তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৪

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৪
নীল মণি

চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমে এখন আর কোনো কোলাহল নেই, নেই উৎসবের রঙ, নেই অতিথিদের গুঞ্জন।
তবু এক ধরণের অদৃশ্য বিকট শব্দ যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে–পুড়ে যাওয়া সম্মান, পদদলিত আত্মমর্যাদা আর ছিন্নভিন্ন ভালোবাসার ক্রন্দন।কিছুক্ষণ আগেও যেখানে মেহেদির ঘ্রাণ ছিল, সেখানে এখন অস্থিরতা
দেখা দিচ্ছে।ঘরের চারপাশে এক ধরনের গুমোট নীরবতা, অথচ সেই নীরবতাই যেন চিৎকার করে বলে যাচ্ছে–এই বাড়িতে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে।

চেয়ার,টেবিল এদিক ওদিক, মাটিতে ছিটিয়ে থাকা মেহেদি রাঙা ফুলের পাপড়িগুলো আজ আর উৎসবের ছোঁয়া দেয় না–তারা যেন জায়নের রাগে পিষ্ট প্রেমের ধ্বংসাবশেষ।
ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে যেন।
তিয়াশাকে কোলে নিয়ে জায়ন যখন সেই বিশাল ফটক পেরিয়ে বাইরের দিকে মিলিয়ে গেল,
চৌধুরী বাড়ির ড্রইং রুম থেকে ভেসে এলো কেবল নিস্তব্ধতা আর অবিশ্বাসের নিঃশ্বাস।
মেহজাবীন বেগম একবারো বসতে পারেননি, দাঁড়িয়েই কেঁপে উঠছেন বারবার।মেহজাবীন বেগম হতবাক হয়ে আছেন ছেলের কাণ্ডে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাসার সবাই জানতেন ছেলে জেদি, আবেগপ্রবণ।
কিন্তু এই পাগলামো, এই দুঃসাহস?
এটা তো কেউ শেখায় না –এটা আসে বুকের গভীর থেকে।
এদিকে বাতাস ভারী। কাঁচের গ্লাস পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। মেঝেতে লেগে আছে তাজা র*ক্তে*র দাগ–
রূহেনা বেগম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, চোখে জল, কিন্তু মুখে একটাও কথা নেই। তিনি জানেন, আজ তিনি কথা রাখার মূল্য দিয়েছেন।

তবে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে কেবল একজনে চোখ নামিয়ে চুপ–আয়েশা বেগম
পুরো পরিস্থিতির নীরব পর্যবেক্ষক। জানেন, জায়ন যা করেছে সেটা ভুল—তবু কোথাও যেন একটা অদ্ভুত সত্যতা, এক অদ্ভুত প্রেমের চিৎকার তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। সে তো কখন ভেবেই দেখিনি আল্লাহতাআলা এত সুন্দর জুটি ও বানাতে পারে, শুধু মুখ থেকে ওদের দুজনকে দেখে একটাই কথা বেরোলো “মাশাল্লাহ কি সুন্দরী না মানিয়েছে দুজনকে এত সুন্দর যে মানাতে পারে এদের কখনো ভেবেই দেখিনি কারো নজর না লাগে। ”
পাশে থাকা আয়েশা বেগমের স্বামী আশরাফ সাহেব বলে উঠলেন —

“কি বিড়বিড় করছো?”
“বলছিলাম যে বাচ্চা দুটোকে কি মানিয়েছে।”
আশরাফ সাহেব একটু গলা কাশিয়ে ধীম গলায় বলল
” চুপ করে থাকো, আর কিছু মানিও না। সামনে তোমার ওই তিন ভাইকে দেখেছো শুনলে এখনই তোমার খবর হয়ে যাবে।।”
“আরে করছেন কী? নামান বলছি।আমি বাসায় যাব!”

তিয়াশা ছটফট করছে জায়নের কোলে, বারবার দেহ ছুঁড়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু জায়নের মুখে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই, যেন সে কিছু শুনছেই না।
তবুও, সেই স্থির অথচ দৃঢ় বুকে মাথা রেখে তিয়াশার মনে হচ্ছে এই পূরুষ টাই বুঝি তার সবচেয়ে আপন।
তবুও কিছুক্ষণ আগের সেই রুদ্র, হিংস্র রূপ দেখে সে আতঙ্কিত,ভয় এসে জমাট বেঁধেছে চোখে-মুখে।
জায়ন নির্লিপ্ত গলায় বলল–

“ইউভি, গ্যারেজ থেকে বাইকটা নিয়ে আয়। আমার বউটা এত ছটফট করছে একটু ছাড়লেই পালাবে আবার।”
জায়নের কণ্ঠে বিরক্তির রেশ, কিন্তু চোখে-মুখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি।
ইউভি হেসে গ্যারেজের দিকে রওনা দিল।
মেইন ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জায়ন, তিয়াশাকে শক্ত করে কোলে ধরে।
আর তিয়াশা, সে যেন একটানা কান্নার সুরে বলে চলেছে–
“আমি বাসায় যাব… প্লিজ, নামিয়ে দিন…”
তিয়াশার এমন কান্নাকাটি দেখে জায়ন কপালের ভাঁজ গাঢ় করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল–
“এখনই যদি এই নাটক বন্ধ না করিস, একটু আগে যেটা কাজীর কপালে ঠেকিয়েছিলাম, এবার সেটা তোর কপালে ঠেকাবো কথা দিলাম।”
এই এক বাক্যেই থেমে গেল তিয়াশার কান্না।

কথা না বাড়িয়ে সে জায়নের বুকে গুটিয়ে গেল, নিঃশব্দে। যেন তার ভয়টুকু বড্ড জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ আর জেমস একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, কিন্তু জায়নের কঠিন চোখ তাদের দিকে পড়তেই মুখের হাসি মুহূর্তেই মুছে গেল।
এদিকে ইউভি বাইক নিয়ে গ্যারেজ থেকে ফিরল। জায়ন তিয়াশাকে নামিয়ে দিতে দিতে হেসে বলল–
“তোর বোনক খেতে দিস না ? কোলে তুলেই মনে হচ্ছে তুলতুলে কটন ক্যান্ডি।”
ইউভি কিছু বলতে যাবে, তার আগেই তিয়াশা মুখ ছোট করে রেগে চিৎকার করে উঠল–
“আপনি এসব বাজে কথা বলবেন না। আমি কি বলেছি আপনাকে আমায় তুলে নিতে?”
জায়ন পাত্তা না দিয়ে বাইকের হ্যান্ডেল ধরল। ইউভিকে উদ্দেশ করে বলল–
“জেমসকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িটা নিয়ে কাজী অফিসের সামনে পৌঁছা তোরা।”
ইউভি হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল।

এরপর জায়ন বাইকে বসে তিয়াশার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে পেছনে বসার ইশারা করল।তিয়াশা থমকে দাঁড়িয়ে আছে।শরীর ঘামে ভিজে একাকার।
শরীরে ভারী বেনারসি, সামনে দাঁড়িয়ে বাঘের বাচ্চা মানে তার ভয়ংকর পুরুষ, আর পেছনে দাঁড়িয়ে সেই পরিবার–যাদের সে ছোট বেলা থেকে আঁকড়ে ধরে ভালোবেসে এসেছে ।
কিন্তু হৃদয়ের গহীনে একটা সত্য গোপন করে রাখা কঠিন…
সে তো এই বাঘের বাচ্চা টাকেই চায় কিন্তু সে তো তার পরিবার কেও চায় ।
” উঠতে বললাম তো নাকি যেটা বলেছি ওটা মাথায় গুজব? ”
জায়নের চোখের সেই দৃষ্টি… গম্ভীর, হিংস্র, তীব্র। কণ্ঠস্বর এতটাই কঠোর যে তিয়াশার মনে হলো–এই মানুষটা যেন তাকে আস্ত গিলে ফেলবে।

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে তিয়াশার। আমতা আমতা করে বলল– “কো…কোথায় যাব?”
জায়ন ঠোঁট টিপে বলল— “জমের দোয়ারে। আর একবারও বলবো না।”
তিয়াশা আর কথা বাড়াল না। নিঃশব্দে, এক রকম কাঁপতে কাঁপতে বাইকের পেছনে উঠে বসল।
জায়নের ঠাণ্ডা কণ্ঠ ছুঁয়ে এল কানে–“ভালো করে জড়িয়ে ধর।”
আর দ্বিধা করল না তিয়াশা। নিঃশব্দে দুই হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জায়নের পিঠ।
মাঝরাস্তায় বাতাস চিরে ছুটছে বাইক, যেন এক বিপ্লবী প্রেমিক নিজের প্রেমকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার সব নিয়ম-কানুন ভেঙে। বাইকের শব্দে মিশে আছে তিয়াশার কাঁপা নিঃশ্বাস, আর জায়নের বুকের ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের ধুকধুক।

কিছুক্ষন পরে বাইক টি এসে দাঁড়াল এক কাজী অফিসের সামনে । কাজী অফিসের গেটের বাইরে দাঁড়ান ছিল সাগর আহান পলাশ।
পেছনে এসে পৌঁছাল জায়ন এর ব্ল্যাক মার্সিডিজ টা যেই গাড়িতে ছিল ইউভি , আকাশ , জেমস।
তিয়াশা সব ই বুঝতে পাড়ছে তার সঙ্গে কি হতে চলেছে —
পায়ের নিচে থরথর করছে জমিন, বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। কিন্তু সেই সঙ্গে কোথাও যেন একটা চাপা উত্তেজনাও দানা বাঁধছে — ওর শখের পূরুষ টাই তো তাকে চাইছে, অন্য সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।
সেও তো তাকে তার ভালোবাসা দিতে চায় । হঠাৎ করেই জায়ন তিয়াশার হাতটা শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল কাজী অফিসের ভেতরে। পেছনে পেছনে এল আকাশ, ইউভি, আহান, সাগর, পলাশ আর জেমস। পুরো অফিসে এক রকম ঘোর লাগা চুপচাপ ভাব।

টেবিলের পেছনে বসে থাকা কাজী সাহেব চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে একবার বুঝে পাচ্ছে না কোন টা ছেলে কিন্তু মেয়ে কে দেখে বুঝেছে এইটাই মেয়ে । জেমস আর আকাশ একটু ঠিক ঠাক বয়স লাগছে বাকি তো এই মেয়ের বড় ভাই আর চাচুর বয়স লাগছে। এদিকে জেমস স্যুট পরা দেখে ভাবছেন ওই হয়তো ছেলে ।
তাকিয়ে একবার জায়নের দিকে, একবার তিয়াশার দিকে, আবার স্যুট পরা জেমসের দিকে চেয়ে যাচ্ছেন। মনে মনে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে–কে ছেলে? কে মেয়ে? কে ভাই? কে চাচা?
তিয়াশাকে দেখে নিশ্চিত হলেন–এটাই কনে। কিন্তু জায়নের চেহারা আর রাগী চোখ দেখে যেন ভয়েও তাকাতে পারছেন না।

অবশেষে জেমসের দিকে তাকিয়ে বললেন– “মেয়ে আর জামাই এই চেয়ারে এসে বসুন।”
তারপর চোখ সরিয়ে জায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন– “আপনি নিশ্চয় মেয়ের চাচা বা বড় ভাই? আপনি নিশ্চয় সাক্ষী হিসেবে থাকবেন, আসুন আপনি ওদিকে দাঁড়ান।”
এই কথা বলতেই জায়নের চোখ লাল হয়ে উঠল। মুখে বিদ্রূপের রেখা। গলার নিচে শিরাগুলো ফুলে উঠেছে যেন মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হবে।
সাগর ফিস ফিস করে পাশে থাকা সবাইকে বলল —
” মামায় বিয়ে করবে পিচ্চি মাইয়া , লোকে কইলে চোঁখ গরম ।”
কাজী সাহেব আবারো জেমস এর দিকে তাকিয়ে বলল –
” আরে আসবেন তো।”

আকাশ , ইউভি, আহান, সাগর , পলাশ হেসেই যাচ্ছে মুচকি মুচকি —
—এমনকি তিয়াশাও নিজের ঠোঁট চেপে রাখতে পারল না। হেসে ফেলল, একটু জোরেই।
হাসির আওয়াজটা ঠিক গিয়ে পড়ল জায়নের কানে। চোখ পাকিয়ে তাকালো তিয়াশার দিকে। মুহূর্তেই তিয়াশা চুপচাপ হয়ে গেল—এই আগুনমুখী মানুষটা আবার কী করে বসে কে জানে!
জায়ন এবার ঠাণ্ডা গলায় জেমস এর দিকে গর্জে উঠল–“টেক অফ ইউর ব্লেজার। রাইট নাও।”
ভয়ে জেমস যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে এমন অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত পা কাঁপছে– “স্যার, আই ডিড নাথিং। প্লিজ ডোন্ট লুক অ্যাট মি লাইক দ্যাট… আই রিয়েলি ফিল স্কেয়ার্ড।”
কাজী সাহেব ইতস্তত করে বললেন– “এই যে, আপনারা কি বিয়ে করতে এসেছেন না বক্সিং রিং?”
এর মধ্যেই জায়ন টেবিলে এমন এক থাপড় বসাল যে, সব কাগজপত্র ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। কাজী সাহেব প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।
জায়ন গর্জে উঠল– “এই বা**র কাজী, তুই ভাবলি আমি মেয়ের ভাই বা চাচা? আমারে জামাই মনে হয় নাই কেন রে?”

কাজী সাহেব এবার সত্যিই বোবা হয়ে গেলেন। চশমার কাঁচ কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে ফাটছে। কানে যেন বাজ পড়েছে।
জেমস কোনো রকমে ব্লেজার খুলে এগিয়ে দিল। জায়ন পরেই ফেলল, যদিও সেটা তার বিশাল শরীরে এমনভাবে টান টান হয়ে উঠল যেন স্কুলের কোনো বাচ্চা ছেলেকে ছোট ভাইয়ের ইউনিফর্ম পরানো হয়েছে।
পেছন থেকে সাগর আবার ফিসফিস করে বলল— “নিজে নিজের বয়স দেখে বিয়া দিলে, এতদিনে স্কুল- কলেজ পড়ুয়া পোলা থাকত। আর এখন বিয়ে করতে আইছে বাচ্চা লইয়া।”
তোরাই কইয়া ফেল কাজী বেচারার কি দোষ ? ”
সাগরের কথায় আকশ বলে উঠলো —
” চুপ চাপ থাকো সাগর ভাই , বাসায় কি করে এসেছে তোমা দের জানা নেই।”
এর মধ্যেই ইউভি বলে উঠলো —
” সাগর ভাই আকাশ ঠিক ই বলছে ,আমার এখনো গা হাত পা কাপছে ।”
সাগরের এদের কথা শুনে একটু ভয় ভয় ই লাগলো।
” না না বলতে দে ওর মুখ বেশি চলে , ওর খাওয়া উচিত জায়ন এর ডোস।”
আহান এর কথায় সাগর কট মট করে তাকাচ্ছে।

জায়ন এবার গর্জে উঠল কাজী সাহেবের দিকে— “নে, ব্লেজার পড়েছি। এখন লাগতেছে না জামাই জামাই? বল, বল।
আর যদি বেশি কথা বলিস, তোর জীবন থেকে বিয়ে পড়ানোর সখ তুলে নিবো। এখনই বিয়ে পড়া শুরু কর।”
কাজী সাহেব আর দেরি করলেন না, হুঁ হুঁ করে শুরু করলেন কাজ। ততক্ষণে তাঁর হাত-পা ঠান্ডা, কণ্ঠ কাঁপছে, মনে মনে পড়ছেন— “ইন্নালিল্লাহি… এই ছেলের হাত থেকে বাঁচাও আল্লাহ…”
এদিকে তিয়াশা অস্থির হয়ে উঠেছে, মুখে কিছু বলার সাহস নেই, কিন্তু চোখ মুখে উদ্বেগ।
হঠাৎ জায়ন ঘুরে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠল—-+”আর যদি বেশি নাটক করিস, পুঁতে রেখে দিবো।”
তিয়াশা কিছুই বলছে না, তবুও তার ওপর এই লোকের বকা চলছেই।
“দে দে, দেনমোহর কত লিখব বাবা?”

কাজী সাহেব ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মনে মনে ভাবছেন–
“বাবা বলছি আবার এই মহা তান্ডব রে। হে আল্লাহ, আমারে এই ঘর থাইকা বাঁচায় বের করো…”
জায়ন ঠাণ্ডা গলায় বলল– “লিখেন, এই মেয়ে যদি জীবনে অন্য কারো দিকে তাকায়, তাহলে চোঁখ তুলে নিতে পারি—আইন যেন আমায় বাধা না দেয়।”
সবাই থমকে গেল। কাজী সাহেব তো প্রায় থরথর করে উঠলেন–“বাবা আমি তো দেনমোহর জিজ্ঞেস করলাম, চোখের অপারেশন না। আমিই তো কাজী, সুপারি না যে এত নীতিবাক্য শুনবো।”
জায়ান আবারও কটমট করে তাকিয়ে পড়ল কাজী সাহেবের দিকে।
এই অবস্থায় পলাশ পাশে থেকে ফিসফিস করে বলে উঠল– “দেনমোহর মানে বিয়ের আগে বউরে কনট্রাকচুয়ালি কিছু টাকা দিতে হয়, তা না দিলে কাবিন হয় না।”
জায়ন একটু কুঁচকে তাকিয়ে বলল– “আচ্ছা, লেখেন আমার সব সম্পত্তি ওর নামে।”
সব রীতিমত কাজ সেরে কাবিননামায় স্বাক্ষর হলো। জায়ন বলল তিনবার “কবুল”, তিয়াশাও বলল তিনবার

“কবুল”—
বিয়েটা হয়ে গেল।
‘আলহামদুলিল্লাহ’।
বিয়ের পর বাইরে বেরিয়ে আহানকে এক বান্ডিল টাকা ধরিয়ে দিল জায়ন— “তোর বন্ধুর বিয়ে হয়েছে আজ, এই নে, একটা রিসেপশন দে গিয়ে।”
তিয়াশার মনের ভেতর চলছে অজানা ঢেউ। পরিবারের চিন্তা থাকলেও কোথাও যেন এক চুপিচুপি আনন্দ খেলে যাচ্ছে।
এই পুরুষটা এখন তার স্বামী।
চোখে চোখ রাখার সাহস নেই, কিন্তু মনে মনে স্বীকার করে নিচ্ছে—এই ভালো লাগা, এই অধিকার–এটাই তো চেয়েছিল সে।

হঠাৎ পলাশ বলে উঠল– “তোর নতুন বাসাটা একবার দেখে আসি চল, ভাইয়ের ঘর কেমন হইছে দেখি।”
জায়নের গম্ভীর কণ্ঠ গর্জে উঠল– “আমার বাসার ধারে কাছেও তোদের একজনরে দেখি, তোদের ছবি থাকবে তোরা থাকবি না—এটুকু নিশ্চিত থাক।”
সাগর একটু এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল– “মামা, তোর বউডা তো অনেক পিচ্চি। একটু ভাবিস, তুই তো এরম পশুর মতো পড়লে মাইয়াডারে বাঁচানো যাবে না।”
জায়নের চোখের দৃষ্টি ঘন হয়ে উঠল– “আমার বউ, আমি বুঝে নেব। আর একবার এই রকম কথা বললে তোর মুখটাই বদলে দিবো।”
সাগর চুপচাপ ফিরে গেল আহানদের কাছে।
আহান ফিসফিস করে বলল–“জ্ঞ্যান দিতে গেছিল, এখন কি অবস্থা?”

ইউভি মজা করে বলে উঠল— “সাগর ভাই, আজকে আপনারেও একটু জায়ন ভাইয়ের ওষুধ খাওয়াইতে হইত।”
সাগর একবার মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু আর কিছু বলার সাহস করল না।
এদিকে সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে গেল বন্ধুর বিয়ে তাই সেলিব্রেট করতে গেল। জেমস উঠবে এক হোটেলে সবাই মিলে যাওয়ার আগে আরেকবার ওদের কংগ্রাচুলেনট করে গেল।
এদিকে জায়ন আবারও তিয়াশাকে নিয়ে বাইক ছুটিয়ে শহরের আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে পৌঁছে গেল তার সেই লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে।
নীরব, সাদা-কালো মার্বেলের দোতলা বিল্ডিংটা যেন রাতের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃশব্দ এক পাহাড়।
জায়ন ধীর পায়ে বাইকটা গ্যারেজে পার্ক করল।
তিয়াশা বাইক থেকে নামতেই হাত দিয়ে আঁচল সামলাতে সামলাতে এক পা দু’পা করে পেছনে সরে এল।
তিয়াশার বুকের মধ্যে তখন যুদ্ধ চলছে–
এই বাড়িটা এখন তার স্বামীর… অর্থাৎ তারও,

কিন্তু তবুও এ যেন অন্য এক জগত।
চেনা জায়ন, অচেনা রূপ নিয়ে হাজির।
রাস্তায়, কাজীর সামনে, পরিবার-পরিজনের চোখের সামনে যে মানুষটা হিংস্র হয়ে উঠেছিল,
তার সঙ্গে এখন একা, এক ছাদের নিচে থাকবে সে?
“এই বাড়িতে… আমি আর উনি… একা…?”
এই ভাবনা মাথায় আসতেই তিয়াশার পায়ের নিচে যেন মাটি কেঁপে উঠল।
“যদি হঠাৎ রাগ করে মে*রে ফেলে? যদি কিছু হয়ে যায়? আমার তো এখানে কেউ নেই…”
গলা শুকিয়ে এলো, পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে ভয়ে।
কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই, কেবল নিঃশব্দ এক কম্পন তার দেহ জুড়ে। আবার নিজে নিজেই ভাবছে না না আমাকে অনেক ভালোবাসে উনি আমাকে মারতেই পারবে না। আজতো তাদের বাসর ইস কি লজ্জা এই বলেই একটু মুচকি হাসি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এদিকে জায়ন তার পকেট থেকে মর্ডান পাসওয়ার্ড কি বের করে বাসার দরজার লক খুলে দিল।
কোনো কথা বলছে না, পেছনে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
শুধু তিয়াশার হাতটা চেপে ধরে রেখেছে শক্ত করে।
তিয়াশা শুধু তার পেছন পেছন এগিয়ে চলেছে
ধীরে, নিরবে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখছে।
রুমে ঢুকতেই আবার ভেতর থেকে দরজাটা লক করে দিল জায়ন।
ঘরের সব আলো জ্বলে উঠল–

সাদা আলোর নিচে জায়নের মুখটা যেন আরও কঠিন আর অচেনা লাগছিল।
তিয়াশার কব্জি ধরে হঠাৎ করেই তাকে টেনে নিয়ে গেল ভিতরের একটা ঘরে।
ঘরটা বেশ সাজান–লাক্সারি বেড, ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিল, ল্যাম্পশেড, জানালার পর্দা–সবকিছু যেন আগে থেকেই কারো জন্য প্রস্তুত।
হঠাৎই জায়ন তাকে ছুড়ে মারল বিছানায়।
তিয়াশা ব্যথায় কেঁপে উঠে মুখ চেপে ধরলো, একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে গেলো গলা দিয়ে।
কিন্তু জায়নের মুখে তখন তীব্র এক বিদ্রূপ–
সে সামান্য ঝুঁকে এসে চোখে চোখ রেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল:
“এই আমি… তোর স্বামী…
আজ থেকে এই সম্পর্কের একটাও অধিকার তোর থাকবে না।এ বাড়ি তোর কারাগার।এই দরজার বাইরে যদি এক পা রাখিস,তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না ”
এইটুকু বলেই সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, দরজার দিকে ফিরে হাঁটা দিল।
তার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল করিডোরে।
ঘরের মধ্যে থেকে গেল তিয়াশা, একা, বিছানার কোণায় গুটিয়ে বসে।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৩

চোখে একরাশ স্তব্ধতা,
মনের ভিতরটা র*ক্তক্ষরণে ভারী।
এই লোকটা…..
এই কি সেই মানুষ… যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল সে এতকাল?এই কি সেই বুক… যার কাছে নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিল?
আজ সেই বুকই তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
তিয়াশা নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল।
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কোলজোড়া করে ধরা হাতের ওপরে।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here