তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৮

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৮
নীল মণি

সেদিন সন্ধ্যায় যা ঘটে গেছে, তার পর থেকে তিয়াশা আর জায়ন প্রায় কথা বলেইনি। তিয়াশা তো রুম থেকেও বেরোয়নি একবার। এই অবস্থায় কার সামনে যাবে? কাজের বুয়ারা দেখলেই মুচকি মুচকি হাসাহাসি করবে, তার থেকে নিজেকে লুকোনোই উত্তম মনে করেছে।
খাওয়ার সময়ও দুজন খেয়েছে যে যার মতো। কোনো কথা নেই, কোনো চোখাচোখি নেই। তিয়াশার গলায় এখনো কালচে লাল দাগ, ঠিক যেন কোন প”শু আক্রমন করেছে ওর উপর। ঠোঁটের কোণটাও এখনো ফুলে আছে হালকা কিছু খেলেই জ্বালা করে তখন তিয়াশার মুখে শোনা যায় গালির বর্ষণ , কিন্তু ঘুমন্ত পরির ব্যথা জায়গা গুলোয় যে রাতে কেউ মলম লাগিয়ে দেই সেই কথা তার অজানা ,জায়ন কে রীতিমত উপেক্ষা ই করছে তিয়াশা , জায়ন ও নিজে থেকে কিছু বলতে চাইছে না সে ও অপেক্ষায় আছে তার এই বাচ্চা বউ কতদিন মুখ টা বন্ধ করে রাখতে পারে, তার উপেক্ষা জায়ন এর অপেক্ষা ।

এদিকে জায়ন জানে, যদি অনু বা আরোহী এসে তিয়াশাকে এই অবস্তায় দেখলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে। তাই ওদের দুইজনকেই আসতে নিষেধ করে দিয়েছে।
খাবারের টাইম এর সময় একরকম তিয়াসার দরজার বাইরে থেকে পরোক্ষ ভাবে কথা সুনিয়েই তিয়াশা কে খাবারের টেবিলে আনা হয় । ব্যাস তাছাড়া আর কোন রকম জায়ন এর কণ্ঠস্বর তিয়াশা এই কদিন শোনেনি। —
তিয়াশা ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যায়, ফোঁটা ফোঁটা অভিযোগ জমে উঠে তার মনে।তিয়াশা মনে মনে ভাবে অন্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথা না হলে তাদের জামাই রা কি সুন্দর বউ কে মানায় আর আমার স্বামী শা**লা এক আস্ত বা””ঘের বা””চ্চা জ”ল্লাদ নিজে দোষ করেও একবার ওকে মানাতে আসলো না । হে আল্লাহ্ আমার মনে ধরার জন্য এই আনরোমান্টিক বদ মেজাজি লোকটাই তোমার চোঁখে পড়ল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ধুর থাকবোই ই না এখানে ,চলে যাব এখন থেকে।
ওই বাসায় ও যেতে দেবে না এই শয়তান বেডা । নিজে ঠিক ড্যাং ড্যাং করে স্টাইল দিয়ে বেরিয়ে যায় । বেটা যায় কোথায়? অন্য মেয়ের সঙ্গে তো চক্কর নাই?
হঠাৎ এই ভেবেই চোঁখ মুখ বড় বড় হয়ে গেল , মুহূর্তেই আবার মন টা খারাপ হয়ে গেল।
পরিবারের জন্য রোজ একবার হলেও তিয়াশা কাদে সেটা জায়ন এর ও অজানা নেই।
রোজকার মতো আজ সকালেও দুজনে নাস্তার টেবিলে বসেছে। ঠোঁটের ফুলে থাকা প্রায় সেরে গেছে, গলায় এখনো কিছুটা কালচে দাগ রয়ে গেছে। পেটের দাগটাও অনেকটাই মিলিয়ে গেছে।
তিয়াশা প্লেটে টুং টাং শব্দ করে খাচ্ছিল , জায়ন এখনো খাওয়া শুরু করেনি শবে এক লোকমা মুখে নিয়েছে তার মধ্যেই কানে আসলো তার বাচ্চা বউ এর কণ্ঠস্বর —

” ভাইয়া কে বলে আমার ফোন টা আনিয়ে দেবেন ?”
কথাটা জায়ন এর কানে গেল কিন্তু কোন রকম উত্তর দিলো না ,
একটু অপেক্ষা করে আবারও বলল তিয়াশা, কিন্তু এবারও সাড়া নেই।
মাথায় রাগ চড়ে উঠল তার। তিয়াশা নিজেই তো আগে এসে কথা বলেছে, এখন উল্টে বসে আছে ভাব দেখিয়ে।
রাগে খাওয়া রেখে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে না বাড়াতেই, গম্ভীর কণ্ঠে পেছন থেকে উচ্চারিত হলো–
“খাবারের প্লেটে যতটা খাবার অবশিষ্ট থাকবে, শরিরে ততটুকুই আঘা**তের ছাপ পড়বে।”
এতক্ষণ ধৈর্য ধরেছিল এই কথা শুনে তিয়াশার মাথার যেন আরো আগুন জ্বলে উঠল । এতক্ষন মুখে কুলু পেতে ছিল আর এখন ধমকি দিচ্ছে?

এক মুহূর্তে তিয়াশার মেজাজ যেন তুঙ্গে উঠে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে পেছন ফিরে এল টেবিলের দিকে, জায়নের মনে হল বুঝি ভয় পেয়েছে, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলে গেল।
কিন্তু পরের মুহূর্তে যা ঘটল, তা দেখে সেই হাসি ওই মুহূর্তেই উড়ে গেল।
তিয়াশা ধপ করে প্লেট তুলে নিয়ে বেঁচে থাকা নাস্তা টা সোজা ট্র্যাশ ব্যাগে ফেলে দিল, তারপর পানি দিয়ে পরিষ্কার করে আবার এনে রাখল জায়নের সামনে।
“ইটস অল ক্লীন, মিস্টার জল্লাদের বাচ্চা।”
তিয়াশা দাঁত চেপে কথাটা বলেই সে মুখ বাঁকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেল।
তার বাচ্চা বউ এর এই রূপ দেখে জায়নের মুখ হাঁ হয়ে গেল ,এই বউ তার তো? না, কোনো জীন ভূত আজ তার মধ্যে প্রবেশ করেছে।

ভেতরে ভেতরে একটু হাসল সে, মনে মনে বলল
“তেজ তো কম নয়। মাস্টার্সটা মনে হয় ‘তেজ ও প্রতিশোধ’ বিভাগে করছে । যাক, এই বউ আমার–
এতেই শান্তি। আরেকটু হলেই তো — না না যখনই
ভাবি বেপরোয়া হয়ে যাই। ”
তৎক্ষনাৎ জায়ন পকেট থেকে ফোন বার করে ইউভি কে ফোন লাগিয়ে বলল আগামীকাল যেন অনু আর আরোহী কে পাঠিয়ে দেয়।
তিয়াশা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল , থাই গ্লাস এর পাশে গিয়ে মনমরা হয়ে দাড়িয়ে আছে।
কেন জানেনা তার ভীষন কষ্ট হচ্ছে।
আর কতদিন এইভাবে। কি চাইছে উনি সম্পর্ক ঠিক না করতে চাইলে বিয়ে কেন করলো ? শুধু মাত্র তার কাছে বেঁধে রাখার জন্য।

এই ভাবতে ভাবতে চোঁখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ে গেল ।
থাই গ্লাস থেকে দেখতে পেল একটা মিনি ট্রাক বাসায় ঢুকছে। তারপর দুটো লোক একটা বড় বাক্স বার করলো , তিয়াশা মনে মনে ভাবল —
” কি এটাতে ? নিচে গিয়ে দেখবো?”
কৌতুহল নিয়ে নিচে যেতে লাগল করিডোর ,কিন্তু তার আগেই জায়ন
নিচে দিয়ে এসে তিয়াশাকে তারাতারি করে কোলে তুলে নিয়ে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো ।
তিয়াশা অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলো
জায়ন এর দিকে মনে মনে ভাবছে —
“আমার জামাই টা আবার হঠাৎ এরকম ভাবে রূমে নিয়ে যাচ্ছে কেন ? তাহলে কি বাসর টা আজ….
তাহলে কি আমার এক ঝাঝিতে আমার জামাই টা শুধরে গেল ?
ইস এই ভেবেই লজ্জায় মুখ ডুবিয়ে দিলো জায়ন এর বুকে কিন্তু নিচে ওই লোক গুলো ওরা তো এই বাসাতেই এসেছে।”

কিন্তু পরম মুহূর্তেই বাস্তবে ফেরাল জায়নের কণ্ঠ।জায়ন এসে তিয়াশাকে ওর রুমে নামিয়ে দিয়ে নিজে বেড়িয়ে গিয়ে দরজা টা লক করতে করতে দাঁত চেপে বলল —
” নিচে লোকজন টিভি ইনস্টলেশন করতে এসেছে , একদম বাইরে বেরোবি না । বেরোলে একটু আগে যা দুঃসাহস দেখিয়েছিস সব ডাবল করে শোধ তুলবো । আমি চাই না আমার বউ কে অন্য কেউ দেখুক,
আমার বউ অন্যপুরুষ দেখলে আবার নিজের রূপের ঝলক দেখাতে থাকে । ”
জায়ন এর এই বিদ্রুপ মার্কা কথা শুনে তিয়াশার
মাথা টা আবার ও গরম হয়ে উঠলো,
এই কথায় তিয়াশার ভেতরের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
” এই শুনুন একদম ফালতু কথা বলবেন না । আমি কোন পুরুষ কে রূপের ঝলক দেখিয়েছি হ্যাঁ? সব সময় যা মুখে আসে বলে যান ।

কখনো সত্যি জানার চেষ্টা করেন।”
তিয়াশার কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট রাগ, অপমান আর দুঃখ।
জায়ন ধীরে এসে তিয়াশার কাছে দাঁড়াল, তার মুখের চোয়াল দুটো নিজের হাতে চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল—
“” আমি নিজেকে কন্ট্রোল করছি বলে এই না তুই আমার সঙ্গে ঝাঝি মেরে কথা বলবি । মাথা গরম হলে
এখানেই মেরে ফেলবো বলে দিলাম।

আমার চোখ যথেষ্ট তোর সত্যি জানার জন্য । তিন বছর আগে তোর ওই বা*** প্রেমিক কে কি ভাবে জড়িয়ে ছিলি ভুলে গেছি আমি? তোর এই মুখ টা মনে পরিয়ে দেয় সব কিছু ,আবার তোর এই মুখ টা ভুলিয়ে দেয় সব কিছু । তোর থেকে নিজেকে এই তিন বছর দূরে রেখেছি প্রতিটা দিন আমার কাছে অভিশপ্তর মত ছিল। যখন শুনলাম নিজের প্রেমিক কে বিয়ে করছিস নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি । এখন তুই আমার বউ কিন্তু আমি ভুলি নি সেই রাতের কথা । তাই ভাবিস না কিছু বলছিনা বলে বেঁচে যাবি, যেদিন ধরবো না ….
যেটা বললাম মনে থাকে যেন।”
এই বলে জায়ন চলে গেলো নিচে ।
তিয়াশা থম মেরে দাড়িয়ে আছে —– সে জানে তার ওই বাঘের বাচ্চা ওই দিনের কথা ভোলে নাই আর এ ও জানে এই বেডা কিছু শুনবে না —
রাগ তো হচ্ছে নিজের উপর সে কি করে ভাবলো
এক ঝাঝি তে হয়তো বাঘের বাচ্চা শুধরে গিয়ে বাসর করতে এসেছে, এই ঘাড় ত্যাড়া বেটারে দিয়ে বাসর আর এ জন্মে হবে না ।
নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়।
চোখ দুটো লাল, ভেতরে যেন আগুন আর পানি একসঙ্গে ফুটছে।

সকাল এগারোটার রোদে একধরনের নরম ঝলমলে উজ্জ্বলতা থাকে–
সূর্যটা তখন ঠিক মাথার ওপর নয়, একটু আড়ে, যেন অলস ভঙ্গিতে দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আলো ঢালছে।
আকাশ টা ছিল ঘন নীল, মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মত মেঘ ভেসে যাচ্ছে হাওয়ার সাথে।
গাছে গাছে রোদ ছায়ার খেলা,
পাখিরা যেন একটু গানের কণ্ঠে ডাকছে,
চৌধুরী বাড়ির সেই চিরচেনা কোলাহল যেন এখন থেমে এসেছে।
বাড়ির সদস্য সংখ্যাও এখন আঙুলের গুনে গোনা যায়।
গিন্নিরা মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলেন, ঘর দরজার ফাঁকে তা ছলছল করে ধরা পড়ে,
কিন্তু কর্তারা?

তাদের চোখে জল ধরা যায় না, তারা শুধুই বোঝে নিজের সিদ্ধান্ত আর সম্মান রক্ষার সংজ্ঞা।
আজ শুক্রবার, তাই প্রায় সবাই বাড়িতেই।
প্রান্তিক সাহেব নিজের রুমে, চুপচাপ চোখ বুজে বসে আছেন আরাম কেদারায়।
কপালে হাত, ঠোঁটে হালকা চাপা উত্তাপ চিন্তার ভারে দোল খাচ্ছেন যেন পুরোটা মানুষ।
হঠাৎ, নিঃশব্দে দরজার কপাট খুলে রুমে ঢুকলেন মেহজাবিন বেগম।
দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি ভেবেছিলেন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কিন্তু তার পায়ের শব্দ টের পেতেই, প্রান্তিক সাহেব চোখ খুলে এক ঝলক তাকিয়ে আবার চোখ বুজে নিলেন।
এই আচরণে মেহজাবিন বেগম একটুও চুপ করে থাকলেন না।
আঁচল সোজা করতে করতে সরল অথচ তীক্ষ্
স্বরে বললেন–

“আপনার চিন্তাকে তো বাসার বাইরে বের করে দিয়েছেন। এখন আবার কি চিন্তা আপনাকে এমন করে ঘিরে ধরেছে?”
প্রান্তিক সাহেব কিছুই বললেন না।
এই ক’দিন ধরে স্ত্রীর এমন ত্যাড়া
বাক্য শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যেন।
“বাড়ির বড় মেয়ে বিয়ে করেছে যাকে ভালোবাসে তার হাত ধরে কোন পাপ তো করেনি মেয়েটাকে আজ তিন বছর হয়ে গেল চোখে দেখি না শুধুমাত্র আপনার জন্য। আপনার জেদের জন্য।
আমার ছেলেও ভুল করেছে, স্বীকার করছি।
কিন্তু সে কি আপনাকে একবার জিজ্ঞাসা করেনি? বিয়েটা আপনার সম্মতি নিয়ে করতে চায়নি?
সব সময় কেন শুধু ছেলেমেয়েদেরই বোঝার দায়িত্ব?
আপনারা বাবারা শুধু সিদ্ধান্ত নেন,
কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো যখন কাঁদে, ভেঙে পড়ে, তখন কি আপনাদের চোঁখে এগুলো কিছুই দেখতে পায় না?”
প্রান্তিক সাহেব চুপ ছিলেন।

চোখের পাতা কাঁপে মাত্র, ঠোঁটের কোনে সামান্য টান।
মেহজাবিন বেগম আবারও বললেন —
বন্ধুরা তো শত্রুদের মাঝে মাঝে ক্ষমা করে দেয়। তাহলে আমরা কেন পারি না আমাদের সন্তান দের ,শুধুমাত্র আপনার জেদের জন্য।
কখনো ছেলেমেয়েদের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করেছেন আপনার চোখে পড়েননি? মেজ আম্মু যে বিয়েতে রাজি ছিল না যে বিয়ের জন্য ঘর কোন হয়েছিল কাউকে মুখ দেখাচ্ছিল না। ওই চার পাঁচ দিন মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি আমরা কখনো বোঝার চেষ্টাই করিনি যে ওর ভিতরে কি চলছে ? যখন জায়ন ওর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটার মুখে শত ভয়ের মাঝে ও এক উজ্জ্বল অনুভূতি দেখা গেছিল চোখে মুখে ছিল এক চিলতে খুশির অনুভূতি । সেগুলো কি আপনার চোখে পড়েনি? পড়বে কি করে চোখে তো জেদের পর্দা লাগানো না আপনাদের এই বাড়ির পুরুষদের । আমারই ভুল যে আমি ওর মনের কথাটা একবারও জানতে চাইনি আর বিয়ের প্রস্তাবটা ওর সামনে তুলে ধরেছি ।

আমি না বুঝে ওকে ভুল জায়গায় ঠেলে দিচ্ছিলাম কিন্তু আল্লাহ আমার ভুল সময় মত ভাঙিয়ে দিয়েছে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।
রুমে এক মুহূর্তের নীরবতা
–তারপরেই, গম্ভীর স্বরে প্রান্তিক সাহেব বললেন–
“শোনো বেগম, আমার সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তোলার দরকার নেই।যা হচ্ছে, তা হোক।এই বাড়ির সম্মান যারা বোঝে না, তারা আমার ক্ষমার যোগ্য নয়।”
তাঁর ঠাণ্ডা অথচ কাঁপানো স্বরে যেন বাতাস জমে উঠল রুমে।
কিন্তু আজ মেহজাবিন বেগমও নরম হবেন না।
চোখে আগুন নিয়ে বলে উঠলেন–
“যেমন আপনি, তেমন আপনার ছেলেমেয়েরা।
এই বাড়িতে আর শান্তি আসবে না।
থাকুন আপনি আপনার জেদ নিয়ে।”

এই বলে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন
এক চিলতে কাপড়ের আচল দুলে গেল বাতাসে,
প্রান্তিক সাহেব আবারো নিজের ভাবনার জগৎ এ চলে গেলেন।
অনন্যার আর রায়ানের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।
অনন্যা নিজের রুমে বসে পড়াশোনায় মন দিয়েছে।
হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–
“পাখি, আছিস?”
শব্দটা শুনেই অনন্যার ঠোঁটে ফুটে উঠলো একরাশ খুশির হাসি।
খিলখিলিয়ে বলল—
“জি ইউভি ভাই, আসেন।”
ইউভি রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল–

“কি করছিস পাখি?”
অনন্যা মৃদু হেসে উত্তর দিল–
“পড়ছিলাম ইউভি ভাই।”
ইউভি ওর পাশে এসে আদরের ছলে মাথার চুলে হালকা হাত বুলিয়ে দিল–
“ভালো করে পড়, পাখি।
মনে মনে বলল —
“আমাদের ছেলেমেয়ে গুলারে যে তোর ই পড়াতে হবে একদিন।”
একটু মুচকি হেসে আবার বলল–
“ভাইয়া বলেছে, আগামীকাল তোকে নিয়ে যেতে।”
এই কথা শুনে অনন্যার মুখ যেন আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
সে হঠাৎই ইউভির হাত ধরে বলে উঠলো–
“সত্যি ইউভি ভাই?”

ইউভি মুহূর্তে থমকে গেল,
তার হৃদয় পাখির নরম আঙুলের সেই ছোট্ট ছোঁয়া যেন বুকের ভেতর হঠাৎ ঝড় তুলে দিলো —
তার চোখ খানিকটা বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল। মনে মনে
বিরবির করল —
“ধরিস না পাখি এভাবে… আমি পাগল হয়ে যাব যে…
তোর এই একটুখানি হাতের স্পর্শ আমার ভিতর কী আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।পাখির ডানায় আমি উড়তে চাই না, আমি তো আকাশ হতে চাই তোর জন্য। কিন্তু যদি কোনোদিন পাখি এই খোলা আকাশে উড়তে না চায়?”
বুক টা হঠাৎ কেঁপে উঠলো ইউভির —

” ইউভি ভাই ?”
অনু ইউভির চোখের সামনে বার বার হাত নাড়াচ্ছে কিন্তু কোন সাড়া নেই —
এবার অনু একটু জোরেই বলে উঠলো —
” ইউভি ভাই শুনছেন , কোথায় হারিয়ে গেছেন ?”
হটাত অনুর কণ্ঠস্বর কানে আসায় ইউভি হচকচিয়ে
উঠলো।—
” হ্যা বল বল ।”
” কোথায় হারিয়ে গেছিলেন ?”
ইউভি একটু ভেবে থেমে নিচু গলায় বলল,
“পাখি, একটা অনুমতি চাই তোর কাছ থেকে…”
অনন্যা একটু অবাক হয়ে, মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল —
“কিসের অনুমতি, ইউভি ভাই?”

ইউভি ধীরে অনুর হাতটা ধরলো… তারপর একটানে একটু নিজের কাছে টেনে আনল।
চমকে উঠল অনন্যা, বুকের ভেতরটা দুলে উঠল কেমন করে, কেমন যেন নিজেকে অস্থির লাগছে এ কেমন অস্থিরতা যার মাঝে খুঁজে পাচ্ছে একরাশ ভালোলাগা।
ভয়ে, লজ্জায় আর অপার বিস্ময়ে সে চোখ মুখ বুজে ইউভির বুকের টিশার্ট আঁকড়ে ধরল –যেন কোথাও পড়ে যাবে।
ইউভির কণ্ঠটা এবার আরও গভীর, আরও নরম, আরও হৃদয়ছোঁয়া হয়ে উঠল —
“পাখি তোকে আমি আমার হৃদয় এর খাঁচায় আটকে রাখতে চাই… কিন্তু সেই খাঁচা হবে খোলা আকাশের মতো। যেখানে শুধু পাবি ভালোবাসা পাখি , ঠিক ততটা যতটুকু ভালবাসলে তুই শুধু প্রতি জনম এই খাঁচাতেই থাকতে চাইবি । থাকবি কি তুই আমার হৃদয়ের খাঁচার মালকিন হয়ে ।
অনন্যার চোখে মুখে তখন এক অন্যরকম আলোর রেখা খেলে গেল।

তবু তার ভেতরে এক টুকরো দ্বিধা, এক বিন্দু লাজ–
কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে যেন একটা নির্দ্বিধা স্বর চিৎকার করে বলে উঠল–
“এই খাঁচায় আমি আমার নিজের খোলা আকাশ দেখতে চাই ইউভি ভাই । আর আপনি তো আমার ডানা… আমি উড়ে যেতে চাই, শুধু আপনার বুকের দিকেই… আপনি ছাড়া এই পাখির মালিক কেউ হবে না ইউভি ভাই। ”
এই বলে অনু চোখ বুঝে ইউভির বুকে মাথা রেখে দিল —
ইউভি এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজের ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে দিল নিজের হৃদয় পাখির মাথায়।
এই চার দেয়ালের ভেতর এক টুকরো নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ।
কথা হয়নি, শব্দ হয়নি…
শুধু নিঃশ্বাস আর বুকের ভেতরের অস্থিরতা যেন চারপাশের বাতাসটাকেও ভারী করে তুলেছিল।
তবে সেই নীরবতা ভাঙল অনন্যা–

ইউভির বুক থেকে মাথাটা তুলেই ধীরে, ডাগর ডাগর চোখের চাহনি দিয়ে নিচু গলায় বলে উঠল—
“আচ্ছা… তাহলে কালকে কি বলে বাসা থেকে বেরোবো?”
ইউভি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি মুচকি হেসে মনে মনে ভাবল
” ইস এই চাহনি শুধু আমার জন্য ”
—সেই চিরচেনা শান্ত আত্মবিশ্বাসী হাসি।
তারপর ধীর গলায় বলল—
“সেদিন তো আমার পাখিটাই বলল… ‘আপনি বুঝে নেবেন’—-
তাহলে এবার আমাকেই না হয় বুঝতে দে পাখি… আমি কিভাবে তোকে নিয়ে যাবো…”
একটা গভীর চাহনি ছুঁয়ে গেল অনন্যার চোখের কোণে।
“তুই শুধু তৈরি থাকিস…”

এইটুকু বলেই ইউভি ধীরে পেছন ফিরল, আর এক মুহূর্ত না দারিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
কারণ সে জানে, আর এক মুহূর্ত এই ঘরে থাকলে…
সে হয়তো নিজের মাঝেই থাকতে পারবে না।
নিজেকে আর সংবরণ করতে পারবে না।
আর অনন্যা?
সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে… বুকের ভিতর অজানা কাঁপন আর ঠোঁটের কোণে এক দমকা হাসি নিয়ে।
তার ‘ইউভি ভাইয়া’।

বিকেলটা আজ একটু অন্যরকম। বনানীর এই নতুন অ্যাপার্টমেন্টে রোদ পড়ে ঘরের ভেতরে নরম সোনালি আলো ফেলে রেখেছে। জানালার ধারে রাখা গাছগুলোতে আলোর ঝিলিক, একটা গাছের পাতার মাথায় ছোট্ট একটা জলের ফোঁটা চকচক করে উঠছে।
ঘরের ভেতর নীরবতা। রান্নাঘরে বুয়া নাস্তার আয়োজন করছে, ডিম পোচ আর পাউরুটি ভাজা। গন্ধটা হালকা হালকা ভেসে আসছে ড্রয়িং রুম অবধি।
তিয়াশা সবুজ জামদানি শাড়ি পরে, খোলা খোপায় এলোমেলো চুল নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরের আলো গিয়ে পড়েছিল তার গালের এক পাশে, যেন কোন সিনেমার দৃশ্য।
জায়ন কিছুক্ষন আগে বেরিয়েছে, কোথায় গেছে—জানে না সে,বলে যায় না তো। এই নতুন বাড়ির রঙিন দেয়ালের মাঝে থেকেও মনটা বড় ফাঁকা লাগছিল।

একসময় হঠাৎ মনে পড়লো নতুন টিভির কথা। নরম সোফায় গিয়ে বসে রিমোট হাতে টিভি অন করল। চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ এক সিরিজে চোখ আটকে গেল –রাগী স্বামীর সামনে এক স্ত্রী নাইট ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে নাটক করছে, আর একটু পরেই সেই স্বামীর মুখ নরম হয়ে গেছে।
তিয়াশার মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল–
“আচ্ছা… তার বাগের বাচ্চার উপরেও কি এমন মায়া কাজ করবে?” –মনে মনে ভাবল সে।
কিন্তু তখনই খেয়াল পড়ল, এই ধরনের নাইটগাউন তো তার কাছে নেই। হঠাৎই মুখটা একটু কালো হয়ে গেল।
মুভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে, টের পায়নি। ঘুমন্ত অবস্থায় তার চুল খসে গিয়ে কপালে পড়ে ছিল, শাড়ির আঁচল এক পাশে পড়ে আছে ––নিঃসন্দেহে এক অপরূপ দৃশ্য।
একটু পরেই জায়ন সদর দড়জা খুলে সোফার পাশে দাঁড়ালো , সে আগে থেকেই জানে তার কিটি ক্যাট এখানে ঘুমিয়ে আছে ।—

একটু কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ঘুমন্ত তিয়াশার পাশে।
তার বাচ্চা বউ এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে , ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল —
বির বির করে বলছে —
” বউ তুই এত সুন্দর কেন , এত মায়াবি কেন ? এত রাগের পরেও রাগ করে থাকতে পারছিনা তোর উপর । মনে হচ্ছে এখনই আমার বুকে তোকে জড়িয়ে নেই। কিন্তু কি নিস্পাপ মুখ রে বউ তোর। কেউ দেখে বলবেই না আমার বউ এত পাষাণ আর তেজে ভর্তি ।”
এই বলেই তিয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুম্বন একে দিলো তিয়াশার কপালে —-
কিন্তু পরক্ষণেই…
তিয়াশার ডাগর চোখ হঠাৎ খুলে গেল। জায়ন থমকে পড়েছে — ইস রে মনে হয় জায়ন এর কোন চুরি ধরা পড়ে গেছে ।

জায়ন এর চোঁখ জোনা রসগোল্লার মত পাকিয়ে গেল হয়েই পিছনে ছিটকে পড়ল—-
জায়ন এর হঠাৎ করেই কাশী উঠে গেল , —
” তু তুই ঘুমাস নি?”
তিয়াশা সোফা ছেড়ে নেমে মেঝে তে বসে থাকা জায়ন কে নিচে ফেলে দিয়ে জায়ন এর উপর উঠে বসলো —-
জায়ন এর যেন তিয়াশার এই হঠাৎ এরকম অবস্থান পরিবর্তন এ ঘাম ছুটে যাচ্ছে ।
গলা কাঠ হয়ে শুকিয়ে আসছে , কাপা কাপা
কন্ঠে বলে উঠলো —
” কি কি করছিস ? ওঠ আ আমার উপর থেকে।”
তিয়াশা চোখ নাচিয়ে , জায়ন এর টিশার্ট এর কলার ধরে নিজের আরো কাছে টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে হ্যাস্কি স্বরে বলল —
” আমার বর এর চুরি করা ধরছি ।”
হায় হায় শেষ শেষ জায়ন , তিয়াশার ভারী নিশ্বাস পড়ছে জায়ন এর ঘাড়ে কানে, যা তাকে মাতন করে তুলছে,জায়ন এদিকে মনে মনে ভাবছে —

” এ কি সত্যিই তার সেই বাচ্চা বউ ,
আরে বউ ওঠ তারাতারি নইলে আমি এদিকে ধংস হয়ে যাচ্ছি । এমনিতেই তোর কাছে আসলে পাগল পাগল লাগে। ওঠ রে বউ ওঠ নইলে আজকে আমার এই বা*** রাগের ফালুদা হয়ে যাবে । না না এক্ষুনি ওঠাতে হবে এটাকে ওঠাতে হবে কিটি ক্যাট বলতে বলতে সত্যি সত্যি বেড়াল হয়ে গেলো নাতো?”
এইসব ভেবেই জায়ন আবারো বলে উঠলো —
” তু তুই ওঠ এক্ষুনি নইলে কিন্তু তোর
ছার নেই , সেদিনের কথা ভুলে গেছিস ?”
এই বলেই উঠতে যাবে জায়ন কিন্তু তিয়াশা উঠতে দিলো না —
জায়ন কে টেনে নিল নিজের কাছে —
জায়ন এর টিশার্ট এর মধ্যে হাত ঢু***কিয়ে তিয়াশা —
নিজের হাতের খেলা চা””লাতে চা””লাতে বলল —

” না বর কিছুই ভুলি নাই , দেখেন সব মনে আছে । ”
জায়ন এর মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেসামাল হয়ে যাবে তার এই বাচ্চা বউ এর বিচলনতায় কেমন যেন সে তোলপার হয়ে যাচ্ছে ।
জায়ন দাঁতে দাঁত পিসে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে —
” কি বর মনে পড়ছে।”
এই বলেই তিয়াশা গলা জড়িয়ে এক জোড়ে কা””মড় বসিয়ে দিল জায়ন এর ঘাড়ে—
এই কা””মড়ে জায়ন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলো —
“শেষ সব শেষ জায়ন তোর তোর সামনে গভীর খাই । পালা এখান থেকে জায়ন পালা। এই খাই এ পড়লে সব শেষ।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৭

এই ভেবেই জায়ন তিয়াশাকে ছুঁড়ে ছিটকে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালালো —
তিয়াশা কোমরে হাত দিয়ে বসে কোমড় ঘষতে ঘষতেই নাক মুখ কুচকে চিৎকার করে বলে উঠলো —
” আরে বাঘের বাচ্চা বর এখনো তো বাকি ছিল মনে করানো, চলে গেলেন যে ……..

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here