তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৮

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৮
নীল মণি

চৌধুরী বাড়িতে যেন হঠাৎ করেই সত্যি সত্যি এক বজ্রপাত ঘটলো। শেষমেশ জায়ন মাঝরাতে মই বেয়ে ব্যালকনি দিয়ে বাসায় ঢুকে পড়েছে , তাও আবার তিয়াশার রুমের কাছে।
মেহজাবীন বেগম দরজা খুলে জায়ন জড়িয়ে ধরতেই সে প্রথমে ভেবেছিল তিয়াশা… কিন্তু যখন কান মচকে ধরলেন মা, আর লাইট জ্বালিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন
“তোমার মা লম্বা, তাই লম্বা লাগছে।”

জায়নের মুখ একেবারে থ হয়ে গেল। হঠাৎ যেন পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে,মা তারই মা এক হাতে শক্ত করে ধরে আছেন চপ্পল, আর পরের মুহূর্তেই ছ্যাঁক করে সেটি পড়লো জায়নের হাঁটুতে।
“মা, মা কী করছো? পাগল হয়ে গেছো নাকি?” — জায়ন লাফ দিয়ে উঠল, , “তুমি তো জীবনে কখনো আমায় মারোনি, এখন হঠাৎ চপ্পল নিয়ে কেন পড়লে?”
মেহজাবীন বেগমের চোখে রাগের আগুন, কপালের ভাঁজ গভীর, ঠোঁট কাঁপছে ক্ষোভে। ছেলের কান্ড-কারখানা দেখে মনে হচ্ছে যেন হৃৎপিণ্ডটাই ধরা পড়ে গেছে।
“এই ছেলে আমার? যে ছোটবেলায় মেঝেতে পানি পড়লেও দু’পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতো, এখন সেই ছেলে মই বেয়ে ব্যালকনি দিয়ে ঢুকছে বউয়ের ঘরে? হায় রে আল্লাহ । আমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে, তাই আমিও পাগল হয়েছি ছেলের সঙ্গে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার ছেলেও তো কোনদিন এই কাজ করেনি না।কি শুরু করেছিস আর একদিন সহ্য হচ্ছে না , যে এই মধ্যরাতে এখানে পায়তারা করছিস । “”
এই বলেই ধপ ধপ করে আরও দুই-তিনটা চপ্পলের বাড়ি পড়লো এবার কাঁধ, পিঠ, এবং হালকা একখানে কোমরেও।
জায়ন এবার সত্যিই দিশেহারা। এদিক-ওদিক ছটফট করতে করতে বলল,
“মা, মা দুই দিন কি , এক মিনিট সহ্য হচ্ছে না।বউ দিলে তো আসতাম না তাই না ?”
মেহজাবীন বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন,

“হায় আল্লাহ আমার ছেলে কি মাথা হাটে বিক্রি করে এসেছে? যে ছেলে উপস্থিতি সবাইকে কাপায় সে এখন নিজের মার সামনেই বউ নিয়ে এমন কথা বলছে।এমন নাটক তো তোর আব্বু পর্যন্ত করেনি।”
জায়ন এবার খানিক মুচকি হেসে মার হাত ধরল।
“এইসব বাদ দাও মা, আমার রুমে একটু যেতে দাও। কতদিন নিজের ঘরে ঢুকিনি, আজ আর সহ্য হচ্ছে না।
জায়ন তিয়াশার রুমের দিকে পা বাড়াতে না বাড়াতেই মেহজাবীন বেগম হুডির ক্যাপ টেনে বললেন,
“এক পাও না, বের হ এখুনি।”
জায়ন কপালে হাত দিয়ে হুডির ক্যাপ ঠিক করতে করতে বলল,
“আরে যাচ্ছি এসেছি যখন তো একবার একটু বউ কে দেখে যাই ।”
“তোর এই খ্যাপাটে কথা শুনে শুনে আমি আর পারছি না।বলেছি তো, বের হ এত সহজে বউয়ের দেখা পাবি না।”
“মা তার জন্য ও তো আমায় এই রুমে ঢুকতে হবে ।”
” কিসের জন্য ?
জায়ন মুখ লম্বা করে বলল,

“তাহলে যাব কোথা দিয়ে? সামনে দিয়ে না গেলে তো যাবার আর পথ নেই।”
মেহজাবীন বেগম ঠোঁট কামড়ে বললেন,
“তাহলে যেখান থেকে এসেছিস, ব্যাক কর। সেই মই দিয়ে আবার নাম এটাই তোর শাস্তি।”
এই বলে তিনি দরজা লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু দরজা আটকে দিলেও, তিয়াশার রুম থেকে আসা এক মৃদু হাসির শব্দ ঠিকই পৌঁছালো জায়নের কানে। সে জানে তিয়াশা এই মুহূর্তে ওর কান্ড দেখে চুপি চুপি হাসছে।
আসলে, আগেরদিন তিয়াশা যে রাতে লুকিয়ে জায়নের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সেই খবর মেহজাবীন বেগম ঠিকই পেয়ে গেছিলেন। তাই সেইদিন থেকে তিনিই তিয়াশার রুমে থাকছেন পাশে পাহারাদার হয়ে। আর আজকের রাতে, সেই পাহারার জালে ধরা পড়লো সেই ছেলেটাই, যার বউপ্রীতি দেখে এখন পুরো বাড়ি তটস্থ।
বাইরে দাঁড়িয়ে জায়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ফিসফিস করে বলল,
“মশার কামড় খেয়েও যদি রোমান্সের দরজা না খুলে, তাহলে এই মই বেয়ে ওঠা-নামার প্রেমের গল্পটা ইতিহাস হয়ে যাবে, মা… ইতিহাস।”

সকালটা ছিল যেন এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির চারদিক জুড়ে উৎসবের রঙ, হলুদের গন্ধ, মেয়েদের হাসি, রান্নাঘর থেকে আসা মিষ্টির গন্ধে ভরপুর চৌধুরী বাড়ি আজ যেন একটা ছোটখাটো মেলা।
তিয়াশার আজ গায়ে হলুদ। বাড়ির বড় উঠোনে তোরণ বাঁধা হয়েছে হলুদ ফুল দিয়ে, বালিশ তোষকের আসন পাতানো, মাঝখানে বসার জন্য কাঠের পিড়ি। ছোটরা কেউ মেহেদি নিয়ে বসে আছে, কেউ হলুদ গানের তালে তালে কোমর দোলাচ্ছে।

আরোহী, পরি, রুবিনা তিয়াশার প্রাণের বান্ধবীরা সকাল সকালই এসে গেছে। আজ তো তাদের প্রিয় বান্ধবীর গায়ে হলুদ, এত বিশেষ দিনে দেরি করে আসার প্রশ্নই ওঠে না।
ঘরভর্তি অতিথি, উঠোন জুড়ে ব্যস্ততা।
আয়েশা বেগম, আশরাফ খান, মারিয়া তো গতরাতেই চলে এসেছেন। তিয়াশার মামার বাড়ির সকলে এসে পড়েছে সকালে।
আর একের পর এক অতিথিরা এসে জমে উঠেছে চৌধুরী বাড়ির রঙিন আঙিনায়।
কেউ রান্নাঘরে গিয়ে ব্যস্ত, কেউ হলুদ রঙের শাড়ি পরে সেলফি তুলছে, কেউ আবার খিলখিল করে হাসতে হাসতে স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছে।
বাড়িটার প্রতিটি কোনা যেন আজ খুশির সুরে সুর মিলিয়েছে এ যেন শুধুই একটা গায়ে হলুদ নয়, এক জমজমাট মিলনমেলা।

কিন্তু তার মাঝেই সকাল সকাল জায়নের গত রাতের কান্ড নিয়ে শুরু হয়েছে হাসির ফোয়ারা।
মেহজাবীন বেগমও এক পাশে দাঁড়িয়ে মুখে কঠিন ভাব ধরে বললেন,
“ভালোই হয়েছে, জানলো সবাই আসলে কার জন্য পাগল আমাদের ছেলেটা।”
নিয়তির খেলা বড়ই রহস্যময়। আল্লাহ্‌ তা’আলা তিয়াশার হাত যে জায়নের সঙ্গেই বেঁধে রেখেছিলেন, তা আজ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো সকলের চোখে। তিন বছর আগে যে বিয়েটা হাজার চেষ্টাতেও হয়নি, যে সম্পর্কের পথে একের পর এক বাধা এসে দাঁড়িয়েছিল আজ তা নিজেই গড়ে উঠল নিয়তির ইশারায়।
কে পারে নিয়তির লিখন মুছে দিতে? যাকে আল্লাহ্‌ একসাথে রাখেন, তাকে পৃথক করার সাধ্য কার?
নিঃশব্দ কান্না, অশ্রুজলে ধুয়ে ফেলা অভিমান, আর হৃদয়ের অতলে জমে থাকা ভালোবাসা চৌধুরী বাড়ির আজকের সকাল যেন শুধুই এক বৃষ্টিভেজা আবেগের সমুদ্র। তিয়াশার গায়ে হলুদের দিন, যেখানে হাসি-আনন্দে মুখর থাকার কথা, সেখানেই নিয়তির এক চমকে সবাই দাঁড়িয়ে গেল একদম স্তব্ধ হয়ে।

সকলকে অবাক করে, বৃষ্টি আজ দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী বাড়ির সেই সদর দরজার সামনে। পাশে নাজিম, , এবং পাশে প্রান্তিক সাহেব ও ওনার কোলে তাদের ছোট্ট সন্তান রেজওয়ান, আর একপাশে প্রণয় সাহেব। যেন একটা পরিপূর্ণ পরিবারের ছবি। একসময় যাদের চলে যাওয়া এই বাড়িকে ভেঙে দিয়েছিল, আজ তারাই ফিরেছে একজোড়া চোখে অনুশোচনা, কোলে সন্তান আর হৃদয়ে পাহাড়সম ভালোবাসা নিয়ে।
বড় মেয়ে কে বাসায় ফিরিয়ে আনার আদেশ অবশ্য এই বাড়ির কর্ত্রী মেহজাবীন বেগম এর।
তাদের এই দরজায় সুরাইয়া বেগম দেখে যখন চিৎকার করে উঠলেন, “বড় আপা, মেজো আপা দেখো আমাদের মেয়ে ফিরে এসেছে”

তখন যেন সমস্ত বাড়িটা গর্জে উঠল আবেগে, সাড়া দিয়ে। ছুটে আসলো সবাই, মেহজাবীন বেগমের চেহারায় যেন মুহূর্তে কালের ছাপ ভেসে উঠল একটা দীর্ঘশ্বাস, একসাথে আটকে থাকা হাজারো রাতের কান্না, উদ্বেগ, চিন্তা, অভিমান।অভিমান করে থাকা রূহেনা বেগম যেন মেয়েকে চোখের সামনে দেখেই সব ভুলে গিয়ে ছুটে আসলেন। যেন সব রাগ, সব অভিযোগ এক নিমিষে উবে গেল একটা ফুটফুটে শিশুর হাসি যেন একটা ভেঙে পড়া পরিবারের হৃদয়ে ফের আলো জ্বালিয়ে দিল।কে ভুল করেছে, কে পালিয়ে গিয়েছিল সেসব যেন আজ অতীত।
সবাই এখন শুধু তাকিয়েই আছে সেই ছোট্ট শিশুটার দিকে।কে তাকে কোলে নেবে, কে দোল দেবে এই নিয়ে যেন একটা ছোট্ট প্রতিযোগিতা চলছে।

বৃষ্টিকে ঘিরে যেন এক অদ্ভুত প্রশ্রয়, এক অদ্ভুত ক্ষমা এসে জড়িয়ে ধরেছে সবাইকে।তাকে আর কেউ তিরস্কার করছে না, বরং তার চোখের ক্লান্তি বুঝে কেউ পানি এগিয়ে দিচ্ছে, কেউ কপালে হাত বুলিয়ে বলছে,
“তুই কেমন করে এতসব সামলালি রে…”
নাজিমরা এতদিন ইন্ডিয়াতেই ছিল , অন্য কোনো দেশে যায়নি এত কাছেই ছিল, অথচ এত দূরে।
বৃষ্টির হাত ধরে ইন্ডিয়া পাড়ি দিয়েছিল নাজিম।কারণ সমাজ যেটা বোঝে না, সেটা হয়তো ভালবাসা বোঝে।
আর সেই ভালবাসার ফলেই আজ কোলে ফুটে উঠেছে এক নতুন প্রাণ যে এসে সব অভিমান ধুয়ে মুছে দিচ্ছে।
তিয়াশা, অনু, ইউভি, রায়ান ছুটে আসলো নিচে —

পেছনে পেছনে আসছে আকাশ, মারিয়া, আরোহী, রুবিনা, পরি, নেহা । সবার চোখে একটাই জিজ্ঞাসা, একটাই বিস্ময় এতদিন পর এই চেনা মুখ, এই হারিয়ে যাওয়া মানুষটা কি সত্যিই ফিরে এসেছে?
দরজার সামনে ভেজা দাঁড়িয়ে বৃষ্টি , মেহজাবীন বেগম ছোট্ট ছেলেটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এদিকে বৃষ্টির চোখ দুটো লাল, মুখ ভয় আর অনুতাপে ভরা। কিন্তু এক ঝলকে তাকাতেই সবাই যেন ভুলে গেলো, কে কী ভুল করেছে। শুধু একটা চেনা মানুষ ফিরে এসেছে, আর সেটা যেন সবার হৃদয় নরম করে দিল।
ইউভি, অনন্যা, তিয়াশা, রায়ান, মারিয়া, আকাশ, আরোহী, পরি—সবাই যেন একসঙ্গে মেতে উঠল ছোট্ট রেজোয়ানকে ঘিরে।

কে তাকে কোলে নেবে, কে তার গালে আলতো চুমু দেবে, কে তার নরম হাত দুটো ধরবে—এই নিয়ে যেন হুলুস্থুল কাণ্ড।
রুবিনা তো একপ্রকার বাচ্চাটাকে সবাই থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেও, আদরের ঝড় সামলানো তার একার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল।
বৃষ্টির সমস্ত ভুল যেন এই শিশুটির একঝলক হাসিতে মুছে গেল, যেন তার নিষ্পাপ মুখটাই হয়ে উঠল পুরো বাড়ির খুশির উৎস।
সবাইকে টপকে ইউভি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বৃষ্টিকে। এতদিনের রাগ, অভিমান, অজানা শত প্রশ্ন।সব উবে গেলো এক মুহূর্তে। কণ্ঠ কেঁপে ওঠে ইউভির, “ভালো আছিস বাচ্চা? জানিস কতো খুঁজেছি তোকে? তুই একবার বললি না এই ভাইটারে? একটিবারও না?”
বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে ভাইয়ের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললো। শাড়ির আঁচল ভিজে গেলো চোখের জলে, কণ্ঠটা থরথর করে উঠে ফিসফিস করে বলল,

“সরি ভাইয়া… প্লীজ মাফ করে দাও, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি… আমি ভয় পেয়েছিলাম ভাইয়া…”
ইউভি চোখের কোণে পানি জমে থাকা হাসিমুখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“মাফ তো তোকে অনেক আগেই করে দিয়েছি। শুধু তোকে দেখতে চেয়েছিলাম আবার, এইটুকুই চাওয়া ছিল।”
ভাই বোনের এই মুহূর্তে পেরিয়ে বৃষ্টি এবার ইউভির বুক থেকে বেরিয়ে তিয়াশার দিকে এগোতেই,
তার আগেই তীব্র হাহাকার করে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলো রায়ান।
“আপু,আপু তুমি কোথায় ছিলা? তোমার এই ভাইটা কতো মিস করতো তোমাকে জানো? তোমার কথা ভেবে রাতে ঘুম হত না।

রায়ানের কণ্ঠে শোকে ভরা কাঁপা কাঁপা আওয়াজ, গলা ধরে আসছে, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে কান্না।
বৃষ্টি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো,
“তোর জন্য মনটা পুড়তো রে ভাই… তোরা সবাই… সবাই আমার হৃদয়ে ছিলি… আমি শুধু সাহস পাইনি ফিরে আসতে…”
পাশ থেকে এসে অনু আর মারিয়া দু’হাত দিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো।
তিয়াশা তখনও দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে, দু’চোখে অপলক তাকিয়ে আছে তার আপুর দিকে। কত বছর পর এই চোখে দেখা, কত আবেগ, কত অপ্রকাশিত ভালোবাসা জমে আছে তার বুকে। বৃষ্টির চোখেও তিয়াশাকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে কান্না জমে উঠলো।
তিয়াশা এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। দুই বোন মুখোমুখি। একে অপরকে দেখে যেন এত বছরের দূরত্ব এক মুহূর্তে গলে গেল। কিছু বলার নেই সুধু দুইজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, বুকের ভিতর জমে থাকা সব কান্না বেরিয়ে এল অঝোরে।

” কেমন আছিস আমাদের বিয়ের কোণে?
” ভালো আপু , তুই কেমন আছিস আপু?”
তিয়াশার কণ্ঠে শীতল ভাঙা সুর।বৃষ্টি শুধু মাথা নাড়ে। তারপর বলে উঠলো ফিসফিস করে,
“তোদের ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ ছিল তিয়াশা… তোদের অনেক মিস করেছি… তোর হাসি, তোর রাগ, তোর পাগলামি সব… সব মনে পড়ত…”
” অনেক ভয় পেয়েছিলাম রে আপু খুব কষ্ট হত চেপে রাখতে সত্যি টা।”
” সরি সোনা, জায়ন ভাই সব বলেছে । আমি জানিস খুব খুশি বনু , যেদিন জানতে পারলাম তুই সেই মেয়ে যে কিনা জায়ন ভাই এর মনে ঝড় তুলেছিল।”

তিয়াশা এবার লজ্জা পেয়ে গেলো , তাই আর কিছু বলল না শুধু জড়িয়ে থাকলো তার আপু কে।
আকাশ, রুবিনা, পরি সবাই এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওদের চারপাশে। কেউ চোখ মুছছে, কেউ কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছে। এতদিন পর পরিবারের হারিয়ে যাওয়া একটি অংশ ফিরে এসেছে সব ভুল, সব আঘাত ভুলে গিয়ে একটাই অনুভূতি বুক ভরে উঠছে সবার ভালোবাসা।
ইউভি, অনন্যা, তিয়াশা, রায়ান, মারিয়া, আকাশ, আরোহী, পরি, রুবিনা, নেহা সবাই যেন একসঙ্গে মেতে উঠল ছোট্ট রেজোয়ানকে ঘিরে।
কে তাকে কোলে নেবে, কে তার গালে আলতো চুমু দেবে, কে তার নরম হাত দুটো ধরবে এই নিয়ে যেন হুলুস্থুল কাণ্ড!

অনন্যা তো একপ্রকার বাচ্চাটাকে সবাই থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেও, আদরের ঝড় সামলানো তার একার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল।
বৃষ্টির সমস্ত ভুল যেন এই শিশুটির একঝলক হাসিতে মুছে গেল, যেন তার নিষ্পাপ মুখটাই হয়ে উঠল পুরো বাড়ির খুশির উৎস।
জায়ন তখনো সোফায় হেলান দিয়ে বসে। তার নিজের বাসাটাও আজ সাজানো হয়েছে ফেয়ারিলাইটে ঝিকিমিকি, সাদা আর গোলাপি নেটের পর্দায় মায়াবি আবরণ। চারপাশে সাজসজ্জার সেই গন্ধটা যেন মনটাকে একটু হালকা করছিল। আট দিনের মধ্যে আজ শেষ দিন – কালই তো বিয়ে! অথচ… বুকের ভেতরটায় এক ধরনের ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
বউটাকে না দেখলে তার আর চলে না… চোখ শুকিয়ে কাঠ।
হঠাৎ মাথায় একটিই প্রশ্ন খেলে গেল–

“বউয়ের তো হলুদ হচ্ছে… আমার কেন হচ্ছে না?”
ফোনটা বের করেই কল লাগালেন মায়ের নাম্বারে। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় নাম্বার তাহসান চাচুর।
রিং বাজলো খানিকক্ষণ।তারপর যখন কলটা উঠলো, এক নিঃশ্বাসে জায়ন বলে উঠলো–
“চাচু, আমার বউয়ের হলুদ হচ্ছে, আমার কেন হচ্ছে না?”
তাহসান সাহেব হতভম্ব।এই ছেলের মাথায় আবার কী ভুত চাপলো।
“তুই তো নিজেই বলেছিলি তোর হলুদের এলার্জি। ভুলে গেছিস নাকি?
জায়নের মুখটা যেন পাথর হয়ে গেল।তিন বছর আগের সেই ছোট্ট মিথ্যে কথা…যেটা তখন বলেছিল শুধুই তখন এর ভুল সিদ্ধান্ত এড়াতে।
সামলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল–

“চাচু, আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আমার কোনো এলার্জি নেই। আমি হলুদ লাগাবো। তুমি এখনই ব্যবস্থা করো।”
তাহসান সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন,
“আবার কী? এত বছর পরে এখন এলার্জি চলে গেল?”
জায়ন এবার বিরক্ত, স্পষ্ট ভাষায় বলল–
“হ্যাঁ, গেল। কারণ এখন আমার মাথায় কিছু যায় আসে না। আমি বউয়ের হলুদের আগে হলুদ লাগাবো, ব্যাস, এখন তুমি ব্যবস্থা কর ব্যাস। আমি কিছু শুনতে চাই না।”
এই বলে কল কেটে দিলো সে।

তাহসান সাহেব প্রান্তিক সাহেব কে বলে ঘণ্টা খানেক এর মধ্যে হলুদের সব ব্যবস্থা করে দিল জায়ন এর বাসার ফ্রন্ট ইয়ার্ডে। সেখানেই বসে সব দেখছিল জায়ন এর জেমস । এর মধ্যেই জায়ান জেমস এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো —
“এরকম ভাবে বিয়ে কর ভালো লাগছে বুঝলে জেমস?
বাংলাদেশী কোন মেয়ে পছন্দ হলে বল তোমারও ধুমধাম করে আমিই বিয়ে দেব আঙ্কেল আন্টি কে ডেকে।”
জেমসের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিয়ে সে তো একথা ভাবেই নি। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার বং বিউটির চেহারা , চেহারা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে খেলে উঠলো এক হাসি, যা এরানো গেলোনা জায়ানের ঐ বাজপাখি চোখে।

এর মধ্যেই জেমস বলে উঠলো–
“স্যার বাংলাদেশী মেয়ে সুন্দরী হয়, এত সুন্দর যে হয় জানা ছিল না আমাদের ভা ….. সরি মানে আমাদের তিয়াশা আপু তো অনেক সুন্দর ।”
জায়ন একটু মুচকি হেসে বলল —
” আমি আমার বউ ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তাকাই না তাই নেক্সট টাইম নেই আমার বউরে উদাহরণ দেবে না আমি জানি আমার বউ মায়াবি। যদি কে নজর দিচ্ছ আমার শালি কাম বোনের দিকে সেদিকেই নজর দাও ভালো হবে।
তাহসান সাহেব প্রান্তিক সাহেব কে বলে ঘণ্টা খানেক এর মধ্যে হলুদের সব ব্যবস্থা করে দিল জায়ন এর বাসার ফ্রন্ট ইয়ার্ডে। মাঝখানে একটা সোফার পেছন হেলান দিয়ে বসে আছে জায়ন পরনে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা চোঁখে সানগ্লাস । ইস বউ টারে দেখার জন্য বুকে টর্নেডো বয়ে যাচ্ছে কিন্তু বউ দেখার কোন চান্স আর খুঁজে পাচ্ছে না , বউ টাকে যে কোন গর্তে তার মা লুকিয়ে রেখেছে আল্লায় যানে ।
এইসব ভেব মন খারাপের সঙ্গে ও ঠোঁটে সেই বিখ্যাত মুচকি হাসি। পাশে বসে থাকা জেমসকে দেখে হঠাৎ সে বলে উঠলো–

“এইভাবে বিয়ে করাটাও মজা বুঝলে জেমস ,ড্রামা বেশি ,সেন্টিমেন্ট বেশি। বাংলাদেশি কোন মেয়ে পছন্দ হলে বল, ধুমধাম করে তোর বিয়েটাও আমি নিজেই দিয়ে দেব আঙ্কেল আন্টি কে কে ডেকে।”
জেমস প্রথমে হেসে ফেলল, কিন্তু হাসির আড়ালে চোয়াল যেন থমকে গেল। বিয়ে! ও তো কখনো এমন কিছু নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবে নি। কিন্তু কথাটা শোনার পরই যেন মাথার ভিতর ঝড় বয়ে গেল একটা মুখ ভেসে উঠলো মনে “বং বিউটি” ঠিক সেই মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে এক আনচান করা হাসি খেলে গেল, চোখে এক চিলতে স্বপ্ন। অথচ সেই মুহূর্তটা ছিঁড়ে ফেলল জায়নের বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ নজর।

“স্যার,”
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জেমস বলল, “বাংলাদেশি মেয়েরা সত্যিই সুন্দর হয়… মানে এত সুন্দর হয় জানতাম না। আমাদের মানে ভা.. তিয়াশা আপু ও তো… অনেক সুন্দর।”
গেল, কিন্তু চোখের গভীরে ছিল দপ করে জ্বলে ওঠা একরাশ স্পর্ধা, অধিকার আর ঈর্ষার অন্ধকার। সে শান্ত স্বরে বলল–
“আমি আমার বউ ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাই না, জেমস। তাই পরের বার উদাহরণ দেওয়ার সময় আমার বউয়ের নাম মুখে আনবে না। আমি যানি আমার বউ মায়াবি , ওর সৌন্দর্য আমার, ওর মায়া শুধু আমার। চোখ যেদিকে দিচ্ছ ওদিকেই রাখো আমার শালি কাম বোন এর দিকে। ”
জেমস যেন অবাক হয়ে উঠলো এই স্যারের চোখে কি কিছুই ফাঁকি দেওয়া যায় না সবই কি ধরা পড়ে।
খানিক পরেই একে একে এসে পৌঁছাল আহান, সাগর, পলাশ, আকাশ আর নাজিম।দূর থেকেই জায়নের চোখে এক অনুভুতি ঝিলমিল করে উঠল।

নাজিমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুক ভরে জড়িয়ে ধরল ওকে।
ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল —
“থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত।থ্যাঙ্ক ইউ…
তখন আমি নিজে যেই সিদ্ধান্তটা নিতে পারিনি,
তুই ভুল পথে গিয়েও ঠিক কাজটাই করেছিস।”
নাজিম থমকে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না।
গলাটা যেন ভার হয়ে উঠল। অনেক কিছু বলার ছিল,
তবু শুধু একটুকুই বলল—
“তুই রেগে নেই তো? মানে… বৃষ্টি যেটা…”
জায়ন কিছু শুনতেই দিল না। ওর চোখে তখন শুধু একটা চেহারা।হালকা হেসে নিজের কথাতেই থামিয়ে দিল নাজিমকে—–
“কিছু বলিস না…

আমি শুধু জানি, আমি আমার রোদকে পেয়ে গেছি।
আর কিছু জানি না দোস্ত… আর কিছু লাগেও না।”
সাগর, পলাশ, আহান তারাও এসে জড়িয়ে ধরল জায়নকে।চোখে একরাশ আবেগ, হাসিতে, উচ্ছ্বাসে এক অদ্ভুত ঘোর যেন নেমে এলো চারপাশে।কতদিন পর বন্ধুরা একসঙ্গে হয়েছে…হৃদয়ভরা ভালোবাসা নিয়ে, ব্যথা ভুলে সবাই আবার একসাথে।
এর মধ্যেই সাগর হঠাৎ বলে উঠল,
— “জায়ন, আমাগো পিচ্চি ভাবি তো নাজিমের শালী হয়। শালী মানে তো আধা ঘরওয়ালি রে ভাই।”
চট করে হেসে উঠল আকাশ, বলল,
-__ “সাগর ভাই, তুমি সবসময় ডোজ খাওয়া কথা বলো কেন ।মাথা খারাপ নাকি?”
আহান আর পলাশও হাসতে হাসতে সাই দিলো আকাশের কথায়।কিন্তু এই খেলো মজার ভেতরেও একজনের মুখের রঙ একেবারে বদলে গেল।

জায়নের চোখ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে, ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে ঠোঁটের কোণে ঠাণ্ডা অথচ আগুনে রাগ জমছে। পুরো রুমটা আচমকা ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো, যেন কেউ গ্যাস হিটারে হাত রেখে তুলে নিয়ে গ্লাভস খুলে বসে গেছে।
জায়ন গলার স্বর না বাড়িয়ে, দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“যদি নাজিম হসপিটাল যেতে না চায়, তবে তুই আরেকটু বল সাগর। হয়তো শুনবে তোর কথা… একেবারে স্ট্রেচারে করে যাবি তোরা দুইজন।”
নাজিম, যার মাথায় এই পুরো কথার মানেই কিছু ঢুকছিল না, হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলল–
“আরে আমি কেন হসপিটালে যাবো? আর আমার শালী যদি অর্ধঘরওয়ালি হয়, তাতে এমন কী হইছে? এটাই তো রীতির কথ।”
তার কথা শেষ হতেই জায়ন যেন বিস্ফোরণ ঘটালো,

__”নাজিম ব্যাস আর একবারও না। জানিস না তাই ওয়ার্ন করলাম নেক্সট টাইম যেন না শুনি।”
ঘরজুড়ে এক নিমিষেই নিস্তব্ধতা।
নাজিমের মুখ ফ্যাকাশে, গলা শুকিয়ে গেছে। সে যেন কিছুক্ষণ সত্যিই শ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
পলাশ তখন ধীরে বলে উঠল—

“ভাই, বাঁচতে চাইলে ওর বাচ্চা বউয়ের নাম মুখে আনিস না। ‘আপু’ বলিস, তাতে তুইও বাঁচবি, ওর মুডও ভালো থাকবে। আমি তো আগেরদিন একবার বলেছিলাম… এখনো হাত-পা কাঁপে। বন্ধু বলেই তোরে ছাইড়া দিছে… ।”
এইসব বাদ দিয়ে আবারো বন্ধুরা মেতে উঠল বন্ধুর হলুদের ফাংশানে। হাসির রোল, ঢাক-ঢোল, আর ব্যাচেলর টাইপ মজা-মাস্তি সব মিলিয়ে যেন উৎসবের আর এক নাম এখন জায়নের ফ্রন্ট ইয়ার্ড।
এরই মাঝে একে একে চৌধুরী বাড়ির সব মানুষ এসে উপস্থিত হল জায়নের এই নতুন ঠিকানায় , এই বাসা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন , কিন্তু বিয়ের পরে প্রান্তিক সাহেবার আদেশ যে এই বাসা ছেড়ে চৌধুরী বাড়িতেই থাকতে হবে।প্রান্তিক সাহেবের মুখে গর্ব আর স্নেহের ছায়া,প্রণয় সাহেবের চোখে প্রশান্তির দীপ্তি,তাহসান সাহেব নিজের হাতে করা হলুদের আয়োজন দেখে খুশিতে চোখ মেলে তাকালেন,মেহজাবীন বেগম ছেলের গায়ে হলুদ লাগাতে গিয়ে বারবার চোখ মুছছিলেন আড়ালে,

রুহেনা বেগম আর সুরাইয়া বেগম কনে বাড়ির গল্প তুলতেই একে অন্যকে মুচকি হেসে চোখ মারছিলেন,
আশরাফ খান আর আয়েশা বেগম ব্যস্ত অতিথিদের অভ্যর্থনায়,আর ইউভি? ইউভি আর রায়ান একদিকে নিজের ক্যামেরায় সব মুহূর্ত বন্দি করতে করতে আবার জায়নের কানে কানে কীসব ফিসফিস করে হেসেই খুন।আর ততক্ষণে আরও আত্মীয়রা এসে পড়েছে কেউ সালাম জানাচ্ছে, কেউ জায়নের মাথায় হাত রাখছে।
এখন এই চৌধুরী-বাসায় রয়েছে তিয়াশা ও বাকি বাচ্চা অনন্যা ,বৃষ্টি ,মারিয়া ,আরোহী ,রুবিনা, পরি ,নেহা এদের কে দেখে রাখার জন্য তিয়াশার মামী, কেউ ঘাগরা ঠিক করে দিচ্ছে, কেউ গয়নার বাক্স সামলাচ্ছে, কেউ আবার মোবাইলে গান ছেড়ে নাচ শেখাচ্ছে বাকি বাচ্চাদের।আর জায়নের বন্ধুদের বউরাও এখন রঙিন শাড়ি আর ঝলমলে হাসিতে এই বাড়িটাকেই যেন সাজিয়ে তুলেছে আরও। কারও হাতে গীতার গীত, কারও ঠোঁটে ভোজনের আলোচনা, কেউ আবার তিয়াশার সাজ নিয়ে ব্যস্ত প্রশংসায়।

এই বাড়িতে এখন কেবল বিয়ের প্রস্তুতি নয়, যেন বহুদিনের অভিমান, বহু বছরের শূন্যতা, অনেক না বলা কথা–
এমন হই হই খুশির মাঝে তিয়াশা তখন রুমে বসে আয়নায় নিজের হলুদের মেকআপের শেষ টাচ নিচ্ছে ,ঠোঁটে হালকা হাসি, কিন্তু চোখে লাজুক আলো, পরনে হলুদ শাড়ি লাল কাছ করা ব্লাউজ দিয়ে , শরীর জুড়ে ফুলের গহনা , কপালে লাল টিপ… আজ তার গায়ে হলুদ, আর এই সকালটা যেন আরও উজ্জ্বল করে দিয়েছে জায়নের ছোট্ট পাগলামি।
হঠাৎ দরজা ঠেলে একে একে ছুটে এলো অনন্যা, আরোহী, নেহা, পরী, রুবিনা আর মারিয়া।
অনন্যা হাসতে হাসতে বলে উঠলো–

“আপু, তোমার জন্য কেউ লাইনে আছে… তাড়াতাড়ি নাও!”
তিয়াশা একটু অবাক–এই সময়, কে ফোন করলো, তাও আবার অনুর নাম্বারে? হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই সামনে ভেসে উঠল এক চেনা মুখ।
হলুদের রঙে মাখানো গাল, চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে সেই অচেনা-চেনা দুষ্টু হাসি জায়ন।
তিয়াশা ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই কেঁপে উঠলো। আট দিন পর নিজের বাঘের বাচ্চা বরটাকে দেখছে, আর তাও এমন রঙিন মুখে… তার নিজের হলুদের দিনে।হলুদ মাখা মুখে জায়নের রূপ যেন চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে একটা পুরুষকে এত সুন্দর লাগতে পারে তা তিয়াশার জানা ছিল না ।

তিয়াশার চোখের কোণে অশ্রুর রেখা, আর জায়নের চোখে হতবাক এক বিস্ময়।তিয়াশার সাজে তাকিয়ে
সে যেন ঘোরে চলে গেছে।জায়নের ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চোখের পলক না ফেলেই তাকিয়ে থাকল। জায়ন যেন আর নিজেকে থামাতে পারল না। চোয়াল শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে বলল–
“তোর মাথা ঠিক আছে তুই এই ভাবে সেজেছিস? তুই বাইরে যাবি না, বেবি। এই সাজে না, একেবারেই না।কারো নজর পড়লে আমি পাগল হয়ে যাব, তুই জানিস না আমি কী করতে পারি। এই চোখ, এই হাসি, এই ত্বকে হলুদের আলো তুই আজ স্বপ্নের মতো লাগছিস… কিন্তু সেই স্বপ্ন শুধু আমার, শুধু আমার, বুঝলি?”
তিয়াশা মৃদু হেসে তাকাল, চোখের ভেতরে মেঘ জমে উঠেছে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে সেই একটুখানি প্রশ্রয়

“এতক্ষণ ধরে সাজলাম কি ঘরে বসে থাকার জন্য? কেউ দেখবে না, কেউ কিছু বলবে না তাহলে সাজাটাই বৃথা।”
জায়নের চোখে মুহূর্তেই গর্জে ওঠে এক অদ্ভুত রকমের অস্থিরতা। ঠোঁট চেপে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তিয়াশার মুখের দিকে, তারপর গলা খানিকটা কাঁপিয়ে বলে–
“আমি ওখানে নেই তুই কার জন্য সাজবী বা** । মোছ এইসব ,আমার তোর এই রূপের ঝলকানিতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।,”
জায়ন এর এই কথা শুনে তিয়াশা ঠোঁট কামড়ে বিরক্তির সুরে বলল–
“আপনি এইজন্য কল করলেন, অনুর ফোনে?”
জায়ন বুঝে গেল, তার বাচ্চা বউ রেগে উঠছে। তাই এবার স্বরটা একটু মোলায়েম করেই বলল–
“বউ আমি তো তোকে দেখার জন্য কল দিয়েছি , বাসার সবাই এইখানে তাই ভাবলাম বউ এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যা হবে না এখন , আমি কি যানি আমার বউ এরকম ডেঞ্জার সেজে বসে আছে। বউ যাস না, তুই আমার কলিজা না।”

পাশেই দাঁড়ানো অনন্যা, মারিয়া, আরোহী, নেহা আর রুবিনা তো হাসতে হাসতে পাগল। তারা এমন জায়ানকে আগে কখনও দেখেনি একজন পজেসিভ, পাগলপ্রেমী বর, যে বউয়ের সাজপোশাকেও ঈর্ষা করে।
কিন্তু তিয়াশার রাগ যেন উপচে পড়ছে। সবসময় এই লোক টার বাড়াবাড়ি দিন দিন পাগলামি বেড়েই যাচ্ছে , নিজের বিয়েতে ও সাজতে পারব না ,
মাথা একটু শান্ত করে ঠাণ্ডা গলায় বলল–
” সব সময় সমস্যা হয় আপনার আমি সাজলে।কি সুরু করেছেন ? আমার কিন্তু বিরক্তি লাগছে বলে দিলাম।”
জায়নের গলা এবারও কাঁপল ভালোবাসায়–
” বউ আমি নেই তো ঐখানে, এইভাবে গেলে তো
আমার চিন্তা হবে বুঝিস না।”
তিয়াশা এবার যেন গর্জে উঠল–
“চিন্তা করুন বসে বসে, অসহ্য।”
” রোদের বাচ্চা মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু , যাবিনা বলেছি তো ব্যাস যাবিনা ।”
” ধুর ভালো লাগে না।”

এই বলে সে জায়ন এর কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দিল।
কিন্তু জায়ান থামবার পাত্র না। সে কল দিচ্ছে একের পর এক, একগুঁয়ে পাগলের মতো।
জায়ন এর কাণ্ড দেখে অনন্যা হাসতে হাসতে বলল,
— “তিয়াশা আপু তুমি বুঝলা না, আপু সাজছে মানেই ভাইয়ের টান বাইপাস লেভেল।”
সবার হেসে হেসে পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছে, আর তিয়াশা মুখে গম্ভীর রাগ ধরে রেখেও ভেতরে ভেতরে লজ্জা আর ভালো লাগার এক অদ্ভুত ঢেউ সামলাতে পারছিল না।
আরোহী আবার একটু ফিসফিস করে বলল,

” বেবি এইবার বুঝলাম, বউ রূপে আগুন হইলে, বর পুড়ে ছাই হয়।”
জায়ন এর হলুদ শেষ করেই সবাই এই বাসায় ফিরে এসেছে। হলুদের স্টেজে বসে আছে তিয়াশা সোনালি হলুদ শাড়িতে ঝকমক করছে, মাথা নিচু, ঠোঁটের কোণে একফালি লাজুক হাসি। চারপাশে যেন সোনার রোদের মতো আলো ছড়ানো, আর সেই আলোয় ভেসে যাচ্ছে তিয়াশার মুখ।
এক এক করে এগিয়ে আসছেন মেহজাবীন বেগম, রূহেনা বেগম, সুরাইয়া বেগম, আয়েশা বেগম চারজনই যেন নিজের মেয়ের মত করে তিয়াশার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কেউ চন্দন ছুঁইয়ে দিচ্ছেন, কেউ মুখে দোয়া পড়ে কানে কানে ফুঁ দিচ্ছেন।
মেহজাবীন বেগম আদর করে বললেন, “আল্লা তোকে শান্তি দিক মা… আমার ঘরের বউ হয়ে এসেছিস, চোখের মণি হয়ে থাকিস।”

তারপর একে একে এগিয়ে এলেন প্রান্তিক সাহেব, , তাহসান সাহেব তারা যেন প্রণয় সাহেব চোখে জল লুকিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। প্রান্তিক সাহেব একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তিয়াশার কপালে হাত রাখলেন, যেন হাজারটা কথা না বলেও বলা হয়ে গেল।
পাশ থেকে বৃষ্টি, আর জায়নের বন্ধুর বউরা এসে চারপাশে ঘিরে ধরল তিয়াশাকে।কেউ গাল ভরে হলুদ মাখাচ্ছে, কেউ ফটো তুলছে ।
অনন্যা, আরোহী, পরি, রুবিনা সবাই এসে হলুদ ছুঁইয়ে দিল তিয়াশা কে।
ছেলে রা সব রয়েছে জায়ন এর বাসায় ।
কিন্তু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ পায়চারি করছে, ফোনটা বারবার হাতে নিয়ে আবার রাখছে, চোখে এক অস্থির আগুন।
নিজের বুকের ভেতর তীব্র এক অজানা জ্বালা নিয়ে সে নিজেকেই বলছে–
“সবাই গায়ে হাত দিচ্ছে, ওরে হলুদ দিচ্ছে, কেউ কি ওকে বলে নাই যে বউ হয়েছে আমার? ছুঁয়ে দেখার অধিকার শুধু আমার।”
তারপর হঠাৎ দাঁত চেপে বলল,

“কেউ ওর দিকে তাঁকিয়ে থাকলে আমি ওই হলুদের স্টেজে আগুন দিয়ে দেবো।”
“ফ্রন্ট ইয়ার্ডে বসানো মঞ্চের চারপাশে লাল, হলুদ আর সোনালি আলোর খেলায় সেজে উঠেছে আজকের সন্ধ্যা। বাতাসে হালকা একটা উষ্ণতা, সেই উষ্ণতার ভেতরেই ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে হলুদের মিষ্টি, স্নিগ্ধ ঘ্রাণ যেন শতবর্ষের পুরোনো কোনো বাঙালি বউয়ের লাজুক প্রস্তুতি। চারদিকে হাসির রোল, ঢোলের তালে তাল মিলিয়ে কেউ সালাম দিচ্ছে, কেউ কপালে চুমু এঁকে দিচ্ছে তিয়াশার। আর ঠিক তখনই, কোথাও দূরে এক কোণায়, চুপচাপ বসে থাকা কারও বুকের গভীরে গড়িয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য অস্থিরতা কারণ বাতাসের সেই হলুদের ঘ্রাণ পার হয়ে এবার মিশে গেছে মেহেদীর আকুল সুবাসে… এক অব্যক্ত ভালোবাসার মতো।
“অনু, তোর তিউ আপু এখন কোথায়?”

জায়ন এর আজকে নিয়ে উনিশতম কল অনুর কাছে। বিয়ের এই উৎসবমুখর ঘরের ভিড় আর কোলাহলে অনু আনন্দ করবে, খুনসুটি করবে,এই আশায় ছিল কিন্তু জায়ন ভাইয়ের একটার পর একটা ফোনে বেচারির মাথায় হাত। হাঁপিয়ে গিয়ে অনু একরাশ বিরক্তি চেপে বলল–
“ভাইয়া, দু’মিনিট আগেই তো বললাম, আপু মেহেদী দিচ্ছে। হাত দুটো ব্যস্ত, এখন ফোন ধরতে পারবে না।”
ওপাশ থেকে মুহূর্তেই এক চাপা গলা, তীব্র উদ্বেগ আর একরাশ অধিকার ঝরে পড়ল—
“একটু নিয়ে যা না ফোনটা ওর কাছে… আমার চিন্তায় শরীরটাই কেমন জানি লাগছে। মনটা কেমন অস্থির হয়ে আছে।”

অনু থমকে গেল। জায়ন ভাইয়ের গলায় কিছু একটা ভাঙনের শব্দ যেন শোনা যাচ্ছে। যাকে সে সারা জীবন পাষাণের মত নির্লিপ্ত আর গম্ভীর দেখেছে, সেই মানুষটা আজ যেন একটা অজানা শঙ্কায় কাঁপছে।
ভেতরে ভেতরে ভালোবাসা আর অধিকার মিলেমিশে এক অদ্ভুত উত্তাপ।
অনু আর না করে উঠতে পারল না। ফোন হাতে স্টেজের দিকে এগোল ফোন সেদিকে ফেরাতেই তিয়াশা সবুজ রঙা লেহেঙ্গায় বসে আছে, মেহেদী আর্টিস্টরা তার দুই হাতে নিখুঁত নকশা আঁকছে, সে যেন একেবারে স্থির একটা ছবি। যার চোখে মিশে আছে চুপিসারে জমে থাকা কল্পনা আর ক্লান্তি।
জায়ন মুহূর্তেই থ হয়ে গেল , আর কত রূপে মারবে এই
বেয়াদপ রমনী। জায়ন নিজেকে সামলাতে না পেরে আবার বলে উঠল–
“অনু, ওই মেহেদী দেওয়া মেয়েদের কাছেই নিয়ে যা ফোনটা।”

অনু ফোনটা এগিয়ে দিতেই, জায়নের আওয়াজ লাউডস্পিকারে যেন ঝড় তুলে দিল চারপাশে–
“এই যে শুনছেন, আমার বউয়ের সারা হাতে শুধু আমার নামই লিখে দেবেন। অন্য কিছু না। ফুল, পাতা, ময়ূর কিছু না। শুধু ‘আবরার জায়ন’। বুঝেছেন?”
মূহূর্তেই সবাই চুপ। মেহেদী আর্টিষ্ট রা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্ভ্ধন করলো।
তিয়াশা প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হকচকিয়ে গেল। তারপর রাগে, লজ্জায়, ক্লান্তিতে গলা তুলে চিৎকার করে বলল–

“অনু ,এই ফোনটা এখুনি নিয়ে যা। অসহ্য লাগছে এই লোকটাকে আমার , মাথার তার ছিঁড়ে গেছে সব , এই সব বাতিল করে আমি একা কোথাও চলে যাব বলে দিচ্ছি ।”
চারপাশে একটা পিন পতনের নীরবতা।
ওদিকে জায়নের গলা এবার আর শান্ত নেই, ওখান থেকে ভারি গলা ঝড় তুলল–
“নেক্সট টাইম কোথাও যাওয়ার কথা বললে… ওখানেই পুঁতে দেব।আমি যা বলেছি তাই হবে। হাতভরা শুধু আমার নাম থাকবে ।”
তিয়াশা এবার পুরো বিরক্ত। তবু নিজেকে ধরে রাখল। মেহেদী লাগাতে লাগাতে, যেন নিজের রাগ আর অস্থিরতা চেপে, বড় আম্মুকে ডাকল হালকা কণ্ঠে সে যানে আপাতত বড়আম্মু কে ডাকলেই এই লোক চুপ থাকবে —
“বড় আম্মু… একটু এদিকে আসো তো।”
জায়ন এর চোখ বড় বড় হয়ে মুহূর্তেই চটে গেল —

” দারা না একবার পাই কালকে , সব শুধে আসলে তুলবো , তখন কোন বড় আম্মু কে ডাকিস দেখব।”
জায়ন এইটুকু বলেই কল কেটে দিল। গলার ধারে রক্তের মত রাগ জমে গেল, আর ঠোঁটের কোণে রয়ে গেল অশান্তির এক তীব্র ছায়া।
তিয়াশা মাথা নিচু করে ফেলল। ওর গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে রাগে, লজ্জায়, আর একরাশ অস্বস্তিতে এই রকম ঠোঁট কাটা লোক নিয়ে সংসার করতে হবে। অথচ মনের ভিতরে কোথাও একটা শিরশিরে ভালোবাসা যেন চেপে বসে আছে এই লোকটা… কেন এমন করে।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৭

চারপাশে মেহেদী আর্টিস্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য আরোহী উপস্থিত সবার মুখে একচিলতে দুষ্টু হাসি। কেউ মুখ টিপে হাসছে, কেউ চোখে চোখ রেখে মজা নিচ্ছে জায়ন নামক পুরুষটা আজ প্রেমের সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে, ফোনের ওপার থেকেই বউয়ের হাতে নিজের নাম লিখে তার দখলদারিত্ব ঘোষণা করছে, যেন এ সংসার, এ সম্পর্ক ওর নিজের গড়া একটা ছোট্ট রাজ্য, যেখানে রাণী শুধু একটাই তিয়াশা।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here