে উঠল—
“ওহ, ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব! তাহলে কোনও মারাত্মক সমস্যা নেই তো? আমরা এখন জায়নকে দেখতে পারি?”
ডাক্তার একটু থমকে গেলেন।
মনে মনে বললেন, আহা পুরো কথা বলার আগেই ছেলেটা বলতে দিলো না।
তারপর নিজেই বললেন—
“হ্যাঁ, দেখতে পারেন। তবে উনি এখন ঘুমোচ্ছেন। দয়া করে বিরক্ত করবেন না।”
এই কথা শোনামাত্র পরিবার ছুটে গেল কেবিনের দিকে।
পেছনে দাঁড়িয়ে রইল আহান ও পলাশ।
তখন আহান ডাক্তারকে পাশে নিয়ে বলল–

“আসলে, ডাক্তার সাহেব… আমরা চাই না জায়নের স্লিপিং পিলস খাওয়ার বিষয়টি পরিবারের কারও কানে যাক।”
ডাক্তার আশ্বস্ত করলেন —
“চিন্তা করবেন না। ওষুধের মাত্রা কম ছিল, বড় কোনও ঝুঁকি ছিল না।
সম্ভবতো উনি ২ টা ট্যাবলেট খেয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, রক্তক্ষরণটা অনেক তাই ছিলো, তার জন্যই ওনার শরীর দুর্বল হয়ে যায় আর স্লিপিং পিলস এর কারনে গভীর ঘুমে চলে আসে।”

ডাক্তারের এই কথা শুনে আহান ও পলাশ কিছুটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
যদিও তারা জানে এই কতো ঘণ্টার আতঙ্ক, অস্পষ্টতা আর বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় সব কিছুর থেকে নিজেদের যেন একটু মুক্ত করল।
জায়ন কে ইমারজেন্সি রুম থেকে শিফট করা হয়েছে প্রাইভেট রুমে,মেহজাবীন বেগম তার সন্তান কে এইভাবে সুয়ে থাকতে
দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল , তিয়াশা বাইরে দাঁড়িয়ে তার জায়ন ভাইকে দেখার চেষ্টা করছে , তার সাহস হলো না ভেতরে যাওয়ার পা স্থির হয়ে রয়েছে , তার এই কিশোরী মনে চলছে এক অজানা ভয় । যা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না ।

সে একনাগাড়ে দু’চোখ বুঁজে দোয়া পড়ে যাচ্ছে—
মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য…
তার ঠোঁট ফাটতে বসেছে, মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ।
জায়নকে দেখে সবাই একে একে বাইরে এসে বসার জায়গায় বসে পড়ল।
সবাই চুপচাপ, ক্লান্ত আর চিন্তিত।
এদিকে রূহেনা বেগমের এখনো কোনও খবর আসেনি।
তাঁর ব্যাপারে সবাই অনেক চিন্তায় আছে।
হঠাৎ রূহেনা বেগমের ডাক্তার এসে জানালেন—
“উনি আপাতত বিপদমুক্ত।
তবে এখনই নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই।
আগামী ৪৮ ঘণ্টা তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
এই সময়ের মধ্যে যদি আবার কোনও শক পান, তাহলে তাঁকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।”
ডাক্তারের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল।
কারো মুখে আর কিছু বলার ভাষা রইল না।
সবাই চুপচাপ একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে, মনে শুধু একটাই কথা—
আর যেন কোনও বিপদ না আসে।

অন্ধকারের পর একসময় সোনালী আলো ফুটে ওঠে, আর রোদের নরম আলিঙ্গনে ঘরগুলো একে একে জাগতে শুরু করে।
হাসপাতালের জানালা দিয়ে কিছুটা আলো ঢুকে আসে, তিয়াশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, একা।
রোদের আলো যেন এক নতুন প্রাণ জোগাচ্ছে তার অন্তরকে, তবে সেই আলোও যেন কিছুটা ম্লান— তার মনের অন্ধকার দূর করতে পারছে না।
বাইরে পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছে, আর বাতাসে গুল্মের গন্ধ ভেসে আসছে।
কিছু দূরেই গাছের পাতাগুলো বাতাসে নেচে উঠছে, যেন এই সকালে কিছু আশা গড়ে উঠবে।
তবে তিয়াশার মনে সেই সুখী ভোরের কিছু নেই।
ভোরের রোদের মাঝে তার মন কিছুটা যেন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
এদিকে মেহজাবীন বেগম ভোরের সূর্য্যের স্নিগ্ধ আলোতে নিজের চোখ মুছছেন।
তিয়াশা বুঝতে পারছে, তার বড় আম্মু আজ কিছুটা শান্ত।
রাতের অস্থিরতা কিছুটা কমে আসছে, তবে তার চোখে এখনো কিছুটা উদ্বেগ।
হাসপাতালের করিডোরে হালকা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর চা-দইয়ের গন্ধ ভেসে আসছে হসপিটাল এর কান্টিং থেকে।

এ যেন একটা নতুন দিনের শুরু–তবে তিয়াশার মনে প্রশ্নের অজানা ঘূর্ণি চলছে,
“এই সকাল, এই রোদের আলোর মাঝে আমি কী দেখতে পাবো?”
তিয়াশার চোখে অশ্রু জমে থাকলেও, মনে এক অদৃশ্য শক্তি এসে তাকে আবার একভাবে টানছে।
রোদের তেজ কমে এসেছে, তবে শীতল হাওয়া কিছুটা প্রশান্তি এনে দিয়েছে, আর তিয়াশার হৃদয়ে স্নিগ্ধতা ভরিয়েছে।
এটি যেন এক নতুন জীবনের প্রহর, তবে ভেতর থেকে কিছুটা শূন্যতা রয়ে গেছে–
এই শূন্যতাটুকু কি কখনো পূর্ণ হবে?
রায়ান আর রিক সবাইকে চা দিয়ে গেল , সবাই খুব ক্লান্ত রাতের ঘুমের রেশ চোখের নিচে কালো ছায়া হয়ে নেমে এসেছে। তাদের খুব আপনজন রা যে এখনো এই হসপিটাল এই সুয়ে আছে —
হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলে এক নার্সের গলা।
তিনি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললেন —

“জায়ন স্যার জেগে উঠেছেন, ঘুম থেকে উঠে বসেছেন , আপনারা দেখে আসতে পারেন”
এই কথা যেন বিস্ময়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল পুরো করিডোরে।
চোখের পাতা ভার করা তিয়াশা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল।
মেহজাবীন বেগম প্রান্তিক সাহেব প্রণয় সাহেব তাহসান সাহেব ওনারা খানিকক্ষণ আগেই চোখ বুজে দোয়া পড়ছিলেন, থমকে গেলেন মুহূর্তে।
ইউভি তৎক্ষনাৎ ছুটে গেল
আহানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, সাগর,পলাশ নিঃশব্দে বলল —
“আলহামদুলিল্লাহ!”
“আলহামদুলিল্লাহ!”
তিয়াশার বুকের ভিতর থেকে হঠাৎ যেন একটা ভার নেমে গেল।
তার কাঁপতে থাকা ঠোঁট হালকা কাঁপনেই উচ্চারণ করল

“জায়ন ভাই… জেগেছে… ওহ আল্লাহ ”
মেহজাবীন বেগম আর অপেক্ষা করলেন না, আঁচল ঠিক করতে করতে দৌঁড়ে চললেন ছেলের কেবিনের দিকে।
পরিবারের বাকি সবাই ও ছুটলেন ।
তিয়াশা কিছুটা দূর থেকেই পেছনে পেছনে গেল।
ভেতরে ঢোকার সাহস নেই তার,
জায়ন পুরোপুরি চোঁখ খুলেই চমকে উঠলেন, অচেনা অস্বস্তিকর পরিবেশে নিজেকে পেয়ে কেমন যেন বিরক্ত বোধ করল , তাকে ঘিরে রয়েছে পরিবার এর সবাই এই দৃশ্য দেখে ,
চোঁখ মুখ কুচকে ইউভি কে দেখে বলে উঠলো —
” কোথায় আমি , আর এসব হাতে কি লাগানো?”
ইউভিকের কিছু না বলতে দিয়েই প্রান্তিক সাহেব বলে উঠলেন–
“তোমার শরীর থেকে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে, তার জন্য তুমি অবচেতন হয়ে গেছিলে আমরা সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম ওই রাতে।”

মেহজাবীন বেগম চোঁখ মুছতে মুছতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন —
” এইতো আমার কলিজাটা কথা বলছে এখন যেন আমি একটু শ্বাস নিতে পারব এখন কেমন লাগছে বলতো বাবা তোর ? তোর কিছু হলে তো আমি পাগল হয়ে যেতাম রে বাবা ।”
জায়ন যেন এক মুহূর্তে সব কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
তার মস্তিষ্ক যেন এই শব্দগুলোকে একসঙ্গে ধরতে চাচ্ছে,
কিন্তু মন চাইছে না বিশ্বাস করতে।
তার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে, চোখের পাতা কাঁপে।
মাথা ঘুরছে না, কিন্তু ভেতরে যেন কিছু একটা থমকে গেছে।
সে চোখটা কিছুটা বড় করে তাকায় মায়ের মুখের দিকে।
মেহজাবীন বেগমের চোখে জল, ঠোঁটে দোয়া।
ইউভি জায়ন কে জড়িয়ে ধরে বলল —

” থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া তুমি এখন সুস্থ, এমনি ই আম্মু কে নিয়ে টেনশান এ আছি তারপর তোমার এই অবস্খা দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ।”
জায়ন ইউভির কথা শুনে চমকে উঠলো চোঁখ বড়বড় হয়ে উঠলো —
” মেজো আম্মুকে নিয়ে টেনশান কেন ? কি হয়েছে মেজো আম্মুর ? ”
জায়ন এর এই চিন্তাভরা প্রশ্নতে ইউভি তাকে সব খুলে বলল। জায়ন চোঁখ মুখ ম্লান হয়ে উঠলো এক চিন্তার ছাপ পড়ে গেলো , সে উঠে তৎপর হয়ে উঠলো তার মেজো আম্মু কে দেখার জন্য , কিন্তু প্রণয় সাহেব বললেন ওনার সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে না ।

এর মধ্যে কারো নজরে পড়েনি জে তিয়াশা ওখানে নেই , সে যে বাইরে তার জায়ন ভাই কে একবার দেখার জন্য আশপাশ করছে , মনের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছে এক অজানা যুদ্ধ, যার জয় পরাজয় তার জানা নেই ।
প্রায় সবাই জায়ন কে দেখে বাইরে বেরিয়ে আসলো ,
ভেতরে জায়ন এর সঙ্গে রয়েছে ইউভি আকাশ আহান সাগর পলাশ ।
সাগর আর নিজেকে সামলাতে না পেরে , জায়ন এর মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল —

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৬ (২)

” তোর হঠাৎ ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কি দরকার ছিল ?”
জায়ন এর মনে পরে গেল রাতের সেই বাস্তবতার কথা , যেই বাস্তবতা কে মেনে নেওয়া তার পক্ষে কখনো সম্ভব নয় , তাই সে বেছে নিয়েছিল
গভীর ঘুম , যা তাকে হয়তো কিছুক্ষন এর জন্য এক অগ্নিতান্ডব করা থেকে বাঁচিয়ে রাখতো, সে হারিয়েছে তার সর্ব জ্ঞানটুকু শুধু মাত্র এক পাষাণ কিশোরীর জন্য
এই সব কথা মনে করতেই , আবার চোঁখ বুঝে নিলো সবার আড়ালে বেয়ে পড়লো এক বিন্দু চোখের পানি।
” ইউভি , আহান মেজো আম্মু সুস্থ হওয়ার পরেই আমি ইউ এস ব্যাক করবো……”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here