তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৫

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৫
নীল মণি

চাঁদের আলো জানালার পর্দা পেরিয়ে এসে পড়েছে মেঝেতে,আলো আঁধারির সেই ছায়াচিত্র যেন এক অদ্ভুত নীরবতা সৃষ্টি করেছে ঘরের কোণায় কোণায়।
বিছানার একপাশে নিঃশব্দে শুয়ে আছে তিয়াশা।
তার চোখের পাতায় এখনো জমে আছে জল।
চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি ফোঁটা,
কোনো শব্দ নেই শুধু নিঃশ্বাসের ভারী চলাচল আর বুকের ভেতর শব্দহীন কান্নার কম্পন।পৃথিবীটা যেন এক রাতেই বদলে গেছে।

আজ যেই মানুষটা তার হাত ধরে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে পরিবারের সামনে থেকে,আবার আজ সেই কিনা
এভাবে হাতটা ছেড়ে দিলো।
কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোন প্রশ্ন উত্তর না নিয়ে শুধু একতরফা বলে চলে গেলো।
তার মন বলে —এই তো সে, আমার মানুষ।
কিন্তু বাস্তব বলে–এই তো সে, যাকে আমি চিনতাম না কখনও।
বালিশে মুখ গুঁজে রাখলেও কষ্টটা দমন হচ্ছে না।
নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরে, অচেনা শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে তিয়াশা।
তবু এই ঘরের নিস্তব্ধতা তাকে একটাই কথা ভাবাতে থাকে বারবার–

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই আমি, তিয়াশা…
এই কি তবে আমার নতুন জীবন?
এই ঘরটাই কি আমার ঠিকানা…?”
এইসব চিন্তার ভেতরেই কখন ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে তিয়াশা তা নিজেও জানে না।
চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার রেখা, বালিশে ভেজা একপাশ–
সে যেনো একটা যুদ্ধ হেরে গিয়ে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়েছে।
তিয়াশার ঘরের পাশের রুমেই উঠে ছিল জায়ন।
জানে একই রুমে থাকলে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না।সেই নিষ্পাপ মুখের সামনে নিজের কঠিন মুখোশটা হয়তো আর ধরে রাখতে পারবে না নিজের রাগ, নিজের জেদ সবকিছু হারিয়ে ফেলবে।তবু সে জানে, তাকে কঠিন হতেই হবে।

নিজের বাচ্চা বউটাকে…আরেকটু হলে তো অন্য কারো পাশে…
না না সে ভাবতেও চায় না,না, এখন তুই শুধু আমার। একমাত্র আমার।কেউ তোর দিকে তাকানোর অধিকারও রাখে না।”
এই দহন, এই ভিতরের আঁচ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে শাওয়ারের নিচে।গরম পানির ধারায় যেন নিজের সমস্ত রাগ ধুয়ে ফেলতে চায়।
কবড খুলে ধূসর ব্যাগি ট্রাউজার আর কালো রঙের একটা টিশার্ট বের করে পরে নিল।চুলে হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে, আয়নার সামনে কিছুটা স্থির হয়ে দাঁড়াল।
তারপর ধীরে ধীরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সিগারেটের প্যাকেট হাতে।একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে দেয়।
লাইটার জ্বালিয়ে নিঃশ্বাসে টেনে নেয় গভীর ধোঁয়া।
ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয় আকাশের দিকে তাকিয়ে।
মনটা যেন কেমন হালকা লাগছে, তবু ভেতরে জ্বলছে এক অদ্ভুত হাহাকার।ভেতর থেকে এক চাপা স্বীকারোক্তি উঠলো মনের ভেতর।

“সরি কিটি ক্যাট…
আমায় কঠিন হতে হচ্ছে।
তুই ছাড়া আমার গতি নেই… আর এখন তোরও গত নেই আমি ছাড়া।তোকে কিছুদিন জ্বলতে হবেই, জান।
আরেকটু হলেই তোকে হারিয়ে ফেলছিলাম আমার ভাবলেই বুকটা কেঁপে উঠে বউ…
ওই কু**র বা***র মধ্যে কি দেখেছিস তুই?যা আমার মধ্যে নেই?”
জায়ন চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য।
সিগারেটের শেষ ধোঁয়াটা নিঃশ্বাসে গিলে ফেললো সে।
তার চোখে এখন শুধু একটাই দৃশ্য ভাসছে
খুব বাচ্চা একটা মুখ, একরাশ ভয় নিয়ে কাঁপছে…
কিন্তু সেই মুখটাই তো তার পৃথিবী।
এইসব অস্থির ভাবনার ভার নামিয়ে, এক নিঃশ্বাসে বুক হালকা করে জায়ন ধীরে পা বাড়ালো তিয়াশার রুমের দিকে।
শক্ত পোক্ত হাত টা দিয়ে দরজার হ্যান্ডেল চেপে আস্তে করে খুলে ঢুকে গেল ঘরের ভিতর।
রুমে এখনো লাইট জ্বলে আছে, ফ্যান বন্ধ। সাদা ফ্লোরাল প্রিন্টের বিছানার এক কোণে নিজেকে গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে তিয়াশা।মেরুন বেনারসীতে মোড়া সেই ছোট্ট শরীরটা যেন একখানা ফুটন্ত লাল গোলাপ…একটু ক্লান্ত, একটু বিধ্বস্ত… তবু অপূর্ব।

জায়ন এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে।
তিয়াশার মুখে এখনো কান্নার রেশ–চোখের কার্নিশ শুকিয়ে আছে, কিন্তু দাগ রয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে জায়ন ঘুরে গেল তিয়াশার ওয়াশরুমে।
সেখানে রাখা টাওয়ালটা একটু ওয়াশ বেসিন থেকে ভিজিয়ে হাতে নিয়ে ফিরে এলো তিয়াশার কাছে। আলতো করে মুছিয়ে দিতে লাগলো তিয়াশার মুখ।

ভেজা টাওয়াল এর ছোঁয়ায় তিয়াশা একটু নড়ে উঠলো।চমকে উঠে জায়ন দ্রুত টাওয়ালটা সরিয়ে ফেললো।তারপর নিজে হাতে একটা কমফোর্টার তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে দিলো তিয়াশার।
ফ্যান চালিয়ে দিয়ে যেন কিছুটা হালকা বাতাস এনে দিলো ঘরে।
বেড সাইড ল্যাম্পের সুইচটা অফ করার ঠিক আগে
তিয়াশার দিকে শেষবারের মতো তাকালো জায়ন।
অধরের সেই দুটো গোলাপি রেখা যেন ঠোঁটের মধ্যে লুকানো এক বেদনাবিধুর কৌতূহল।
জায়ন ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লো তার মুখের কাছে…
তিয়াশার নিঃশ্বাসের গভীরতা যেন অনুভব করছিল নিজের গালজুড়ে।কিন্তু ঠোঁট ছোঁয়ালো না।
একটু হাসলো মনে মনে বিড়বিড় করল

— বউ আমার বাচ্চা বউ ”
সেই স্নিগ্ধ, অভিমানী হাসি।তারপর নরম করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়াল।ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একে একে সব আলো নিভিয়ে দিলো।অন্ধকার রুমে ফেলে গেল একটুকরো কোমল ভালোবাসা–যার উচ্চারণ নেই, দাবি নেই, কিন্তু ওজন অপার।
রাত প্রায় ১টা। চৌধুরী বাড়ি যেন একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে—একটা বড় ঝড়ের পরে যেমন শূন্যতা নেমে আসে, ঠিক তেমনি নিস্তব্ধতা যেন চারপাশে জমে আছে।
বাড়ির লোহার ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইউভি আর আকাশ। জায়নের গাড়িটা জেমস নিয়ে চলে গেছে, আর আহান নিজের গাড়িতে ওদের এখানে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু এখন যে কীভাবে ঘরে ঢুকবে, সেটা নিয়ে দুজনের মাঝেই টানটান উদ্বেগ।
পেছনে ফিরেও তাকায়নি তারা যখন ভাইয়ার পেছন পেছন বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন যদি বাসায় না ঢুকতে দেয়? কী হবে?

ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল দারওয়ান চাচা কিন্তু সে তো গভীর ঘুমের তলে চেয়ারে ঝিমচ্ছে । সদর দরজার কাছে পৌঁছাতেই ইউভি পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলতে গেল–
তখন আকাশ ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো–
“ভাইয়া কি দরকার সিংহের খাঁচায় পা দেওয়ার আমাদের বাসায় চলো আমার কাছে বাসার চাবি আছে। আম্মু তো এখানেই কিন্তু তাও আমরা দুই ভাই রাত টা ঠিকঠাক কাটিয়ে নেব।”
ইউভি একটু সাহস নিয়েই বলে উঠলো —
“এখন যদি সাহস না দেখাই তাহলে ভবিষ্যতে আমার হৃদয় পাখিকে নিয়ে যদি পালাতে হয় তখন সাহস পাব কোথা থেকে? আমার শ্বশুর তো বড় ভাইয়ের শ্বশুরের থেকেও ডেঞ্জারেস মানে আমার বাবার থেকেও আমার শ্বশুর ডেঞ্জারেস। উনি যদি মেয়ে না দিতে চায় তখনও আমার সাহসের দরকার হবে। চল চল ভেতরে চল যা হবে দেখা যাবে।”
এই বলে ভেতরে ঢুকে গেল দুই ভাই ভেতরে ঢুকতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখন হঠাৎ করেই ড্রয়িং রুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো।
ইউভি এতক্ষণ সাহস দেখালেও হঠাৎ করে যেন ভয়ে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সঙ্গে আকাশের ও একই অবস্থা। দুজনেই দাঁড়িয়ে পরল স্থির হয়ে। কিন্তু পিছন ঘুরে তাকানোর সাহস তাদের নেই।
পেছন থেকেই এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো —

” তো কি দিয়ে এলে পাগল বড় ভাইয়ের বিয়ে তাও আবার নিজের বোনের সঙ্গে? ওখানেই তো থাকতে পারতে বাসায় ফেরত আসার কি দরকার ছিল? ”
এই কণ্ঠস্বর আর কারো না এই বাড়ির মেইন কর্তা
প্রান্তিক সাহেব এই চৌধুরী পরিবারের কর্তা। যাঁর এক কথাতেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।
হাত পা যেন কাপছে , ভাবছে পেছনে ঘুরবে কি ঘুরবেনা, মনে অনেক সাহস নিয়ে তাকালো, পিছনে তাকাতেই মাথা চড়ক গাছে —
তিন কর্তা প্রান্তিক সাহেব, তাহসান সাহেব, আর প্রণয় সাহেব পেছনে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে।তাদের চোখে আগুন, কণ্ঠে নীরব ধ্বনি, যেন মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটবে।
এসব কর্মে ভাইয়ের সাথ দিয়ে নিজেকে কি মনে করছিস ইউভি । তোর কোন রকম লাগলো না তোর ওই টুকো বোন টাকে জায়ন এর হাতে তুলে দিতে?
জায়ন এর এরূপ দেখার পরেও কি করে পারলি?”
তাহসান সাহেব এর এই হুঙ্কার এর পর এবার প্রণয় সাহেব বলে উঠলো–

” পারবে না কেন ?দেখছিস না নিজেই তো একটা আস্ত বজ্জাত ওদের বিয়ে দিয়ে চুপি চুপি কিরকম
বাসায় ঢুকছে । নিজেও কোথায় কাকে জুটিয়ে
রেখেছে তা বলবে কে ?”
আকাশ এত ভয়ের মাঝেও ধীর কন্ঠে বিড়বিড় করল–
” কোথাও খুঁজতে যেতে হবেনা মামু এই বাসাতেই জুটানো আছে ।”
” তুই আবার পাশে কি বিড়বিড় করছিস আকাশ ?”
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন প্রান্তিক সাহেব ।
কি কিছু না মামু।”
আকাশের এই আমতা আমতা কথায় তাহসান সাহেব বললেন —
” তোমাকে বলবে ও কি বিড়বিড় করছে বড় ভাই ,
সব এক গোয়ালের গরু । সঙ্গ দোষ এর প্রভাব সব।””
এবার ইউ ভি একটু বিরক্তই হল। মনে ভয় থাকলেও একটু সাহস নেই বলল–
“ভুল বললে চাচু এটা সঙ্গ দোষের না এটা আমাদের রক্তের মধ্যেই আছে । ভাইয়ের সঙ্গত আমরা পাইনি সে তো আমাদের কাছ থেকে ১৩ বছর দূরেই ছিল । সঙ্গ পাবো কোথা থেকে? আর যদি বলেন আমার বোনের কথা আমার বোনকে আমি সঠিক হাতেই তুলে দিয়েছি । সঠিক জায়গাতেই রেখে এসেছি, একদিন আপনারাও সেটা বুঝে তাদেরকে মেনে নেবেন। এই আমি বলে গেলাম ।”

ইউভির এই কথাগুলো তো মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কিন্তু বুকের মধ্যে চলছে ধুকপুক। সামনেই বাবা চাচারা তাদের সামনে আমার মুখ থেকে এতগুলো কথা বেরোলো যদি এখন দেয় ধোলাই । তাহলে কি করব। এই ভেবেই আর কিছু না বলে পিছন ঘুরে চলে গেল নিজের রুমে আর দাঁড়ানো যাবে না দাঁড়ালেই নিজের সাহস যেটুকু দেখিয়েছিল সেটুকু ব্যাঙের মতো লাফিয়ে পড়বে।
তাদের চোখে ভেসে উঠছে ছেলেদের মুখ।
যারা এক সময় মায়ের আঁচলের পেছনে লুকিয়ে থাকত, আজ তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছে।
তাদের সেই নির্ভীক কথাগুলো যেন একে একে ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছিল তাদের অভ্যস্ত অহংকারে।
তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।

জায়নের ভয়াবহ সিদ্ধান্তের চেয়েও এখন অবাক হচ্ছেন এই দুই ছেলের সাহসে।
এই প্রজন্ম আর মুখ বুজে থাকার নয়–
এটাই কি ছিল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?
সকালের হালকা রোদটা পর্দার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকেছে। নরম আলো এসে থেমে আছে বিছানার ধবধবে সাদা চাদরের গায়ে। একটা অদ্ভুত শান্ত নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে গোটা ঘরটাকে। বাতাসে যেন এক অন্যরকম গন্ধ,বিবাহের নতুন রাত্রির পরের সকালের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।
সেই রোদের ঝিলিক থাই গ্লাস এর পর্দার ফাঁক এ গলে স্পর্শ করেছে তিয়াশার ওই ছোট্ট মুখে ধীরে ধীরে চোখ মেলল। চোঁখ একটু খুলতেই প্রথমেই চমকে উঠল এই ঘর তো তার না চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে অচেনা দেয়ালের রঙ, অপরিচিত সিলিং, অদ্ভুত সাজানো আসবাব… তারপর হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো গত রাতের কথা সে তো বিবাহিত , ইবলিস বাঘের বাচ্চা টার বউ, মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নামল বুকের গহীন থেকে। মনে পড়ে গেল জায়নের সেই তীব্র, রুক্ষ অথচ অসহায় ভাষা–

“স্বামীর অধিকার দেবে না? না, আমি তা চাই না।”
তবু…
চোখ পড়ল নিজের গায়ে জড়ানো কমফোর্টারের দিকে।
সে তো রাতভর কিছুই জড়ায়নি।তবে এই কমফোর্টার?
এই আলো নিভানো ঘর?তার মানে রাতে তার ইবলিশ জামাই এই রুমে এসেছিল ?
ভাবতেই একটু থেমে এক চিলতে মুচকি হাসি খেলে গেল ঠোঁটে। মনের ভিতরে জমে থাকা অস্থিরতা আর সংশয় যেন একটুখানি গলে গেল।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিয়াশা। নিজের শরীরে চোখ পড়তেই আবার থমকে গেল–
গত রাতের সেই গা-ছমছমে বেনারসী শাড়িটাই এখনো গায়ে।উফ… এখন আমি কী পরবো?নিজের কিছু তো সে নিয়ে আসেনি।

এক অদ্ভুত অস্বস্তি, এক ভরসাহীন দোলাচল এসে নামল চোখে মুখে।
ওনাকে কি বলব?যদি আবার রাগ করে?যদি আবার খেকশিয়াল এর মতন চেঁচিয়ে ওঠে ?
ঠিক তখনই চোখ পড়ল ড্রেসিং টেবিলের দিকে।
আর সেখানেই যেন খুলে গেল আরেকটা চমকের জানালা।
ড্রেসিং টেবিলজুড়ে সাজানো মেয়েলি মেয়েদের এক্সেসরিজ— বিভিন্ন রকমের ব্র্যান্ডেড পারফিউম, কাজল, লিপস্টিক, নানান রঙের কাঁচের চুড়ি, নেইলপলিশ, চুলের ক্লিপ, হেয়ার ব্রাশ, সব এক নিখুঁত পরিচর্যায় সাজানো। তিয়াশা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।
তারপর হঠাৎ কী মনে হলো সোজা ছুটে গেল ওয়ার্ডরোবের দিকে।ওয়ার্ডরোব খুলতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অবাক চোঁখে তাকিয়ে আছে সেদিকে
একটা কেবিনেটে সাজানো নানান রকমের রঙিন শাড়ি, আরেকটায় থ্রি-পিস, গাউন… এমনকি তার মাপের অন্তর্বাস পর্যন্ত।
হাতে তুলে নিয়ে একটু অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলো,
হঠাৎ লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেল।

“এই লোকটা… মানে এই শয়তান জামাইটা এত কিছু আগেই ভেবে রেখেছে?”
মনে মনে ভুরু কুঁচকে বলল— “আর মুখে বলে–স্বামীর অধিকার পাবি না।”
ঠোঁটের কোণে চাপা এক হাসি ফুটল।
“দিতে হবে না… আমি নিজেই সব অধিকার নিয়ে নেব। আমিও আবরার জায়ন চৌধুরীর স্ত্রী। আপনি যেমন ঘাড়ত্যাড়া, এবার দেখবেন আপনার এই মিসেস ঘাড়ত্যাড়া কে।”
একটা লাল পাতলা জামদানি, লাল ব্লাউজ আর পেটিকোট তুলে নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।

কিছুক্ষণ পরে…
ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো সে।
লাল শাড়িতে যেন নিজেই নিজের চোখ ফেরাতে পারছিল না।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাকিয়ে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
একটা ছোট্ট লাল টিপ, হালকা কাজল, একটু লিপস্টিক…
চুড়ির বাক্স থেকে লাল সবুজের কিছু কাঁচের চুড়ি তুলে দুই হতেই পরে নিল ।
চুল গুলো হালকা ভেজা, আলতো করে একপাশে ছেড়ে দিয়ে আবারও নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল।
আজ সে বিবাহিত।
আজ তার পরিচয় বদলে গেছে।

চুপচাপ করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে সে।
নীচে ড্রয়িংরুমের ডিভানে বসে জায়ন ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কী যেন করছিল।
হঠাৎই শোনা গেল নূপুর আর চুড়ির মিষ্টি শব্দ।
উপরে তাকাতেই চোখ আটকে গেল।
তিয়াশা।
লাল জামদানি, ভেজা চুল, হালকা সাজে ধীর পায়ে নেমে আসছে।
তার প্রতিটি চরণ যেন রক্তে আগুন ধরাচ্ছে।
জায়নের মুখ হা হয়ে গেল। বুকটা ধক করে উঠল। গলা শুকিয়ে গেল এক মুহূর্তে।কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে,তার মন যেন বলে উঠছে —

“তাকাস না আবরার জায়ন তাকাস না এই মেয়ে একদিন আমায় তার রূপের আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে… সত্যি ই লোকের কথা ঠিক বিয়ে হয়ে গেলে মেয়ে দের রূপের চমক দ্বিগুণ হয়ে যায় , কিন্তু আমার বউ টার
তো মনে হয় দশ গুণ বেড়ে গেছে । ইস আমার বউ টাকে কেমন আমার বউ বউ লাগছে । আমি কি পাগল হয়ে গেছি আমার বউ কে তো বাল আমার বউ ই লাগবে।
কন্ট্রোল, আবরার জায়ন… কন্ট্রোল…
নিজেকে শক্ত রাখতে হবে…
এই পাষাণ বউয়ের সামনে গলে গেলে চলবেনা।
তিয়াশা নিচে নেমে জায়ন এর অবস্থা দেখে একটু মুচকি হেসে বলল — ” মুখ টা বন্ধ করেন মাছি ঢুকে যাবে ।”
তিয়াশার এই শ্লেষমিশ্রিত বাক্য যেন জায়নের দিব্য ঘোর ভাঙার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটাল সামান্য কাঁপা কাঁপা গলায়, চোঁখ সরিয়ে নিয়ে তিয়াশা কে উপেক্ষা করে, যেন নিজের খোলসে নিজেকে লুকাতে চাইল–
“আমার আই গ্লাস টা যে কোথায় রেখেছি?

জায়ন এর কাণ্ড কারখানা দেখে তিয়াশা নিজের দুই হাত সামনের দিকে জোর করে মনে মনে বলল — ” ভেবে ছিলাম ভালোভাবে বুঝিয়ে ভুল বোঝা বুঝিটা মিটিয়ে নেব বর কিন্তু তোমার মতন ব্যাডা যে ভালো কথা বুঝবে না , ঘাড়ত্যাড়া বেটা কে ঘাড় ত্যাড়া হয়েই বুঝাবো।”
তিয়াশা আবার ও রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল — ” এদিক ওদিক না খুঁজে নিজের চোঁখ আয়নায় দেখলেই হয় । যে সেটা নিজের চোঁখেই আছে । মানুষ চশমা পরেও যে এত অল্প দেখে এই বয়সে লক্ষ্মণ ভালো না ।”
তিয়াশার এরকম খোঁচা মারা কথা শুনে জায়ন বিরক্তির গলায় দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিল —
” আমি কি তোকে বলতে বলেছি ?”
তিয়াশাও উল্টে জবাব দিলো — ” আমি তো কারো নাম নেই নি , যে কম দেখে তাঁরই গায়ে লাগবে ।”
জায়ন দাঁত খিঁচিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এদিকে তিয়াশা মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে । এদিকে রান্না ঘরে এসে দেখে সব কিছুই আছে সেগুলো রান্না করতে হবে , তাহলে সে কি খাবে ? সে তো রান্নাই করতে পারেনা । এই ভেবে
শরীর অচল টা কোমরে গুঁজে জায়ন এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো , জায়ন এর চোঁখ ল্যাপটপ এর দিকে সে বুঝেছে তিয়াশা তার সামনে দাড়ানো কিন্তু এই মেয়ের চোঁখে তাকালে সে নিজের রাগ ঝাড়তে পারবেনা তার এই আত্মসংবরণ চুরমার হয়ে যাবে।

তাই ল্যাপটপ এর দিকেই নজর রেখে বলল–
” কি চাই?”
তিয়াশা কোমড়ে হাত দিয়ে জবাব দিল — ” আমি রান্না করতে পারি না ।”
এখনো জায়ন এর চোঁখ ল্যাপটপ এর দিকে ।
” তো?”
” আমার খিদে পেয়েছে কাল থেকে কিছু খায় নি।”
জায়ন কোন জবাব দিলো না কারন একটু পড়েই নতুন কাজের বুয়া ও রান্নার বুয়া এসে যাবে , তাই মজা করেই বলল — ” বউ দের কাজ রান্না করা , সে কিভাবে করবে সে জানে ।”

জায়ন এর কথায় বিরক্ত হয়ে গেল তিয়াশা একটু রেগেই বলল — “আমি পারি না রান্না করতে বললাম তো।”
তিয়াশার এই চিৎকারে জায়ন ও বিরক্তি হয়ে গেল, এবার আর ল্যাপটপ এর দিকে তাকিয়ে জবাব দেবে না , তিয়াশার দিকে চোখ রাঙাতে যাবে তার আগেই চোঁখ গেল তিয়াশার মেদহীন কোমড়ে আর আর উন্মুক্ত উদরে , শাড়ির আঁচল কোমড়ে গোজায় দু হাত কোমড়ে রাখায় উদরের অনেক টা উনুক্ত হয়ে আছে যার ফলে তিয়াশার কেন্দ্রবিন্দু ও দেখা যাচ্ছে , কেন্দ্রবিন্দুর ঠিক নিচে একটা কালো তিল , জায়ন এর চোঁখ এই প্রথম দেখল তিয়াশার এই তিল, যা জায়ন কে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা যেন এক নিঃশব্দ মানসিক অস্ত্র অদৃশ্য অথচ অপ্রতিরোধ্য।
জায়ন মনে মনে ভাবছে — ” এ কি দেখছে সে , জায়ন রে তুই শেষ। ওহ গড তুমি কি আমায় পাগল করতে চাও? এই মেয়ে কে আমার সামনে থেকে সরাও ,আমি যদি এই মাদকতার নেশায় ডুবতে চাই। আমি সত্যি অসুস্থ হয়ে যাব ।”
এই মার্চের হালকা নরম ওয়েদার এও এ.সি. চালানো আছে তবুও জায়ন এর শরীর ভিজে উঠছে , ললাটে জড়ো হয়েছে বিন্দু বিন্দু নোনা জল।

” আরে বলবেন তো ।”
জায়ন এর মাদকতার আসরে ভেসে এলো তিয়াশার কণ্ঠস্বর । জায়ন এর নজর এখনো তিয়াশার দিকে ,
” এক্ষুনি রান্নার বুয়া আসবে , এখন আমায় ডিস্টার্ব করিস না।”
ওইদিক তাকিয়েই জবাব দিল জায়ন, গলায় কষ্টে চেপে রাখা উষ্ণতা।
তিয়াশা মনে মনে ভাবছে ওনার কিসে ডিস্টার্ব হচ্ছে যেন খামোখা আটকে আছে।
তিয়াশা চোখ সরিয়ে জায়ানের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই তার মুখ রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠল , কিন্তু জায়ন এর নজর এখনো সেই উদরের কেন্দ্র বিন্দুর দিকে।

তিয়াশা দাঁত খিঁচিয়ে পেছন ঘুরে বলতে বলতে গেল — ” অসভ্য বেডা। জীবনেও শুধরাবে না ”
তিয়াশা এরকম ভাবে চলে যাওয়ায় জায়ন এক দম বন্ধ করা ঘোরে থেকে উঠে এসে দুই হাত দিয়েই নিজের চুল টেনে বলল, — ” ওহ শিট শি মেক মি গড ডেমন ক্রেজী”
এর মধ্যেই সদর দড়জার কলিং বেল বেজে উঠল ,
এদিকে জায়ন ডিভান থেকে উঠে নিজের টিশার্ট ধরে নিজের গায়েই ফু দিচ্ছে বার বার হাঁসফাঁস করছে এদিক ওদিক করছে ছটফট করছে , নিজেই চিৎকার করে বলে উঠলো
” ইটস টু মাচ হট হেয়ার, আই নিড আ কোল্ড শাওয়ার।”
জায়ন দরজা খুলছে না দেখে তিয়াশা নিজেই গেলো দরজা খুলতে , দরজা খুলতেই দেখতে পেল — দুই মহিলা দাড়িয়ে আছে , তাদের দুজনের মুখ থেকেই বেরিয়ে এলো তিয়াশা কে দেখে — ” মাশাল্লাহ আপা মনি আপনি কি সুন্দর দেখতে।” তিয়াশা একটু মুচকি হেঁসে বললেন -“ধন্যবাদ আপনাদের ।”
জায়ন এর কানেও গেল সেই কথা , জায়ন এর বিষয় টা মোটেই ভালো লাগলো না , তার বউ কে কি মহিলা রাও এখন নজর দিবে , তাই এগিয়ে গেল দরজার দিকে তিয়াশার হাত ধরে তাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল

— ” কী চাই , আপনারা কারা?”
ওনারা বুঝে গেলেন এই জে সেই নতুন স্বামী স্ত্রী যাদের কথা আহান ভাইয়া বলেছেন। আ হা যেমন জামাই তার তেমন স্ত্রী ” মাশাল্লাহ দুজনরেই যেন আল্লাহ একে অপরের জন্য বানাইছে ।”
” জী আমাদের আহান ভাইয়া পাঠাইছে । আমি রেবেকা ও হইলো সাফিরা । আমি বাসার সব কাম করুম আর ও খাবার বানাইবে।”
জায়ন একটু ভেবে বলল — ” ওহ আসেন। ”
ওনারা এসেই কাজ করতে শুরু করে দিলেন , জায়ন বুঝিয়ে দিলো সে রোজ সকালে ডায়েট ফুড নেয়।অয়েলি খাবার সে খায় না বেশি আর তিয়াশা যা খাবে তাই বানাতে ।
এদিকে তিয়াশাও তাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে লাগলো । কিন্তু জায়ন ডেভিনে বসেও তার নজর বেহায়ার মতন তার বউ এর দিকে । এই লোক নাকি আবার কঠিন হয়ে থাকবে ।
রান্নার বুয়া সব নাস্তা বানিয়ে রাখলো টেবিল এ ,নাস্তা করতেও বসেছে তিয়াশা আর জায়ন ।এর মধ্যেই আবারো কলিং বেল বেজে উঠল —

জায়ন উঠতে যাবে তার আগেই তিয়াশা নিজে দরজা খুলতে চলে গেলো , জায়ন খুব রেগে গেলো ।
কে না কে দরজায় ? এই মেয়ে হুট করেই চলে গেলো। এই বদমাইস বউ কে শায়েস্তা না করলে হবে না । আমি কি জ্বালাবো ওকে ও নিজেই আমায় জ্বালিয়ে যাচ্ছে ।
তিয়াশা দরজা খুলতেই দেখল — আগের দিনের সেই আধা বিদেশি পুরুষ। তাকে দেখেই একটু হেসে বলল ” আপনি সেই কালকের আধা বিদেশি ভাইয়া না ।”
এই বলেই তিয়াশা বলল —

” আসুন ভিতরে …..
কিন্তু এদিকে জেমস তিয়াশার দিকে তাকিয়ে ভাবছে — ” জুলি রে তুই যদি স্যার এর ওয়াইফ কে দেখতি তাহলে তো জলে জেতি। ভাবার মাঝেই জেমস বলল
” ইয়েস ভাবি আমি জেমস স্মিথ ।” এই বলে হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ড সেক করার জন্য ,
এদিকে তিয়াশা হাত বাড়াতে বাড়াতে বলে উঠলো
” ওয়াও ভাইয়া আপনি এত ভালো বাংলা জা……”
বলতে পারল না , না পারল হাত মেলাতে তার আগেই তো এসে তিয়াশার হাত ধরে বসলো কেউ–
সে যে তাদের অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে এতক্ষন দেখছিল তা তাদের জানা নেই । জায়নের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।জায়ন এর চোঁখ যেন জেমস কে গিলে খাবে।
চেপে ধরেছে তিয়াশার হাত । তিয়াশা ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু জেমস এর জন্য কিছু বলতেও পারছে না।
এদিকে জেমস জায়ন এর এই চেহারা দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে আছে । মনে মনে ভাবছে কেন যে নিজের দেশের ফরমালিটি করতে গেলাম — কি করে আমি ভুলে গেলাম ইয়েস্টারডে নাইটের কথা, ও গড প্লিজ সেভ মি।

” বলেছিলাম তো গাড়িতেই থাকতে , আসলে ফোন করবে আমি চলে আসবো গেটের কাছে ।”
জায়নের গর্জনে তিয়াশাও কেঁপে উঠল । জেমস ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো–
” স্যার অনেকবার কল দিয়েছি আপনি রিসিভই করছিলেন না তাই না পেরে এসেছি সরি স্যার আর হবে না, প্লিজ ডোন্ট লুক অ্যাট মি লাইক দিস।”
জায়নের তখন মনে পরল তার ফোনটা উপরে তার রুমেই রয়েছে। ” ওয়েট ফর মি ইন দ্যা কার ।” এই বলেই দরজাটা ঠাসস করে লাগিয়ে দিল।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৪

“এইভাবে কেউ বাসায় আশা মেহমা…
বলতে পারল না তার আগেই জায়ন তিয়াশাকে কোলে তুলে নিজের বুকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো…….
এদিকে তাদের এইরকম উপরে যাওয়া দেখে কাজের বুয়া দের মুখ হা হয়ে গেলো।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here