তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৩
নীল মণি
“এই জন্যই বুঝি এত ব্যথা নিয়ে ভার্সিটিতে আসার তাড়া ছিল… কু****ত্তার লেজ টানলেও সোজা হয় না… আর বিয়ের পরেও প্রেমিককে ভোলা যায় না, তাই না জান?”
তিয়াশার শরীরের প্রতিটি শিরায় তখন শীতল স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভয়।
জায়নের এই ক্ষুব্ধ, ঠাণ্ডা, বিদ্রুপে ছাওয়া কণ্ঠ মানেই আজ ঝড় বয়ে যাবে।
তিয়াশা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
প্রতিটা শব্দ তার শরীরের ভেতর ধ্বনি তুলে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
ধীরে ধীরে তিয়াশা পেছন ফিরলো,
আর ওর চোখে পড়ল সেই মানুষটা,
যার ভালোবাসা আগুন।
ওর পা জমে গেছে ,ঘাড় কাঁপছে।আর হাতের তালুতে ঘাম জমেছে অদ্ভুত এক অপরাধবোধে।
হঠাৎ জায়নের চোখ নামল সেই হাতটার দিকে ।
জায়ন চোখ নামিয়ে সরাসরি অয়নের হাতে আটকে থাকা তিয়াশার কবজির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর ঠোঁট বেয়ে ধীরে ধীরে ফুঁটে উঠলো এক বিদ্রুপ হাসি।
জায়নের এই ক্ষুব্ধ, ঠাণ্ডা, বিদ্রুপে ছাওয়া কণ্ঠ মানেই আজ ঝড় বয়ে যাবে।
গলা গম্ভীর, কাঁপা কাঁপা, কিন্তু সোজা হাড়ের ভেতর গিয়ে কেঁপে ওঠায় মানুষকে–
“হাতটা ছাড়, না হলে এই হাতটা একবারেই ক**বরস্থানে পাঠিয়ে দেব।”
জায়ন এরভয়ে আরোহী আর পরি থর থর করে কাপছে । আরোহী ইতিমধ্যেই আকাশ কেও মেসেজ করে দিয়েছে।
পরি একটু সরে গিয়ে জেমস কে দেখে,
ফিস ফিস করে বলল —
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এই যে দেশী বিদেশী মিক্সার একটু জায়ন ভাইয়া কে আটকান না।”
জেমস মাথা নিচু করে বলল —
” আই কান্ট বং বিউটি, আই এম হেল্প লেস।”
যেখানে অয়নের আঙুল তিয়াশার কব্জি চেপে ধরে রেখেছে।এক সেকেন্ড…
মাত্র এক সেকেন্ডই নিল জায়ন।
জায়ন তারপর ঝড়ে পড়ে থাকা মেঘের মত,সে এগিয়ে গেল,
বুক থেকে একটা দম নিয়ে এমন ঘুষি মারল অয়নের মুখে,যার শব্দ পুরো গেট জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল।
অয়ন ছিটকে পড়ে গেল,তিয়াশা দাঁড়িয়ে আছে
ঠায়…
নিঃশব্দে…
একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে,
আর বুকের ভেতর বিষক্রিয়ার মত জমছে ভয় ।
জায়নের চোখে তখন আগুন, মুখে ছায়া, বুকের ভেতরে যেন হিমালয় গলছে বিস্ফোরণে।
তিয়াশাকে সরিয়ে রেখে জায়ন অয়নের সামনে দাঁড়ালো।
কোনো কথা না, কোনো হুঁশিয়ারি না,
এক ঝটকায় অয়নের কলার ধরে তুলে নিয়ে ঠাস করে একটা ঘুষি মেরে দিল নাকের মাঝ বরাবর।
রক্ত ছিটকে পড়লো,
অয়ন কাত হয়ে পড়ছে । জায়ন আরেকটা গুঁতো দিয়ে তার পেটের মাঝ বরাবর মারল।
“কু*** বাচ্চা কোন সাহসে তুই আমার বউ কে টাচ করলি? হাত কাপল না তোর? তোকে বলেছিলাম না শু*****র বাচ্চা, তোর মতো কু*** ছায়া যেন আমি আমার বউ এর আশে পাশে ও না দেখি।
তোকে হাসপাতাল পাঠানোর পরও তোর ঘিলুতে ঘাস গজিয়েছে রে?”
এই বলেই আরও এক ঘুষি, ঠাস। এবার চোখের কোণে লেগে গেল।
অয়ন কাতরাচ্ছে, মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
অয়ন এবার চিৎকার করে বলে উঠল —
” আমি তিয়াশাকে ভালো…..
বলতে পারলো না তার আগেই মুখ ফা**টিয়ে …জায়নের চোখের মণি র*ক্ত লাল হয়ে উঠেছে।
তারপরে, যেন এক হিংস্র প্রাণী গর্জে বলে উঠল
” শু*** বাচ্চা ওই মুখ দিয়ে আমার বউ এর নাম নিলে তোর জীব টেনে ছিঁ**ড়ে ফেলব বা**।তুই আসলে নিজের ক*বর খুঁড়ে রাখছিস…”
ভয়ে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠছে ,তিয়াশা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো —
” প্লীজ ওনাকে ছেড়ে দেন । মরে যাবে উনি আর মারবেন না।”
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জায়নের রাগটা সেই মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল —
অয়ন কে আরো ঘুষি মারতে মারতে বলল —
” দেখ দেখ আমার বউ কে দেখ নিজের প্রেমিক কে বাঁচাতে বর এর সামনে কাকুতি মিনতি করছে ।”
জায়ন অয়নের দিকে চিতকার করে বলে উঠল —
” ওই হা**** বাচ্চা রে এত ভালোবাসলাম তাও তোর জন্য চোখের জল ফেলছে।”
অয়ন ও ওই ব্যাথা অবস্থায় বলে উঠলো —
” জায়ন তুই আমাদের মধ্যে এসেছিস।”
জায়ন এর চোখের আগুন যেন জ্বালিয়ে দেবে এক্ষনি সঙ্গে সঙ্গে।
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না ।
আর এক ঘুষি, এবার পেটের বাম দিকে ,
অয়ন রীতিমতো ছটফট করছে মাটিতে। তিয়াশা আরোহী কেঁদে ফেলছে, “ভাইয়া থামেন, প্লিজ ভাইয়া থামেন।”
কিন্তু জায়ন থামছে না।
তিয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বার বার বলছে —
“আপনি ভুল ভাবছেন, প্লিজ… ওনাকে ছেড়ে দিন…”
কিন্তু সেই ভুলের মধ্যেই জায়ন এখন বন্দী।
ভালোবাসার মতোই ভুল বোঝাবুঝিও একধরনের নেশা,যেটা মানুষকে পাগল করে তোলে।
তিয়াশার মুখ তখন জলে ভিজে একাকার।
দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে, চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
শ্বাস নিচ্ছে অনিয়মিত, যেন বুকটা ফেটে যাবে এই বুঝি।
আরোহী আর পরি ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে,
কিন্তু এই মুহূর্তে ওদেরও চোখের পাতা ভিজে উঠেছে।
তিয়াশা পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে জায়নের বাহু আঁকড়ে ধরে বলে উঠলো— “প্লীজ ছেড়ে দিন না ওনাকে… প্লীজ… আর মারবেন না…
একটু শান্ত হন… ।
কিন্তু সেই মুহূর্তে জায়নের চোখে যেন আগুন।
শুধু আগুন নয়, অভিমান, প্রতারণার যন্ত্রণায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ভালোবাসা।
তিয়াশার এই বার বার বলায় ,হঠাৎই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় তিয়াশার গালে এমন এক চড় বসাল,
যার শব্দটা যেন শূন্যে ছিটকে পড়ল সবার কানে।
তিয়াশা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।
চোখে জল, মুখে রক্তিম ছাপ ,ভয় আর ব্যথায় ঠোঁট কাঁপছে।
আরোহী ছুটে এসে তিয়াশাকে জড়িয়ে ধরে,
পরি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জায়নের দিকে,
ওর চোখে এই জায়ন যেন চেনা কেউ নয়।
এ যেন এক উগ্র হিংস্র আগুন, যা শুধু ধ্বংস চেনে।
জায়নের বুক উঠছে নামছে, চোখ লাল।
সে দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার দিয়ে বলে উঠল–
“হা**** বাচ্চা তুই আমার বউ , আমার সংসার, আমার জীবন।আর আজ তুই দাঁড়িয়ে হাত পাতছিস,
তোর অতীতের জন্য?তোর পুরোনো প্রেমিকের জন্য?”
জায়ন আবার সামনে এগিয়ে এল, চোখে আগুন।
“আমি তোকে বুকের বা দিকে রাখার জন্য ভালোবেসেছিলাম,আর তুই আজ দাঁড়িয়ে আমার ভালোবাসার বুকে ছুরি চালাছিস”
তার কণ্ঠ ভাঙছে, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখছে।
“আমি যদি তোকে এতটা ভালো না বাসতাম,
তাহলে আজ এই প্রেমিক নামধারী ভণ্ডটার সঙ্গে তোর লাশ ফেলে দিতাম এই রাস্তায়।”
এদিকে আরোহী পাশে বসে ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলছে ,
“তিয়া, কাঁদিস না প্লিজ… প্লিজ শান্ত হ… ভাইয়া রাগে… সে তো…”
কিন্তু তিয়াশা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ভয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আরোহী কে ।
গায়ে রক্ত লেগে আছে। চোখে আগুন।মাথার রগ দপদপ করছে, আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসছে ক্ষোভের বিষ…জায়নের নিঃশ্বাস এখন আর নিঃশ্বাস নয়, যেন আগ্নেয়গিরির লাভা। সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল,ভয়ে কাঁপতে থাকা তিয়াশার দিকে।আরোহী আর পরি তখন দুপাশে দাঁড়িয়ে,তিয়াশার কাঁপা শরীর জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
“ভাইয়া প্লিজ… ওর দোষ নাই… আপনি ভুল বুঝছেন,”
আরোহীর অসহায় মিনতি যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু জায়ন শুনছে না কিছু।ওর চোখে এখন কোনো প্রিয়জন নেই,ওর সামনে এখন শুধুই এক অপরাধী–
যে নাকি তার ভালোবাসার সমস্ত মানে মিথ্যে করে দিয়েছে।জায়ন সামনে গিয়ে ঝটকায় তিয়াশার হাতটা চেপে ধরল।
তিয়াশা আর্তনাদ করে উঠলো,
“আআ… ছেড়ে দিন প্লিজ… প্লিজ…”
কিন্তু জায়নের চোক্ষে সেই একটাই ভাষা —
“চুপ কর। কথা বলিস না একটাও। নয়তো এখানেই শেষ।”
আরোহী পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়নের হাত চেপে ধরল —
“ভাইয়া প্লিজ… ছেড়ে দিন তিয়াশাকে, আপনি যা ভাবছেন সবটা…”
জায়ন সেখান থেকে পেছনে না তাকিয়েই ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠলো —
“আরেকবার কেউ বাধা দিলে ভুলে যাব সে কে?”
পরি আর কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে চুপ করে গেল।
তিয়াশা তখনও বলছে —
“আমি কিছু করিনি… প্লিজ বিশ্বাস করুন… আমি…”
কিন্তু সেই কথা শেষ হওয়ার আগেই
জায়ন ওকে জোরে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল।
চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল,
কিন্তু চোঁখে এক বিন্দু সহানুভূতি নেই।
তিয়াশা যেন জোর করেই নিজের ভার হারাচ্ছে–
শুধু শরীর না, ভেতরের আত্মাটাও যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে এক টানে।
গাড়ির দরজা খুলে, ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল তিয়াশাকে।
আরোহী আর পরি ছুটে এসে গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
“ভাইয়া… প্লিজ, একটু শুনুন না,”
আরোহীর চোখে অশ্রু, কণ্ঠে প্রার্থনা।
জায়ন ধীরে ধীরে ওদের দিকে তাকাল,
চোখের ভাষায় যেন বলে দিলো–
“একটা শব্দও না।”
জায়নের চোখ সেই মুহূর্তে একদম ফাঁকা…
না ও শুনছে, না দেখছে,সে যেন এখন কেবল প্রতিশোধ।
জায়ন আবার ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল অয়নের উপর–
এইবার যেন সত্যি শেষ করে দেবে।
ঠিক সেই সময় ইউভি, আকাশ আর আহান এসে জায়নকে ধরে ফেলল।
আহান চিৎকার করে উঠলো —
“জায়ন স্টপ , পাগল হয়ে যাচ্ছিস?
ও তো তোর মামাতো ভাই। মেরে ফেলবি নাকি ছেলেটাকে?”
জায়নের চোখ দুটো তখন লাল অগ্নিময়।
সে এক হুঙ্কারে গর্জে উঠল —
“ওই কুর বাচ্চা আমার দুনিয়ায় হাত দিয়েছে রে,
আমার কলিজাতে টাচ করেছে ।ওকে আমি ক**বরে পুঁতে দেব বলছি। ওকে এত বার ওয়ার্নিং দিয়েছি কিন্তু ও …*
তার কণ্ঠে যেন পুরো আকাশ ফেটে পড়ছে।
একটা তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগে
যেই নিস্তব্ধতা নামে, ঠিক সেই রকম দৃশ্য।
ইউভি কাঁপা গলায় বলে উঠল —
“ভাইয়া, প্লিজ… এইটা পাবলিক প্লেস, চারপাশে লোকজন, সিসিটিভি আছে… রেকর্ড হচ্ছে সব…”
জায়ন এক ঝটকায় শরীর ছাড়াতে গিয়ে আবার গর্জে উঠল —
“যেই পাবলিক প্লেসে আমার কলিজা ছুঁয়ে যায়,
সেই পাবলিক প্লেস হল ফা**কিং কসাইখানা।
আমি কারো কিছু শুনতে চাই না। ওই বালের সিসিটিভির কেয়ার এই আবরার জায়ন করেনা।
তার মুখের প্রতিটি শিরা তখন জ্বলছে।দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে শ্বাস ফেলছে সে,হাতগুলো আরেকবার আক্রমণের জন্য কাঁপছে।
ওদিকে আরোহী তখন একদম থর থর করে কাঁপছে,
চোখ ভয়ে বিস্ফারিত, ঠোঁট কাঁপছে,
তার শরীর থেকে যেন রক্ত সরে গেছে।
আকাশ দেরি না করে তৎক্ষণাৎ এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকের ভেতর।সেই বুকে মাথা রাখতেই আরোহীর ভিতরটা কেঁপে উঠল আরও।কাপা কাপা গলায়, কান্না জড়ানো স্বরে বলে উঠল–
“ভাইয়া কে… ভাইয়া কে প্লিজ আটকাও… প্লিজ… উনি ওনাকে মেরে ফেলবে…।”
আকাশ তখন নিজের সবটুকু ধৈর্য, স্নেহ, আর সাহস দিয়ে,ওর চুলে হাত বুলিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল।
“শান্ত হও জলপরী… কিচ্ছু হবে না… আমরা আছি তো…একদম চুপ… কাঁদবে না… …”
আকাশের সেই দৃঢ়, অথচ মমতাময় কণ্ঠ
আরোহীর বুকের ভেতর খানিক শান্তির ঢেউ বইয়ে দিলেও।চোখের কোনে জমে থাকা কান্নার জল যেন বয়ে যেতে দিচ্ছিলো সবটা ।
ইউভি তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অয়নের পাশে।অয়নের মুখে রক্ত, চোখে যন্ত্রণা, আর ভিতরে এক অদম্য প্রেমের হাহাকার।
ইউভি কাঁপা হাতে অয়ন কে ওঠাতে ওঠাতে বলল “সেদিনের পরেও কিসের জন্য নিজের এই অবস্থা করতে আসলি আবার অয়ন? ”
অয়ন চোখ মেলে তাকাল ইউভির দিকে, ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে,
তবুও তার গলাটা কঠিন, কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল —
“আমি তিয়াশাকে নিয়ে যাবই ভাই…
আমি ছাড়া ওর কেউ না… আমি জানি ও এখনো আমায় ভালোবাসে।”
ইউভির মুখে মুহূর্তেই একরাশ রাগ ছায়া ফেলল, কণ্ঠটা একেবারে গম্ভীর,চোখে ঝলসে উঠলো এক দায়িত্বশীল বড় ভাইয়ের দৃঢ়তা–
“আর একবার ও একথা মুখে আনবি না, বনু এখন বড় ভাইয়ের স্ত্রী। দুজনদুজন কে ভালোবাসে ।তোর মতো কারোর ঢোকার অধিকার নেই। আজ যা এখান থেকে। এখন তুই যা প্লীজ।”
অয়ন আবারো বলল, কণ্ঠে কাঁপন, তবুও একরকম জেদ —
“আমি মানি না ইউভি ভাই… তিয়াশা আমাকেই ভালোবাসে।
“তুই কথা বারাশ না এখন এখান থেকে যা । আর তিয়াশা তোকে না জায়ন ভাই কে ভালো বাসে। ”
কিন্তু ইউভির কথা অয়নের বিশ্বাস হচ্ছে না । কারণ তিয়াশা নিজে ভালোবাসো ব্যাক্ত করেছিল।
এদিকে পরি আর জেমস দুজনেই ভয়ে জরস্বর হয়ে আছে । হঠাৎ পরি বলে উঠল জেমস কে–
” আপনার ভয় লাগে না ভাইয়ার সঙ্গে থাকতে ।”
জেমস পরির দিকে তাকিয়ে জবাব দিল —
” আগে ভয় লাগতো , আর এখন হার্টবিট কাপে বুঝলে বং বিউটি ।”
জায়ন তখনো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে ।
চোখে আগুন, মুখে হিংস্রতা, বুকজুড়ে এক রক্তক্ষরণ।
কিন্তু তার সামনে হঠাৎ এক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আহান।
“তুই যাস না .. প্লিজ… এখন না… আরেকটু হলে তুই খুন করে ফেলবি।”
জায়ন চিৎকার করে উঠল–
“সরে যা আহান ,সরে যা বলছি ও,রে আজকে মা*”টির নিচে পুঁতে ছাড়ব।”
আহান চিৎকার করে বলে উঠলো —
” তোকে তিয়াশার কসম ওই দিকে আর এক পাও বারাবি না।”
এই একটা বাক্য যেন মুহূর্তে থমকে দিল জায়নকে।
জায়ন তখনো ছটফট করছে, চোখ ছলাৎ ছলাৎ করে খুঁজে ফিরছে অয়নকে ।তাকে ছিঁড়ে ফেলার, টুকরো করে দেওয়ার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ।
রেগে উঠে আহান কে বলে উঠলো —
” ঠিক করলি না তোরা।”
জায়ন নিজের গাড়ির দিকে যেতে লাগল,
জেমস ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে পেছন থেকে,
কিন্তু জায়নের ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তাকে থামিয়ে দেয়।
“ডোন্ট।”
একটা শব্দ, কিন্তু জেমস থেমে যায়।
জায়ন হাঁটতে থাকে নিজের গাড়ির দিকে,
তার পেছনে দাঁড়ানো ইউভি, আকাশ, আহান
তাদের উদ্দেশে আবারও বলে ওঠে জায়ন ।
“আমার পেছনে যেন কেউ না আসে।”
তার গলার আওয়াজে এমন একটা শীতলতা মেশানো ছিল
যা রক্ত জমিয়ে দিতে পারে, এমনকি আত্মীয়তাকেও।
তিয়াশা তখনো কাঁদছে…
আর সেই কাঁদা চোখে দেখতে পায়,জায়ন তার কালো গাড়ির দরজা খুলে
বসে পড়ছে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে।
আর ঠিক তখনই…
গাড়ির দরজা এমন এক প্রচণ্ড শব্দে বন্ধ করল,
যেন সেই শব্দেই তিয়াশার বুকের সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেল।তার কান্না থেমে গেল না, বরং গলায় ফেঁসে থাকা কষ্ট আরো জোরে কাঁপিয়ে তুলল তাকে।
গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হলো…একটা ঠান্ডা, যান্ত্রিক গর্জন।
আর পাশের সিটে বসে থাকা তিয়াশা তখন
নিজের মুখে হাত চেপে ধরে ভয়ে কাঁপছে, হাঁপাচ্ছে,
নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমতো।তার শরীরের প্রতিটি কাঁপুনি যেন আঘাত দিচ্ছে
জায়নের হৃদয়েও…
কিন্তু জায়ন নিজের চোখ সরিয়ে রেখেছে সামনে।
তিয়াশা ভয়ে-ভয়ে চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
জায়নের চোখের কোণে অশ্রু…কিন্তু সেটা ঘৃ*ণার না ভালোবাসার,সে আর বোঝার শক্তি তিয়াশার নেই।
জায়নের গাড়ি রাস্তায় যেন উড়ছে,প্রতিটি গিয়ার বদল, প্রতিটি স্টিয়ারিং ঘোরানোতে সে যেন নিজেকেই শেষ করে ফেলতে চাইছে।দাঁতে দাঁত চেপে স্টিয়ারিংয়ে বারবার থাবা বসাচ্ছে।রক্ত চলতে থাকা শরীরটার ভেতর যেন আবেগ আর ক্রোধ ঠাঁই চাইছে না আর।
হঠাৎ, ব্রেকের এক ধাক্কায়,গাড়ি থেমে গেল তাঁদের বাড়ির সামনে।কোনো কথা নেই, কোনো দয়া নেই,জায়ন নিজের দরজা খুলে গাড়ির চারপাশ ঘুরে এসে তিয়াশার পাশের দরজাটা খুলে ফেলল জোরে।
“নাম।”
তিয়াশা কিছু বোঝার আগেই তার হাত চেপে ধরে টেনে তুলল জায়ন। গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। দরজা পেরিয়েই ড্রইং রুমের মেঝেতে ঠেলে ফেলল।
তিয়াশা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে,
চোখ থেকে জল পড়ছে, ভয় আর লজ্জায় মুখ পুড়ে যাচ্ছে।কিন্তু জায়নের চোখে তখনও আগুন।
ড্রয়িং রুমে রাখা এক র্যাক থেকে হঠাৎ স্যানিটাইজারের বোতল তুলে নিলো সে। স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিল তিয়াশার কব্জির ওপর,
যেখানে অয়নের স্পর্শ পড়েছিল,সেখানে রীতিমত রগড়ে রগড়ে লাগাতে লাগল সেই তরল আগুন।
“আআঁহ্… প্লীজ ছেড়ে দিন… খুব লাগছে… প্লীজ।”
তিয়াশা ব্যথায় ছটফট করছে।
কিন্তু জায়নের চোখে এক বিন্দু করুণা নেই।
সে যেন এখন কিছু শুনছে না,কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
“ফোন কোথায় তোর?”
জায়ন হঠাৎ তিয়াশার চুলের মুঠি চেপে ধরে ফিসফিস করে উঠল।
“যেই ফোন পেয়েছিস, অমনি ওই কু**র বাচ্চা না*গর কে ডেকে নিয়েছিস?বল ফোন কোথায় তোর?”
তিয়াশার শরীরটা তখন ব্যথায় অবশ।তবুও চোখ বন্ধ করে বলে উঠল—
“আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে… আপনি যা খুশি তাই বলছেন…”
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ,জায়নের হাত উঠে গেল…
ঠাস স স্ —
নাক মুখ জড়িয়ে থাপ্পড় মারায়, নাকের ব্যথায় তিয়াশা চিৎকার করে উঠলো , নীরবতার বুক চিরে ফেটে পড়ল সেই শব্দ।তিয়াশা ছিটকে পড়ল একপাশে।জায়নের গলা থেমে গেল না
“হা*** বাচ্চা, বিয়ের পরেও প্রেম করবি?
আমি বললে আমার মাথা খারাপ?”
“ফোন, কোথায় তোর ফোন?”
তিয়াশা হেঁচকি তুলে কাঁপা গলায় বলল–
“ব্যাগে… ব্যা-ব্যাগে…”
এক মুহূর্ত দেরি না করে ,জায়ন ব্যাগ ছুঁড়ে খুলে
ফোন বের করে এনে ।ধোঁররর করে ছুঁড়ে মারল মেঝেতে।ফোনটা টুকরো হয়ে ছিটকে গেল চারদিকে।
একটা দামী স্মার্টফোনের ভাঙা ডিসপ্লে,আর তিয়াশার চোখের পানিতে একসঙ্গে ছাপ ফেলল ।একটা শেষ হয়ে যাওয়া আত্মার প্রতিচ্ছবি।
তিয়াশার মুখ দুই হাতের মুঠোয় চেপে ধরল জায়ন।
চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত পিষে বলল এক নিঃশ্বাসে–
তীব্র ক্রোধ আর ভাঙা ভালোবাসার এক ছায়া যেন কাঁপছিল তার কণ্ঠে–
“বিয়ের দিন নিজের কাছে কসম করেছিলাম তোর চোখে পানি আসতে দিব না , ব্যথা হচ্ছে নিজের ।এই হাত দিয়ে তোকে আঘাত করে, আমার বুকটাই যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।কিন্তু তুই ………
‘ভালোবাসা’ তুই কাকে বলিস আমি জানি না, তবে তুই কার, সেটা পৃথিবীকে আমি ভালো করেই বুঝিয়ে দেবো।”
জায়নের চোখে তখন রক্তের আঁচ, কথাগুলো যেন পাথরের মতো ভারি।তার ঠোঁট জ্বলছিল ঘৃণা আর তীব্র দখল
“তুই যদি ভাবিস তুই পুরনো ভালোবাসা নিয়ে আজও বাঁচবি, ভুল করছিস। তোর চোখে যদি এখনো অন্য কারো প্রতিচ্ছবি থাকে, তাহলে সেই চোখ আমি নিজেই মুছে দেবো। নিজের ভালোবাসা কে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া বা*** পূরুষ আমি নই, আমি খুব ভয়ংকর। ”
তার গলার নিচ থেকে যেন হুঙ্কার বেরিয়ে এল–
একটা ভালুকের মতো প্রলয়…
তারপরই হঠাৎ সে থেমে গেল। নিঃশ্বাস গম্ভীর, ধাক্কাধাক্কির মতো।এক চিলতে নিস্তব্ধতা।তিয়াশার মুখটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় পেছন ফিরল জায়ন।
চোখের সামনে এক মুহূর্তে ঝড় নামিয়ে,সে দরজা খুলে তীব্র শব্দে তা বন্ধ করে বাড়ির বাইরে চলে গেল।কোনো ব্যাখ্যা, কোনো দয়া, কোনো স্পর্শ ছাড়াই।
শুধু চলে যাওয়ার শব্দটাই যেন পুরো বাড়িটা কাঁপিয়ে দিল।এদিকে তিয়াশা মেঝেতেই পড়ে রইল নিঃশব্দে।
তার শরীর নিস্তেজ, ঠোঁট থর থর করে কাঁপছে,
চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল,
কিন্তু সে যেন আর কাঁদতেও পারছে না…
পড়ি একা একাই ফিরে গেছে বাসায়,আর আকাশ চুপচাপ আরোহীকে তার বাসার গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।কিন্তু বিদায়ের সেই মুহূর্তে, আরোহীর চোখে ছিল একধরনের আতঙ্ক…
একটা আশঙ্কা, যে ঝড় এসেছে তাদের জীবনে
তা বোধহয় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বাসায় ফিরে আরোহী বারবার ফোন করছে তিয়াশার নাম্বারে। কিন্তু বারবার সেই একই শব্দ “দুঃখিত, আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে…”
এই বার্তাটা যেন এখন রক্তে চুঁইয়ে পড়ছে ওর।
আরোহী তখন কাঁপা কণ্ঠে আকাশকে ফোন করে বলছে —
“ভাইয়াকে একটা ফোন দাও, প্লিজ। উনি তো পাগলের মতো হয়ে গেছে…”
কিন্তু আকাশের ফোনেও নীরবতা।
পুরো দুপুরটায় আরোহীর বুকের ভেতর যেন একটা চাপা কান্না গুমরে মরছে।সে জানে, কিছু একটা ভয়ংকর ঘটে গেছে।
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে।বিকেলের রোদ লাল হয়ে উঠেছে ঠিক যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সবার মন।
এখন পলাশ, সাগর, আহান আর ইউভি একসাথে বসে আছে সঙ্গে আছে বেচারা জেমস ও। জেমস পড়েছে
মহা জালায় । একটা ভারী নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে চারদিক।সবাই বোঝে এখন আর হাসির কিছু নেই
এটা সেই সময়, যখন একটা মানুষের আত্মা ভেঙে পড়ে।
হঠাৎ আহান ইউভির দিকে তাকিয়ে বলল —
“তুই কি করে জানলি ছোট ভাই , জায়ন অয়ন এর জন্য দেশ ছেড়ে ছিল?ও তো আমাদের কোনদিন কারন টাই বলে নাই দ্বিতীয় বার দেশ ছাড়ার । ”
”
তার গলায় কৌতূহল নেই, বরং আছে আঘাত।
ভালোবাসার গল্পটা এতদিনের পুরনো হলে কী হয়, ব্যথাটা এখনও একেবারে টাটকা।
ইউভি নিচু স্বরে বলল —
“আমায় বনু বলেছে…”
এই কথাটা যেন এক পশলা হাওয়া,যা লুকিয়ে থাকা আগুনকে হঠাৎ জ্বালিয়ে তোলে।
পলাশ তখন থমকে গিয়ে বলল–
“কি বলছিস ছোট ভাই ?আমরা জানতাম কিছু একটা ঘটেছিল, কিন্তু জায়ন তো মুখ ফুটে কিছু কখনো বলেনি।”
তখন ইউভি এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগল–
কীভাবে জায়ন ভুল বুঝেছিল, কীভাবে একটা ছোট্ট দৃশ্য ওর বুকের ভেতর বাজ পড়িয়ে দিয়েছিল,
আর কীভাবে সেই ভুল বোঝা নিয়ে সে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তিনজনেই স্তব্ধ হয়ে শুনল। একটু যেন নিঃশ্বাস ও আটকে গেল ওদের।
ইউভর কথায় সাগর তখন হঠাৎই গর্জে উঠলো —
“ওই বা***রে আল্লাহ বুদ্ধি দিছে ঠিকই, কিন্তু কান দেই নাই রে। কারো কিছু শুনে না, নিজেই নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়, আবার গর্বও করে তাতে।
কলিজার টুকরা বন্ধু না হইলে আমি নিজে হাতে ওরে শায়েস্তা করতাম আজ , পাগলা কু**ত্তা ছুটাইতাম ওর পিছনে।
আহান একটু বিরক্তি হয়েই বলে উঠলো
” আহ সাগর চুপ করবি। তোর সবসময়
ফাউল কথা বার্তা।”
সাগর ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো —
“হ তোরা আমার লগেই পারবি, যারে কওয়ার সেইখানে তো ভেজা বিড়াল হয়া থাকো ।”
আহান সাগর এর কথায় কান না দিয়ে
ইউভি কে বলল —
“ভাই তুই যখন সব জানতি তাহলে সেটা বলিস নি কেন জায়ন কে?”
ইউভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো–
” আহান ভাই অনেকবার চেষ্টা করছি কিন্তু বলতে পারেনি এমনকি ভাইয়া বিদেশ যাওয়ার আগেও চেষ্টা করেছি কিন্তু বোনের নাম নিতেই চিৎকার করে উঠতো । তোমরাও তো জানতে কিরকম রিয়েক্ট করত।”
ইউভির কথা শুনে পলাশ বলে উঠলো —
“এতই যখন ত্যাজ ছিল ব্যাটার তাহলে আবার দেশে এসে বিয়ে করার কি দরকার ছিল । থাকতো দেশের বাইরে।
চালা কাঠের বারি ওরে আগে দেওয়া দরকার ।”
একটু থেমে ইউভি আবারও বলতে লাগলো —
” ভাইয়া আমার বনু কে বিয়ে করার পর ভাবলাম সব হয়তো ঠিক হয়ে গেছে মিটমাট হয়ে গেছে। তাই আর একবার ইয়ে পুরনো কথা তুলতে চাইনি। কিন্তু আজকে যা দেখলাম আর যা আরোহীর মুখে শুনলাম। তাতে ওদের মধ্যে কিছু ঠিক নেই। ভাইয়া এখনো বনুকে ভুল বুঝেই রয়েছে। ”
এই বলে মাথা নিচু করে রইল ইউভি ।
চোঁখে মুখে একরাশ ক্লান্তি।
এর মধ্যেই সাগর বলে উঠলো —
” হারামযাদা রে ফোন লাগা , ফোন তুলবে না আবারো করবো। ওর ওই
তার ছিড়া মাথার তার গুলারে জয়েন্ট না করলে বেটা সুধরাবে না।”
পলাশ বারবার ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু জায়ন এর কোন খবর নাই ।
খানিকক্ষণ বাদে ফোন টা রিসিভ হলো , ফোন টা রিসিভ হতেই পলাশের হাত থেকে ফোন টা সাগর চিৎকার করে বলে উঠলো —
” তার ছিড়া তোর বাসায় আইতাছি, বারন করলেও আজ আসুম । দরজা না খুললে ভাইঙ্গা ঢুকুম। খালি তোর গেটের পাসওয়ার্ড কইয়া ফেল জলদি ,
সময় নাই। তোরে আইয়াই ঠিক করতে হবে ।”
এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো এত গুলো কথা ।
এবার ওপাশ থেকে এক অচেনা গলায় বলে উঠল —
” আসলে স্যার, এই ফোনের মালিক ফোন তোলার অবস্তায় নেই । তাই এতবার ফোন আসছে দেখে আমি নিজেই রিসিভ করলাম।”
সাগর চমকে উঠলো —
” মানে , ওঠানোর অবস্তায় নেই মানে ?কি হয়েছে ওর? কোথায় আছে ও?আপনি কে বলছেন ?”
ওই ব্যক্তি বলে উঠলো —
” চিন্তিত হবেন না স্যার এটা হল সানশাইন ফাইভ স্টার হোটেলের বার ,স্যার একটু অতিরিক্ত ড্রিংক করে ফেলেছেন । ”
সাগরের হাত থেকে আহান ফোনটা নিয়েই বলল–
” ঠিক আছে আপনি লোকেশন টা বলেন আমরা এক্ষুনি আসছি।”
লোকেশন নিয়েই ফোন কেটে দিল —
এর মধ্যেই সাগর বলে উঠলো —
” বুড়া বয়সে পিচ্চির প্রেমে পইড়া
দেবদাশ সাজনের সখ হইছে এই দিন বিকালে ।”
সানশাইন ফাইভ স্টার হোটেলের বারটা যেন একটানা বিষণ্ন সংগীতের মত।চারদিকে অর্ধ-আলো, মৃদু ব্লুজ মিউজিক বাজছে, চকচকে মেঝেতে ছায়ারা লম্বা হয়ে পড়ে আছে,সুগন্ধি আর দামি সিগারেটের গন্ধ মিশে একধরনের ভারী নীরবতা ছড়িয়ে রেখেছে।
ঘরের এক কোণে, গা ঢাকা একটা গাঢ় বাদামী রঙের কাউচে বসে আছে আব্রার জায়ন চৌধুরী ।
তাঁর চোখজোড়া যেন ক্লান্ত এক যুদ্ধ শেষে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সৈনিকের মতো…
এক হাতে হাফ-ফুল গ্লাস, যেটা নিজের অজান্তেই একপাশে হেলে পড়েছে,আরেকটা হাত ঝুলে আছে সোফার বাহিরে,পায়ের নিচে গ্লাসের কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
কালো শার্টের বোতাম কয়েকটা খুলে গেছে,
কাঁধের ওপরে কোটটা কুঁচকে আছে,
চুল এলোমেলো, চোখের নিচে গাঢ় ছায়া।
আর চোখ?তাতে আগুন নেই, অশ্রুও নেই,
কেবল শূন্যতা।একটা চাহনি, যেখানে বেঁচে থাকা আছে, কিন্তু জীবন নেই।
মাঝেমধ্যে কাঁচের গ্লাসটা ঠোঁটে নিয়ে যায়,কিন্তু মুখ ছোঁয়ানোর আগেই ফিরে আসে।হয়তো স্বাদ পাচ্ছে না, হয়তো তৃষ্ণা নেই আর।
বারের ঠিক পাশের টেবিলে তাঁর ফোন পড়ে আছে,
বারবার ভাইব্রেট করছে, আলো জ্বলছে নিভছে,
কিন্তু জায়ন তাকিয়েও দেখছে না।
বার টেন্ডার একপাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।একজন ধ্বংস হওয়া রাজপুত্রের দিকে,
যে ভালোবাসার লড়াইয়ে শুধু হেরেই যায় বারবার।
ওর পাশে টেবিলে পড়ে আছে একটা সিগারেট প্যাকেট,আর একটাই কথা যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ করেই পাঁচ জন হোটেলের লবিতে ঢুকে পড়লো,আর চোখের সামনে যে দৃশ্যটা পড়লো,
তা যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত সৈনিকের পরিণতি।
একদম নিঃশেষ, বিধ্বস্ত, নির্বাক জায়ন চৌধুরী।
গা ছমছমে আলোয়, গা ঢাকা কাউচে হেলে পড়ে আছে সে।চোখে নেশা, ঠোঁটে বিষণ্নতা, আর শরীরে একরাশ অবসাদ।
সাগর হঠাৎ করে থেমে বাইরের দিকে একবার তাকালো।তারপর ধীরে এগিয়ে এসে পলাশকে বললো–
“ওর হাত ধর, পলাশ।
বারটেন্ডার এদিকেই এগিয়ে এসে নরম গলায় বললো
“আপনারাই কি মি. জায়নের বন্ধু?”
আহান মাথা নেড়ে সম্মতির ইঙ্গিত দিল।
পলাশ জায়নের হাত ধরতেই সে যেন ছিটকে উঠতে চাইল,কিন্তু শরীর তো আর শোনে না হৃদয়ের বেপরোয়া আদেশ।নেশাগ্রস্ত দেহে সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।নেশাল গলায় সে বলে উঠলো–
“আরে কি করছিস তোরা… ছাড়…”
সাগর দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠলো।
“তোরে ছাড়তেই যাচ্ছি। আগে শান্তির মাইরে আইনা লই।”
দুজনে মিলে টেনেহিচড়ে জায়নকে নিয়ে এলো বার এর বাইরের সুইমিং পুলের ধারে।এক মুহূর্তও না ভেবে সাগর ঠেলে দিল জায়নকে ওই পুলের জলে।পেছন পেছন জেমস ইউভি আহান ও ছুটে আসলো।
হঠাৎ ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় জায়নের চোখ-মুখ খুলে উঠলো, একটু বুজতেই হকচকিয়ে চিৎকার করে উঠলো —
“আর ইউ গাইস ফাকিং ক্রেজি?কি করলি এটা ?”
সাগর দুই হাত নিজের কোমড়ে দিয়ে
বলে উঠলো —
” এ রাখ তোর ওই বালের ইংলিশ। মাথার তার কি তোর পুরাই ছেড়া মামা?”
জায়ন রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো —
” আহান ওরে চুপ করা।নইলে এমনি ই মাথা ঠিক নেই , কিছু করে বসবো ।”
আহান ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো —
” ওহ ঠিক ই বলছে । তোর তো কান চিলে নিয়ে গেছে,
আগে ফিরিয়ে আনি ।”
জায়ন চোখ মুখ খিচে বলে উঠল—
“কি সব বলছিস তোরা, মাথা আমার ঠিক নেই না তোদের ঠিক নেই?”
জায়ন এর কথায় পলাশ গর্জে বলে উঠলো —
” ইউভি ভাই এই ঘাড় ত্যাড়ার মাথা আগে ঠিক কর।
আজকে না শুনলে ওরে উদমা পিডান
দিয়ে শুনাবো ।”
ইউভি পকেট থেকে ফোন বের করে অনন্যাকে কল দিল। হাটু গেড়ে বসে ফোন টা লাউড স্পিকার দিয়ে
জায়ানের সামনে ধরল।
রিসিভ হতেই অনন্যার উত্তেজিত কণ্ঠ—
“হ্যাঁ বলেন ফোন দিয়েছেন কেনো আবার , বললাম না তখন ফোন দিবেন না?”
সবাই তাকিয়ে পরল ইউভির দিকে
ইউভি চোঁখ বুঝে শুনে যাচ্ছে চুপচাপ , হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো–
“পাখী তিন বছর আগে বৃষ্টি পালিয়ে যাওয়ার দিন আমার ছোট বনু কাকে ওই রাতে পাগলের মত খুঁজছিল?
জায়ন থমকে যায়, নিঃশব্দে তাকায়…
ওপাশ থেকে অনন্যা বলে উঠলো
“আপু জায়ন ভাইয়াকে খুঁজছিল। কেন কি হয়েছে?
জায়নের বুক হঠাৎ ভারী হয়ে আসে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে…
ইউভি ধীম কন্ঠে বলল —
” কিছু না পাখি , ওই দিন রাতে তিয়াশা
কাকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিল ? তুই কার কথা বলেছিলি কে ছিল ছাদে ।”
অনন্যা ওদিক দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল —
” আরে বাবা জায়ন ভাই কে খুঁজতে গিয়েছিল । আমি ই বলেছিলাম ভাইয়া ছাদে আছে
এই কথা শুনেই জায়নের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল, বুক ভার হয়ে এলো।
ফোনের ওপাশ থেকে অনন্যা গর্জে উঠে বললো–
“আপনারা ছেলেরা একেকটা বদজাত। আপু কি কষ্ট পেয়েছে জানেন না। আপনাদের ভালোবাসা প্রাপ্য না। যান না নাইট ক্লাব আমাকে কেন ফোন দিছেন এইসব বলার জন্য যে জায়ন ভাই কি ভাবে আপু কে ভুল বুঝে চলে গেছিল? একবার আপুর কথা টা পর্যন্ত
শোনে নাই । আপু এত ভালোবাসলো ভাইয়া কে না বুঝে চলে গেল কি ভাবে কষ্ট পেত আপু রোজ । আর এখন নাইট ক্লাবে গিয়ে অন্য মেয়েদের দেখেন আপনারা।আল্লাহ আপনাদের হেদায়েত দিন।আপনাদের না বুড়িগঙ্গায় ফেলা উচিত।”
এই বলে অনন্যা ফোন কেটে দিল —
কিন্তু জায়ন এ কি শুনল , জায়ন এর বুক ভারী হয়ে আসছে । বিশ্বাস হচ্ছে না সে কি শুনছে । কাঁপা কাঁপা গলায় বলল —
” আহান আমায় টেনে তোল আমি ওঠার শক্তি পাচ্ছি না। ”
এরপরেই আহান ও সাগর মিলে জায়ান কে উপরে তুলল ।উপড়ে উঠতেই ইউভির কাধ ধরে হাঁপাতে হাপাতে জায়ন বলতে লাগল —
” অনু কি বলল ইউভি ,কি বলল অনু?আমি কি শুনলাম এটা কি সত্যি?”
ইউভি মাথা নিচু করে ভেজা চোঁখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে–
“অনু যা বলেছে ঠিক শুনেছ ভাইয়া সেদিন কে বনু তোমায় খুজতে উপড়ে গেছিল । অন্ধকারে অয়ন কে তুমি ভেবে নিজের ভালবাসার কথা প্রকাশ করেছিল । কিন্তু তুমি ভুল বুঝে ছিলে ভাইয়া ভুল বুঝে ছিলে আমার বোনটাকে । শুনতে চাওনি কারো কথা
চলে গেছিলে সবাইকে ছেড়ে। আমার বোন তোমার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করত। কত আমার বুকে তোমার জন্য জড়িয়ে কেঁদেছে তা আমি নিজে বলতে পারব না। আমার বোনটা তোমায় পাগলের মতন ভালবেসে গেছে কিন্তু বোঝাতে পারেনি দেখাতে পারেনি।”
জায়নের মুখ লাল, চোখ কাঁপছে, ইউভির কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো —
” মিথ্যে বলেছিস না তো ইউভি , দেখ মিথ্যে বলিস না প্লীজ আমি বাঁচব না
তাহলে আর । ”
ইউভি ভেজা চোঁখে বলে উঠলো —
“আমি আমার জিবনে তোমায় কখনো অন্তত মিথ্যে বলিনি ভাই। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি ভাইয়া ।আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি সব সত্যি ভাইয়া সব সত্যি।”
জায়ন নিজেকে আর সামলাতে পারল না ওই কঠিন মানুষ টার চোঁখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ল ।
হঠাৎ করে নিচে বসে পরল ।মনে মনে বলতে লাগল —
” আমার কিটি ক্যাট আমায় ভালোবাসে? আমার বাচ্চা বউ শুধু মাত্র আমার ছিল আর আমি , ওহ গড
ওহ গড। আমি আমার জান টাকে এত কষ্ট দিয়েছি , আজ আমি ওকে এইভাবে আঘাত করলাম এইভাবে শুধু মাত্র আমার ফ*কিং মাইন্ড এর জন্য ”
এই প্রথম, জায়ন নিজের ভালোবাসার ওজন টের পেল। নিজের ভুলের ফল টের পেল।ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।পানির চেয়ে লবণাক্ত, অনুশোচনার চেয়ে জ্বলন্ত।
কি ভেবে জায়ন আবার ও উঠে দাঁড়িয়ে ইউভির কলার ধরে চিৎকার করে পাগল উন্মাদ এর মত বলে উঠল–
” এতদিন কেন বলিশ নি, কেন বলিশ নি বল?জানতিস তাহলে বলিস নি কেন?”
এর মধ্যেই সাগর ওকে ঘুরিয়ে মুখে বসালো দুই ঘুষি —
” এই বা** ওর কলার ধরোস ক্যান ?
তোর কান আছে ? কখনো শুনতে চাস কারো কথা । ঘাড় ত্যাড়া বেডা।”
সবাই যেন সাগর এর এই হঠাৎ পদক্ষেপে একটু অবাক ই হলো —
কিন্তু জায়ন একটু হেসে বলে উঠল —
” ক্যান ইউ হিট মী মোর দোস্ত? প্লীজ মার না আরো আমি ডিজার্ভ করি মার আরো মার।”
সাগর অবাক চোখে চেয়ে হাত সরিয়ে বলে উঠল–
” এ আহান পাবনা পাগল গারদে কল লাগা। এ বেডা পাগল হইয়া গেছে ।”
জায়ন সবার হাত ধরে অজস্র বার থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ বলে ভিজে গায়ে দৌড়ে চলে গেল।
পলাশ চিৎকার করে বলে উঠল —
” কোই জাস দারা আমারা আসি ।”
জায়ন পিছন না তাকিয়েই বলে উঠল —
” আমার জান কে মানিয়ে আমার ব্লাড লাইন কে পৃথিবী তে আনার ব্যবস্থা করতে ।”
জায়ন এর এই লাগাম ছাড়া কথায় সবাই মুচকি হেসে উঠলো , কোথায় যেন এক খুশি কাজ করছে সবার মধ্যেই।সাগর জেমস এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল —
” দেখলা হাফ বিদেশী ভাই কোন পাগলের অ্যাসিস্ট্যান্ট তুমি। কি করে থাকো আল্লায় জানে।”
জেমস একটু নিজের কানে হাত দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল–
” জ্বী ভাইয়া ওই আর কি।”
পেছনে সেদিনের বিকেলের রোদ ছড়িয়ে পড়ল,
আর এই পাঁচ জন, একটু হালকা হেসে বুঝে গেল।
ভালোবাসা ভুল করলে মরে না,
ঠিক বুঝলে বাঁচে…
গাড়ির চাকা যেন মাটিকে স্পর্শ করছে ঠিকই, কিন্তু গতি… তা যেন জায়নের হৃদয়ের গতি ছুঁয়ে ছুটে চলেছে। চোখের কোণে তখনও ভিজে ভাব, কিন্তু ভেতরে তীব্র আলোড়ন ভালোবাসা ফিরে পেতে চলেছে সে, তার “কিটি ক্যাট” আবার তারই হবে, এবার ভুল বুঝে নয়… বোঝে বুঝে।
গাড়ি বাসার সামনে থামাতেই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। স্লাইডিং গেট পেরিয়ে এক দৌঁড়ে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে। নিঃশ্বাস টেনে দরজার বেল বাজানোর আগেই তার নজর পড়ল নিচে রাখা একটি ছোট্ট চিরকুটে।
“এই যে বাঘের বাচ্চা, এত তাড়া কিসের? আস্তে যাবেন আর সবগুলো চিরকুট পড়বেন।”
চোখে অদ্ভুত এক হাসি খেলল, একটুখানি ঝিম ধরল ঠোঁটে। কিন্তু সেই হাসির ভেতরেই যেন ছিল অজস্র কৃতজ্ঞতা, ছিল কিছু না বলা আবেগ। পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
সাথে সঙ্গে চোখে পড়ল টিভির উপর লাগানো আরেকটা চিরকুট–
“এত ভাবার কিছু নেই। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না , ঘাড় ত্যাড়া জামাই জুটেছে কপালে আর কি করবো।”
জায়নের মুখে হাসি এবার আর নেই। হৃদয় যেন একটু কেঁপে উঠল।
এটা কী? দুঃখের শুরু নাকি ভালোবাসার শেষ চেষ্টা?
আবার চোখ গেল ডানপাশের দেয়ালে, আরেকটি চিরকুট।
“জীবনে শুধু হাত চালাতে আর মুখ চালাতে শিখেছেন, মন দিতেও শিখেছেন কিন্তু মন বুঝতে শেখেননি। এবার কিচেনে যান।”
জায়ন ধীরে পা বাড়াল রান্নাঘরের দিকে। পা যেন ভারী, শরীর আর মন দুই-ই কাঁপছে।
ফ্রিজের উপর লাগানো চিরকুট:
“আপনার ঐ বাঘের থাবায় এখনো কান ঝন ঝন করছে জানেন তার উপর নাকের ব্যথা, এদিকে হাত কাপছে। তবুও লিখছি।”
এইটুকু পড়তেই হঠাৎ… জায়নের মুষ্টিবদ্ধ হাত উঠে এসে দেয়ালে সজোরে আঘাত করল। চোখে জল।
“জান, প্লীজ… সরি ক্ষমা করে দে। আমি যা করেছি… তার প্রতিটা ব্যথা ফিরিয়ে নিতে চাই। আমাকে এর থেকে বেশী মেরে আঘাত করিস, কিন্তু প্লীজ… এইভাবে বলিশ না জান…।”
তারপরেই চোখ গেল চিমনির দিকে। সেখানে আরেকটি চিরকুট।
“এখানে আর কিছু নেই। খুঁজতে হবে না। উপরে আপনার রুমে যান।”
জায়ন সমস্ত চিরকুট হাতে নিয়ে দৌড়ে উপরে গেল। নিজের রুমে ঢুকেই চিৎকার–
“কিটি জান, তুই কোথায়? সামনে আয় না প্লীজ।আমি তোকে সব শুনবো , শুধু একবার সামনে আয়… প্লীজ।”
কিন্তু কোনও সাড়া নেই।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে চোখ পড়তেই আরেকটি চিরকুট।
“তোমার ভালোবাসায় ডুবে বৃষ্টি ফোঁটা থেকে সাগর হয়ে যাব। তোমা থেকে শুরু হয়ে তোমাতেই শেষ হয়ে যাব। এতটাই ভালোবাসি আপনাকে। কিন্তু সেই ভালোবাসা বুঝবার ক্ষমতা আপনার হলো না।”
এই লাইনটা পড়ে বুকটা যেন চেপে ধরল কেউ, নিশ্বাস আটকে গেল। চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠছে, আঙুল কাঁপছে।
বুক সেলফের উপর চোখ গেল আরেকটা চিরকুট।
“একটা কথা বলবো আপনাকে। জানেন, ভালোবাসা একটা পুরো বই আর ভুল বোঝা হলো একটা মাত্র পৃষ্ঠা। যদি কাউকে সত্যি ভালোবাসেন, তাহলে একটা পৃষ্ঠার জন্য পুরো বইটা ফেলে দেবেন না। কিন্তু আপনি তো বাঘের বাচ্চা”
জায়নের পা এবার টলমল। মুখে নীরব কান্না।
ভুল, অহংকার, রাগ, সবকিছু মিশে এখন একটা ভয়াবহ যন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে।
রুমে আর কিছু নেই। ওয়াশ রুম পর্যন্ত খুজলো কিন্তু কিছু পেল না।জায়ন ছুটে গেল তিয়াশার রুমে। ঢুকেই চোখে পড়ল
কাউচে রাখা চিরকুট:
“আসেন আসেন, একটু খুঁজে খুঁজেই আসেন।”
জায়নের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার
“বউ, সামনে আয় বলছি। এবার আমার সত্যি চিন্তা হচ্ছে… প্লীজ জান, সামনে আয়…।”
কিন্তু চোখ গেল বিছানার উপর রাখা আরও একটি চিরকুট:
“আমি এবার হাপিয়ে উঠেছি। কখনো কিছু শুনতে চান না, কেন সব সময় আপনার কথাই শুনবো? আমার কথা কেন শুনবেন না?”
“সব শুনবো জান সামনে আয় ।”
পাশের বুক শেলফে আরেকটি চিরকুট —
“জানেন, ওইদিন রাতে আমি আপনাকে খুঁজছিলাম আপুর কথা বলার জন্য। আপনি বললেন যদি সত্যি না বলি, আমায় ছেড়ে চলে যাবেন। তখন আমার ভিতরটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল । জানবেন কি করে শুনতে চেয়েছেন কখনো? কিন্তু আমি বলতে পারছিলাম না… নাজিম ভাই বারন করেছিলেন ওনার নাম বলতে। হঠাৎ মনে হলো, নাম বলা বারণ, কিন্তু ঘটনা তো বলতে পারি, তাই ছাদে গিয়েছিলাম…”
এই চিরকুটে আর জায়গা নেই। এবার ওয়াশরুম যান।”
জায়ন ছুটে গেল ওয়াশরুমে। আয়নার সামনে লাগানো চিরকুট উঠিয়ে নিল —
“জানেন, ওইদিন আপনাকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিলাম। আর ওখানেই সব শেষ হয়ে গেল আমার। আপনি ভুল বুঝলেন। আমায় ছেড়ে গেলেন। কেন?”
চোখের জল গড়িয়ে পরছে।জায়ন ফিসফিস করে বলল —
“প্লীজ জান, সরি। এবার সামনে আয়… তোকে ছুঁয়ে ক্ষমা চাইবো… ছুঁয়ে ভালোবাসা দিবো…।”
ওয়াশরুম থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক তখনই চোখ পড়ল দেয়ালে আরেকটি চিরকুটে–
“আপনি চলে যাওয়ার পর খুব কেঁদেছি। কত রাত বালিশ ভিজিয়েছি, আমি নিজেই জানি না। কত স্বপ্ন দেখতাম জানেন? কিন্তু আপনি …….
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪২
এবার আমার কাবার্ডের সামনে যান।”
জায়ন প্রায় ছুটেই গেল।কাবার্ড খুলতেই আরেকটি চিরকুট—
“একদিন হঠাৎ আমায় বিয়ে করলেন ভাবলাম পেয়ে গেছি সখের পুরুষ কে এবার সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু আবারও সব শেষ… ভুল বোঝাবুঝিতে। আমি আর পারছি না। এই তিন বছর ওই বাসায় বসে অনেক কেঁদেছি। এবার আমি আবারো ওখানেই ফিরছি,ওখানে বসেই চোখের পানি ফেলব ,… আপনার দেওয়া জামাকাপড়গুলো আপনি পরেন , আপনি শুধু কষ্ট দেন ,আপনি একজন বাজে লোক, আপনার সঙ্গে সংসার টা আমার আর হলো না তাই আমি চলে যাচ্ছি। বায়।”
জায়ন কাপা কাপা হাতে চিরকুটটা নিয়ে নিচে বসে পড়ল।
ধসসস…….