তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৬

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৬
নীল মণি

“আকাশ, তোর ফোন বাজতেছে… ফোনটা ধর।”
“…(ঘড়ঘড় করে ঘুমের আওয়াজ)”
“এই আকাশ,ফোন ধর ,না হলে এই বিছানা থেকে তোকে লা**থি মা**রব।”
ইউভির এত ডাকাডাকিতেও আকাশের নড়াচড়ার নাম নেই। বিছানায় ওল্টাচ্ছে-পাল্টাচ্ছে, কিন্তু ঘুম যেন বেজায় গভীরে।

“আরে তোর জলপরী ফোন করছে রে।”
এই কথাটা যেন ঘুমের মধ্যেও বাজ পড়ার মতো, আকাশ এক লাফে উঠে বসে চাদরটা একদিকে ছুঁড়ে ছিটকে পড়লো, দুই চোখ কুঁচকে ঘরের এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো।
“কই? কই আমার জলপরী? কোথায় গেল আমার রাজকন্যা?”
ইউভি একহাত কোমরে দিয়ে বিরক্ত চাহনিতে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো।
“এই ফোনে, এই যে তোর জলপরী… নে, ধর।”
আকাশ যেন ঝাঁপিয়ে এসে ফোনটা ইউভির হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। স্ক্রিনে তাকিয়েই হেসে উঠল — সত্যি, আরোহী ফোন করেছে। ফোনটা কানে দিতেই ওপাশ থেকে এক চিৎকারে কানের পর্দা কেঁপে উঠলো —
“এই রাঙ্গা মূলো। কখনো তোমায় ফোন করলে এক কলেই ধরা যায় না কেন?”
আকাশ ফোনটা কানের একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল —

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এত জোরে চিৎকার করো না জলপরী… তোমার গলা বসে গেলে আমি কী করব বলো তো?”
“বেশি চালাকি করবেন না, আগে বলেন আমার বেবি টা কোথায়? পরে আপনার খবর আছে!”
আকাশ মুচকি হেসে বলল —
“তোমার বেবি তো এখন তোমার সঙ্গেই কথা বলছে!”
“উহ্। বাজে বকবেন না। প্রোপোজ করার মুরোদ নেই, আবার ফোনে ‘বেবি’ বেবি খেলতেছেন!”
আকাশ এবার একটু হকচকিয়ে বলল —
“…তুমি এত সিরিয়াস কেন হঠাৎ?”
আরোহীর গলা এবার একটু কোমল হলো —
“বলুন না প্লিজ, আমার বেবিটা কোথায়?”
“তোমার বেবি… এখন তার বেবির সঙ্গে আছে। মানে, তার জামাইয়ের কাছে। এখন ওরা একসাথে, নতুন বাসায়।”
“কি-ই-ই-ই!”

আরোহীর গলায় যেন বজ্রপাত!
“মানে ভাইয়া অলরেডি আমার বেবিকে বিয়ে করে ফেলল?”
“জ্বি হ্যাঁ। একদম হালাল উপায়ে বিবাহ সেরেছে।”
“আমি তো ওকে ফোনেও পাচ্ছি না। একটু কথা বলিয়ে দিতে পারবেন? আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। খুব চিন্তা হচ্ছে।”
আকাশ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপর বলল —
“আসলে কাল তিয়াশা ফোন রেখে চলে গিয়েছিল। আমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছি তোমাকে, ঠিক আছে?”
“প্লিজ জানাবেন। আমি ভীষণ চিন্তায় আছি।”
আকাশ একটু দম নিল, চোখ বন্ধ করে বলল —
“তিয়াশার জন্য চিন্তা করে লাভ নেই, জলপরী। আসল চিন্তা তো আমার জন্য করো, আমার জলপরীকে কে ছেড়ে যদি আমি অন্য কাউকে বিয়ে করি।…”
আরোহী গম্ভীর স্বরে বলল —

“শুনেন, এবার চিন্তা আপনি করুন। আপনাকে এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি আমাকে প্রোপোজ না করেন… তাহলে সত্যি বলছি, ওই পাশের বাসার পটলাটাকে ‘হ্যাঁ’ বলে দেব!”
আকাশের মনে হলো যেন পৃথিবীটা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ভূকম্পন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মাথার ভেতর বাজতে থাকল–
“পটলা মানে কে? এই পটলা টা আবার কে ? এই পটলা কোন সাহসে আমার জলপরীর কথা ভাবে রে?”
আকাশ রেগে গিয়েই একটু গম্ভীর স্বরেই বলল —
“শোনো, মোর জলপরী… পটলা হোক আর বেগুন হোক, কেউ যদি আমার জলপরীর দিকে তাকায়, তাহলে আমি তাকে ফ্রিতে হার্ট সা**র্জারি করব। এই আমি বলে রাখলাম।
ওপাশ থেকে আরোহীও এবার গলা চড়িয়েই বলল —
“যাকে খুশি তাকে সা**র্জারি করুন, সমস্যা নেই কিন্তু সময় আপনার কাছে এক সপ্তাহ। এর মধ্যে কিছু না করলে… আমি কিন্তু সত্যি বলছি।
এই বলে সটাস করে ফোনটা কেটে দিল। ফোনের কাঁটা আওয়াজটা যেন আকাশের বুকে ছ্যাঁকা দিয়ে গেল।
ফোনের স্ক্রিনে “Call Ended” ভেসে উঠতেই আকাশের চোখ কপালে। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।

“ও মা… জলপরী এক সপ্তাহ টাইম দিয়েছে…।আমি তো এখনো ঠিকঠাক একটা লাইনও মুখে আনতে পারি না। আর যদি সত্যি পটলা রে ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়?”
চোখেমুখে স্পষ্ট আতঙ্ক —
ভয় লেগেছে।
ভয়টা এবার সত্যিই জেঁকে বসেছে আকাশের চোখে।
“ওহ ভাইরে… এইবার মনে হচ্ছে আমাকেই আমার হার্টের সা**র্জারি করাতে হবে।”
হঠাৎ করেই আকাশের মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেল,ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, চোখে ধাঁধা।আকাশের এই করুন অবস্থা দেখে ইউভি তখন পাশ থেকে বলল —

“কিরে, তোর মুখের উপর এরকম তবলা কেন বাজল? লাগতেছে যেন কেউ লাফায়া বাজায় দিতেছে।”
আকাশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটু নেতিয়ে গিয়ে বলল —
“ভাবছিলাম… এমবিবিএসটা কমপ্লিট করে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একদম রাজকীয়ভাবে আমার জলপরীকে বিয়ের প্রোপোজ করব। কিন্তু আমার জলপরী আমায় এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়ে দিল ভাই। এক সপ্তাহ মাথায় তো কিছুই কাজ করছে না ইউভি ভাই… আমি এখন কি করবো বল তো?”
ইউভি মুখ টিপে হাসি চেপে বলল —
“তুই না আগে ‘হার্ট সা**র্জারি’র কথা বললি, এখন নিজের হার্টই তো ঝুলে গেল।”
আকাশ কপাল চাপড়ে বলল —

“সত্যি বলছি ইউভি ভাই… যদি পটলাটা ওরে প্রোপোজ করে ফেলে, আর ও রাজি হয়ে যায়… তাইলে আমি মেডিকেল লাইফ ছেড়ে কবিরাজি পড়ব।”
ইউভি এবার আর হাসি থামাতে পারল না।
“তোর প্রেম আর প্ল্যান –দুইটাই ফার্স্ট ইয়ারেই ফেল মে*রে গেছে ভাই।”
” কি করবো ইউভি ভাই ?”
ইউভি বাইরে যেতে যেতে বলে গেল —-
” আমাদের বড় ভাই কি করতে আছে ।”””

“কি করছেন নামান, বলছি তো। কাজের বুয়ারা দেখছে।”
তিয়াশা ছটফট করতে লাগলো জায়নের কোলে, হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
জায়নের ঠান্ডা গম্ভীর গলায় একটা আগুন ধ্বনি বাজল —
“আমার নিজের তিন কবুল বলা বউ তুই… যা ইচ্ছা তাই করব। এতে কার কিসে কি?”
তিয়াশা থমকে গেল। এই স্বরের মধ্যে যে অদ্ভুত দহন, সেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল সে।
জায়ন নিজের রুমের দরজা খুলে ঢুকেই পা দিয়েই উল্টে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে দিল দড়জা টা। মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে যেন এক গুমোট নীরবতা নেমে এলো। তারপর এক ঝাঁকুনিতে তিয়াশাকে বিছানায় ছুঁ**ড়ে ফেলল।
তিয়াশা বিছানায় পড়েই কেঁপে উঠলো, কোমরের পাশে ব্যথা লেগে গোঁ গোঁ করে উঠল —
“আমি কি আলুর বস্তা? যখন খুশি উঠিয়ে নেন, যখন খুশি ফেলে দেন।আমারও ব্যথা লাগে না বুঝি?”
চোখের জল গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে। কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে কাঁদছে সে। কিন্তু জায়নের চোখে কোনো কোমলতা নেই। তার পা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে
বিছনায় পরে থাকা তিয়াশার দিকে ।

হঠাৎ জায়ন এর এরকম কাছে আসতে দেখে তিয়াশার যেন কান্না হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল , পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে , কণ্ঠস্বরে শোনা গেল এক নতুন ভয় —-
” এ এ রকম ভাবে এগিয়ে আ আসছেন কে কে কেন?”
তিয়াশার কথায় জায়ন একটু বিদ্রুপ হাসি দিয়ে বলল —
” বিয়ের পরে স্বামীরা কি করতে তার বউ এর দিকে আগায়?”
তিয়াশার ডাগর চোখজোড়া তৎক্ষণাৎ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল, যেন কথার আড়ালে চেতনার শূন্যতায় পড়ে গেছে সে।
তারপর, হঠাৎ করেই জায়ন ঝাঁপিয়ে পড়ল তিয়াশার উপর।
তিয়াশার নিঃশ্বাস আটকে এলো, বুকের পাঁজরে চাপ সৃষ্টি করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ মনে হচ্ছে কিছু আটকে গেছে।
হঠাৎ করেই জায়ন তার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরল–
চু*ড়ি গুলোর একাংশ জায়নের হিং”””স্র চাপে কচ করে ভেঙে পড়ল, কাঁচের তীক্ষ্ণ শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের স্তব্ধতায়।
তিয়াশা ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল–

” আ””হ লাগছে তো।”
জায়ন এর আগুন জ্বালা চোঁখ নিয়ে কিছুই বলছে না শুধু দৃষ্টি তিয়াশার দিকেই, কিছুই বলছে না কিন্তু এদিকে হঠাৎ করেই জায়ন এর গলার অ্যাডামস আপেল বার বার উপর নিচে হতে লাগল ,
হঠাৎ করেই তিয়াশার চেপে ধরা হাতটা একটু আলগা হয়ে আসলো । তিয়াশা সেটা বুঝেই কাপা কাপা গলায় বলল

” কি কি সমস্যা?”
জায়ন দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল —
” আমার জীবনের বড় সমস্যা তুই ।”
তিয়াশার হঠাৎ করেই মন টা খারাপ হয়ে গেল —
” আমি তো জানি আমি আপনার জন্য বড় সমস্যা।”
জায়ন তিয়াশার কাছে এসেছিল শাস্তি দিতে একরাশ রাগ উগরে দিতে
কিন্তু তিয়াশার দৃষ্টি, তার নিঃশব্দ অনুরণন সব মিলিয়ে, ওর শরী**রের ছোঁয়া, ওর গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ সব তাকে যেন আবারো মাতন করে তুলছে ,এখন সে নিজেই নিজের ভিতরে ডুবে যাচ্ছে,
এক গোপন ঘোর,
এক নেশার গভীর মোহে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ গুঁজে দিলো
তিয়াশার ঘা**ড়ে।

” জানিস যখন বলছিস কেন”
তিয়াশার ঘা*ড়ে নাক ঘষতে ঘষতে জায়ন এর এই হাস্কি কন্ঠে বলা কথায় যেন তিয়াশার পেটের ভেতর কি জানো মুচড়ে উঠলো । নিশ্বাস আটকে আসছে। এখন তিয়াশার পুরো শ**রীর টাই জায়ন এর নিচে । তিয়াশা কি করবে বুঝতে পারছেনা মস্তিষ্ক বলছে সরে যা সরে যা কিন্তু তার মন এর এই হঠাৎ ওঠা অনুভূতি চাইছে কিছু ব্যতিক্রম। এইটা বুঝি শুধু ভালোবাসার সঙ্গেই হয় । কিন্তু উনি যে বলল আমি ওনার জন্য জীবনের বড় সমস্যা।
এদিকে জায়ন যেন কোন অন্য জগৎ এ চলে যেতে চাইছে , সে পারছেনা নিজেকে সামলাতে —
হঠাৎ করেই জায়ন এর কানে আসলো তিয়াশার
কাপা কন্ঠস্বর —

” তাহলে বিয়ে করেছেন কেন আমাকে ?”
জায়ন এর যেন এই কথা শুনেই মাথা টা গরম হয়ে গেল , তৎক্ষনাৎ উঠে গেল
তিয়াশার উপর থেকে , নিজের ব্যাগী ট্রাউজার আর টিশার্ট ঠিক করতে করতে বলল —
” তোর আমার কাছ থেকে মুক্তি নেই তাই। ”
জায়ন এর কথায় যেন তিয়াশা মুহূর্তের রেগে বিছানা
থেকেই উঠতে উঠতে বলতে লাগল —
” আপনি একটা বা**ঘের বাচ্চা। বাজে লোক।”
জায়ন নিজের কাবর্ড থেকে ফার্স্ট এইড বক্স টা বার করতে করতে তিয়াশার দিকে পেছন ঘুরেই একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলল —

” তাহলে তো তোর আমাকে থ্যাংকস বলা
উচিত ।”
তিয়াশা একটু অবাক হয়েই ভ্রু কুচকে বলল —
“কিসের জন্য?”
জায়ন অয়েনমেন্ট ক্রিম টা নিয়ে এগিয়ে আসছে তিয়াশার দিকেই । তিয়াশার সামনে আসতেই একটু ঝুঁকে তিয়াশার ব্যাথা লাগা হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে অয়েনমেন্ট লাগাতে লাগাতে বলল —
” এইযে আমি বা”‘”ঘের বা”*চ্চা তোকে এখনো
ছিঁ*”*ড়ে খায়নি ।”

তিয়াশার হাতে অয়েনমেন্ট লাগায় হাতের কাটা জায়গা টা একটু জ্বলেই উঠলো , কিন্তু তার চেয়ে বেশি রেগে উঠলো জায়ন এর কথায় জায়ন । তিয়াশা মুহুর্তেই রেগে লাল হয়ে উঠল , দাঁতে দাঁত পিষে বলল —
” আ আ আপনি একটা অসভ্য।”
জায়ন নিজের ওই বিদ্রুপ হাসি মুখ টা মুহরতেই পরিবর্তন করে অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে বলল —
” অন্য পুরুষের সামনে নিজের রূপের ঝলক দেওয়া
বন্ধ কর , নেক্সট টাইম যদি দেখি কোন পুরু**ষের ছোঁ**য়া নিতে চেয়েছিস তাহলে তোর হা**ত টা থা**কবে কি না সন্দেহ। ”
জায়ন এর কথা শুনে তিয়াশার চোঁখ যেন ছানাবড়া
হয়ে উঠলো —

এর মাঝেই
তিয়াশার চিবুক ছুঁয়ে জায়ন গম্ভির কন্ঠে বলে উঠলো
” আর এই যে সেজেছিস যা মুছে আয় নইলে দেখাবো
এই বা**”ঘের বা***চ্চার আনলিমিটেড অস**ভ্যতামি।”
এই বলে জায়ন চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে —
তিয়া শাকে রেখে গেলো এক নিস্তব্ধ পরিবেশে।
তিয়াশা মনে মনে বলে উঠলো —
” নিজেও দেখবে না তো অন্য কাউকে দেখতে দেবে।
অ**সভ্য বেডা ।
ধুর শুধু শুধু এত সুন্দর করে তৈরি হয়েছি । জামাই তো
গল লোই না উল্টে আরো…..
ধুর ভাল লাগে না ।”
এই বলে মুখ ফুলিয়ে বেড়িয়ে গেল ।

এদিকে সকাল থেকে নেমেছে নিস্তব্ধতা চৌধুরী বাড়িতে। রোদ ঠিকই উঠেছে, পাখিরা ডাকছে জানালার গরাদে বসে, কিন্তু এই বাড়ির ভেতর যেন রোদ্দুরও প্রবেশ করতে ভয় পায়।কিন্তু এই ভোর, এই সকাল, এই পাখিদের কিচিরমিচির সব কিছু যেন আজ নিষ্প্রাণ।
মাথার উপর আকাশ পরিষ্কার, রোদ ঝলমল করছে ছাদের কার্নিশে,
কিন্তু এই বাড়ির ভিতরটা যেন অন্ধকারে ডুবে আছে।
ঘরের প্রতিটি কোণে যেন জমে আছে এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা, যা কেবল হৃদয়ের ভারে, অভিমানে, কিংবা না বলা কথার বোঝায় জন্ম নেয়।

সেই বাড়ি, যেখানে প্রতিদিনের সকাল মানেই ছিল রান্নাঘর থেকে এলাচ-দারচিনির গন্ধ
আর নারকেল কোরার খচখচ শব্দ ,
আজ সেখানে কেবল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজ শোনা যায়।
চৌধুরী বাড়ির সকালের চিরচেনা কোলাহল আজ কোথায়?
আজ যেন গৃহকোণটা নিঃশব্দ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।
ঘরের কর্তার মুখ গম্ভীর, কঠিন নীরবতায় দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছেন।
আর গৃহিণীরা যাদের প্রাণে প্রাণ ছিল এই তাদের বাচ্চারা । কিন্তু তারা অন্য কোথাও আজ মলিন মুখে, এই ভেবে নির্বাক বসে আছেন গৃহিণীরা একেক কোণে।

প্রান্তিক সাহেব ও মেহজাবীন বেগম এর একমাত্র সন্তান আবরার জায়ন। প্রান্তিক সাহেব যেমন কঠোর
মেহজাবীন বেগম ঠিক তার ব্যতিক্রম ,শুধু জায়ন এর ব্যাপারে না এই বাসার সব সন্তানদের প্রতি ই তার অনুভুতি সমান। কিন্তু তবুও মায়ের মন কি ভাবে নিজেকে শান্ত করবে , চোঁখের জলে ভিজে যাচ্ছে শাড়ির আঁচল।
রুহনা বেগম বৃষ্টির সময় বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজেকে বোঝালে ও এখন আর সামলাতে পারছেনা
নিজেকে । হয় তো তিয়াশার এখানে কোন দোষ নেই
কিন্তু সবাই গত কালের দৃশ্য দেখে বুঝেই গেছে জায়ন
তিয়াশাকে কিছুতেই আসতে দেবে না । এই ভেবেই রূহেনা বেগমের অসুস্থ লাগছে। কিন্তু সে জায়ন কে কথা দিয়েছিল আর নিজেকে দুর্বল করবে না।
হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা চিরে গম্ভীর কণ্ঠে বজ্রের মতো উচ্চারিত হলো–
“এইভাবে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। যে যার কাজ করো।”
প্রান্তিক সাহেবের কণ্ঠে এতটাই দৃঢ়তা ছিল যে, উপস্থিত সকলেই প্রায় থরথর করে উঠল।
এক মুহূর্ত নীরবতা।

তারপর রূহেনা বেগম ধীর কণ্ঠে বললেন–
“বড় ভাইয়া, একটা কথা ছিল… যদি আপনি অনুমতি দেন, তবে সেই কথাটি আপনার সামনে বলার ইচ্ছে ছিল।”
প্রণয় সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। এক দৃষ্টিতে যেন অনর্থক দুঃসাহসের শাস্তি দিতে চাইছেন।
কিন্তু এরপরই কঠিন স্বরে, ঘরের বাতাস কাটতে কাটতে উচ্চারিত হলো তার বাক্য–
“এই বাড়ির বড় মেয়ে যখন অপমানজনক এক ভুল করেছিল, তখন থেকেই তার নাম উচ্চারণ এই বাড়িতে নিষিদ্ধ। এটা যেন কেউ ভুলে না যায়। আর আজ আমার ছেলে সেই একই পথ ধরেছে বলে আমি মুখ বুজে সহ্য করব—এটা যেন কেউ ভাবে না। তার নাম যেন এ বাড়িতে কেউ না তোলে, আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।”
রূহেনা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে, গলার কাঁপুনি যেন তাঁর আত্মার লজ্জা প্রকাশ করছিল।
অন্যপাশে, এক কোণে বসে থাকা আশরাফ সাহেব ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লেন আয়েশা বেগমের কানে, ফিসফিস করে বললেন—

“দেখো, দেখো তোমার এই তিন ভাইকে। যেন ভালোবেসে বিয়ে করা পাপ। আমার ছেলে যদি এসে একবার বলে, ‘আব্বু, এই মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি’—আমি নিজেই গিয়ে নিজের হাতে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসতাম।”
জবাবে আয়েশা বেগম বললেন —
” আমার নিজের ও খারাপ লাগছে , এই কথায় আমি আপনার মতের সঙ্গে মিল রাখছি। কত দিন হয়ে গেল বৃষ্টি আম্মু কে দেখিনা ।”
আবারো যে যার মত নিজেদের কর্ম ক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে
পরল।

“ইউভি ভাই, একটু আসব?”
ইউভি আর আকাশ তখন নিজেদের মধ্যে কী এক গুরুগম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত, হঠাৎ করেই সেই নিরালায় অনুর হৃদয়ভেজা কণ্ঠস্বর যেন ঝর্ণার মতো স্নিগ্ধ করে তুলল বাতাস।
ইউভি মুহূর্তেই পিছন ফিরে তাকাল, কণ্ঠে কোমলতা ছুঁয়ে বলল–
“হ্যাঁ পাখি, আয়।”
আকাশ চোখ সরিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল–
“আর দু’দিন পর তো ওর নিজের ঘরই হবে, এখন আবার পারমিশন এর কি দরকার।”
কিন্তু বিড়বিড় করলেও কথাটা যেন কানের ভেতর দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল ইউভির মগজে।
সে একবার তীক্ষ্ণ চোখে আকাশের দিকে তাকাল,
নির্বাক এক দৃষ্টিতে ইঙ্গিত করল— “চুপ থাক।”
অনু ঘরে ঢুকে পড়েই বলল–
“একটা কথা বলব, রাখবেন?”
“হ্যাঁ পাখি, বল না।”

অনু একটু মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে বলল —
“আপনি তো জানেন বড় ভাইয়া আর আপু কোথায়?
আমাকে একটু নিয়ে যাবেন। বৃষ্টি আপু চলে যাওয়ার
পরে , তিউ আপুর কাছেই বেশি সময় কাটাতাম।
এখন আর ভালো লাগছে না একা একা।”
অনুর কথা শুনে ইউভি মনে মনে ভাবলো একা কোথায় পাখি আমিতো আছি শুধু তুমি আমার তৈরি করা বাসায় একবার ধরা পরো।
এই ভাবনার গভীরে ডুবে গিয়ে ইউভি একটা মুচকি হাসি নিয়ে বলল—-

“ঠিক আছে, একদিন নিয়ে যাব। তবে বাসায় কী বলে যাবি? বাসা থেকে তো যেতে দেবে না ।
” সেটা আপনি বুঝবেন , কিন্তু আপনি যখন বলেছেন
নিয়ে যাবেন তারমানে নিয়ে যাবেন।”
অনুও কায়দা করে বলে চলে গেল , এদিকে এই শুনে
ইউভির মুখ অবাক বিস্ময়ে খোলা। ইউভি সে এক দৃষ্টিতে অনুর চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়েই আকাশ কে বলে উঠলো —

” “দেখলি আকাশ? আমি তো ভাবতাম আমার পাখি বুঝি কোমল তুলোর মত… কিন্তু না রে ভাই, এও যে সময়ে সময়ে আমায় ঠিক সুন্দরভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াবে, সব এক একটা ধানিলঙ্কা ঠিক তোর জলপরীর মতোই।”
আকাশ আবার একটু হেসেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল —
” আল্লাহ আমার টা তো সবার ঊর্ধ্বে, আমায় বলে

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৫

আমি নাকি বা*** ডাক্তার ।খুব তো সকালে বলছিলে আমি ফার্স্ট ইয়ার ফেলের আইডিয়া দিচ্ছি এবার বোঝো ঠেলা । আমার তো মনে হয় বড় ভাইয়াও এই প্রেমের পতাকা হাতে আমাদের দলে যোগ দিতে চলেছে।”
ইউভি বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–
“আল্লায় জানে রে ভাই আর কি কি যে দেখবো।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here